যাবার ভাবনা
রোজই ভাবি, এবার যাবো অনেক দূরে।
একটি সদূর পথের ছবি কবে থেকে
মগ্ন কবির আধফোটা এক ভাবনা হয়ে
আমার সঙ্গে সঙ্গে আছে।
সেই অচেনা পথের ধারে হয়তো এখন
যুগল গাছের ছায়া কাঁপে, তিনটি ঘোড়া
যাচ্ছে ছুটে উড়িয়ে স্বপ্ন তীক্ষ্ণ খুরে,
কেশর-ঝালর মত্ত নাচে।
সেই অদেখা পথের ধারে সন্ধ্যা নামলে
নির্জনতা বাড়ে আরো, জ্বলজ্বলে ঐ জোনাকিরা
রহস্যময় খুশি ছড়ায় ঝোপেঝাড়ে
ওষ্ঠ রাখে রাতের ঠোঁটে।
রোজই ভাবি সেই পথেরই প্রান্তে যাবো।
কেউ কি গেছে আমার আগে? অঙ্গ-জোড়া
ধূসর ধুলো ঝেড়েঝুড়ে বলেনি কেউ-
‘এইতো এলাম জরিপর করে।
বস্তুত কেউ আজ অবধি বেলনি তো-
সেই পথেরই স্মৃতিগুলি সত্তা থেকে
ঝরছে শুধু লাল গোলাপের পাপড়ি যেন।
সে-পথ কোথায়, জানে না কেউ।
হয়তো সে-পথ হয়তো শুধু আমার জন্যে
পথ চেয়ে রয় অধীর হয়ে সকল সময়।
হায় কখনও ফুরোবে তার প্রতীক্ষা কি?
ব্যস্ত হয়ে প্রস্তুতি নিই।
সাত-সকালে খানিক মাতি বাঁধছাঁদায়,
অনেক দূরে যাবো বলেই এটা-সেটা
ব্যাগের ভেতর ব্যাকুল পুরি, খানিক ঘুরি
মনের ভেতর সারস হয়ে।
উল্টোপাল্টা চিত্রকল্প জেগে ওঠে,-
তারপর কী মনে করে উপুড় করি
হল্দে রঙের ব্যাগটি এবং সরিয়ে রাখি
শূন্য একটা খাদির ঝোলা।
জান্লে দিয়ে তাকাই দূরে- হয় না যাওয়া।
ইচ্ছে হলেই যেতে পারি, যাই না তবু;
কোথাও ছুটে যাবার চেয়ে যাবার ভাবনা
মধুর বড়ো, দীর্ঘ ভালো।
সন্ধ্যার খালুই থেকে
সন্ধ্যার খালুই থেকে লাফিয়ে উঠেছে চাঁদ দূরে
বহুদূরে, ঘাটে বাঁধা তন্বী নাও, একটি কি দুটি
নয়, কয়েকটি, নিচ্ছে বিশ্রাম এখন, মেঠো সুরে
মাঝি পড়ে সায়ফুল মুলুকের পুঁথি লুটোপুটি
খায় নানারঙা মাছ পানির ভেতরে মাঝে-মাঝে,
যেন দ্যায় সায় ত্রিপদীতে। আমানি নকশি-কাঁথা
দ্যাখে মাঝি পাঠ সেরে। মনে পড়ে, মসলার ঝাঁজে
মনে পড়ে তাকে যে সেলাই করে রাতে কাঁথা মাথা
নিচু করে স্মৃতিময় কূপির আলোয়, খোকা কোলে
সুহাস আসবে বলে। পলাশতলীর বিছানার
কথা মনে পড়ে তার। দুটি পাখা ভর করে দোলে
সে আকাশে, ওড়ে দূরে মাছের নাছোড় পাইকার
ডাকে তাকে বহু নিচু থেকে তারস্বরে, কিন্তু মাঝি
শোনে না কিছুই, ভাবে এ দর-দস্তুর ছায়াবাজি।
সহজে ফোটাতে গিয়ে
সহজে ফোটাতে গিয়ে অনিবার্য শব্দের কোরক
গোধূলি নিঃশেষ হলো দীর্ঘশ্বাসে। জন্মন্ধ ব্যর্থতা
উপড়ে ফেলতে চায় আমার মনের গুল্মলতা,
আমার পরাস্ত সত্তা জুড়ে নামে উদাসীন শোক।
হঠাৎ এলেন গুরু উদ্ভাসিত করে অন্তর্লোকে
রহস্যের মেঘ থেকে। ‘যদি চাও তুমি অমরতা,
তাহলে সংহত করো বাক, থামও প্রগলভতা,’
বলে তিনি স্তব্ধতাকে সাক্ষী রেখে মুদলেন চোখ।
তারপর অদৃশ্য পদ্মের মতো তিনি, মনে হয়,
গহীনে বিরাজমান। আমি তাঁর দীক্ষার মঞ্জরী
অঞ্জলিতে নিয়ে মিতাক্ষরে পবিত্রতা আঁকি শাদা
পাতা জুড়ে চিদানন্দে। অমরতা সকল সময়
কুহকের মতো ডাকে, একজন গহন মেস্তরি
স্বপ্নে আসে বাঁশি হাতে; নিমেষে হৃদয় হয় রাধা।
সুচেতা তখন
যখন সহসা চোখ মেলে দেখি, কোরবানি-দেওয়া
ছাগলের ভেজা চামড়ার মতো আকাশকে দেখি
একলা কে পাখি উড়ে উড়ে ঘুরে ডানা ঝাপটায়,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
যখন ঘরের পর্দায় লাগে হাওয়ার ঝাপটা,
দোলে দেয়ালের ক্যালেন্ডারের মদির-তন্বী
এবং ক্যাসেটে বিলায়েত খান নিজেই সেতার,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার।
যখন আমার গলির ধুলায় জ্যোৎস্নামরাল
নিথর ঘুমায়, উড়ে যায় দূরে পুরনো কাগজ,
ঝরা পাতা আর কাঁপে মাঝে মাঝে ছায়ার নকশা,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
যখন মধ্যরাত্রে গহননিদ্রার জাল
ছিঁড়ে যায় আর মগজের রাঙা উদ্যানে জ্বলে,
পূর্ণিমা-চাঁদ, বন্দনাময় রক্তগোলাপ,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
যখন আমার ভাবনা মরণ বেলা-অবেলায়
ছন্দ মিলের চুমো খেয়ে হয় সংগীতময়,
যখন হৃদয়ে গীতবিতানের পাতা নেচে ওঠে,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
যখন ব্যাপক আঁধারে হাওয়ায় দোল খায় খাঁচা
অন্ধ বাউল চা-খানায় বসে দোতারা বাজায়,
অচিন পাখির উদ্দেশে গায় নভর্চারী গান,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখে।
যখন রাতের বুক চিরে দূরে চলে যায় ট্রেন
বাজিয়ে বিরাগী হুইসেল তার, যখন ঘুমের
গহীন ভিতরে দুঃখ আমাকে নাম ধরে ডাকে,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
যখন গভীর রাত্রির বুক বৃষ্টি-নখের
আঁচড়ে-আঁচড়ে বিক্ষত হয়, তৃতীয় প্রহরে
একা ভেজা পাখি এদিক-ওদিক আশ্রয় খোঁজে,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
যখন একাকী বসে থাকি আমি আপন বিবরে,
প্রেতায়িত ঘরে, অতীতের সাথে খেলি কানামাছি,
যখন হঠাৎ ভেসে আসে ধ্বনি শবযাত্রার,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
যখন আমিও ক্রোশ ক্রোশ পথ পেরিয়ে ক্লান্ত
আবার আমার উঠোনে দাঁড়াই, যখন চকিতে
চরাচর বিসমিল্লা খানের সান্দ্র সানাই,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
যখন অমল সুবে সাদেকের জাগরণী ধ্বনি
ভেসে আসে কানে, যখন প্রভাত পুণ্য আয়াত,
কাজল মাটির দুর্বার টানে ঝরে শত ফুল,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
যখন নদীতে গ্রাম্যরমণী প্রদীপ ভাসায়
কারো কথা ভেবে সন্ধ্যাবেলায়, যখন বিপুল
বেড়াজালে দেখি ছটফট করে বন্দিনী মাছ
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
যখন ভগ্নসেতুর অপারে ডাক দেয় কেউ,
ব্যাকুল সে-সুর বৈরী বাতাসে হারায় নিয়ত,
যখন স্রোতের ক্রূর চোরা টানে নৌকো লুপ্ত,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।