- বইয়ের নামঃ কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার দিকে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ ঐতিহ্য
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অক্ষরবৃত্তের টানে
এতই কি জাঁহাবাজ হ’তে পারে পায়ের তলার
মাটি, এত হিংস্র, যে রকম আসমান
যখন তখন চোখ রাঙায় এবং মনে হয়
এ রকম গাছপালা যারা শান্ত থাকে প্রায়শই
তারাও কেমন যেন মূল ছিঁড়ে ছুটে এসে আমাদের ঘাড়
মুচড়ে দেয়ার সাধ অন্তরে লালন করে, নদ
নদীও বিরূপ অতিশয়। এ রকম ভয়াবহ অন্ধকার
নামেনি কখনও চারদিক লুপ্ত ক’রে অর্থহীনতায় আর।
মানবের, বানবীর মুখচ্ছদ এই মতো পাথরস্বরূপ,
দেখিনি কখনও আগে। হাটে, মাঠে, ঘাটে
হেঁটে যায় যারা, যেন চলমান কিছু পুতুলের
নিষ্প্রাণ মিছিল!
অকস্মাৎ মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি
আমাদের প্রিয় বাংলাভাষার প্রদীপ্ত কতিপয়
স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ বিছানার কিনারে দাঁড়িয়ে
আমাকে কী যেন বলবার অপেক্ষায়
রয়েছে অনেকক্ষণ থেকে। তাদের নির্দিষ্ট প্রতিনিধি
বিনীত ভঙ্গিতে বলে, ‘আর কতকাল কবি তুমি
আমাদের কেবলই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ব্যবহার
করবে বলো তো? আমরা তো ব্যবহৃত হতে হতে ক্লান্ত
ক্লান্ত হ’য়ে ঝিমিয়ে পড়েছি, তা’কি বুঝতে পারো না
তুমি আজও? অক্ষরবৃত্তের মায়াজাল থেকে মুক্তি দাও কবি’।
নিরুত্তর আমি ভোরবেলা আপন টেবিলে ঝুঁকে
রাতের ঘটনা ভুলে অক্ষরবৃত্তেরই টানে ফের লিখে চলি।
১৬-১২-২০০২
অন্ধকার কাঁটা হয়ে বিঁধে
ভাবতেই পারিনি আমার মুখোমুখি বসবেন একজন
প্রবীণ সাধক আর বলবেন গাঢ়
কণ্ঠস্বরে কিছু গূঢ় অনুপম কথা। বিষণ্নতা
ছিল তাঁর বিদায়ী বক্তব্যে যার অর্থ বস্তুত পাইনি খুঁজে
বুঝি না আমাকে কেন অসংখ্য বাদুড় বার বার
চারদিকে থেকে
হামলা করতে আসে। ওদের ডানার
ঝাপ্টায় দু’চোখ থেকে রক্ত ঝরে যখন তখন।
কিছুতেই পারি না তাড়াতে হিংস্র এই প্রাণীদের; বহু দূরে
ছুটে যেতে চাই,
অথচ এমন ভারী হয়ে যায় পদযুগ,
পারি না নড়তে এক চুলও কিছুতেই। অন্ধকার কাঁটা হয়ে
ভীষণ বিঁধতে থাকে শরীরে আমার। অসহায়,
দিশহারা এই আমি নিজেকেই কামড়াতে থাকি।
যে মোহন বাগানের স্বপ্ন দেখে ঘর ছেড়ে পথে
বেরিয়ে পড়েছিলাম, তার
কোনও চিহ্ন নেই কোনও দিকে, শুধু ধুধু
শূন্যতা বিলাপ করে অবিরত শব্দহীনতায়।
এমন বিরান স্থান ছেড়ে অন্য কোনখানে যেতে
চাইলেও শুধু ঘুরে ফিরে
একই স্থানে থেকে যেতে হবে শাস্তিপ্রাপ্ত,
অসহায় বন্দীর মতোই, জানবো না কী আমার অপরাধ!
৬-১২-২০০৩
অপরাধ জানা নেই
কী আমার অপরাধ জানা নেই, অথচ কেন যে
খামোকাই ধ’রে বেঁধে আমাকে হাজির
করেছে এখানে কাঠগড়ায় হঠাৎ! পথে যেতে
মারিনি পকেট কারও, লাঠির আঘাতে কিংবা ঠাণ্ডা
মাথায় চালিয়ে ছোরা কাউকে করিনি খুন ঘরে
অথবা রাস্তার মোড়ে। কোনও ব্যাংক লুট করিনি কস্মিনকালে।
তবু মনে হয়, যেন কেউ কেউ খুব খাঁখাঁ দুপুরে অথবা
সন্ধ্যায় গলিতে অনুসরণ করছে
আমাকে নিশ্চুপ গোয়েন্দার মতো, যেন আমি কোনও
ধুরন্ধর, দাগী
আসামি, সবার চোখে ধুলো দিয়ে দিব্যি
ঘুরছি, ফিরছি সবখানে, বিলক্ষণ দিচ্ছি আড্ডা, সিগারেট
অথবা চুরুট ফুঁকে চলেছি বেদম কখনও-বা
একাকী নিজেরই সঙ্গে কথা বলি মুখ রেখে দেয়ালের দিকে।
কখনও কখনও মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠি বুক-ভরা
কান্না নিয়ে, আচমকা কে যেন আমাকে
চুল ধ’রে দ্রুত টেনে হিঁচড়ে কোন্ সে অজানায়
নিয়ে যেতে চায়, কেঁদে উঠলে শাসায়
বেয়াড়া ভাষায়, আমি কোনওমতে দম বন্ধ রেখে
নরক যন্ত্রণা ভোগ করি; মনে হয়,
এলো বুঝি অন্তিম বিদায়ক্ষণ এই
জগতের শোরগোল থেকে অতিশয় অন্ধ চাপে!
কার ক্রীড়নক এই লোক?- আয়নার মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে সওয়াল করি। উত্তর পাবো না খুঁজে কারও
কাছে, শুধু এক ব্যাকুলতা সত্তা জুড়ে
করবে বিরাজ। আমি শুধু ডানে বামে বারবার
তাকিয়ে খুঁজবো কেউ রহস্যের তটে ভেলা নিয়ে
অপেক্ষা করছে কি না পৌঁছে দিতে আমাকে কোথাও।
ইচ্ছে হয় চাঁদটিকে ছিঁড়ে আনি
যে যায় তোমাকে ছেড়ে দূরে, বহুদূরে, প্রকৃতই
সে কি চলে যায়। না, সে যায় না তোমাকে
ছেড়ে অন্য কোনও খানে। সে-তো
কখনো হঠাৎ ভোরবেলা সহস্র মাইল থেকে
তোমার শয্যার পাশে এসে
দাঁড়ায় প্রসন্ন মুখে এক লহমায়, স্মৃতিময় কথা বলে।
যদি বলো কাউকে এ-কথা, নিশ্চিত সে
গাঁজাখুরি গপ্প ভেবে হেসেই উড়িয়ে দেবে, জানি। এ-ঘটনা
বান্ধব মহলে রটে যাবে। কেউ কেউ
বলবে নিশ্চিত, “শোনও, শোনও, আমাদের
বন্ধুটির ভীষণ উর্বর মাথা, ওহে
বেজায় বিগড়ে গেছে। এক্ষুণি পাঠাও ওকে পাগলা গারদে।
কখনো, কখনো দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদে, কখনো-বা মধ্যরাতে
তোমাকে জাগিয়ে তোলে ঘুম থেকে আর
শোনায় স্বপ্নিল সুরে কৈশোরের খেলার মাঠের
কাহিনী, তুমি কি ওকে ভর্ৎসান ক’রে
তক্ষুণি তাড়িয়ে দেবে বিরানায়? তোমার কি সেই
স্মৃতিকথা উপভোগ্য মনে হবে? অবশ্যই নয়।
ধরা যাক, যে যুবতী একদা আমাকে ভালবেসে
আমার যৌবনে দূর দেশে চলে গেছে, যদি সে নিমেষে এসে
দাঁড়িয়ে আমারই পাশে অপরূপ হাসি দেয় উপহার, তখন এ বান্দা
মুহূর্তে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াবে কি তার পাশে? সে-তো
এসে পড়ে নিমেষেই মাঝে মধ্যে, করে না পরোয়া কারও, এই
এমন কি বয়সের ভারে জব্দ আমারও কখনো।
নিদ্রোহীন মাঝরাতে বস্তুত ছিলাম মগ্ন একটি ধূসর
কাব্যগ্রস্থ পাঠে; অকস্মাৎ কানে এলো
কার যেন গাঢ় কণ্ঠস্বর, “কেন তুমি নিজেকেই
দিচ্ছ ফাঁকি লুকোচুরি খেলায় এমন
মেতে উঠে? এই খেলা কারো কারো দিবাস্বপ্ন দিব্যি
সুখকর করে তোলে। না, হবে না যার স্বপ্নে তুমি মশগুল”।
ঈষৎ চমকে উঠি উটে, তবে ভীতি ব্যর্থ হয়
আমাকে ঘায়েল ক’রে জন্মন্ধ গুহায়
ঠেলে দিতে। হাতের ধূসর কাব্যগ্রন্থ বিছানার
এক পাশে রেখে উঠে পড়ি। মনে হলো, এখন আকাশ থেকে
চাঁদটিকে ছিঁড়ি এনে শহরকে শতগুণ আলোকিত ক’রে
অশুভ আন্ধার চিরতরে ঝেঁটিয়ে বিদায় ক’রে দিতে পারি।
১৭-১২-২০০৩