কেউ কি পালিয়ে যায়
কেউ কি পালিয়ে যায় অকস্মাৎ নিজের বাড়ির
দোরগোড়া থেকে কোনোদিন ? নিজের একান্ত প্রিয়
বই, যাবতীয়
খুঁটিনাটি বস্তুময় ঘরটাকে খুব ফাঁকা করে
কেউ কি স্বেচ্ছায় সাততাড়াতাড়ি চলে যায় নিজস্ব হাঁড়ির
ভাপ-ওঠা ভাত ফেলে? ঘোরে
এলোমেলো গন্তব্যবিহীন
অন্ধকারে মুখ ঢেকে ভয়ে ভয়ে থাকি রাত্রিদিন?
মাঝে-মাঝে এরকম হয়, হতে থাকে-
গেরস্থ সাজানো ঘরদোর ছেড়ে নিমেষে পালায় ঊর্ধ্বশ্বাসে
সেখানে, যেখানে রক্তখেকো বাঘ ডাকে,
পড়ে গণ্ডারের, বন্যবরাহের পদচ্ছাপ,
বিষধর সাপ
ফণা তোলে, দোলে হিস্হিসে তাজা ঘাসে।
বলো তো এমন কেন হবে বলে কেউ
ছাগলের চামড়ার মতো স্তব্ধ আকাশের দিকে
চেয়ে কিছুক্ষণ হাসে ফিকে
হাসি, আড়চোখে দেখে আশপাশে কত ফেউ
এর ওর তার ছায়া চেটে খায়। যেহেতু হঠাৎ
এপাড়া-ওপাড়া
সব পাড়াতেই চলে প্রেতের পাহারা,
অকৃত্রিম সুহৃদের মুখের আদল
নিয়ে প্রত্যেকেই দ্রুত হয়ে ওঠে নির্দয় কিরাত।
বিশ্ব-চরাচরে রাসায়নিক বাদল
ব্যেপে আসে দেখি ক্রমান্বয়ে
খুব ঘন হয়ে।
নিজস্ব বিবর ছেড়ে যাই না কোথাও
দূরে স্বপ্ন সঞ্চরণে, দোরগোড়া থেকে
কখনও হঠাৎ সরে গেলে গেলে অভিমানে মুখ ঢেকে,
‘ঘুমন্ত রাজার ঘরে দাও
হানা মধ্যরাতে’ বলে দেয় প্ররোচনা চতুর্থ ডাকিনী।
তাকে দেখে মুখ আমি কখনও ঢাকিনি।
তবু আর্তবিবেকের নিঃসঙ্গ জোনাকি জ্বলে আর
নেভে, নেভে আর জ্বলে
আজও অবচেতনের গহীন জঙ্গলে।
ভয়ার্ত পাখির মতো ইদানীং কাঁপছে সময়,
হোক না যতই অন্ধকার
ঘর, স্বখানেই ফিরে আসি, আসতেই হয়।
ক্লান্ত তুই
তোর সাহসের গলাফোলা স্তব করবে না কেউ
কোনোদিন; ক্লান্ত তুই বিক্ষুব্ধ সমকালে ঢেউ
তুলিসনি, তোর ডাক শুনে কোনো অশান্ত তরুণ
ঝরায়নি বেপরোয়া তার দীপ্ত টগবগে খুন
রাজপথে, তোর জন্যে কস্মিনকালেও অনশন
ধর্মঘট করবে না কেউ কিংবা হবে না হরতাল
শহরে বন্দরে, কেউ বাজাবে না ট্রাম্পেট কর্তাল
স্বাগত জানাতে তোকে। দিকে দিকে উজ্জ্বল তোরণ
তুলবে না মাথা তোর নামে। পুষ্পিত বিগ্রহ তুই
নোস, তোর পায়ে কেউ করবে না অর্পণ কিছুই।
ক্লান্ত তুই, অবসন্ন শরীর ও মন দিয়ে তোর
কী ঝক্কি ঝামেলা আজ। আধিব্যাধি বড়ই নাছোড়।
থাকিস একলা পড়ে অন্ধকার কোণে, দুষ্ট ক্ষত
চেটে বেলা যায়, কাদা ঘেঁটে কী খুঁজিস অবিরত
অমন ব্যাকুল হয়ে? হঠাৎ কখনও সূর্যোদয়
সুদূর দিগন্ত ছেঁড়া সূর্যোদয় দেখে মনে হয়-
মাথার ভিতরে তোর এখনও গুঞ্জন কিছু আছে
বাকি, সব ফাঁকি, সব ভ্রান্তি উজিয়ে এখনও নাচে
শিরায় আহত দেবশিশু। তবে কেন অকস্মাৎ
মধ্যপথে কোন্ ভুলে এমন অবশ তোর হাত?
আকাশে নতুন আলো ফোটার আগেই, ওরে বোকা,
ভুলে গেলি বাজাতে আশার ডুগডুগি। কেন ধোঁকা
দিন না অম্লান মুখে দশজন পড়শিকে? চেয়ে
দ্যাখ চারপাশে কত লোক কী উল্লাসে যাচ্ছে বেয়ে
তা’ ধিন তা’ ধিন খেয়া, কাড়া-নাকাড়ার ধুন্ধৃমার
শব্দে দিকগুলি দিনরাত্রি কম্পমান বারবার।
ছায়ায় আছিস মিশে, রোদ্দুরে অরুচি অতিশয়;
হেলায় বিকিয়ে দিলি বাস্তুভিটা, বিষয়-আশয়।
তুই ভীরু, বড় ভীরু উদ্যমরহিত চিরদিন,
সঙ্গলিপ্সু তুই, তবু রয়ে যাবি নিঃসঙ্গ মলিন?
গুলিবিদ্ধ লাশের মতন
১
একটি দশক কেটে গেছে; যেন আমি এতকাল
ছিলাম সিনেমা হলে শ্বাসরোধকারী পরিবেশে।
কত দৃশ্য নৃত্যপর চোখের সম্মুখে, দিগ্ধিদিক
ছোটে নানা কুশীলব। অনেকে নিষ্প্রাণ অতিশয়,
যেন কাকতাড়ুয়া ধরনে দাঁড়ানো অন্ধকারে।
কেউ ছদ্মবেশে পথ হাঁটে আস্তিনে লুকিয়ে ছোরা,
সিঁদ কাটে কেউ মধ্যরাতে গেরস্থ পাড়ায়, কারো-
কারো হাত হতাশা ছড়িয়ে দেয় সম্পন্ন সংসারে।
কেউ-কেউ পুকুর চুরির পরে কাতলার মতো
ঝলসাতে থাকে রৌদ্রে বারেবারে; কেউ খুব ক্ষব্ধ,
প্রায় ক্রুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে হাতে অস্ত্র ধরেছিলো বলে।
অস্তরাগে শ্মশানের ধারে চোরাগোপ্তা মাল টেনে
গলাগলি করে গড়াগড়ি যায় ডাকাত পুলিশ।
কেউবা ফাঁসিতে ঝোলে, কেউ যায় দীর্ঘ নির্বাসনে।
২
একটি দশক গেছে, তবু কেন দৃশ্যাবলি হঠাৎ এমন
পাল্টে যায় বারাংবার? কেন গাছপালা তছনছ,
অগ্নিদগ্ধ বাড়িঘর? কেন মৃত্তিকা উগরে দেয়
করুণ করোটি সংখ্যাহীন? অকস্মাৎ এ কেমন
পরাবাস্তবের লীলা শহরের আনাচে-কানাচে?
মাঝে-মাঝে মনে হয়, আমার চোখের রেটিনায়
কী ব্যাপক বিভ্রমের ছায়া নাচে বেলা-অবেলায়।
নইলে কেন গাছে-গাছে সদ্য কাটা নরমুণ্ডু দেখি,
দেখি দিনদুপুরেই শেয়ালে শকুনে ছেয়ে গেছে
পৌরপথ! এমনিতে মোটামুটি ভালো থাকি, মানে
খাই-দাই, প্রত্যহ কামাই দাড়ি। হঠাৎ আবার
সবকিছু উল্টা-পাল্টা, আমার দৃষ্টিতে বারংবার
একাত্তর ভেসে ওঠে গুলিবিদ্ধ লাশের মতন।
টানেলে একাকী
একটি টানেলে
কাটিয়ে দিলাম হিমযুগ এবং প্রস্তরযুগ, তাম্রযুগ,
লৌহযুগ খুব একা একা,
কাছাকাছি কেউ নেই এবং দূরেও ঘর কুয়াশায় কারো
অস্তিত্ব ফোটে না, শুধু ব্যর্থ যৌবনের মতো একটি কুকুর আজও
সঙ্গে সঙ্গে থাকে।
কতকাল আমি সূর্যোদয়
দেখিনি, শুনিনি কোনো দোয়েলের শিস। কালেভদ্রে
যেন কোনো বাজিকর টানেলের দেয়ালে ফোটায়
আলোর গোলাপ, ঝিল্লীস্বর শুনে টের পাই রাত।
যদিও প্রায়শ শ্বাসকষ্ট হয়, তবু নিশ্বাস নেবার মতো
অবশ্য থেকেই যায় কিছু অক্সিজেন।
টানেলের ভেতরে হঠাৎ
কখনও চিৎকার শুনে আতঙ্কে শরীর শজারুর
কাঁটা হয় আর চোখ ফেটে যায় আনারের মতো। চতুর্দিকে
দৃষ্টি ছোটে, ঘুরি দুটি হাত প্রসারিত করে, অথচ আমার
নিজস্ব অস্পষ্ট ছায়া ছাড়া কাউকে পাই না খুঁজে
কোথাও এখন।
কখনও কখনও
মনে হয়, কী যেন কিসের ঘোরে চলে গেছি সুদূর কোথাও
স্বপ্নচর পাখির পাখায় ভর করে, কাছে আসে
বাহাদুর শাহ জাফরের গজলের মতো এক
বিরান বাগান আর মোগল মিনিয়েচার কিছু অস্তরাগে কান্নারুদ্ধ
রক্তাভ চোখের মতো পুরাণসম্ভব।
অপরাহ্নে ডিভানে শায়িতা
মহিলা আমাকে ডেকে পিকাসোর ত্রিমুখী রমণী হয়ে যান
চোখের পলকে, আমি তার স্তনদ্বয়, অভিজাত নাভিমূল,
রমণীয়, উল্লসিত যোনি থেকে দূরে, ক্রমশ অনেক দূরে
চলে যেতে থাকি তিনি কবিতার পংক্তির মতন
কেবলি ওঠেন বেজে অস্তিত্বে আমার।
এ কোথায় এসে
দাঁড়ালাম অবশেষে? তবে কি প্রকৃত রোবটের
কাল শুরু হলো আজ? সকলেই রোবট তাহলে ইদানীং?
কান্তিমান লাইনো টাইপগুলি করেছে নির্মাণ
অদ্ভুত জগৎ এক; রাশি রাশি টাইপ কি দ্রুত
বেলা অবেলায়।
অবলীলাক্রমে
মিথ্যাকে বানায় সত্য, সত্যকে ডাগর মিথ্যা আর
রমণ, বমন, বিস্ফোরণ, যূথবদ্ধ আত্মহনন ইত্যাদি
শব্দাবলি দশদিকে সহজে রটিয়ে দেয় এবং সাজায়
সুচারু যান্ত্রিকভাবে কবিতার পংক্তিমালা মিল-
অমিলের উদ্ভট নক্শায়।
অসম্ভবে হয়েছি সওয়ার
আকৈশোর; অতিকায়, মৎস্যপৃষ্ঠে করেছি ভ্রমণ
সমুদ্দুরে বহুকাল, জলপরীদের দিব্যলালিম স্তনাগ্র ছুঁয়ে-ছেনে
গেছে বেলা পাতালের জলজপ্রাসাদ আর খসিয়ে নিজের
বুকের পাঁজর থেকে হাড় বানিয়েছি দেবতারও
ঈর্ষণীর বাঁশি।
অথচ উচ্চাভিলাষহীন
গৌরবের হেমবর্ণ চূড়া থেকে বহুদূরে আছি,
দেখি কয়লার গুঁড়ো, স্বপ্নবৎ ঊর্ণাজাল, কীটপতঙ্গের
ঘর-গেরস্থালি, দেখি জানু বেয়ে ওঠে নীল পোকা, মাঝে-মাঝে
বাদুড়ের ডানা কাঁপে, সিল্কের রুমাল যেন; থাকি দীর্ঘ কালো
টানেলে একাকী।