বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে
বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে
রৌদ্র, বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন। বাংলা ভাষা
উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের একতারা বাজে
উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে, উত্তাল নদীর
বাঁকে বাঁকে; নদীও নর্তকী হয়। যখন সকালে
নতুন শিক্ষার্থী লেখে তার বাল্যশিক্ষার অক্ষর,
কাননে কুসুমকলি ফোটে, গো-রাখালে বাঁশি
হাওয়াকে বানায় মোঠা সুর, পুকুরে কলস ভাসে।
বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে চোখে ভেসে ওঠে কত
চেনা ছবি মা আমার দোলনা দুলিয়ে কাটছেন
ঘুমপাড়ানিয়া ছড়া কোন্ সে সুদূরে; সত্তা তাঁর
আশাবরী। নানি বিষাদ সিন্ধুর স্পন্দে দুলে
দুলে রমজানি সাঁঝে ভাজেন ডালের বড়া আর
একুশের প্রথম প্রভাতফেরি, অলৌকিক ভোর।
মণিপুর লোকদূহিতা
(ওয়াহিদুল হক বন্ধুবরেষু)
তখনো আমার সুহৃদের মনে শহুরে
ক্লান্তি ছিলো কি? অবশ্য তাঁর ভব্যতটুকু
বজায় রেখেই, আন্দাজ করি, চায়ের পেয়ালা
হাতে তুলে নিয়েছিলেন সুচারু ধরনে।
মফস্বলের আলাভোলা ছায়া দু’চোখে
সাজিয়ে হলুদ বিকেল বেলায় তুমি আঙিনায়
পাতলে আসন, সিলেটি শ্যামল লাগে বিদগ্ধ
বন্ধুর প্রাণে, প্রাঙ্গণ যেন মিনতি।
শহুরে মনের নিসর্গপ্রীতি পেয়েছে
তৃপ্তি এবং তারই রেশ কিছু বাঙময় হয়,
বৈকালী সিএ স্নিগ্ধ স্মৃতির হার্দ্য লেখনে,
বর্ষ-শুরুতে হ্রস্ব ভ্রমণকাহিনী।
বস্তুত আমি দেখিনি কখনো তোমাকে।
বন্ধুর চোখে গাছপালাঘেরা একটি আঙিনা,
আনন্দসুরে মাতাল পক্ষী, লাজুক তন্বী
যেন বা স্বপ্নে উঠেছিলো দুলে বিকেলে।
ক’জন অচেনা শহুরে শ্রোতার সমুখে
যখন দ্বিধায় ধরেছিলে গান, তখন হে মেয়ে
নয়নে জল, আঁচলের ফুল ঝরেছে ব্যাকুল;
গীতি ও গায়িকা একই বৃন্তের সুরভি।
যখন তোমার ছোঁয়ায় হারমোনিয়াম
হলো নজরুল করুণ রঙিন, তখন আঙিনা
হরিণমুখর বনরাজিনীলা, টলটলে দিঘি,
ময়াল-বাসর, দূর নীলিমার বসতি।
ঘনিষ্ঠ তানে তুমি চলে গেলে সুদূরে।
রইলো আড়ালে অতিথি, উঠোন, হরিয়ালপাখি,
ঝোপঝাড় আর মলিন জীবিকা এবং অবাধ
তোমার যাত্রা চেনা বৃত্তের বাইরে।
যদিও দেখিনি, তবু বলা যায়, দেখেছি
আমিও তোমাকে হরফের বনে, বন্ধুব চোখে
প্রকৃত তোমাকে। আশাবরী রাগে তোমার শরীর
হোক লীলায়িত চিরায়ুষ্মতী ছায়ায়।
দেখিনি তোমাকে, তবু ভাবা যায় শরীরে
তোমার মোহন ঊষার সখ্য, জাগরে চকিতে
সুরমা নদীর কূল-উপচানো তন্বী জোয়ার।
হৃদয়ে তোমার শারদ রাত্রি, মিনতি।
তোমার না-থাকা তোমাকেই আনে নিকটে।
সমাজদ্রোহিতা আমার মনের নেপথ্যে বাঁচে,-
কলুষমুক্ত স্বরচিত এই স্মৃতিতে আমার
তুমি বাঁচো সুরে মণিপুর লোকদুহিতা।
মহাপ্লাবনের পরেও
প্রত্যাশা থাকে না, তবু কিছু ঘটে যায় আকস্মিক-
যেমন খরায় বৃষ্টি, বিরতিবিহীন বৃষ্টিপাতে
কৌতূহলী স্মিত বালকের মতো রোদের ঝলক।
ভাবিনি কখনো পাবো, অথচ নিঝুম অপরাহ্নে
আমাকে বিস্মিত করে এলো কার্ড এক অলৌকিক
তোমার ঠিকানা থেকে। শ্যামল মেদুর কার্ডে লেখা
বিদেশী ভাষায় শুধু তিনটি মায়াবী শব্দ, ‘খুব
মনে পড়ে।’ শব্দ এত চুম্বন-প্রবণ হতে পারে
কখনো জানিনি আগে। এক কার্ড যেন কোনো
জাহাজ ডুবির পর ভাসমান বোতলের বাণী,
গোপনে পাঠানো, কিংবা নূহের কপোত, যার ঠোঁটে
সুবাতাসে স্পন্দমান সবুজ আশ্বাস। জেনে গেছি
চরাচরব্যাপী মহাপ্লাবনের পরেও ভূভাগ
স্নিগ্ধ জেগে থাকে কিছু; তুমিই আমার সেই ভূমি।
মাদল
কে ক্লান্ত পুরুষ তার ঘরের জঠরে বসে আছে
হাঁটুতে থুতনি রেখে। তার
অস্তিত্বের আনাচেকানাচে
গ্লানির পঙ্কের ছাপ, শরীরের সব কটি হাড়
খেয়েছে কামড়
সে কোন্ রহস্যময় নেকড়ের বারংবার। চোখ
নিজের কাছেই তার শোক
করবার মতো জায়গা এবং জীবন
প্রায় সারাক্ষণ
শোকার্ত চোখের মতো করে ছলছল।
বার্ধক্য ঝুঁকেছে তার দিকে বড় বেশি,
বুঝি তাই গৃহকোণে পড়ে থাকে অলস মাদল,
হয় না চঞ্চল পেশী
আগেকার মতো আর। কিছু স্মৃতি শুধু
রৌদ্রদগ্ধ মাঠের মতন করে ধুধু।
কে রাগী পুরুষ তীব্র বাজায় মাদল অকস্মাৎ
নেচে নেচে নিজের উঠোনে-
দেখা যায় কিনা যায় তরঙ্গিত হাত।
আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে দশদিকে, আওয়াজের কী-যে
মানে, তা সে নিজ
বোঝে না, কেবলি শোনে
এবং পা ফেলে তালে তালে, আলোময়
হয়ে ওঠে তার অস্তিত্বের প্রতিটি স্পন্দিত ভাঁজ।
খসে যায় জরা বাকলের মতো আর মনে হয়
তাকে বন্দনীয় কারুকাজ
মহান শিল্পীর। আর সারা বাংলাদেশ যেন আজ
তার দীপ্র মাদলের গুরুগুরু অজর আওয়াজ।
মে দিনের কবিতা
মাদুরে সে শুয়ে, হাত তার পায় মাটির আদর,
আড়মোড়া ভেঙে দ্যাখে-
তাকে ঘিরে জাগে চারা গাছ কিছু ফুল ঝুঁকে আছে
ওষ্ঠ ও গালে, স্তনের ওপর,
যেন চুমো খেতে চায়।
স্বপ্নে সে নয় বিভোর এখন; একটু আগেই
নিদ্রার হাত গুটিয়ে নিয়েছে জাল।
কী করে যে এই খেলার ঘরের মাটি ফুড়ে জাগে
পুষ্পল এক চকিত বাহার, ভাবে বিস্মিত-
এ কোন তেলেসমাত?
চোখ কচলিয়ে শাড়ি সামলায়; ঘর দুয়োরের
আনাচেকানাচে সূর্য বিলায় মুঠো থেকে তার
সোনালি অনুগ্রহ।
ছুটি বাজাচ্ছে বাঁশি আশেপাশে, বাঁশির আওয়াজ
খুপরিটা ছেড়ে, মহল্লা ছেড়ে
ছড়িয়ে পড়েছে তামাম শহরে আজ।
ছুটি, আজ ওর মরদের ছুটি। পাশ ফিরে দ্যাখে
কেমন অঘোরে ঘুমায় লোকটা,
স্বপ্নের মায়া লেগেছে শরীরে,
নিথর ঘুমায় গাছের গুঁড়ির মতো।
আজ মে দিবস। দুনিয়ার যত মজদুর আজ
পোহায় ছুটির ছায়া।
এদিনের মানে জানে না সে, তবে
আবছা কাহিনী মরদের কাছে শোনা।
মানে যাই হোক, এটুকু সে জানে
ঘরের মানুষ আজকে যাবে না কঠোর কারখানায়।
কিন্তু ঘরের মানুষের মন, আছে তার জানা
সহজে টেকে না ঘরে।
বেলা না চড়তে মিশে যায় সেও দোস্তের ভিড়ে,
মদে চুর হয়ে টলতে টলতে ফেরে রাত্তিরে
আপন বিবরে, নামে অবশ্য গালিগালাজের ঢল।
এক ঝটকায় ঘরনীকে তার দ্যায় সে সরিয়ে
কখনো-বা ফের কোমর জড়িয়ে টেনে নেয়,
ভুরভুরে মুখ চেপে ধরে মুখে,
যেমন ভালুক মৌচাকে দেয় হানা
নারী সত্তায় লাগে আচমকা
জব্বর এক নেশার মদির দাগ।
ওর গায়ে নেই কাঁচা-সোনা রঙ, শ্যামলাই বলে
পাড়া-পড়শিরা, নাকও নয় বাঁশি,
কিন্তু ঘরের মানুষ বলে-
‘কসম খোদার তোর চোখ জোড়া বড় গজবের,
নশিলা, জংলা বড়।’
ঘরের ভেতরে জোয়ান মরদ অঘোরে ঘুমায়,
হাত তার যেন কোণে পড়ে থাকা
মহররমের নিশান কোনো।
এই হাত তার সকাল-সন্ধ্যা মেশিন চালায়,
এই হাত তার মিছিলে মিছিলে আকশচুম্বী,
এই হাত তার বউয়ের পাছায় আদর ঝরায়,
কড়া এ হাতের সাহসী আঙুল
ভবিষ্যতের জাবদা খাতায় টিপসই দ্যায়,
দূরাগত কোনো রহস্যময় সুনীল পক্ষী
এই হাতে তার চঞ্চু ঘষে।
ঘরের ভেতরে জোয়ান মরদ অঘোরে ঘুমায়।
মজুরের বউ চুলে গুঁজে নেয়
অখ্যাত ফুল, জানা আছে আর
শত তালিমার চাদরের মতো গরিবের সংসার।
তবু সে আড়ালে সাদামাটাভাবে
করে সাজগোজ, আলতা লাগায় পায়ে।
ভাঙা আয়নার নিজস্ব মুখ? এ কোন সুদূর
হাবেলির বিবি এসছে গরিব-মরবার ঘরে।
কোথায় বেদাগ চকমকে টিপ?
কোথায় কাজললতা?
চাঁদের চমক, হাওয়ার ঝলক পাওয়ার জন্যে
বেরিয়ে সে আসে কৃপণ উঠোনে,
ভাসে জ্যোৎস্নার বানে।
মজুরের বউ করে অনুভব নিজের ভেতরে
জরায়ুর লতাগুল্মে কী যেন নড়ছে প্রাণের মতো।
মে দিন এখন জাগর জ্যোৎস্না,
মে দিন এখন তন্বী শরীর, সে নিজের হয়
আগামী কোন প্রসূত-বিভোর মে দিনের গীতিকবিতা।