Site icon BnBoi.Com

কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি – শামসুর রাহমান

কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি - শামসুর রাহমান

অর্ফির বাঁশির মতো

কত কিছু খসে যায়, সরে যায়, ঝরে যায় ক্রমে
আমার জীবন থেকে। শৈশবের কাগজের নৌকো,
বাবুই পাখির বাসা, তালপাতার ভেঁপু, বৈশাখের
উন্মত্ত হাওয়ায় আমগাছের তলায় ছুটোছুটি
বালক-বালিকাসহ, খুব ভোরবেলা পাতে-দেয়া
নানির হাতের পিঠা ঝরে গেছে সুদূর আড়ালে।

স্কুলে সহাপাঠী ছিল যারা, তারা কে কোথায়
সরে গেছে বহুদূরে; কারো নাম, কারো মুখ
ভুলে গেছি আর বাবুবাজারের মোহন কাঁচের
দোকানের তীর বিদ্ধ দুলদুল পঙ্গপাল-ছাওয়া
সোনালি শস্যের মতো ঝরে গেছে স্মৃতির প্রান্তরে।
জনকের উঠোনে ঘুরতো কান্তিমান দুটো হাঁস,
সুপ্ত ওরা; মাতামহ ঝাপ্‌সা পুরাণ, এমনকি
পিতৃস্মৃতি মাঝে-মধ্যে মেঘের আড়ালে বড় বেশি
ছায়াচ্ছন্ন হয় আর আজ কাছে আছে যারা, হায়,
তারাও কেমন দূরত্বের কুয়াশায় মুখ ঢাকে।
নিদ্রায় ভ্রমণকারী ওরা, নিশীথে হারিয়ে যায়।

কত কিছু খসে যায়, সরে যায়, ঝরে যায় ক্রমে
আমার জীবন থেকে। একদা বসন্তোৎসব দেখে
যার চোখে লক্ষ পদ্ম ফুটেছিলো হৃদয়ে আমার,
যাকে ছুঁয়ে জেনে গেছি অমরত্ব বলে কাকে, সে-ও
আমার সকল আকাঙ্ক্ষার বহ্ন্যৎসব করে যায়
দীর্ঘ পরবাসে। শুধু তুমি হে আমার বর্ণবোধ,
মাতৃভাষা ক্রমশ আমার আরো কাছে এসে যাও,
অস্তিত্বের গ্রন্থিমূলে অর্ফির বাঁশির মতো বাজে।

আবার যাবে কি চলে?

আবার যাবে কি চলে অভিমানে দীর্ঘ পরবাসে
আমাকে খরায় ফেলে? পথক্লেশ, না কি মতিভ্রম,
কী আমার দোষ
বুঝতে পারিনি ঠিক, তবু শেষমেষ
রেখেছি তোমারই প্রতি অঞ্জলি আমার। শূন্য রইলে করতল,
আমার সকল দিক হবে চির হাহাকারময়,
কংকালে-কংকালে যাবে ছেয়ে শূন্য ভূমি।

তুমিহীনতায় অবেলায়
আমার একান্ত অন্তর্গত অনল ফুরিয়ে গেলে
নিঃসঙ্গ থাকবো পড়ে সীমাহীন শীতে
ভীষণ আহত।
কখনো বেগানা কোনো কুকুর শুঁকবে এসে ছেঁড়া
জামার রক্তের দাগ, শরীরের বর্ধমান ক্ষত।
অথচ এ-ও তো জানি, বসন্তমায়ায়
শহরের নিঝুম কবরখানাতেও
বেলা শেষে কোকিল ব্যাকুল ডেকে যায়।

দূরে আছি, তোমার নিকট থেকে বহুদূরে আছি-
যেমন আকাশ থেকে দুর্বল ডানার কোনো পাখি,
শস্যময় ক্ষেত থেকে উপদ্রুত চাষী,
অন্ধের নিকট থেকে জ্যোতি
কবির নিকট থেকে অভীষ্ট প্রতিমা শব্দেশ্বরী।

দূরত্বের অস্তহীন মরুর সিমুম ঝড়ে দিশাহারা আমি
রোজই ভাবি, দেখা হবে আমাদের কখনও আবার
বনানীর স্নিগ্ধতায়, দীর্ঘ গাঢ় লাল বারান্দায়।
যে-পথ সন্ধ্যার স্পর্শ পেয়ে কেমন মায়াবী হয়,
তার দিকে চোখ পড়ে হঠাৎ যখন,
যখন কোথাও দেখি অপরাহ্নে নতুন ব্লেডের মতো ঝিল,
মনে হয় দেখা হবে আমাদের, দেখা হবে তোমার রূপের স্তব্ধতায়।

আবার যাবে কি চলে? এখনই যেও না,
ফিরিয়ে নিও না মুখ; তুমি
না তাকালে আমি হৃতদীপ্তি, হীনবল
ঈগলের মতো পঙ্গু ডানা নিয়ে হাওয়ার ধিক্কারে
ক্ষয়ে-ক্ষয়ে
নিষ্ফল ক্ষোভের ভারে শ্বাসকষ্টে ভূগি সর্বক্ষণ-
পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে, বহু নিচে
হয়তো কচুরিপানাময় এঁদো ডোবায় অথবা খানাখন্দে
খুব অসহায় মুখ থুবড়ে পড়বো ভেবে ভয়ে নীল হই।

তুমি না বাড়ালে হাত পণ্ড হবে যজ্ঞ সুন্দরের,
ঋত্বিক যাবেন ভুলে মন্ত্র, হোমাগ্নি না জ্বেলে দ্রুত
পুড়িয়ে দেবেন সুশ্রী মণ্ডপ বেবাক;
সুসৌম্য আলেম কোরানের পাতা না উল্টিয়ে ভ্রমে
ঐন্দ্রজালিকের কালো নিষিদ্ধ কেতাবে
দৃষ্টি বুলোবেন।

এখন থেকো না দূরে, এসো চলে এসো-
হে মেয়ে তোমার আশা করার মধ্যাহ্নে স্নিগ্ধ ছায়া,
ফসলের আভা,
দীর্ঘ পরবাসে যোগাযোগহীন পত্রপ্রার্থীদের
সম্মেলনে অলৌকিক ডাক পিয়নের চিঠি বিলি,
অন্ধের ইশ্‌কুলে ব্রেইলির
ব্যাপক দেয়ালি, মৃত শহরের ধু-ধু স্তব্ধতায়
প্রবল আশ্বাসময় দৈব উচ্চারণ।

আশি দশকের পদাবলি

একটি কেমন পাখি ছায়াকে স্বপ্নের মতো বাহার করে
ঘরের ভেতরে আসে। ডানা থেকে টেবিলে লাফিয়ে
পড়লো কবিতা লাল বলের মতন।
হকারের হাত থেকে খসে পড়ে ভোরবেলাকার
খবর-কাগজ, ঝকঝকে
লাইনো টাইপগুলি মনিপুরী নাচের ধরনে
ঘূর্ণমান কিছুক্ষণ, অনন্তর কবিতার মুখ।
শ্রাবণ ধারায় ভেজা ভাঙা জানালায়
রোদের ঝলক, জ্যোৎস্না রাতে
সরুগলি বোবা তরুণীর মতো স্তব্ধ; কলোনির
ফ্ল্যাট থেকে ঝুলে থাকে কবিতার হাত,
যেন ক্রূশকাঠে জেসাসের বিশীর্ণ সাধক হাত।

আমার দেরাজ খুলে দেখি
নিজস্ব কাগজপত্র, চিঠি, ক্যাশমেমো, লন্ড্রির রশিদ আর
স্মৃতির মতন গোলাপের পাপড়ি, কিছু ফটোগ্রাফ। অকস্মাৎ
একরাশ গন্ধরাজ কাঠ
দীর্ণ করে প্রস্ফুটিত দেরাজের ভেতরে। খরগোশ
কোমল তাকায় ক্যালেন্ডারের রঙিন
তরুণীর দিকে
আমার টেবিলে বসে। কবেকার লাল ঝরাপাতা
চমৎকার উড়ে আসে খাতার পাতায়,
মিশে যায় যুবতীর ডাগর স্তনের
কিশমিশ, বেলা-পড়ে আসা সান্দ্র প্রহরে আহত
টিয়ের পালক আর আস্তিনের ঘ্রাণসহ নেভীব্লু কালিতে।

সোফার অতীতে হাই তোলে, বর্তমান জ্বলে
উৎসবের মতো, যেন বিবাহ বাসরে
দু’জন রমণে লিপ্ত, অজস্র নক্ষত্র স্পন্দমান
যুগল সত্তাকে ঘিরে। যখন রাত্রির কিশোরীর
মতো বয়সিনী,
তখনই রাত্রিকে খুব ঘনিষ্ঠ পাওয়ার জন্যে ওরা
তীব্র গুঞ্জরণময় শহরের হট্ররোল থেকে কিছু দূরে
দাঁড়ায় শহরে মাঠে বহুদিন পর। গোধূলিতে
কেবলি গুমরে ওঠে, টেলিফোনে বিদায়ের গহন বেহাগ-
আবার এয়ারপোর্ট, প্লেনের গর্জন, ফিরে-আসা, চলে-যাওয়া
সময়কে বুনে চলে স্বপ্নের রীতিতে।

অশেষ অভ্রের স্তরে স্তরে মাইল স্টোনের মতো
কী এক রহস্যময় সংকেত প্রোথিত, বিরানায় যোজন-যোজনব্যাপী
ফণিমনসায়
কবিতার ত্রিকালজ্ঞ চোখ জেগে থাকে।

একথা সবাই জানে, মানে না সে টাইম টেবল;
যখন যেখানে খুশি হরিণের মতো লাফ দেয়,
চিতার চোখের মতো ধক জ্বলে,
উচ্ছুসিত হয়ে ওঠে ফোয়ারার মতো। মধ্যরাতে
আশি দশকের পদ্যাবলী কী ব্যাকুল
ডেকে ওঠে ফুটপাতে, ধাবমান শেষ বাসে আর
অন্ধকার ফ্ল্যাটের ভেতরে বারংবার।

 উচ্চারণ

কখনো কখনো মনে হয় আট কোটি লোক শোনে
আমার নিভৃত উচ্চারণ, কখনো-বা মনে হয়
আমার কথার জন্যে পিপাসার্ত একজনও নয়।
প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যা অত্যন্ত একাকী গৃহকোণে
বসে শব্দ দাও শব্দ দাও বলে কী গহন বনে,
পর্বতে, পাতালে হই নতজানু, করি আয়ুক্ষয়
প্রতীকের প্রতীক্ষায়, কম্পমান একটি হৃদয়
বিজন সৈকতে সারাক্ষণ রহস্যের ঢেউ গোনে।

যে-কথা হৃদয়ে ফোটে, হৃদয়ের ধ্বনি মতন
অন্তরঙ্গ বেজে ওঠে, তা যদি না শোনে কেউ কান
পেতে কিংবা না বোঝে কখনো, ক্ষতি নেই, নেই খেদ।
তোমার উদ্দেশে আমি যখন যা করি উচ্চারণ,
সে ধ্বনি তোমার কানে সকল সময় হোক গান-
মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্ধেদ।

এ কেমন স্বভাবের তিলক

এ কেমন স্বভাবের তিলক বেড়াচ্ছো বয়ে তুমি আশৈশব?
নইলে কেন দিন-দুপুরেই ঢ্যাঙা পাতাছুট গাছ
হঠাৎ তোমার চোখে পাতালবাসিনী কোনো মোহিনীর নাচ?
কেন বারংবার দ্যাখো তুমি
বেলা-অবেলায় চেনা চা-খানায় অন্তর্গত বিপুল বৈভব
নিয়ে ছারপোকা-ছাওয়া কাঠের চেয়ারে মৃদু ভিড়ে
তন্ময় আছেন বসে এক জালালউদ্দীন রুমী?
অস্তিত্ব কি অনস্তিত্ব বাজে তাঁর সত্তায় মরমী মীড়ে;
মাথার ভেতরে তাঁর ত্রিলোকী গুঞ্জন, যেন অন্য মসনভি
এ যুগ-সংকটে লিখবেন, তুমি ভাবো; নভশ্চারী প্রেরণায়
আঁকবেন জগচ্চিত্র মননে প্রোজ্বল সে তাপস-কবি।

তোমার পাড়ায়
আশপাশে বসতিতে আছে যারা, যাকে সাঁকো
বলে, তুমি তার নাম রাখো
নির্দ্বিধায় ছায়াপথ,
বাগানের নানা ফুল চোখের পলকে
অসুস্থ অনাথ বালকের টলটলে
চোখ আর মেঘপুঞ্জ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু শিবির
হয়ে যায় বারবার তোমার দৃষ্টিতে। আগামীর
নৈরাজ্যে সংকট স্বর্ণরথ
ভেবে যাকে দ্রুত ছুটে যাও তুমি প্রত্যহ, বলো কে
তা সহজে মেনে নেবে তর্কাতীত? আর জ্বলজ্বলে
এ শহর পম্পেয়াই-নগরীর ধ্বংসস্তুপ বদলে যদি
হঠাৎ চিৎকার করে দশদিক ভীষণ কাঁপিয়ে তোলে, তবে

‘ওরা তোর কী হবে, কী হবে?
সেই যে আঁতুড় ঘরে ঢুকেছিলো ক্ষ্যাপা জিন অলক্ষ্যে সবার,
এখন অবধি
সওয়ার হয়ে সে আছে তোর কাঁধে হে বাছা আমার,’
বলে ফেলবেন এক নদী
ঝরঝর চোখের পানি জননী তোমার। তবু তুমি শেষ বাসে
ঘরে ফেরা প্রহরে হঠাৎ
দেখে ফেলো খোলা রাস্তা এভিন্যু ছাপিয়ে হেঁটে আসে
বহুদূর-দূরাস্তর থেকে মহাকাব্যের দীর্ঘাঙ্গ স্ফীতবক্ষ
নায়কের মতো
তৃতীয় বিশ্বের জনস্রোত। স্তব্ধ রাত

গানে গানে তরঙ্গিত সমুদ্রেরই সমকক্ষ।
কী বিশাল মানবিক স্থাপত্য চৌদিকে, অকস্মাৎ
ফুটপাথে ফুটপাথে বনরাজিনীলা আর আমাদের ভীষণ আহত
এ শতক মাথা নত
করে দেয় অগণিত পায়ের ধুলায়। কে কিরাত
কেউ-বা শিকার চরাচরব্যাপী মৃগয়ায় আজ
বলা মুশকিল আপাত। তোমার তৃতীয় চোখ
আছে, পাড়াপড়শীরা পরস্পর করে বলাবলি।
দৃশ্যাতীত নানা দৃশ্যাবলী দেখা তোমারই তো কাজ;
হে নবীন বন্ধু, দাও বলে দাও, এই জীবলোক
বিধ্বংসী ভয়াল নাট্যে কে হবে জল্লাদ, কে-বা বলি!

 এরকম হলে

এরকম হলে হাঁসের পংক্তি শিশুর আনাড়ি
হাতে আঁকা রেখা হয়ে যায় নির্ঘাৎ।
মানে, অতিশয় ত্রঁকেবেঁকে যায়, আকাশের ভুল
সীমানায় ওড়ে যেনবা হংসদল।

এরকম হলে ঘনঘন কাঁপে এপাড়ার কালো
রজস্বলা সে মেয়েটির বাম চোখ।
এরকম হলে বাড়ি খুঁজে-খুঁজে কাটে সারাবেলা,
পা চলে না আর; ঠিকানা-চিহ্নহীন।

এরকম হলে উদাস দুপুরে নিশুত নিশীথে
বার-বার ছেঁড়ে মীর কাশিমের তার,
গ্রীষ্ম-দুপুরে মুর্ছিত স্বরে দিন দিন বলে
কৃষিঋণ চায় জয়নুলী শত কাক।

এরকম হলে পার্কে কি মাঠে পেনশনভোগী
বয়স্কজন চুষিকাঠি নেন হাতে,
বারোয়ারি কত পার্টি অফিসে দোতারা বাজিয়ে
অন্ধ বাউল গায় লালনের গান।

এরকম হলে চৌরাস্তায় সন্ধ্যাবেলায়
ওড়ে সুবিশাল কৃশপুতুলের ছাই,
দূর শতকের কারুকাজময় পত্র চকিতে
রুক্ষ ধুলায় হয় সানকির নাচ।

এরকম হলে এ শহর ঢাকা বড় অভিমানী,
ভীষণ অসুখী; আঁধারে লুকায় মুখ।
এ শহর ঢাকা কখনও আবার এক নিমেষেই
দীপ্র তরুণ নজরুল ইসলাম।

এরকম হলে আহত বিবেকও লোকচক্ষুর
আড়ালে নিখুঁত পরে নেয় পরচুলা;
মনন, বিবাগী মরালের মতো
ডানা ঝাপটায় অকূল শূন্যতায়।

এরকম হলে বাক্যের ভীরু খরগোশ যেন,
এদিক-ওদিক তাকায় আর্তচোখে।
নিদাঘবেলায় দ্রুত উবে যায় আনন্দসুর,
কাব্যকলার রোদেলা অনুগ্রহে।

ঐতিহাসিক

বাইরে হার্মাদ ঝড়। যেন খুব বদরাগী কেউ
বারংবার গর্জে উঠে গাছপালা, ল্যাম্পেস্ট ঘরের
চাল, খুঁট পাখিদের ডেরা, বেবাক ফেলছে ছিঁড়ে
খুঁড়ে কাগজের মতো। তিনি, প্রাজ্ঞ একজন, একা
ঘরের ভেতরে বাতি জ্বেলে পড়ছেন ইতিহাস আর
মাঝে-মাঝে ঝাড়ছেন ছাই ত্র্যাশট্রেতে। অকস্মাৎ
দৃষ্টিপথে তাঁর ভাসে অগ্নিদগ্ধ বিপন্ন শহর-
এবং ছাড়ছে হ্রেষা চেঙ্গিসের ক্ষিপ্রগতি ঘোড়া
পাহাড়ে, প্রান্তরে, জনপথে। এণক্লান্ত, পরাভূত
নেপোলিয়নের তেজী ঘোড়ার শরীরে যত্রযত্র,
তুষার কামড় আর লাঞ্ছিতা পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরিতে
ট্যাঙ্কের ঘর্ঘর আর একাত্তরে বাংলাদেশে ক্রূর
বর্ষরের কী ব্যাপক নিপীড়ন, বই বন্ধ করে
ভাবেন প্রবীণ গবেষক, ইতিহাস তালেবর
তাশ জোচ্চোরের মতো হাত সাফাইয়ের কেরদানি
দেখায় প্রচুর আর নমস্য গিবন বলে সাত
তাড়াতাড়ি খাতা খুলে তিনিও লিখতে বসে যান
অতীতের ছায়াতলে ফরমায়েসি ভ্রষ্ট ইতিহাস।

কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি

যখন আমি সাত আট বছরের বালক
তখন আমার মেজোভায়ের হাতে
প্রথম দেখেছিলাম
রবীন্দ্রনাথের চয়নিকা। আমাদের বাড়ির চিলেকোঠায়
কাটতো আমার অগ্রজের সিংহভাগ সময়।
অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর,
যদিও মঞ্চে পাঠ মুখস্থ বলেননি কোনো দিন।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
নানা ধরনের মুখভঙ্গি করার অভ্যাস ছিল তাঁর।
কখনও ভুরু জোড়া কুঁচকে যেত খুব
কখনও আবার চোখ হয়ে উঠতো
শোকাহত বাল্মীকির চোখের মতো। মাঝে-মাঝে তিনি
চয়নিকা থেকে আবৃত্তি করতেন
পাকা অভিনেতার মতো হাত-পা নেড়ে,
দিব্যি গলা খেলিয়ে। যখন দরাজগলায়
অগ্রজ উচ্চারণ করতেন, ‘হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থ,’
তখন কেন জানি না
আমি নিজেকে দেখতে পেতাম খুব উঁচুতে
কোনো পর্বতচূড়ায়। আর যখন ‘মহামানবের সাগরতীরে’
বলে তিনি তাকাতেন জানালার বাইরে,
তখন তাঁকে এক মুগ্ধ বালকের চোখে লাগতো
যাত্রাদলের সুদর্শন রাজার মতো। সবকিছু ছাপিয়ে
মহামানবের সাগরতীরে-এই শব্দগুচ্ছ
আমার সত্তায় জলরাশির মতো গড়িয়ে পড়তো বারংবার।
চয়নিকার সঙ্গে আমার পরিচয় হবার আগেই
হলদে মলাটের সেই বইটি
কোথায় হারিয়ে গেলো, তারপর
কখনও চোখে পড়েনি আর।
এখনও যখন আমি ফিরে যাই মাঝে-মধ্যে
ছেলেবেলার চিলেকোঠায়, তখন বিকেলের রঙের মতো
চয়নিকা কেমন অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে।

চয়নিকার সঙ্গে যখন আমার চক্ষু মিলন হয়েছিলো,
তখন রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে
শুধু একটা নাম। সে নামের আড়ালে কী মহান বিস্ময়
দীপ্যমান, তা জানার জন্যে আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে
দীর্ঘপথ। আমার নিজস্ব রবীন্দ্রনাথকে
আমি আবিষ্কার করেছি ক্রমান্বয়ে
অভিযানের দুর্বার নেশায়।
চয়নিকার কাল থেকেই কি শুরু
কবিতার সঙ্গে আমার গেরস্থালি? নাকি
বাঁশবাগানের মাথার উপর যে-শাশ্বত চন্দ্রোদয়
আমি লক্ষ্য করেছিলাম, সেদিন থেকে?
হতে পারে অনেক অনেক বছর আগে
আমার নানি ভোরবেলা আঙিনায় বসে
যে-মুহূর্তে গৃহপালিত মোরগের ঝুঁটি
পরখ করতে করতে আমাকে বলেছিলেন, ‘এটা ওর তাজ’
সেই মুহূর্তেই কবিতা ঊষা হয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো আমাকে,
কিংবা এও তো সম্ভব,
দীর্ঘকাল আগে আমার নানা যে-স্বপ্নের
কথা বলেছিলেন, যে স্বপ্নে তিনি বহু আলিশান হাবেলি
মিস্‌মার হতে দেখেছিলেন,
সেই স্বপ্নই আমাকে কবিতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো,
অথবা হতে পারে বাল্যকালে কোনো এক মধ্যরাতে
বৃষ্টির শব্দ শুনে আমি জেগে উঠেছিলাম
যখন, ঠিক তখনই কবিতা আমাকে নিয়ে গেলো
বিরামবিহীন শ্রাবণধারায়।

আমাদের চিলেকোঠা থেকে চয়নিকা লুপ্ত হবার পর
আমার অগ্রজ আর কখনও গলা খেলিয়ে
কবিতা আবৃত্তি করেছে কিনা, মনে পড়ে না।
তাঁর আবৃত্তি আর না শুনলেও,
সেই, যে মহামানবের সাগরতীরের ধ্বনি
তিনি মিশিয়ে দিয়েছিলেন আমার অন্তর্লীন প্রবাহে
তা আমাকে ছেড়ে যায়নি কখনও।
চল্লিশের দশকের গোধূলিতে কবিতার সঙ্গে, বলা যায়,
আমার ঘনিষ্ঠ জীবনযাপন হলো শুরু।
তখনই সঞ্চয়িত উপহার হয়ে
এসেছিলো আমার হাতে। কিছুকাল আমি
মগ্ন হয়েছিলাম তাতে, যেমন কোনো দরবেশ
সমাধিস্থ হন অনন্ত কি অসীমের প্রেমে।
কিন্তু কী যে হলো, পঞ্চাশের দশকের প্রত্যূষ
আমাকে ছুঁতেই, সেই ঘোর গেলো কেটে-
তিরিশের কবিসংঘ দিলেন প্রবল ডাক, পোড়ো জমি থেকে
হাতছানি দিলেন এলিয়ট, জান পাতলাম
এলুয়ার এবং আরাগর যুগলবন্দিতে আর নিমেষে
তারুণ্যের তেজে হঠকারী অবহেলায়
সঞ্চয়িতাকে ধূলোয় মলিন হতে দিয়ে
স্বভাবত স্বতন্ত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরে সরে গেলাম
ভিন্ন স্বাতন্ত্রের আকুল সন্ধানে। বুঝি তাই
তখন আমাকে লিখতে হলো-
‘মধ্যপথে কেড়েছেন মন,
রবীন্দ্র ঠাকুর নন, সম্মিলিত তিরিশের কবি।’

কিন্তু সরে গেলেই কি যাওয়া যায়?
বয়স যতই বাড়ছে, ততই আমি সেই সমুদ্রের দিকে
যাচ্ছি, রবীন্দ্রনাথ যার নাম, যেমন যাচ্ছি
দান্তের বিপুল বিশ্বে; যেন ভীষণ রুক্ষ
নির্বাসন থেকে প্রত্যাবর্তন করছি নিজ বাসভূমে।
জানি না আমার অগ্রজ-উচ্চারিত
মহামানবের সাগরতীরে সেই সুদূরে
কবিতার সঙ্গে প্রথম আমার জীবনযাপন
শুরু হয়েছিলো কিনা,
তবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কোনো গৌরীর
মুখ মনে-পড়ার মতন্‌
একদা আমাদের চিলেকোঠায় হারিয়ে যাওয়া
হলদে মলাটের চয়নিকাকে আজও মনে পড়ে, মনে পড়ে, মনে পড়ে।

কীভাবে করবো শুরু

কীভাবে করবো শুরু ভেবেই পাচ্ছি না। প্রতিবার
সেই একই মুশকিল-অস্তিত্বের ঈষৎ কম্পন,
শব্দহীনতার মরুভূমি, ভ্রষ্ট চিন্তার গহ্বর,
তবে কি এখন আমি মুদ্রাদোষবশত খানিক
আমতা-আমতা করে নামতার মতো গড়গড়
বলে যাবো কিছু, নাকি খাতা নিরক্ষর রেখে ফের
থাকবো আলস্যে ডুবে অথবা আড্ডার লোভে যাবো
বন্ধুর ডেরায় মেনে নিয়ে পরাজয়? কিন্তু আমি
পরমুহূর্তেই দেখি সারস আকাশ পাড়ি দেয়,
মৌলানা রুমির খিবকা কাঁপে, রক্তাপ্লুত যেশাসের
উনিশ শো একাশিটি জন্মন্ধ পেরেক জেগে থাকে,
এবং সন্তের চোখ। একটি সোনালি সিংহ তার
মুখে গোলাপের তোড়া নিয়ে ছোটে নৈশ ফুটপাথে,
বাজে কারো কণ্ঠস্বর, মুশকিল কেমন আসান হয়ে যায়।

 কে দেবে অভয়

কোনো-কোনোদিন মধ্যরাতে ভয় পেয়ে জেগে উঠি।
দেয়ালে নিবদ্ধ চোখ, মগজের কোষে জ্বালা,
কিসের নিঃশ্বাস লাগে চোখে-মুখে, প্রেতের ভ্রুকুটি
ঘরময় জেগে থাকে সারাক্ষণ, যেন বোবা-কালা
আমি, পড়ে থাকি ঠাণ্ডা শবগন্ধী কফিনের মতো
শয্যায় নিঃস্পন্দ, একা। অকস্মাৎ অগ্নিবর্ণ ঝুঁটি
নেড়ে কাকাতুয়া তেড়ে আসে শয্যাপার্শ্বে, অবিরত
চঞ্চু আর নখ দিয়ে আমাকেই ছেঁড়ে কুটি-কুটি।
দেয়ালের টিকটিকি বিশাল ডাইনোসর হয়,
উঠোনের গাছপালা খুব প্রতিহিংসাপরায়ণ
হুনের মতন ধেয়ে আসে এই ঘরে কী দুর্জয়।
আমার ওপরে ঘোর কালো ফণিমনসার বন
সহসা ঝাঁপিয়ে পড়ে, এমনকি যে শান্ত বেড়াল
আমার নিবাসে করে বসবাস, সে-ও চক্ষুদ্বর
পাকায় গভীর রাতে। ঘোড়ার পায়ে ভারি নাল,
হাজার-হাজার, ঝরে সারা ঘরে; কে দেবে অভয়?

হঠাৎ ভয়ার্ত মধ্যরাতে তীব্র স্মৃতির মতন
তোমার মুখের দ্বীপ মনে পড়ে, তোমার সোনালি
শরীরের কথা ভাবি আর কী আশ্চর্য, এতক্ষণ
যে ভয় আমাকে কাটছিলো অতিশয় ফালি-ফালি,
তার ছায়া নেই আর কোথাও এখন। তুমিহীন তুমিময়
এ ঘর আমার; তুমি চোখের তারার মতো তুমি
অন্তরঙ্গ তুমি, দেখি আমার হৃদয়ে চন্দ্রোদয়,
তোমার শিল্পিত কণ্ঠস্বরে গুঞ্জরিত মনোভূমি।

কেউ কি পালিয়ে যায়

কেউ কি পালিয়ে যায় অকস্মাৎ নিজের বাড়ির
দোরগোড়া থেকে কোনোদিন ? নিজের একান্ত প্রিয়
বই, যাবতীয়
খুঁটিনাটি বস্তুময় ঘরটাকে খুব ফাঁকা করে
কেউ কি স্বেচ্ছায় সাততাড়াতাড়ি চলে যায় নিজস্ব হাঁড়ির
ভাপ-ওঠা ভাত ফেলে? ঘোরে
এলোমেলো গন্তব্যবিহীন
অন্ধকারে মুখ ঢেকে ভয়ে ভয়ে থাকি রাত্রিদিন?

মাঝে-মাঝে এরকম হয়, হতে থাকে-
গেরস্থ সাজানো ঘরদোর ছেড়ে নিমেষে পালায় ঊর্ধ্বশ্বাসে
সেখানে, যেখানে রক্তখেকো বাঘ ডাকে,
পড়ে গণ্ডারের, বন্যবরাহের পদচ্ছাপ,
বিষধর সাপ
ফণা তোলে, দোলে হিস্‌হিসে তাজা ঘাসে।

বলো তো এমন কেন হবে বলে কেউ
ছাগলের চামড়ার মতো স্তব্ধ আকাশের দিকে
চেয়ে কিছুক্ষণ হাসে ফিকে
হাসি, আড়চোখে দেখে আশপাশে কত ফেউ
এর ওর তার ছায়া চেটে খায়। যেহেতু হঠাৎ
এপাড়া-ওপাড়া
সব পাড়াতেই চলে প্রেতের পাহারা,
অকৃত্রিম সুহৃদের মুখের আদল
নিয়ে প্রত্যেকেই দ্রুত হয়ে ওঠে নির্দয় কিরাত।
বিশ্ব-চরাচরে রাসায়নিক বাদল
ব্যেপে আসে দেখি ক্রমান্বয়ে
খুব ঘন হয়ে।

নিজস্ব বিবর ছেড়ে যাই না কোথাও
দূরে স্বপ্ন সঞ্চরণে, দোরগোড়া থেকে
কখনও হঠাৎ সরে গেলে গেলে অভিমানে মুখ ঢেকে,
‘ঘুমন্ত রাজার ঘরে দাও
হানা মধ্যরাতে’ বলে দেয় প্ররোচনা চতুর্থ ডাকিনী।
তাকে দেখে মুখ আমি কখনও ঢাকিনি।
তবু আর্তবিবেকের নিঃসঙ্গ জোনাকি জ্বলে আর
নেভে, নেভে আর জ্বলে
আজও অবচেতনের গহীন জঙ্গলে।
ভয়ার্ত পাখির মতো ইদানীং কাঁপছে সময়,
হোক না যতই অন্ধকার
ঘর, স্বখানেই ফিরে আসি, আসতেই হয়।

ক্লান্ত তুই

তোর সাহসের গলাফোলা স্তব করবে না কেউ
কোনোদিন; ক্লান্ত তুই বিক্ষুব্ধ সমকালে ঢেউ
তুলিসনি, তোর ডাক শুনে কোনো অশান্ত তরুণ
ঝরায়নি বেপরোয়া তার দীপ্ত টগবগে খুন
রাজপথে, তোর জন্যে কস্মিনকালেও অনশন
ধর্মঘট করবে না কেউ কিংবা হবে না হরতাল
শহরে বন্দরে, কেউ বাজাবে না ট্রাম্পেট কর্তাল
স্বাগত জানাতে তোকে। দিকে দিকে উজ্জ্বল তোরণ
তুলবে না মাথা তোর নামে। পুষ্পিত বিগ্রহ তুই
নোস, তোর পায়ে কেউ করবে না অর্পণ কিছুই।

ক্লান্ত তুই, অবসন্ন শরীর ও মন দিয়ে তোর
কী ঝক্কি ঝামেলা আজ। আধিব্যাধি বড়ই নাছোড়।
থাকিস একলা পড়ে অন্ধকার কোণে, দুষ্ট ক্ষত
চেটে বেলা যায়, কাদা ঘেঁটে কী খুঁজিস অবিরত
অমন ব্যাকুল হয়ে? হঠাৎ কখনও সূর্যোদয়
সুদূর দিগন্ত ছেঁড়া সূর্যোদয় দেখে মনে হয়-
মাথার ভিতরে তোর এখনও গুঞ্জন কিছু আছে
বাকি, সব ফাঁকি, সব ভ্রান্তি উজিয়ে এখনও নাচে
শিরায় আহত দেবশিশু। তবে কেন অকস্মাৎ
মধ্যপথে কোন্‌ ভুলে এমন অবশ তোর হাত?

আকাশে নতুন আলো ফোটার আগেই, ওরে বোকা,
ভুলে গেলি বাজাতে আশার ডুগডুগি। কেন ধোঁকা
দিন না অম্লান মুখে দশজন পড়শিকে? চেয়ে
দ্যাখ চারপাশে কত লোক কী উল্লাসে যাচ্ছে বেয়ে
তা’ ধিন তা’ ধিন খেয়া, কাড়া-নাকাড়ার ধুন্ধৃমার
শব্দে দিকগুলি দিনরাত্রি কম্পমান বারবার।
ছায়ায় আছিস মিশে, রোদ্দুরে অরুচি অতিশয়;
হেলায় বিকিয়ে দিলি বাস্তুভিটা, বিষয়-আশয়।
তুই ভীরু, বড় ভীরু উদ্যমরহিত চিরদিন,
সঙ্গলিপ্সু তুই, তবু রয়ে যাবি নিঃসঙ্গ মলিন?

গুলিবিদ্ধ লাশের মতন


একটি দশক কেটে গেছে; যেন আমি এতকাল
ছিলাম সিনেমা হলে শ্বাসরোধকারী পরিবেশে।
কত দৃশ্য নৃত্যপর চোখের সম্মুখে, দিগ্ধিদিক
ছোটে নানা কুশীলব। অনেকে নিষ্প্রাণ অতিশয়,
যেন কাকতাড়ুয়া ধরনে দাঁড়ানো অন্ধকারে।
কেউ ছদ্মবেশে পথ হাঁটে আস্তিনে লুকিয়ে ছোরা,
সিঁদ কাটে কেউ মধ্যরাতে গেরস্থ পাড়ায়, কারো-
কারো হাত হতাশা ছড়িয়ে দেয় সম্পন্ন সংসারে।
কেউ-কেউ পুকুর চুরির পরে কাতলার মতো
ঝলসাতে থাকে রৌদ্রে বারেবারে; কেউ খুব ক্ষব্ধ,
প্রায় ক্রুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে হাতে অস্ত্র ধরেছিলো বলে।
অস্তরাগে শ্মশানের ধারে চোরাগোপ্তা মাল টেনে
গলাগলি করে গড়াগড়ি যায় ডাকাত পুলিশ।
কেউবা ফাঁসিতে ঝোলে, কেউ যায় দীর্ঘ নির্বাসনে।


একটি দশক গেছে, তবু কেন দৃশ্যাবলি হঠাৎ এমন
পাল্টে যায় বারাংবার? কেন গাছপালা তছনছ,
অগ্নিদগ্ধ বাড়িঘর? কেন মৃত্তিকা উগরে দেয়
করুণ করোটি সংখ্যাহীন? অকস্মাৎ এ কেমন
পরাবাস্তবের লীলা শহরের আনাচে-কানাচে?
মাঝে-মাঝে মনে হয়, আমার চোখের রেটিনায়
কী ব্যাপক বিভ্রমের ছায়া নাচে বেলা-অবেলায়।
নইলে কেন গাছে-গাছে সদ্য কাটা নরমুণ্ডু দেখি,
দেখি দিনদুপুরেই শেয়ালে শকুনে ছেয়ে গেছে
পৌরপথ! এমনিতে মোটামুটি ভালো থাকি, মানে
খাই-দাই, প্রত্যহ কামাই দাড়ি। হঠাৎ আবার
সবকিছু উল্টা-পাল্টা, আমার দৃষ্টিতে বারংবার
একাত্তর ভেসে ওঠে গুলিবিদ্ধ লাশের মতন।

টানেলে একাকী

একটি টানেলে
কাটিয়ে দিলাম হিমযুগ এবং প্রস্তরযুগ, তাম্রযুগ,
লৌহযুগ খুব একা একা,
কাছাকাছি কেউ নেই এবং দূরেও ঘর কুয়াশায় কারো
অস্তিত্ব ফোটে না, শুধু ব্যর্থ যৌবনের মতো একটি কুকুর আজও
সঙ্গে সঙ্গে থাকে।

কতকাল আমি সূর্যোদয়
দেখিনি, শুনিনি কোনো দোয়েলের শিস। কালেভদ্রে
যেন কোনো বাজিকর টানেলের দেয়ালে ফোটায়
আলোর গোলাপ, ঝিল্লীস্বর শুনে টের পাই রাত।
যদিও প্রায়শ শ্বাসকষ্ট হয়, তবু নিশ্বাস নেবার মতো
অবশ্য থেকেই যায় কিছু অক্সিজেন।

টানেলের ভেতরে হঠাৎ
কখনও চিৎকার শুনে আতঙ্কে শরীর শজারুর
কাঁটা হয় আর চোখ ফেটে যায় আনারের মতো। চতুর্দিকে
দৃষ্টি ছোটে, ঘুরি দুটি হাত প্রসারিত করে, অথচ আমার
নিজস্ব অস্পষ্ট ছায়া ছাড়া কাউকে পাই না খুঁজে
কোথাও এখন।

কখনও কখনও
মনে হয়, কী যেন কিসের ঘোরে চলে গেছি সুদূর কোথাও
স্বপ্নচর পাখির পাখায় ভর করে, কাছে আসে
বাহাদুর শাহ জাফরের গজলের মতো এক
বিরান বাগান আর মোগল মিনিয়েচার কিছু অস্তরাগে কান্নারুদ্ধ
রক্তাভ চোখের মতো পুরাণসম্ভব।

অপরাহ্নে ডিভানে শায়িতা
মহিলা আমাকে ডেকে পিকাসোর ত্রিমুখী রমণী হয়ে যান
চোখের পলকে, আমি তার স্তনদ্বয়, অভিজাত নাভিমূল,
রমণীয়, উল্লসিত যোনি থেকে দূরে, ক্রমশ অনেক দূরে
চলে যেতে থাকি তিনি কবিতার পংক্তির মতন
কেবলি ওঠেন বেজে অস্তিত্বে আমার।

এ কোথায় এসে
দাঁড়ালাম অবশেষে? তবে কি প্রকৃত রোবটের
কাল শুরু হলো আজ? সকলেই রোবট তাহলে ইদানীং?
কান্তিমান লাইনো টাইপগুলি করেছে নির্মাণ
অদ্ভুত জগৎ এক; রাশি রাশি টাইপ কি দ্রুত
বেলা অবেলায়।

অবলীলাক্রমে
মিথ্যাকে বানায় সত্য, সত্যকে ডাগর মিথ্যা আর
রমণ, বমন, বিস্ফোরণ, যূথবদ্ধ আত্মহনন ইত্যাদি
শব্দাবলি দশদিকে সহজে রটিয়ে দেয় এবং সাজায়
সুচারু যান্ত্রিকভাবে কবিতার পংক্তিমালা মিল-
অমিলের উদ্ভট নক্‌শায়।

অসম্ভবে হয়েছি সওয়ার
আকৈশোর; অতিকায়, মৎস্যপৃষ্ঠে করেছি ভ্রমণ
সমুদ্দুরে বহুকাল, জলপরীদের দিব্যলালিম স্তনাগ্র ছুঁয়ে-ছেনে
গেছে বেলা পাতালের জলজপ্রাসাদ আর খসিয়ে নিজের
বুকের পাঁজর থেকে হাড় বানিয়েছি দেবতারও
ঈর্ষণীর বাঁশি।

অথচ উচ্চাভিলাষহীন
গৌরবের হেমবর্ণ চূড়া থেকে বহুদূরে আছি,
দেখি কয়লার গুঁড়ো, স্বপ্নবৎ ঊর্ণাজাল, কীটপতঙ্গের
ঘর-গেরস্থালি, দেখি জানু বেয়ে ওঠে নীল পোকা, মাঝে-মাঝে
বাদুড়ের ডানা কাঁপে, সিল্কের রুমাল যেন; থাকি দীর্ঘ কালো
টানেলে একাকী।

তুণে খুঁজি তীর


একদা আমার স্বপ্ন সুপ্রাজ্ঞ নূহের করতল
থেকে উড়ে-যাওয়া কপোতের মতো ছিল যার ঠোঁটে
পুষ্পল জলজ কণা সদ্য জাগা পল্লবের ঘ্রাণ।
একদা আমার স্বপ্ন নীলিমাকাতর ঊর্ধচারী
পাখায় জড়িয়ে নিয়ে নির্বাসিত দান্তের ভাবনা
ক্লান্তিকালে খুঁজেছে নীড়ের ওম; একদা আমার
স্বপ্ন ছিল দ্য ভিঞ্চির অলৌকিক আঙুলের মতো;
একদা আমার স্বপ্ন মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্যসঙ্গী
ছিল ঝোপঝাড়ে, বনবাদাড়ের আঁধারে, জলার-
সবুজ গ্রেনেডে, বন্দুকের নলে, ক্যাম্পে, পরিখায়।
এখন আমার স্বপ্ন ক্রাচাশ্রয়ী, একা-একা ঘোরে
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাঝে-মাঝে; এখন আমার স্বপ্ন
চাঁদা আর ভাতা প্রার্থী, কখনও আবার নজরুলী
কবিতার মতো অগ্নি উদ্‌গীরণে ব্রতী হতে চায়।


তবু আমি নিজেকে বিপন্ন ভেবে করি না বিলাপ।
ক্রমশ কাদার চাকা দেবে যাবে, আমার শোণিত
মিশে যাবে অস্তরাগে, ভূলুণ্ঠিত শরীর দলিত
হবে আর শস্যশূন্য মাঠের মতন এ জীবন
ক্ষণকাল হবে উদ্ভাসিত দৃষ্টপথে, অনন্তর
লুপ্ত গান, স্মৃতি সমুদয়, অতীত ও বর্তমান।
এখন যদিও স্বপ্ন রোগা ঈগলের মতো বাঁচে
উপহাস কুড়িয়ে সর্বদা, তবু স্বপ্নের টানেলে
কাটে বেলা মাঝে-মধ্যে। সম্প্রতি আমার নেই কোনো
সঙ্গী আর; একদা যাদের সঙ্গ দিত সুখ, তারা
তিন ডাইনীর প্ররোচনা মেনে অতি দ্রুত পাল্টে
নিয়েছে জীবন, আমি একা এখনও কুড়াতে যাই
ফুল বনবাদাড়ে এবং চাকা নাছোড় কাদায়
দেবে যাবে নিশ্চিত জেনেও আজও তূণে খুঁজি তীর।

তোমার কুশল

তোমার কুশল আমি জানি না এখন। বড় যোগাযোগহীন
আছি ইদানীং
এ এমনই যুগ, যোগাযোগ ক্রমান্বয়ে হচ্ছে যত
সহজ ততই যোগাযোগহীন হয়ে পড়ছে মানুষ। তুমি
এ মুহূর্তে কি করছো, কোন শহরের ফ্ল্যাটে আছো
তোমার বিবাহোত্তর রূপ নিয়ে নিজস্ব সংসারে,
আগেকার মতো আজও আমাকে তোমার
মনে পড়ে কিনা,-
জানি না কিছুই। আগেকার মানে কবেকার? বলো
তুমি কি এখনও
আমাকে অত্যন্ত ভেবে রাত্রির চিতায় জ্বলজ্বলে
যৌবন পোড়াও হে সুচেতা?

এই প্রশ্নে কুয়াশার আবছায়া মেদুরতা আছে, অতিদূর
অরণ্যের হরিণ্যের চঞ্চলতা আছে,
ঝিলের কোমল আলোড়ন আছে, আছে
পরিত্যক্ত বসতির স্তব্ধতা এবং
পুরনো আন্ধারে কোনো গহনা নৌকার যাত্রাধ্বনি।

একদা আমিও ভাবতাম
কখনও আমাকে যদি ছেড়ে চলে যাও দূর দেশে
আমার সকল প্রত্যাশাকে মরীচিকা করে, তবে
আমি বন্ধ ঘরে মরে পড়ে থকবো একাকী
কিংবা উন্মত্ততা
আমাকে দখন করে ফেলবে নিমেষে,
অথবা আমার কাছ থেকে কর্কশ অংকের কর
আদায় করবে অসুস্থতা অবিরত। কিন্তু আমি
আত্মহননের আফিমে হইনি বুঁদ
নাবালক পুরুষের মতো।

হে দয়িতা সুচেতা আমার
সে কবে হয়েছে দেখা, রাত্রির প্রথম যামে কথোপকথন
আর লোকচক্ষুর আড়ালে
নাগরিক ক্ষণিক ভ্রমণ আর থরথর তোমার শরীর
কিছু কল্পনায় আর কিছুটা বাস্তবে
ছুঁয়ে ছেনে বাউণ্ডুলে কবির গভীর পংক্তিমালা আহরণ
কিছু তার মনে পড়ে, কিছু বিস্মৃতির কাছে আমি
রেখেছি বন্ধক। মনে পড়ে, মাঝে-মাঝে তোমাকেই
মনে পড়ে সকাল সন্ধ্যায়
দুপুরে কি মধ্যরাতে, অকস্মাৎ বাড়াই দু’হাত
তোমার একান্ত দিকে, কখনও-কখনও পদ্য লিখি
তোমারই উদ্দেশে, রাত জেগে তোমার মধুর নামে চিঠি
লিখে ডাকঘরে যাই বারেবারে, অথচ করি না
পোস্ট কোনো পত্র ঠিক ডাক-টিকিটের অভাবে কখনও।

যৌবসাজ খসে গেছে, আমার যৌবন সে কখন
আহত চিলের মতো আর্তনাদ করতে-করতে
অসহায় পড়ে গেছে জন্মন্ধ ডোবায়। আমি আজ
অতীত চিবোই শুধু যে অতীত আমরা দু’জন
অন্তরঙ্গ করেছি রচনা
কখনও ড্রইং রুমে, কখনও-বা খোলা মাঠে, লাল বারান্দায়,
কোনো-কোনো রাতে
স্বপ্নিল মোটরকারে সান্নিধ্যের বৈদূর্যমণির
বিপুল আভায় উদ্ভসিত, চুম্বনের সঙ্গীতে অধীর হয়ে,
রাত্রির অসিত মখমলে গাল রেখে
বসে-থাকা, প্রকৃত হার্দিক কথা ভুলে যাওয়া আর
চুপচাপ চেয়ে-থাকা দিয়ে।
আজ ব্যর্থতার ভস্মারাশি আমাকে ফেলেছে ঢেকে,
আবার কখনও আমি ভস্ম ঝেড়ে অবিনশ্বর পাখির মতো
সূর্যোদয় আর পদ্মপ্রসূত আভার সম্মিলনে
গীতময় হবো কিনা, স্পষ্টতই আমি তা জানি না।

দাঁড়াবো কোথায় আজ?

দাঁড়াবো কোথায় আজ? সাতপুরুষের ভিটেমাটি
উঠেছে নিলামে প্রায়; উপরন্তু ঘুঘুর অভাব
নেই আশেপাশে আর, হা কপালে, আমিও স্বভাব
দোষেই উড়নচণ্ডী আকৈশোর, বলা যায় খাঁটি
জুয়াড়ি এবং পরিণামে উদাসীন। ঘটি-বাটি
সমস্ত বন্ধক রেখে মহাজনদের কাছে ঘুরি
সহায়-সম্বলহীন, গৃহিণী অকালে প্রায়-বুড়ি;
ক্ষুধার অনলে পুড়ে সন্তানেরা চোষে শুকনো আঁটি।

মাঝে-মধ্যে মসজিদে মানতের বাতি জ্বেলে
কাবা শরিফের দিকে মুখ রেখে ক্লান্ত হাঁটু মুড়ে
বসে থাকি লোবানের ঘ্রাণে মগ্ন অতিশয়, ভাবি
আগামী বৈশাখে তোফা তক্‌দিরের চাকা যাবে ঘুরে,
সন্তান থাকবে দুধে-ভাতে আর কড়াইয়ে ঘি ঢেলে
এবং গৃহিণী পরবেন স্বর্ণবালা, নাকছাবি।

দীর্ঘ কেঁদে যায়

কোনো কোনো নিদ্রাহীণ রাতে জানালায়
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তজবা ফুটে থাকে। ওরা
আমার টেবিলে-রাখা কবিতার খাতার ভেতরে
প্রবেশ করতে চায় নিরিনিলি, বলে-
বিজনে আমরা জ্বলি, দূরে কাঁদে কে একাকী নিঃসঙ্গ শয্যায়,
বিজনে জ্যোৎস্নাও কেঁদে যায়, কেঁদে যায়, কেঁদে যায়।
কিছু হাড়, কিছু শুকনো পাতার ওপরে
আহত পাখির মতো নিথর জ্যোৎস্নাও কেঁদে যায়।

মনে পড়ে
জনশূন্য নদী তীরে, নাঙ্গা আকাশের নিচে
ব্যাপক বিকেলে
কতিপয় বিষণ্ণ নাবিক
নুনমাখা দাড়ি আর রাঙা চোখ নিয়ে দিগ্ধিদিক
করেছিলো ছুটোছুটি, খুব ক্লান্ত হয়ে

নিরাশায় স্নান করে সর্বদা গন্তব্যহীনতার ধুধু ভয়ে
শুয়েছিলো মাটিতে সটান, তারপর
ওঠেনি কখনো- বহু দূরে কিছু বালির কবর,
এলোমেলো দাঁড়
দেখে যদি কেউ কোনোদিন
থমকে দাঁড়ায়, তবে করুণ সঙ্গীত, ভায়োলীন
কিংবা অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র থেকে নয়,
প্রকৃতির থেকে জেগে উঠবে সহসা, মনে হয়।

এখন আমার হাত থেকে সুর ঝরনার মতন
উৎসারিত ক্ষণে-ক্ষণে, সুরের ভেতর থেকে সুর
ঝরে যায় বনাবৃত নিরালায়। মন
ঘরের নিকটে যেতে চেয়ে ফিরে আসে, অশ্বখুর
বেজে ওঠে বারংবার হৃদয়ের খুব অভ্যন্তরে,
নাশপাতি বন দোলে, কার মুখ, চক্ষুদ্বয়, স্তন,
বসে-থাকা, হেঁটে-যাওয়া আঁচল উড়িয়ে, মনে পড়ে।
আমার শয্যায় সারাক্ষণ
সে কার অস্পষ্ট ছায়া শুয়ে থাকে ছায়াময়তায়।
হা-হা স্বরে
আমার শয্যায় জ্যোৎস্না কেঁদে যায়, দীর্ঘ কেঁদে যায়।

দেখা হলো না

কলকাতার সরকারি কলোনিতে দুপুর চমকাচ্ছিলো
সোনালি চিলের মতো। এক দশক আগে,
যদ্দুর মনে পড়ে,
আমরা ক’জন গিয়েছিলাম সেখানে
তোমাকে এক ঝলক দেখার জন্যে, শুধু দেখার জন্যে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম আমরা, হঠাৎ কেন জানি না মনে হলো
এলসিনোরের পুরনো সিঁড়ির ধাপ
অতিক্রম করে চলেছি।
যখন সিঁড়ি চেয়ে উঠছিলাম, তখন আবার
নতুন করে আমি একটি কিংবদন্তির দখলে।
তিরিশের দশক আমার ওপর দিয়ে বয়ে গেলো
জৈষ্ঠের ঝড়ের ঝাপটার মতো। খেলার মাঠের জয়ধ্বনি,
মজলিসের গুলজার ঐকতান, দূরাগত
হারমোনিয়ামের আওয়াজ আর
রাজবন্দির জবানবন্দি ছুঁয়ে গেলো আমাকে। ফ্ল্যাটের জঠরে
তোমাকে দেখলাম এই প্রথম। বিস্ময়ের
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট আমি দেখলাম সেই ঈগলকে,
যে তার আকাশের নীলিমাকে ভুলে গেছে;
একদা তার উদ্দাম ডানা মেঘের স্তরে স্তরে
স্পন্দিত হতো বীণার মতো, তার ত্রিকালজ্ঞ চোখে
চরাচরের রূপান্তর হতো বারংবার,
এই স্মৃতিটুকু থেকেও যে বঞ্চিত।
গ্রীষ্মের ভরদুপুরে এ কাকে দেখতে এলাম আমি?
এই কি সেই ওষ্ঠ যার ক্ষণিক স্পর্শের জন্যে
কত বঙ্গীয় ললনার শরীর শিহরিত হতো
কদম ফুলের মতো? এই কি সেই স্বনামধন্য
বাবরি-শোভিত চির উন্নত শির, যা চৌরঙ্গির
সবগুলো দরদালান ছাপিয়ে, কার্জন হল আর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়া ছাড়িয়ে পৌঁছে যেতো মেঘলোকে?
এই কি সেই হাত যার আন্দোলনে
কেঁপে উঠতো কারার লৌহকপাট?
এই কি সেই আঙুল যার স্পর্শে হারমোনিয়াম চোখের পলকে
হয়ে যেতো রাগমালা আর সেই অনিন্দ্য সুরে সারা
বঙ্গভূমি নিমেষে নজরুল ইসলাম।
আমি ফ্ল্যাটের জঠরে তন্ন-তন্ন করে
পুরাণের সেই পাখিকে খুঁজলাম, যে ভস্মস্তূপ থেকে
গা ঝাড়া দিয়ে মৃত্যু থেকে জীবনে প্রবেশ করে
বারবার। আমি ভস্মরাশি দেখলাম, অথচ
কোনো পাখির পুনরুত্থান আমার চোখে পড়লো না।

তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে, কী আশ্চর্য,
আমার মনে পড়লো ডেনামার্কের যুবরাজের উক্তি-
‘এই করোটির ভেতরে ছিলো জবান
এবং একদা সে গান গাইতে পারতো।’
তোমার দিকে আমার চোখ আর তোমার চোখ
হীরের মতো জ্বলজ্বল করে যেন
খরদুপুরকে শাসন করছিলো ক্ষমতারহিত
বুড়ো লীয়ারের মতো। সিএ মুহূর্তে আমি
কান্তিমান এক ঘোড়াকে চোরাবালিতে ডুবে যেতে দেখ্লাম,
হাজার-হাজার বনকপোতকে দগ্ধ হতে দেখলাম
দাবানলে; একটি সোনার সিংহাসনকে দেখলাম
কুষ্ঠরোগীর মাংসের মতো গলে পড়তে।

দিলদরিয়া যিনি, উদরে আতিথেয়তা ছিলো যাঁর
প্রবাদ প্রতিম, তিনি কেন এক উদাসীন, এমন
অভ্যর্থনাকৃপণ? জীবনের ওষ্ঠে-ওষ্ঠে চেপে যিনি
টেনে নিয়েছেন জীবনরস, তাঁর কাছেই
সব কিছু হয়ে গ্যাছে কেমন অবান্তর।
‘খেয়ে যেও দুপুর বেলা’ বলবেন না
কাউকে তিনি। আর পেছনে থেকে শুনবো না তাঁর ডাক।

আচমকা কোত্থেকে এক পাপিয়া ভরদুপুরে
শুনিয়ে গেলো গান। একটা প্রজাপতি কিছুক্ষণ
ঘরময় ওড়াউড়ি করে তোমার কাঁধ ছুঁয়ে
বেরিয়ে গেলো জানলা দিয়ে। আর আমি
ভক্তি করতে এসে তোমার পায়ে রাখি ভালবাসার মঞ্জরী।

কলকাতার সরকারি ফ্লাটের সিঁড়ি দিয়ে
নামতে নামতে ভাবি
যাকে দেখতে এলাম তাকেই দেখা হলো না আমার।

নিজস্ব উঠোনে

টেবিলে ছিলেন ঝুঁকে কিছুক্ষণ আগে, এখন চেয়ার ছেড়ে
পুরাণের পুরনো ট্যাপেস্ট্রি ছেড়ে আলোছায়াময়
নিজস্ব উঠোনে তিনি পায়চারি করছেন অত্যন্ত তন্ময়।
অকস্মাৎ হাঁস দুটি জব্দ পাখা ঝেড়ে
উঠলো ভয়ার্ত ডেকে। কখন যে সুনামগঞ্জের ক্ষেতে পাকা
ধান-খেতে-আসা চকলেট-রঙ হাঁসের বাচ্চাটা
(নতুন পালক তার এ শহরে হয়েছিলো ছাঁটা)
হলো ক্ষিপ্রগতি নেউলের সহজ শিকার লতাগুল্ম ঢাকা।

কিঞ্চিৎ দুর্গম কোণে, তিনি কিছুই পাননি টের
বিকেল বেলায়, পরে পাখিপ্রিয় কনিষ্ঠ কন্যার জবানিতে
জানা গেলো খুঁটিনাটি সকল বৃত্তান্ত। আত্মজার দুচোখ পানিতে
ছিলো খুব টলটলে। আকস্মিক এই হিংস্র ঘটনার জের
টেনে মনে তিনি ফের অন্য মনে উঠোনে হাঁটেন
নিরিবিলি থেকে-থেকে কখনো কাশেন।

কনিষ্ঠ কন্যার পোষা ময়নাটা দাঁড়ে বসে থাকে
বারান্দায়, ছোলা খায়, কখনো-বা তার
‘শেবা, শেবা’ ডাকে
বাড়ির স্তব্ধতা জব্দ হয় খুব এবং গোলাপ গাছটার
পাতা শিহরণে শব্দহীন গীত যেন মাঝে-মাঝে।
বসন্তের সাঁঝে
বাতি জ্বলে ওঠে ঘরে। প্রৌঢ় কবি তখনও উঠোনে;
ধাবমান যানপিষ্ট কুকুরের মতো
স্বীয় যাবতীয় অতীতের কথা ভেবে-ভেবে তিনি গৃহকোণে
আবার আসেন ফিরে অভ্যাসবশত।
অনন্তর অসমাপ্ত কবিতার চিত্রকল্প যমক অথবা
অক্ষরবৃত্তের সুর ভাবেন। উঠোনে হাস্যময়ী রক্তজবা।

নিমগ্নতা

আমাকেও বারাঙ্গ বারাঙ্গনা প্রলোভন অন্ধকারে ডেকে
নিয়ে দ্রুত দেখার আগ্রাসী ঊরু, উন্মোচিত স্তন,
উন্মাতাল হাসির জহর হানে যখন-তখন।
তবে কি আমিও আজ দালালের মতো যাবো হেঁকে
দিগ্ধিদিক? স্বরচিত শামুকের ঠাণ্ডা খোল থেকে
বেরিয়ে সোৎসাহে ঘন ঘন করবো মঞ্চারোহণ
ত্বরিত খ্যাতির মোহে? স্বতঃস্ফূর্ত করবো লেহন
সাম্প্রতিক চটচটে চুষিকাঠি লজ্জা ব্যতিরেকে?

ভিড়াক্রান্ত আমি, চোখ-ধাঁধানো পসরা সবখানে;
অশ্লীল চিৎকার আর তুইতোখাড়ির তুবড়িতে
ঝালাপালা কান; শুদ্ধ বাণী নয়, বিটকেল কথা
নিয়ত পুলক আনে এমনকি ধীমানের কানে।
শিল্প পদ্মরাগমণি হয় স্তব্ধতার অঞ্জলিতে,
তাই চটকিলা হল্লা নয়, চাই ধ্যানী নিমগ্নতা।

নূহের জনৈক প্রতিবেশী

লোকশ্রুত মহাপুরুষের অলৌকিক জেল্লা নেই
আমার সত্তায়, আমি আটপৌরে ছাপোষা মানুষ,
কোনোমতে সংসারের হাল ধরে, আছি দাঁতে দাঁতে
চেপে সামান্যের ভরসায়, কিছু আয় করে আর
কিছুবা দেনার টানে। সন্ধেবেলা গৃহিণী ভাজেন
রুটি, আমি, কাজ-থেকে-ফেরা, পুরনো জোব্বাটা রেখে
এক কোণে ক্লান্ত গা এলিয়ে খাটে আমার নিজস্ব
অতীতের অভ্যন্তরে আস্তেসুস্থে আঙুল চালাই,
যেমন ধার্মিক ধর্মপুস্তকের পাতা ক্রমাগত
উল্টে যান ভাবাবেশে নিরিবিলি। এইমতো কাটে
দিন কায়ক্লেশে, থাকি প্রাতঃস্মরণীয় মহাপ্রাণ
নূহের বাড়ির পাশে সন্তান-সন্ততিসহ আর

বৈয়মের তৈলসিক্ত জলপাইয়ের মতন আমি
শুষে নিই, যতদূর পারা যায়, উচ্ছল আরক
জীবনের; প্রায়শই বন্ধুর ডেরায় যাই, করি
গল্পগাছা, মাঝে-মধ্যে গুঞ্জরণময় বাজারের
আশপাশে শুনি সদ্যপ্রত্যাগত মাঝিমাল্লাদের
সরস কাহিনী কত। কখনও-কখনও মধ্যরাতে
অতীত সম্ভোগ করি গৃহিণীর সঙ্গে কিংবা ভাবি
যুগ্মতায় কীভাবে কতটা ব্যয়সঙ্কোচন করা
যায়, কেনা যায় কিছু শস্যদানা এবং একটি
পাহাড়ি দুধালো ছাগী। জালার শীতল পানি শেষ
হয়ে এলো কিনা, দেখি কখনও সখনও। এভাবেই
দিন যায়, দিন আসে জন্মমৃত্যুময় এই নাটে।

অকস্মাৎ পথে পথে মজলিসে হট্ররোলে শুনি
নূহের জাহাজ নাকি জোড়া জোড়া নানা পশুপাখি,
হরেকরকম শস্যবীজসমেত ভেসেছে আজ
ভয়ানক ফুঁসে-ওঠা সমুদ্রে। কেননা গর্জমান
মহাপ্লাবনের ক্রূর তাণ্ডব হয়েছে শুরু আর
চতুর্দিকে দিশাহারা বিপন্ন মানুষ অগ্নিদগ্ধ
মৌমাছির মতো পলায়নপর। কে এক পায়রা
চকিতে আসবে বলে নূহের ব্যাকুল দৃষ্টি গাঁথা
পানি-ধোয়া দিগন্তের দিকে। জনসাধারণ থেকে
বহুদূরে নিরাপদে এই অবস্থান, একি নয়
পলায়নীমনোবৃত্তি ধীমান নূহের? আমি এক
সাধারণ নগণ্য মানুষ, আছি অতি উপদ্রুত
মানুষেরই মাঝে; কাদামাখা হাতে সকলের
সাথে মিলে নিয়তির বিরুদ্ধে নিয়ত অনলস
লড়ে বাঁধ গড়ে মহাপ্লাবনের এ ব্যাপক রোষ
আকুল থামাতে চাই। যদি যাই ভেসে, তবু নেই
কোনো খেদ; পাড়াপড়শীকে, হাজার-হাজার আর্ত-
মানুষকে বিপর্যয়ে ফেলে আমি সুদূরে হইনি
পলাতক-এই গৌরবের কিরীট জ্বলবে হিংস্র
ঢেউয়ের চূড়ায় নৃত্যপর প্রদীপের মতো দ্রুত
মজ্জমান আমার মাথায় আর এই হস্তদ্বয়,
তরঙ্গে তরঙ্গে ক্ষুব্ধ হস্তদ্বয়, ক্রোশ ক্রোশব্যাপী
নারী পুরুষের আর্তনাদে, ভয়ংকর চোরাটানে
ব্যাকুল খুঁজবে শুধু বিপন্ন ডুবন্ত কোনো হাত।

 পাড়াগাঁর অন্ধকার

হাওয়ায় মশারি ওড়ে পাড়াগাঁর অন্ধকার ঘরে।
ঐখানে ঘুমাতো সে মশারির নিচে, মনে পড়ে
মাঝে মাঝে বসতো ঠাণ্ডা দেয়ালে হেলান দিয়ে, ফিকে
অন্ধকারে কী সব দেখতো আর শহরের দিকে,
অবছায়া শহরের দিকে দৃষ্টি ছিলো প্রসারিত।
কখনও সে আচমকা উল্লসিত, কখনও-বা ভীত
লুকাতো বালিশে মুখ। স্নেহের সৈকত থেকে দূরে
নির্বাসিত, কখনও সে উঠতো নেচে কী ভৌতিক সুরে।

কোথায় থাকতো পড়ে ময়লা জামা জুতো, শূন্য থালা
এলোমেলো। জানালার শিকে হাত; পাখি, গাছপালা,
হঠাৎ-পালিয়ে-যাওয়া বেজি তার মাথার ভেতরে
একাকার, উদ্দেশ্যবিহীন এক নিঝুম চক্করে
ছিলো মেতে সর্বক্ষণ, কখনও-বা অতিশয় ঝুঁকে
কাগজের বিরানায় হিজিবিজি নিতো কী-যে টুকে
কিংবা সবকিছু ফেলে-টেলে হতো সে ভ্রমণকারী
রুক্ষ কিংবা বৃষ্টিময় পথে একা সাত তাড়াতাড়ি।
এখন চুলের গুচ্ছে তার চৈত্র শ্রাবণের স্মৃতি
মরহুম, কোনোদিন অতীতের হবে না বিস্তৃতি
তার অভ্যন্তরে আর। লোবান কি সুখাদ্যের ঘ্রাণ
কখনও জাগাতে তাকে পারবে না। কী যে পরিত্রাণ
না-ফেরায় আছে ভেবে চলে গ্যাছে দূর বিরানায়।
ছিলো কি সন্ন্যাসে মন সারাক্ষণ? পানি বয়ে যায়,
হাওয়ায় মশারি ওড়ে বিজন নিবাসে নিরন্তর
পাড়াগাঁর অন্ধকারে। ভয়ানক স্বরহীন ঘর।

পুনর্মিলনের আগে

আজ আমাদের দুজনের দেখা হবে পুনরায়
এই শতকের রাঙা অস্তরাগে বহুদিন পর।
তোমাকে দেখি না আমি কতকাল? তিনটি বছর
কেটে গেছে যোগাযোগহীন দুটি চোখের পাতায়
তোমার সত্তার ছায়া নিয়ে দিনরাত্রি বিরানায়।
আবার তোমার চোখে পড়বে আমার চোখ, ঝড়
বইবে শিরায় আর হবে ঘন ঘন স্পন্দিত অধর,
বুকের ভেতরে লুপ্ত সভ্যতা জাগবে নিরালায়।

তোমাকে দেখবো আমি এতকাল পর, তবু আজ
কেন যে দ্বিধার শুঁয়াপোকা ঘোরে মনে। ভাবি মেয়ে,
যে-তোমাকে আগে আমি দেখেছি অনেক, ঠিক তাকে,
তাকেই তো দেখবো আবার? নাকি ভিন্ন কোনো সাজ
রাখবে আড়ালে খুব প্রকৃত তোমাকে? মেদে চেয়ে
যায়নি তো দেহমন? হৃদয় দিয়েছো ফের কাকে?

প্রতিমাসন্ধানী

মুমূর্ষ সূর্যের দিকে চোখ,
অস্তরাগে কারুকাজময় মঞ্চসহ কুশীলব
ডুবে যায়, পোকা-মাকড়ের ভিড় ধেয়ে আসে নানা দিক থেকে,
ঝাঁক ঝাঁক রাগী পাখি ভীষণ চককর কেটে কেটে
হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘর-বাড়ি তছনছ করে
চঞ্চুর আঘাতে, হিচ্‌ককি ছায়াছবিতে যেমন।

দূরের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ ঝানু
গোয়েন্দার মতো চোখে চোখে রাখছে আমাকে, আমি
তবু খুব প্রকাশ্য পাহারা, বলা যায়,
উপেক্ষা করেই ডুব দিই সেই ভরা সরোবরে, লোকে যাকে
নিদ্রা বলে, আমার দু’হাত স্বপ্ন দেখে, হাতল দাঁড়িয়ে আছে
দড়ির সাঁকোয়, যেন জমাট পাটল মেঘস্তূপ।

আহত যোদ্ধার মতো
কতকাল একা একা করবো লালন ক্ষত, কতকাল আর?
ব্যান্ডেজে অচিন পাখি বসে, মাঝে মাঝে
স্মৃতিজাগানিয়া শিস দিয়ে আরো বেশি
স্মরণ করিয়ে দেয়- এখন কোথাও কেউ আমার উদ্দেশে
রাখেনি জ্বালিয়ে কল্যাণের ঝাড়বাতি।

তোমার ভেতরে তুমি কী জগৎ রেখেছো লুকিয়ে
বোধের অতীত? সেখানে কি গহন দুপর বাজে বাউলের
মৃদু একতারার ঝংকারে? সেখানে কি মুকুলিত
হতে চায় অসুস্থ গায়কের নিভৃত আকাঙ্ক্ষা কিছু?
যখন আমাকে কেউ এইমতো প্রশ্ন করে, আমি নিরুত্তর
আমার ভেতরে খুঁজি সালভাদর দালির ছবি।

এখন পরাস্ত ভূমি বলে
আমাকে খোঁচালে কেউ চিড়িয়াখানার বন্দি প্রাণীর মতন,
অপমানে বন্য ক্রোধে আমি কি উঠবো ফুঁসে
গোখরোর ছোবলের ক্ষমাহীন ভঙ্গিতে এখন?
অস্তমিত হোক ব্যক্তিগত ক্রোধ, থাকুক সতত অনির্বাণ
আমার ভেতরে পুণ্যবানের সংযম নিমগ্নতা।

একদা একটি সভাঘরে, মনে পড়ে,
একজন প্রাজ্ঞ, সৌম্য পুরুষ উদাত্ত কণ্ঠস্বরে,
শুনিয়ে ছিলেন কিছু কথা, যেন বাগানের সকল ফুলের
উদ্দেশে তন্ময় গল্প বলে মালী, পাথরের তিন ধরনের
বাক্যের পবিত্র পুষ্পে সাজিয়ে দিলেন সভাঘর।

বললেন তিনি
পাথরে বানানো যায় কালের থাবায় দৃঢ় দরদালানের
সারি, গির্জা আর মূর্তি হরেক রকম
আমি তাঁর সংকেতের আলোয় তন্ময় ওজু করে
আজো এই ব্যাপক আঁধিতে
পাথরে পাথরে শুধু প্রতিমাসবন্ধানী।

বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে

বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে
রৌদ্র, বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন। বাংলা ভাষা
উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের একতারা বাজে
উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে, উত্তাল নদীর
বাঁকে বাঁকে; নদীও নর্তকী হয়। যখন সকালে
নতুন শিক্ষার্থী লেখে তার বাল্যশিক্ষার অক্ষর,
কাননে কুসুমকলি ফোটে, গো-রাখালে বাঁশি
হাওয়াকে বানায় মোঠা সুর, পুকুরে কলস ভাসে।

বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে চোখে ভেসে ওঠে কত
চেনা ছবি মা আমার দোলনা দুলিয়ে কাটছেন
ঘুমপাড়ানিয়া ছড়া কোন্‌ সে সুদূরে; সত্তা তাঁর
আশাবরী। নানি বিষাদ সিন্ধুর স্পন্দে দুলে
দুলে রমজানি সাঁঝে ভাজেন ডালের বড়া আর
একুশের প্রথম প্রভাতফেরি, অলৌকিক ভোর।

মণিপুর লোকদূহিতা

(ওয়াহিদুল হক বন্ধুবরেষু)

তখনো আমার সুহৃদের মনে শহুরে
ক্লান্তি ছিলো কি? অবশ্য তাঁর ভব্যতটুকু
বজায় রেখেই, আন্দাজ করি, চায়ের পেয়ালা
হাতে তুলে নিয়েছিলেন সুচারু ধরনে।

মফস্বলের আলাভোলা ছায়া দু’চোখে
সাজিয়ে হলুদ বিকেল বেলায় তুমি আঙিনায়
পাতলে আসন, সিলেটি শ্যামল লাগে বিদগ্ধ
বন্ধুর প্রাণে, প্রাঙ্গণ যেন মিনতি।

শহুরে মনের নিসর্গপ্রীতি পেয়েছে
তৃপ্তি এবং তারই রেশ কিছু বাঙময় হয়,
বৈকালী সিএ স্নিগ্ধ স্মৃতির হার্দ্য লেখনে,
বর্ষ-শুরুতে হ্রস্ব ভ্রমণকাহিনী।

বস্তুত আমি দেখিনি কখনো তোমাকে।
বন্ধুর চোখে গাছপালাঘেরা একটি আঙিনা,
আনন্দসুরে মাতাল পক্ষী, লাজুক তন্বী
যেন বা স্বপ্নে উঠেছিলো দুলে বিকেলে।

ক’জন অচেনা শহুরে শ্রোতার সমুখে
যখন দ্বিধায় ধরেছিলে গান, তখন হে মেয়ে
নয়নে জল, আঁচলের ফুল ঝরেছে ব্যাকুল;
গীতি ও গায়িকা একই বৃন্তের সুরভি।

যখন তোমার ছোঁয়ায় হারমোনিয়াম
হলো নজরুল করুণ রঙিন, তখন আঙিনা
হরিণমুখর বনরাজিনীলা, টলটলে দিঘি,
ময়াল-বাসর, দূর নীলিমার বসতি।
ঘনিষ্ঠ তানে তুমি চলে গেলে সুদূরে।
রইলো আড়ালে অতিথি, উঠোন, হরিয়ালপাখি,
ঝোপঝাড় আর মলিন জীবিকা এবং অবাধ
তোমার যাত্রা চেনা বৃত্তের বাইরে।
যদিও দেখিনি, তবু বলা যায়, দেখেছি
আমিও তোমাকে হরফের বনে, বন্ধুব চোখে
প্রকৃত তোমাকে। আশাবরী রাগে তোমার শরীর
হোক লীলায়িত চিরায়ুষ্মতী ছায়ায়।

দেখিনি তোমাকে, তবু ভাবা যায় শরীরে
তোমার মোহন ঊষার সখ্য, জাগরে চকিতে
সুরমা নদীর কূল-উপচানো তন্বী জোয়ার।
হৃদয়ে তোমার শারদ রাত্রি, মিনতি।

তোমার না-থাকা তোমাকেই আনে নিকটে।
সমাজদ্রোহিতা আমার মনের নেপথ্যে বাঁচে,-
কলুষমুক্ত স্বরচিত এই স্মৃতিতে আমার
তুমি বাঁচো সুরে মণিপুর লোকদুহিতা।

মহাপ্লাবনের পরেও

প্রত্যাশা থাকে না, তবু কিছু ঘটে যায় আকস্মিক-
যেমন খরায় বৃষ্টি, বিরতিবিহীন বৃষ্টিপাতে
কৌতূহলী স্মিত বালকের মতো রোদের ঝলক।
ভাবিনি কখনো পাবো, অথচ নিঝুম অপরাহ্নে
আমাকে বিস্মিত করে এলো কার্ড এক অলৌকিক
তোমার ঠিকানা থেকে। শ্যামল মেদুর কার্ডে লেখা
বিদেশী ভাষায় শুধু তিনটি মায়াবী শব্দ, ‘খুব
মনে পড়ে।’ শব্দ এত চুম্বন-প্রবণ হতে পারে
কখনো জানিনি আগে। এক কার্ড যেন কোনো
জাহাজ ডুবির পর ভাসমান বোতলের বাণী,
গোপনে পাঠানো, কিংবা নূহের কপোত, যার ঠোঁটে
সুবাতাসে স্পন্দমান সবুজ আশ্বাস। জেনে গেছি
চরাচরব্যাপী মহাপ্লাবনের পরেও ভূভাগ
স্নিগ্ধ জেগে থাকে কিছু; তুমিই আমার সেই ভূমি।

 মাদল

কে ক্লান্ত পুরুষ তার ঘরের জঠরে বসে আছে
হাঁটুতে থুতনি রেখে। তার
অস্তিত্বের আনাচেকানাচে
গ্লানির পঙ্কের ছাপ, শরীরের সব কটি হাড়
খেয়েছে কামড়
সে কোন্‌ রহস্যময় নেকড়ের বারংবার। চোখ
নিজের কাছেই তার শোক
করবার মতো জায়গা এবং জীবন
প্রায় সারাক্ষণ
শোকার্ত চোখের মতো করে ছলছল।
বার্ধক্য ঝুঁকেছে তার দিকে বড় বেশি,
বুঝি তাই গৃহকোণে পড়ে থাকে অলস মাদল,
হয় না চঞ্চল পেশী
আগেকার মতো আর। কিছু স্মৃতি শুধু
রৌদ্রদগ্ধ মাঠের মতন করে ধুধু।

কে রাগী পুরুষ তীব্র বাজায় মাদল অকস্মাৎ
নেচে নেচে নিজের উঠোনে-
দেখা যায় কিনা যায় তরঙ্গিত হাত।
আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে দশদিকে, আওয়াজের কী-যে
মানে, তা সে নিজ
বোঝে না, কেবলি শোনে
এবং পা ফেলে তালে তালে, আলোময়
হয়ে ওঠে তার অস্তিত্বের প্রতিটি স্পন্দিত ভাঁজ।
খসে যায় জরা বাকলের মতো আর মনে হয়
তাকে বন্দনীয় কারুকাজ
মহান শিল্পীর। আর সারা বাংলাদেশ যেন আজ
তার দীপ্র মাদলের গুরুগুরু অজর আওয়াজ।

 মে দিনের কবিতা

মাদুরে সে শুয়ে, হাত তার পায় মাটির আদর,
আড়মোড়া ভেঙে দ্যাখে-
তাকে ঘিরে জাগে চারা গাছ কিছু ফুল ঝুঁকে আছে
ওষ্ঠ ও গালে, স্তনের ওপর,
যেন চুমো খেতে চায়।

স্বপ্নে সে নয় বিভোর এখন; একটু আগেই
নিদ্রার হাত গুটিয়ে নিয়েছে জাল।
কী করে যে এই খেলার ঘরের মাটি ফুড়ে জাগে
পুষ্পল এক চকিত বাহার, ভাবে বিস্মিত-
এ কোন তেলেসমাত?
চোখ কচলিয়ে শাড়ি সামলায়; ঘর দুয়োরের
আনাচেকানাচে সূর্য বিলায় মুঠো থেকে তার
সোনালি অনুগ্রহ।

ছুটি বাজাচ্ছে বাঁশি আশেপাশে, বাঁশির আওয়াজ
খুপরিটা ছেড়ে, মহল্লা ছেড়ে
ছড়িয়ে পড়েছে তামাম শহরে আজ।

ছুটি, আজ ওর মরদের ছুটি। পাশ ফিরে দ্যাখে
কেমন অঘোরে ঘুমায় লোকটা,
স্বপ্নের মায়া লেগেছে শরীরে,
নিথর ঘুমায় গাছের গুঁড়ির মতো।
আজ মে দিবস। দুনিয়ার যত মজদুর আজ
পোহায় ছুটির ছায়া।
এদিনের মানে জানে না সে, তবে
আবছা কাহিনী মরদের কাছে শোনা।
মানে যাই হোক, এটুকু সে জানে
ঘরের মানুষ আজকে যাবে না কঠোর কারখানায়।

কিন্তু ঘরের মানুষের মন, আছে তার জানা
সহজে টেকে না ঘরে।
বেলা না চড়তে মিশে যায় সেও দোস্তের ভিড়ে,
মদে চুর হয়ে টলতে টলতে ফেরে রাত্তিরে
আপন বিবরে, নামে অবশ্য গালিগালাজের ঢল।
এক ঝটকায় ঘরনীকে তার দ্যায় সে সরিয়ে
কখনো-বা ফের কোমর জড়িয়ে টেনে নেয়,
ভুরভুরে মুখ চেপে ধরে মুখে,
যেমন ভালুক মৌচাকে দেয় হানা
নারী সত্তায় লাগে আচমকা
জব্বর এক নেশার মদির দাগ।

ওর গায়ে নেই কাঁচা-সোনা রঙ, শ্যামলাই বলে
পাড়া-পড়শিরা, নাকও নয় বাঁশি,
কিন্তু ঘরের মানুষ বলে-
‘কসম খোদার তোর চোখ জোড়া বড় গজবের,
নশিলা, জংলা বড়।’

ঘরের ভেতরে জোয়ান মরদ অঘোরে ঘুমায়,
হাত তার যেন কোণে পড়ে থাকা
মহররমের নিশান কোনো।
এই হাত তার সকাল-সন্ধ্যা মেশিন চালায়,
এই হাত তার মিছিলে মিছিলে আকশচুম্বী,
এই হাত তার বউয়ের পাছায় আদর ঝরায়,
কড়া এ হাতের সাহসী আঙুল
ভবিষ্যতের জাবদা খাতায় টিপসই দ্যায়,
দূরাগত কোনো রহস্যময় সুনীল পক্ষী
এই হাতে তার চঞ্চু ঘষে।
ঘরের ভেতরে জোয়ান মরদ অঘোরে ঘুমায়।
মজুরের বউ চুলে গুঁজে নেয়
অখ্যাত ফুল, জানা আছে আর
শত তালিমার চাদরের মতো গরিবের সংসার।
তবু সে আড়ালে সাদামাটাভাবে
করে সাজগোজ, আলতা লাগায় পায়ে।
ভাঙা আয়নার নিজস্ব মুখ? এ কোন সুদূর
হাবেলির বিবি এসছে গরিব-মরবার ঘরে।
কোথায় বেদাগ চকমকে টিপ?
কোথায় কাজললতা?

চাঁদের চমক, হাওয়ার ঝলক পাওয়ার জন্যে
বেরিয়ে সে আসে কৃপণ উঠোনে,
ভাসে জ্যোৎস্নার বানে।
মজুরের বউ করে অনুভব নিজের ভেতরে
জরায়ুর লতাগুল্মে কী যেন নড়ছে প্রাণের মতো।
মে দিন এখন জাগর জ্যোৎস্না,
মে দিন এখন তন্বী শরীর, সে নিজের হয়
আগামী কোন প্রসূত-বিভোর মে দিনের গীতিকবিতা।

যাবার ভাবনা

রোজই ভাবি, এবার যাবো অনেক দূরে।
একটি সদূর পথের ছবি কবে থেকে
মগ্ন কবির আধফোটা এক ভাবনা হয়ে
আমার সঙ্গে সঙ্গে আছে।
সেই অচেনা পথের ধারে হয়তো এখন
যুগল গাছের ছায়া কাঁপে, তিনটি ঘোড়া
যাচ্ছে ছুটে উড়িয়ে স্বপ্ন তীক্ষ্ণ খুরে,
কেশর-ঝালর মত্ত নাচে।
সেই অদেখা পথের ধারে সন্ধ্যা নামলে
নির্জনতা বাড়ে আরো, জ্বলজ্বলে ঐ জোনাকিরা
রহস্যময় খুশি ছড়ায় ঝোপেঝাড়ে
ওষ্ঠ রাখে রাতের ঠোঁটে।
রোজই ভাবি সেই পথেরই প্রান্তে যাবো।
কেউ কি গেছে আমার আগে? অঙ্গ-জোড়া
ধূসর ধুলো ঝেড়েঝুড়ে বলেনি কেউ-
‘এইতো এলাম জরিপর করে।
বস্তুত কেউ আজ অবধি বেলনি তো-
সেই পথেরই স্মৃতিগুলি সত্তা থেকে
ঝরছে শুধু লাল গোলাপের পাপড়ি যেন।
সে-পথ কোথায়, জানে না কেউ।
হয়তো সে-পথ হয়তো শুধু আমার জন্যে
পথ চেয়ে রয় অধীর হয়ে সকল সময়।
হায় কখনও ফুরোবে তার প্রতীক্ষা কি?
ব্যস্ত হয়ে প্রস্তুতি নিই।
সাত-সকালে খানিক মাতি বাঁধছাঁদায়,
অনেক দূরে যাবো বলেই এটা-সেটা
ব্যাগের ভেতর ব্যাকুল পুরি, খানিক ঘুরি
মনের ভেতর সারস হয়ে।
উল্টোপাল্টা চিত্রকল্প জেগে ওঠে,-
তারপর কী মনে করে উপুড় করি
হল্‌দে রঙের ব্যাগটি এবং সরিয়ে রাখি
শূন্য একটা খাদির ঝোলা।
জান্‌লে দিয়ে তাকাই দূরে- হয় না যাওয়া।
ইচ্ছে হলেই যেতে পারি, যাই না তবু;
কোথাও ছুটে যাবার চেয়ে যাবার ভাবনা
মধুর বড়ো, দীর্ঘ ভালো।

সন্ধ্যার খালুই থেকে

সন্ধ্যার খালুই থেকে লাফিয়ে উঠেছে চাঁদ দূরে
বহুদূরে, ঘাটে বাঁধা তন্বী নাও, একটি কি দুটি
নয়, কয়েকটি, নিচ্ছে বিশ্রাম এখন, মেঠো সুরে
মাঝি পড়ে সায়ফুল মুলুকের পুঁথি লুটোপুটি
খায় নানারঙা মাছ পানির ভেতরে মাঝে-মাঝে,
যেন দ্যায় সায় ত্রিপদীতে। আমানি নকশি-কাঁথা
দ্যাখে মাঝি পাঠ সেরে। মনে পড়ে, মসলার ঝাঁজে
মনে পড়ে তাকে যে সেলাই করে রাতে কাঁথা মাথা
নিচু করে স্মৃতিময় কূপির আলোয়, খোকা কোলে
সুহাস আসবে বলে। পলাশতলীর বিছানার
কথা মনে পড়ে তার। দুটি পাখা ভর করে দোলে
সে আকাশে, ওড়ে দূরে মাছের নাছোড় পাইকার
ডাকে তাকে বহু নিচু থেকে তারস্বরে, কিন্তু মাঝি
শোনে না কিছুই, ভাবে এ দর-দস্তুর ছায়াবাজি।

সহজে ফোটাতে গিয়ে

সহজে ফোটাতে গিয়ে অনিবার্য শব্দের কোরক
গোধূলি নিঃশেষ হলো দীর্ঘশ্বাসে। জন্মন্ধ ব্যর্থতা
উপড়ে ফেলতে চায় আমার মনের গুল্মলতা,
আমার পরাস্ত সত্তা জুড়ে নামে উদাসীন শোক।
হঠাৎ এলেন গুরু উদ্ভাসিত করে অন্তর্লোকে
রহস্যের মেঘ থেকে। ‘যদি চাও তুমি অমরতা,
তাহলে সংহত করো বাক, থামও প্রগলভতা,’
বলে তিনি স্তব্ধতাকে সাক্ষী রেখে মুদলেন চোখ।

তারপর অদৃশ্য পদ্মের মতো তিনি, মনে হয়,
গহীনে বিরাজমান। আমি তাঁর দীক্ষার মঞ্জরী
অঞ্জলিতে নিয়ে মিতাক্ষরে পবিত্রতা আঁকি শাদা
পাতা জুড়ে চিদানন্দে। অমরতা সকল সময়
কুহকের মতো ডাকে, একজন গহন মেস্তরি
স্বপ্নে আসে বাঁশি হাতে; নিমেষে হৃদয় হয় রাধা।

সুচেতা তখন

যখন সহসা চোখ মেলে দেখি, কোরবানি-দেওয়া
ছাগলের ভেজা চামড়ার মতো আকাশকে দেখি
একলা কে পাখি উড়ে উড়ে ঘুরে ডানা ঝাপটায়,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন ঘরের পর্দায় লাগে হাওয়ার ঝাপটা,
দোলে দেয়ালের ক্যালেন্ডারের মদির-তন্বী
এবং ক্যাসেটে বিলায়েত খান নিজেই সেতার,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার।

যখন আমার গলির ধুলায় জ্যোৎস্নামরাল
নিথর ঘুমায়, উড়ে যায় দূরে পুরনো কাগজ,
ঝরা পাতা আর কাঁপে মাঝে মাঝে ছায়ার নকশা,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন মধ্যরাত্রে গহননিদ্রার জাল
ছিঁড়ে যায় আর মগজের রাঙা উদ্যানে জ্বলে,
পূর্ণিমা-চাঁদ, বন্দনাময় রক্তগোলাপ,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন আমার ভাবনা মরণ বেলা-অবেলায়
ছন্দ মিলের চুমো খেয়ে হয় সংগীতময়,
যখন হৃদয়ে গীতবিতানের পাতা নেচে ওঠে,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন ব্যাপক আঁধারে হাওয়ায় দোল খায় খাঁচা
অন্ধ বাউল চা-খানায় বসে দোতারা বাজায়,
অচিন পাখির উদ্দেশে গায় নভর্চারী গান,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখে।

যখন রাতের বুক চিরে দূরে চলে যায় ট্রেন
বাজিয়ে বিরাগী হুইসেল তার, যখন ঘুমের
গহীন ভিতরে দুঃখ আমাকে নাম ধরে ডাকে,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন গভীর রাত্রির বুক বৃষ্টি-নখের
আঁচড়ে-আঁচড়ে বিক্ষত হয়, তৃতীয় প্রহরে
একা ভেজা পাখি এদিক-ওদিক আশ্রয় খোঁজে,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন একাকী বসে থাকি আমি আপন বিবরে,
প্রেতায়িত ঘরে, অতীতের সাথে খেলি কানামাছি,
যখন হঠাৎ ভেসে আসে ধ্বনি শবযাত্রার,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন আমিও ক্রোশ ক্রোশ পথ পেরিয়ে ক্লান্ত
আবার আমার উঠোনে দাঁড়াই, যখন চকিতে
চরাচর বিসমিল্লা খানের সান্দ্র সানাই,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন অমল সুবে সাদেকের জাগরণী ধ্বনি
ভেসে আসে কানে, যখন প্রভাত পুণ্য আয়াত,
কাজল মাটির দুর্বার টানে ঝরে শত ফুল,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন নদীতে গ্রাম্যরমণী প্রদীপ ভাসায়
কারো কথা ভেবে সন্ধ্যাবেলায়, যখন বিপুল
বেড়াজালে দেখি ছটফট করে বন্দিনী মাছ
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন ভগ্নসেতুর অপারে ডাক দেয় কেউ,
ব্যাকুল সে-সুর বৈরী বাতাসে হারায় নিয়ত,
যখন স্রোতের ক্রূর চোরা টানে নৌকো লুপ্ত,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

সুপ্রভাত

আমি তো সকাল-সন্ধ্যা থাকি নানা কাজে, ব্যস্ততার
ধূলো ওড়ে সত্তাময়। সময় খরচ হতে থাকে
যথারীতি, কিন্তু সময়ের কতটুকু কোন্‌ ফাঁকে
আমর নিজস্ব হয়? সময়ের মুঠো থেকে আকসার
স্বর্ণ চূর্ণ নয়, বালি ঝরে, একটি কি দুটি কণা, যার
উপস্থিতি হিরন্ময়; তার আনুকূল্যে কিছু ঘটে
রূপান্তর বাস্তবের, ভিন্ন মাত্রা লাগে প্রেক্ষাপটে।
তবু সর্বদাই ভয় থাকে সবকিছু হারাবার।

বিশেষত মধ্যরাতে কালো নিঃসঙ্গতা আরো বেশি
ব্যেপে এলে মজ্জায় আমার নানা ধ্বনি, খাপছাড়া,
শুনে কণ্টকিত হয় সত্তা, মনে হয়, অকস্মাৎ
কেউ যেন করবে ঢোকার জন্যে দিচ্ছে খুব তাড়া।
খেচরের ডাকে রাত্রি আরো দীর্ঘ হয়; হে সুকেশী
তোমাকেই ভাবি শুধু তুমিই আমার সুপ্রভাত।

 সুহৃদের প্রতি

যেও না ঘাসের কাছে, ইদানীং ঘাস খুব হিংসাপরায়ণ।
যেও না নদীর কাছে, নদী তার ভুলেছে মমতা;
তাণ্ডবের মোহে স্ফীত হয়, তেড়ে আসে
অজগর হয়ে বারংবার, গিলে খায়
ঘর-গেরস্থালি।

যেও না টিলার কাছে, অতিকায় করোটির মতো
টিলা আপনার অভ্যন্তরে নিয়ত লুকিয়ে রাখে ক্রোধ।
যেও না মরুর কাছে, রাশি রাশি বালি
কর্কশ চিৎকারে করে গ্রাস সভ্যতাকে।
অরণ্যের কাছে যাবে? জানো না কি অরণ্য কেমন ভয়ংকর?
এখন তোমার জন্য হাঁ-খোলা পাতাল
জেগে আছে সবখানে। ফুলবাগানের
লতাপাতা অপরূপ লাস্যে জ্বলে উঠে
কখন সাপের ফণা হয়ে যাবে, কিছুতে পাবে না টের তুমি।

থমকে দাঁড়াও কেন হে আমার নিঃসঙ্গ সৃহৃদ?
কেন এত দ্বিধান্বিত নিজস্ব চৌকাঠ ছেড়ে দূরে
যেতে হে বিবাগী পর্যটক? বরং হে বন্ধু তুমি
যাও স্মিত যাও ট্রাউজারের পকেটে
হাত পুরে, শিস দিতে দিতে, যাও মানুষের কাছে।
কখনো বিকেল বেলা আলতো নাড়তে পারো কড়া
কারো দরজায়, কিংবা নিঃশব্দে চেয়ার টেনে নিয়ে
সহজে বসতে পারো চায়ের আসরে।

মানুষের কাছে যাও, নাও মানুষের হৃদয় গোলাপ ঘ্রাণ।
কেন না মানুষ আর হিংস্রতা কখনো
কখনো হাসির খাপে পুরে পূর্ণিমায় চিতাবাঘের মতন
অত্যন্ত উজ্জ্বল হয় সাবলীলভাবে।

এমনকি খুব মন্দ লোকও রমণীকে ভালবেসে
রাত্তিরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, রক্তজবা-পদ্য লেখে
নিষ্করুণ নিদ্রাহীনতায় কুকুরের মাথায় বুলায় হাত,
খেলা করে, শিশুদের খেলাঘরে, বিবর্ণ রোগীকে
সতেজ ফুলের তোড়া উপহার দেয়।
মৃত্যু-ঘেঁষা বিবাদের পরেও মানুষ
সবকিছু ভুলে করে শক্রকে অম্লান আলিঙ্গন।

তবু কেন আজও
কালো অবিশ্বাসের কুণ্ডলী নড়ে ওঠে
বারংবার? কেন মনে হয় প্রত্যেক মানুষ তার
নিজস্ব প্রকৃত মুখ ছিমছাম মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে
পথ হাঁটে, আস্তিনের নিচে রাখে অস্ত্রের বাহার!

যে যাই বলুক, তুমি হে আমার নিঃসঙ্গ সুহৃদ,
মানুষের দিকে উষ্ণ হাত নিয়ত বাড়িয়ে দাও।
তোমার নিকট এলে যে-কোনো অতিথি
যে-কোনো প্রহরে,
‘কেমন, ভালো তো’ বলে তাকে ঘরের ভেতরে, মানে
হৃদয়ের কাছে ডেকে নাও।

স্বপ্নাচ্ছন্ন মানুষের মতো

যখন নিঃশব্দে আমি স্বপ্নাচ্ছন্ন মানুষের মতো
পেরিয়ে গেলাম গেট, তখন কি আগের মতোই
ফুলগাছগুলি ছিল অভ্যর্থনাপরায়ণ? তুমি
কতকাল পরে পুনরায় নিয়ে গেলে শান্ত ঘরে।
সোফায় বসেই আমি চকিতে নিলাম মৃদু ঘ্রাণ
ড্রইং রুমের যেন অতীতের। যখন তাকালে
আমার চোখের দিকে তুমি, ফিরে এলো অপসৃত
যৌবন আমার নিমেষেই। যখন আশার সব
পায়রা নিশ্চিহ্ন, ঠিক তখনই আবার তুমি দিলে
ডাক, আমি ঝঞ্ঝাহত একা পথিকের মতো ফিরে
এলাম আপন ঘরে। দেখি সেই মুখ, সেই স্তন,
পবিত্র কপোতদ্বয়, যাদের করে না স্পর্শ কোনো
পুণ্যার্থী কখনও, আমি তোমার স্মৃতিকে চুমো খাই,
যেমন কায়েস খেতো হরিণের মুখে বিরানায়।

স্মৃতিময় উজ্জ্বল আঁধারে

খারাপ লাগছে এই নিস্তরঙ্গ সতেজ সকালে।
গুচ্ছ-গুচ্ছ পাতার আড়ালে
ফুল ফুটে আছে, পাখি সুন্দরের পাশে
বসে গান হয়, শৈশবের মতো কিছু মেঘ ভাসে
স্বরণমন্থনকারী আসমানে, অথচ আমার
খারাপ লাগছে খুব। যেন হৃদয়ের ঝোপঝাড়
ভীষণ বিশীর্থ আর জোনাকিবিহীন। আপতত
মুখ ধুতে রুক্ষ গালে ঘষতে বুরুশ কিংবা সুদীর্ঘ বিগত
রাত্রির জামাটা বদলাতে লাগছে না ভালো
কিছুতেই; মগজের রাশি রাশি কালো
আমাকে রেখেছে ঘিরে আপাদমস্তক, মনে হয়
ক্রমাগত যাচ্ছি ডুবে দীর্ঘ কৃষ্ণকায় ঘাসে; ভয়, তাই ভয়।

কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে পট। শত-শত কুশীলব
নব্য নায়কের করে স্তব
বেজায় পুরোনো সুরে, হয় নতজানু সারি সারি
পুরুষ ও নারী
ইস্পাতি নির্দেশে, মাঝে-মাঝে ওরা কী যেন কুড়ায়
ডানে-বামে, অকস্মাৎ যখন ফুরায়
মেকী সে উৎসব, জিভে তীব্র তেতো স্বাদ ঝুলে থাকে
সরাক্ষণ, ভাঙা দঙ্গলের ভেতরে কে কাকে ডাকে,
বোঝা দায়, এলোমেলো প্রেতারিত পদধ্বনি বাজে
চতুষ্পার্শ্বে, রুক্ষ শব্দরাশি মেশে আরো বেশি কর্কশ আওয়াজ।

খারাপ লাগছে এই নিস্তরঙ্গ সতেজ সকালে।
কী যে হয় চোখে পড়ে দূরে শুকনো ডালে
ঝুলছে তোমার জামা, যেন এক খণ্ড মেঘ, আবার হঠাৎ
প্রজাপতি হয়ে ওড়ে, ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে, শূন্য হাত
জামার ভেতরে কেলিপরায়ণ। আমার কাঁধের বারান্দায়
কে এক রঙিন পোস্টম্যান ভাসমান, ডেকে যায়
প্রহরে প্রহরে কখনও-বা পল্লবের ভিড় থেকে
সহসা বেরিয়ে আসে হলদে মসলিনে মুখ ঢেকে,
অথচ জরুরি খাম, টেলিগ্রাম, কিছুই করে না বিলি, শুধু
নাচায় বাদামি ব্যাগ ধু ধু
দিগন্তের দিকে আর একজন দলছুট অন্ধ কবি জীর্ণ রাজবেশে
চলে নিরুদ্দেশে।
আমিও বেরিয়ে পড়ি মাঝে-মাঝে চোখ-কান বুজে
মায়াবী চপ্‌পল পায়ে, খুঁজে
বেড়াই তোমাকে রাত্রিদিন তুমিহীন
এ শহরে, কবেকার টেলিফোন পোল, ডাকবাক্স ম্যান্ডোলিন
সময়ে মলিন হতে থাকে আর ঘরে ফেরা মানে
নিজের কাছেই ফিরে-আসা জেনে অন্তর্গত টানে
বারংবার চলে আসি স্মৃতিময় উজ্জ্বল আঁধারে একা একা,
বিরূপ হাওয়ায় লুপ্তপ্রায় পদরেখা।

হে আমার বাজারের থলে

হে আমার বাজারের থলে আলাভোলা, হে আমার
সকালবেলার নিত্যসঙ্গী, উদাসীন,
তুমি পাখিদের কেউ নও;
মগডাল, সরোবর ছুঁয়ে নীলিমার ওড়াওড়ি
আসে না তোমার।
অথচ বান্ধব, ভোরবেলা কিংবা বর্ষার সন্ধ্যায়
যখন ভাজেন রুটি গৃহিণী, তখন এই বিংশ শতাব্দীর
শেষার্ধে আন্ধার কোণে তুমি
পড়ে থাকো কী নিঃশব্দ খুব জব্দ ডানাকাটা পাখির মতন।
তখন তোমার প্রতি দৃষ্টি নেই ‘কারো’, তুমি কোনো
স্বপ্ন দেখ কিনা কিংবা স্বপ্নহীন কাটে বেলা
তা নিয়ে কারুর কোনো মাথাব্যথ নেই। মধ্যরাতে
ইঁদুরের পদচ্ছাপ নিয়ে বুকে জেগে থাকো ফকিরের মতো।

হে আমার বাজারের থলে আলাভোলা, হে আমার
সকালবেলার নিত্যসঙ্গী উদাসীন,
কখনো যাওনি তুমি আফ্রিকার গহন গঙ্গলে বেলাবেলি,
কেশর-দোলানো কোনো সিংহের গর্জন
কখনো শোনোনি।
প্রকৃত জিরাফ কিংবা ডোরাকাটা ঘোড়া, মানে, জেব্রা, শান্ত ঝিলে
হরিণের জলপান, সে-ও তো দেখনি কোনোদিন।
চিড়িয়াখানায় যাওয়া হয়নি তোমার;

ছা-পোষা করুণ মধ্যবিত্ত তুমি, নিঃস্ব, অভিমানী।
প্রত্যহ গ্রহণ করো কত কিছু-কমবেশি, অথচ আবার
নিজেকে উজাড় করে নিমেষেই সন্ন্যাসীর কৌপীনের মতো
কী নির্মোহ নৈব্যক্তিক হয়ে যাও তুমি,
শুয়ে থাকো চুপচাপ নৈমিত্তিক সকালবেলার প্রতীক্ষায়।

হে আমার বাজারের থলে আলাভোলা, হে আমার
সকালবেলার নিত্যসঙ্গী, উদাসীন,
মাছ তুমি ভালবাস না কি শাকসব্জি, বোঝা দায়।
নিকিরি হাঁকলে চড়া দর,
তুমি মৃত মাছের মতোই নির্বিকার,
কেমন তাকিয়ে থাকো ভাবলেশহীন
গায়ে নিয়ে কাঁচালংকা, খলিশা মাছের গন্ধ আর
রুইয়ের ভাগার মরা রক্ত সুনসান।

হে আমার বাজারের থলে আলাভোলা
সুগন্ধি সাবান তুমি মেখেছো কখনো বাথরুমে
অস্তিবাদী তত্ত্বকথা ভাবতে ভাবতে
ছুটির দুপুরে?
শিল্পের আঙ্গিক নিয়ে তুমি
ভাব না কিছুই।
কবিতা তোমার প্রতি নিঃস্পৃহ অমনোযোগী, তুমি কবিতার প্রতি।
সার কথা, কস্মিনকালেও
তরঙ্গিত নও তুমি রূপবাদী চেতনায়, শুধু
সম্বলবিহীন
একা-একা শুয়ে থাকো অন্ধকারে অভাবের মতো।

হে আমার বাজারের থলে আলাভোলা, হে আমার
সকালের নিত্যসঙ্গী, উদাসীন,
তুমি কি কাম্পুচিয়ায় যাবে?
যাবে ফিলিস্তিনি গেরিলার দীপ্র বন্দুকের নলের নিকট?
করবে কি লুট পুঁজিপতিদের
সান্ধ্য ভাষাময় চেকবই, কালো বেবাক সিন্দুক?
হে আমার বাজারের থলে আলাভোলা, হে বান্ধব
শুনতে কি পাও তুমি
এই বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সিঁড়িতে
ফুটপাতে জনপথে নব্য সভ্যতার পদধ্বনি?
তুমি পারবে কি ঢেকে দিতে পারমাণবিক
ধ্বংসের ভয়াল মুখ? পারবে কি বিভ্রান্ত বিপন্ন মানুষের
অভীক নিশান হতে ব্যাপক তাণ্ডবে?

Exit mobile version