তুণে খুঁজি তীর
১
একদা আমার স্বপ্ন সুপ্রাজ্ঞ নূহের করতল
থেকে উড়ে-যাওয়া কপোতের মতো ছিল যার ঠোঁটে
পুষ্পল জলজ কণা সদ্য জাগা পল্লবের ঘ্রাণ।
একদা আমার স্বপ্ন নীলিমাকাতর ঊর্ধচারী
পাখায় জড়িয়ে নিয়ে নির্বাসিত দান্তের ভাবনা
ক্লান্তিকালে খুঁজেছে নীড়ের ওম; একদা আমার
স্বপ্ন ছিল দ্য ভিঞ্চির অলৌকিক আঙুলের মতো;
একদা আমার স্বপ্ন মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্যসঙ্গী
ছিল ঝোপঝাড়ে, বনবাদাড়ের আঁধারে, জলার-
সবুজ গ্রেনেডে, বন্দুকের নলে, ক্যাম্পে, পরিখায়।
এখন আমার স্বপ্ন ক্রাচাশ্রয়ী, একা-একা ঘোরে
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাঝে-মাঝে; এখন আমার স্বপ্ন
চাঁদা আর ভাতা প্রার্থী, কখনও আবার নজরুলী
কবিতার মতো অগ্নি উদ্গীরণে ব্রতী হতে চায়।
২
তবু আমি নিজেকে বিপন্ন ভেবে করি না বিলাপ।
ক্রমশ কাদার চাকা দেবে যাবে, আমার শোণিত
মিশে যাবে অস্তরাগে, ভূলুণ্ঠিত শরীর দলিত
হবে আর শস্যশূন্য মাঠের মতন এ জীবন
ক্ষণকাল হবে উদ্ভাসিত দৃষ্টপথে, অনন্তর
লুপ্ত গান, স্মৃতি সমুদয়, অতীত ও বর্তমান।
এখন যদিও স্বপ্ন রোগা ঈগলের মতো বাঁচে
উপহাস কুড়িয়ে সর্বদা, তবু স্বপ্নের টানেলে
কাটে বেলা মাঝে-মধ্যে। সম্প্রতি আমার নেই কোনো
সঙ্গী আর; একদা যাদের সঙ্গ দিত সুখ, তারা
তিন ডাইনীর প্ররোচনা মেনে অতি দ্রুত পাল্টে
নিয়েছে জীবন, আমি একা এখনও কুড়াতে যাই
ফুল বনবাদাড়ে এবং চাকা নাছোড় কাদায়
দেবে যাবে নিশ্চিত জেনেও আজও তূণে খুঁজি তীর।
তোমার কুশল
তোমার কুশল আমি জানি না এখন। বড় যোগাযোগহীন
আছি ইদানীং
এ এমনই যুগ, যোগাযোগ ক্রমান্বয়ে হচ্ছে যত
সহজ ততই যোগাযোগহীন হয়ে পড়ছে মানুষ। তুমি
এ মুহূর্তে কি করছো, কোন শহরের ফ্ল্যাটে আছো
তোমার বিবাহোত্তর রূপ নিয়ে নিজস্ব সংসারে,
আগেকার মতো আজও আমাকে তোমার
মনে পড়ে কিনা,-
জানি না কিছুই। আগেকার মানে কবেকার? বলো
তুমি কি এখনও
আমাকে অত্যন্ত ভেবে রাত্রির চিতায় জ্বলজ্বলে
যৌবন পোড়াও হে সুচেতা?
এই প্রশ্নে কুয়াশার আবছায়া মেদুরতা আছে, অতিদূর
অরণ্যের হরিণ্যের চঞ্চলতা আছে,
ঝিলের কোমল আলোড়ন আছে, আছে
পরিত্যক্ত বসতির স্তব্ধতা এবং
পুরনো আন্ধারে কোনো গহনা নৌকার যাত্রাধ্বনি।
একদা আমিও ভাবতাম
কখনও আমাকে যদি ছেড়ে চলে যাও দূর দেশে
আমার সকল প্রত্যাশাকে মরীচিকা করে, তবে
আমি বন্ধ ঘরে মরে পড়ে থকবো একাকী
কিংবা উন্মত্ততা
আমাকে দখন করে ফেলবে নিমেষে,
অথবা আমার কাছ থেকে কর্কশ অংকের কর
আদায় করবে অসুস্থতা অবিরত। কিন্তু আমি
আত্মহননের আফিমে হইনি বুঁদ
নাবালক পুরুষের মতো।
হে দয়িতা সুচেতা আমার
সে কবে হয়েছে দেখা, রাত্রির প্রথম যামে কথোপকথন
আর লোকচক্ষুর আড়ালে
নাগরিক ক্ষণিক ভ্রমণ আর থরথর তোমার শরীর
কিছু কল্পনায় আর কিছুটা বাস্তবে
ছুঁয়ে ছেনে বাউণ্ডুলে কবির গভীর পংক্তিমালা আহরণ
কিছু তার মনে পড়ে, কিছু বিস্মৃতির কাছে আমি
রেখেছি বন্ধক। মনে পড়ে, মাঝে-মাঝে তোমাকেই
মনে পড়ে সকাল সন্ধ্যায়
দুপুরে কি মধ্যরাতে, অকস্মাৎ বাড়াই দু’হাত
তোমার একান্ত দিকে, কখনও-কখনও পদ্য লিখি
তোমারই উদ্দেশে, রাত জেগে তোমার মধুর নামে চিঠি
লিখে ডাকঘরে যাই বারেবারে, অথচ করি না
পোস্ট কোনো পত্র ঠিক ডাক-টিকিটের অভাবে কখনও।
যৌবসাজ খসে গেছে, আমার যৌবন সে কখন
আহত চিলের মতো আর্তনাদ করতে-করতে
অসহায় পড়ে গেছে জন্মন্ধ ডোবায়। আমি আজ
অতীত চিবোই শুধু যে অতীত আমরা দু’জন
অন্তরঙ্গ করেছি রচনা
কখনও ড্রইং রুমে, কখনও-বা খোলা মাঠে, লাল বারান্দায়,
কোনো-কোনো রাতে
স্বপ্নিল মোটরকারে সান্নিধ্যের বৈদূর্যমণির
বিপুল আভায় উদ্ভসিত, চুম্বনের সঙ্গীতে অধীর হয়ে,
রাত্রির অসিত মখমলে গাল রেখে
বসে-থাকা, প্রকৃত হার্দিক কথা ভুলে যাওয়া আর
চুপচাপ চেয়ে-থাকা দিয়ে।
আজ ব্যর্থতার ভস্মারাশি আমাকে ফেলেছে ঢেকে,
আবার কখনও আমি ভস্ম ঝেড়ে অবিনশ্বর পাখির মতো
সূর্যোদয় আর পদ্মপ্রসূত আভার সম্মিলনে
গীতময় হবো কিনা, স্পষ্টতই আমি তা জানি না।
দাঁড়াবো কোথায় আজ?
দাঁড়াবো কোথায় আজ? সাতপুরুষের ভিটেমাটি
উঠেছে নিলামে প্রায়; উপরন্তু ঘুঘুর অভাব
নেই আশেপাশে আর, হা কপালে, আমিও স্বভাব
দোষেই উড়নচণ্ডী আকৈশোর, বলা যায় খাঁটি
জুয়াড়ি এবং পরিণামে উদাসীন। ঘটি-বাটি
সমস্ত বন্ধক রেখে মহাজনদের কাছে ঘুরি
সহায়-সম্বলহীন, গৃহিণী অকালে প্রায়-বুড়ি;
ক্ষুধার অনলে পুড়ে সন্তানেরা চোষে শুকনো আঁটি।
মাঝে-মধ্যে মসজিদে মানতের বাতি জ্বেলে
কাবা শরিফের দিকে মুখ রেখে ক্লান্ত হাঁটু মুড়ে
বসে থাকি লোবানের ঘ্রাণে মগ্ন অতিশয়, ভাবি
আগামী বৈশাখে তোফা তক্দিরের চাকা যাবে ঘুরে,
সন্তান থাকবে দুধে-ভাতে আর কড়াইয়ে ঘি ঢেলে
এবং গৃহিণী পরবেন স্বর্ণবালা, নাকছাবি।
দীর্ঘ কেঁদে যায়
কোনো কোনো নিদ্রাহীণ রাতে জানালায়
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তজবা ফুটে থাকে। ওরা
আমার টেবিলে-রাখা কবিতার খাতার ভেতরে
প্রবেশ করতে চায় নিরিনিলি, বলে-
বিজনে আমরা জ্বলি, দূরে কাঁদে কে একাকী নিঃসঙ্গ শয্যায়,
বিজনে জ্যোৎস্নাও কেঁদে যায়, কেঁদে যায়, কেঁদে যায়।
কিছু হাড়, কিছু শুকনো পাতার ওপরে
আহত পাখির মতো নিথর জ্যোৎস্নাও কেঁদে যায়।
মনে পড়ে
জনশূন্য নদী তীরে, নাঙ্গা আকাশের নিচে
ব্যাপক বিকেলে
কতিপয় বিষণ্ণ নাবিক
নুনমাখা দাড়ি আর রাঙা চোখ নিয়ে দিগ্ধিদিক
করেছিলো ছুটোছুটি, খুব ক্লান্ত হয়ে
নিরাশায় স্নান করে সর্বদা গন্তব্যহীনতার ধুধু ভয়ে
শুয়েছিলো মাটিতে সটান, তারপর
ওঠেনি কখনো- বহু দূরে কিছু বালির কবর,
এলোমেলো দাঁড়
দেখে যদি কেউ কোনোদিন
থমকে দাঁড়ায়, তবে করুণ সঙ্গীত, ভায়োলীন
কিংবা অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র থেকে নয়,
প্রকৃতির থেকে জেগে উঠবে সহসা, মনে হয়।
এখন আমার হাত থেকে সুর ঝরনার মতন
উৎসারিত ক্ষণে-ক্ষণে, সুরের ভেতর থেকে সুর
ঝরে যায় বনাবৃত নিরালায়। মন
ঘরের নিকটে যেতে চেয়ে ফিরে আসে, অশ্বখুর
বেজে ওঠে বারংবার হৃদয়ের খুব অভ্যন্তরে,
নাশপাতি বন দোলে, কার মুখ, চক্ষুদ্বয়, স্তন,
বসে-থাকা, হেঁটে-যাওয়া আঁচল উড়িয়ে, মনে পড়ে।
আমার শয্যায় সারাক্ষণ
সে কার অস্পষ্ট ছায়া শুয়ে থাকে ছায়াময়তায়।
হা-হা স্বরে
আমার শয্যায় জ্যোৎস্না কেঁদে যায়, দীর্ঘ কেঁদে যায়।