দেখা হলো না
কলকাতার সরকারি কলোনিতে দুপুর চমকাচ্ছিলো
সোনালি চিলের মতো। এক দশক আগে,
যদ্দুর মনে পড়ে,
আমরা ক’জন গিয়েছিলাম সেখানে
তোমাকে এক ঝলক দেখার জন্যে, শুধু দেখার জন্যে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম আমরা, হঠাৎ কেন জানি না মনে হলো
এলসিনোরের পুরনো সিঁড়ির ধাপ
অতিক্রম করে চলেছি।
যখন সিঁড়ি চেয়ে উঠছিলাম, তখন আবার
নতুন করে আমি একটি কিংবদন্তির দখলে।
তিরিশের দশক আমার ওপর দিয়ে বয়ে গেলো
জৈষ্ঠের ঝড়ের ঝাপটার মতো। খেলার মাঠের জয়ধ্বনি,
মজলিসের গুলজার ঐকতান, দূরাগত
হারমোনিয়ামের আওয়াজ আর
রাজবন্দির জবানবন্দি ছুঁয়ে গেলো আমাকে। ফ্ল্যাটের জঠরে
তোমাকে দেখলাম এই প্রথম। বিস্ময়ের
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট আমি দেখলাম সেই ঈগলকে,
যে তার আকাশের নীলিমাকে ভুলে গেছে;
একদা তার উদ্দাম ডানা মেঘের স্তরে স্তরে
স্পন্দিত হতো বীণার মতো, তার ত্রিকালজ্ঞ চোখে
চরাচরের রূপান্তর হতো বারংবার,
এই স্মৃতিটুকু থেকেও যে বঞ্চিত।
গ্রীষ্মের ভরদুপুরে এ কাকে দেখতে এলাম আমি?
এই কি সেই ওষ্ঠ যার ক্ষণিক স্পর্শের জন্যে
কত বঙ্গীয় ললনার শরীর শিহরিত হতো
কদম ফুলের মতো? এই কি সেই স্বনামধন্য
বাবরি-শোভিত চির উন্নত শির, যা চৌরঙ্গির
সবগুলো দরদালান ছাপিয়ে, কার্জন হল আর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়া ছাড়িয়ে পৌঁছে যেতো মেঘলোকে?
এই কি সেই হাত যার আন্দোলনে
কেঁপে উঠতো কারার লৌহকপাট?
এই কি সেই আঙুল যার স্পর্শে হারমোনিয়াম চোখের পলকে
হয়ে যেতো রাগমালা আর সেই অনিন্দ্য সুরে সারা
বঙ্গভূমি নিমেষে নজরুল ইসলাম।
আমি ফ্ল্যাটের জঠরে তন্ন-তন্ন করে
পুরাণের সেই পাখিকে খুঁজলাম, যে ভস্মস্তূপ থেকে
গা ঝাড়া দিয়ে মৃত্যু থেকে জীবনে প্রবেশ করে
বারবার। আমি ভস্মরাশি দেখলাম, অথচ
কোনো পাখির পুনরুত্থান আমার চোখে পড়লো না।
তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে, কী আশ্চর্য,
আমার মনে পড়লো ডেনামার্কের যুবরাজের উক্তি-
‘এই করোটির ভেতরে ছিলো জবান
এবং একদা সে গান গাইতে পারতো।’
তোমার দিকে আমার চোখ আর তোমার চোখ
হীরের মতো জ্বলজ্বল করে যেন
খরদুপুরকে শাসন করছিলো ক্ষমতারহিত
বুড়ো লীয়ারের মতো। সিএ মুহূর্তে আমি
কান্তিমান এক ঘোড়াকে চোরাবালিতে ডুবে যেতে দেখ্লাম,
হাজার-হাজার বনকপোতকে দগ্ধ হতে দেখলাম
দাবানলে; একটি সোনার সিংহাসনকে দেখলাম
কুষ্ঠরোগীর মাংসের মতো গলে পড়তে।
দিলদরিয়া যিনি, উদরে আতিথেয়তা ছিলো যাঁর
প্রবাদ প্রতিম, তিনি কেন এক উদাসীন, এমন
অভ্যর্থনাকৃপণ? জীবনের ওষ্ঠে-ওষ্ঠে চেপে যিনি
টেনে নিয়েছেন জীবনরস, তাঁর কাছেই
সব কিছু হয়ে গ্যাছে কেমন অবান্তর।
‘খেয়ে যেও দুপুর বেলা’ বলবেন না
কাউকে তিনি। আর পেছনে থেকে শুনবো না তাঁর ডাক।
আচমকা কোত্থেকে এক পাপিয়া ভরদুপুরে
শুনিয়ে গেলো গান। একটা প্রজাপতি কিছুক্ষণ
ঘরময় ওড়াউড়ি করে তোমার কাঁধ ছুঁয়ে
বেরিয়ে গেলো জানলা দিয়ে। আর আমি
ভক্তি করতে এসে তোমার পায়ে রাখি ভালবাসার মঞ্জরী।
কলকাতার সরকারি ফ্লাটের সিঁড়ি দিয়ে
নামতে নামতে ভাবি
যাকে দেখতে এলাম তাকেই দেখা হলো না আমার।
নিজস্ব উঠোনে
টেবিলে ছিলেন ঝুঁকে কিছুক্ষণ আগে, এখন চেয়ার ছেড়ে
পুরাণের পুরনো ট্যাপেস্ট্রি ছেড়ে আলোছায়াময়
নিজস্ব উঠোনে তিনি পায়চারি করছেন অত্যন্ত তন্ময়।
অকস্মাৎ হাঁস দুটি জব্দ পাখা ঝেড়ে
উঠলো ভয়ার্ত ডেকে। কখন যে সুনামগঞ্জের ক্ষেতে পাকা
ধান-খেতে-আসা চকলেট-রঙ হাঁসের বাচ্চাটা
(নতুন পালক তার এ শহরে হয়েছিলো ছাঁটা)
হলো ক্ষিপ্রগতি নেউলের সহজ শিকার লতাগুল্ম ঢাকা।
কিঞ্চিৎ দুর্গম কোণে, তিনি কিছুই পাননি টের
বিকেল বেলায়, পরে পাখিপ্রিয় কনিষ্ঠ কন্যার জবানিতে
জানা গেলো খুঁটিনাটি সকল বৃত্তান্ত। আত্মজার দুচোখ পানিতে
ছিলো খুব টলটলে। আকস্মিক এই হিংস্র ঘটনার জের
টেনে মনে তিনি ফের অন্য মনে উঠোনে হাঁটেন
নিরিবিলি থেকে-থেকে কখনো কাশেন।
কনিষ্ঠ কন্যার পোষা ময়নাটা দাঁড়ে বসে থাকে
বারান্দায়, ছোলা খায়, কখনো-বা তার
‘শেবা, শেবা’ ডাকে
বাড়ির স্তব্ধতা জব্দ হয় খুব এবং গোলাপ গাছটার
পাতা শিহরণে শব্দহীন গীত যেন মাঝে-মাঝে।
বসন্তের সাঁঝে
বাতি জ্বলে ওঠে ঘরে। প্রৌঢ় কবি তখনও উঠোনে;
ধাবমান যানপিষ্ট কুকুরের মতো
স্বীয় যাবতীয় অতীতের কথা ভেবে-ভেবে তিনি গৃহকোণে
আবার আসেন ফিরে অভ্যাসবশত।
অনন্তর অসমাপ্ত কবিতার চিত্রকল্প যমক অথবা
অক্ষরবৃত্তের সুর ভাবেন। উঠোনে হাস্যময়ী রক্তজবা।
নিমগ্নতা
আমাকেও বারাঙ্গ বারাঙ্গনা প্রলোভন অন্ধকারে ডেকে
নিয়ে দ্রুত দেখার আগ্রাসী ঊরু, উন্মোচিত স্তন,
উন্মাতাল হাসির জহর হানে যখন-তখন।
তবে কি আমিও আজ দালালের মতো যাবো হেঁকে
দিগ্ধিদিক? স্বরচিত শামুকের ঠাণ্ডা খোল থেকে
বেরিয়ে সোৎসাহে ঘন ঘন করবো মঞ্চারোহণ
ত্বরিত খ্যাতির মোহে? স্বতঃস্ফূর্ত করবো লেহন
সাম্প্রতিক চটচটে চুষিকাঠি লজ্জা ব্যতিরেকে?
ভিড়াক্রান্ত আমি, চোখ-ধাঁধানো পসরা সবখানে;
অশ্লীল চিৎকার আর তুইতোখাড়ির তুবড়িতে
ঝালাপালা কান; শুদ্ধ বাণী নয়, বিটকেল কথা
নিয়ত পুলক আনে এমনকি ধীমানের কানে।
শিল্প পদ্মরাগমণি হয় স্তব্ধতার অঞ্জলিতে,
তাই চটকিলা হল্লা নয়, চাই ধ্যানী নিমগ্নতা।