উচ্চারণ
কখনো কখনো মনে হয় আট কোটি লোক শোনে
আমার নিভৃত উচ্চারণ, কখনো-বা মনে হয়
আমার কথার জন্যে পিপাসার্ত একজনও নয়।
প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যা অত্যন্ত একাকী গৃহকোণে
বসে শব্দ দাও শব্দ দাও বলে কী গহন বনে,
পর্বতে, পাতালে হই নতজানু, করি আয়ুক্ষয়
প্রতীকের প্রতীক্ষায়, কম্পমান একটি হৃদয়
বিজন সৈকতে সারাক্ষণ রহস্যের ঢেউ গোনে।
যে-কথা হৃদয়ে ফোটে, হৃদয়ের ধ্বনি মতন
অন্তরঙ্গ বেজে ওঠে, তা যদি না শোনে কেউ কান
পেতে কিংবা না বোঝে কখনো, ক্ষতি নেই, নেই খেদ।
তোমার উদ্দেশে আমি যখন যা করি উচ্চারণ,
সে ধ্বনি তোমার কানে সকল সময় হোক গান-
মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্ধেদ।
এ কেমন স্বভাবের তিলক
এ কেমন স্বভাবের তিলক বেড়াচ্ছো বয়ে তুমি আশৈশব?
নইলে কেন দিন-দুপুরেই ঢ্যাঙা পাতাছুট গাছ
হঠাৎ তোমার চোখে পাতালবাসিনী কোনো মোহিনীর নাচ?
কেন বারংবার দ্যাখো তুমি
বেলা-অবেলায় চেনা চা-খানায় অন্তর্গত বিপুল বৈভব
নিয়ে ছারপোকা-ছাওয়া কাঠের চেয়ারে মৃদু ভিড়ে
তন্ময় আছেন বসে এক জালালউদ্দীন রুমী?
অস্তিত্ব কি অনস্তিত্ব বাজে তাঁর সত্তায় মরমী মীড়ে;
মাথার ভেতরে তাঁর ত্রিলোকী গুঞ্জন, যেন অন্য মসনভি
এ যুগ-সংকটে লিখবেন, তুমি ভাবো; নভশ্চারী প্রেরণায়
আঁকবেন জগচ্চিত্র মননে প্রোজ্বল সে তাপস-কবি।
তোমার পাড়ায়
আশপাশে বসতিতে আছে যারা, যাকে সাঁকো
বলে, তুমি তার নাম রাখো
নির্দ্বিধায় ছায়াপথ,
বাগানের নানা ফুল চোখের পলকে
অসুস্থ অনাথ বালকের টলটলে
চোখ আর মেঘপুঞ্জ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু শিবির
হয়ে যায় বারবার তোমার দৃষ্টিতে। আগামীর
নৈরাজ্যে সংকট স্বর্ণরথ
ভেবে যাকে দ্রুত ছুটে যাও তুমি প্রত্যহ, বলো কে
তা সহজে মেনে নেবে তর্কাতীত? আর জ্বলজ্বলে
এ শহর পম্পেয়াই-নগরীর ধ্বংসস্তুপ বদলে যদি
হঠাৎ চিৎকার করে দশদিক ভীষণ কাঁপিয়ে তোলে, তবে
‘ওরা তোর কী হবে, কী হবে?
সেই যে আঁতুড় ঘরে ঢুকেছিলো ক্ষ্যাপা জিন অলক্ষ্যে সবার,
এখন অবধি
সওয়ার হয়ে সে আছে তোর কাঁধে হে বাছা আমার,’
বলে ফেলবেন এক নদী
ঝরঝর চোখের পানি জননী তোমার। তবু তুমি শেষ বাসে
ঘরে ফেরা প্রহরে হঠাৎ
দেখে ফেলো খোলা রাস্তা এভিন্যু ছাপিয়ে হেঁটে আসে
বহুদূর-দূরাস্তর থেকে মহাকাব্যের দীর্ঘাঙ্গ স্ফীতবক্ষ
নায়কের মতো
তৃতীয় বিশ্বের জনস্রোত। স্তব্ধ রাত
গানে গানে তরঙ্গিত সমুদ্রেরই সমকক্ষ।
কী বিশাল মানবিক স্থাপত্য চৌদিকে, অকস্মাৎ
ফুটপাথে ফুটপাথে বনরাজিনীলা আর আমাদের ভীষণ আহত
এ শতক মাথা নত
করে দেয় অগণিত পায়ের ধুলায়। কে কিরাত
কেউ-বা শিকার চরাচরব্যাপী মৃগয়ায় আজ
বলা মুশকিল আপাত। তোমার তৃতীয় চোখ
আছে, পাড়াপড়শীরা পরস্পর করে বলাবলি।
দৃশ্যাতীত নানা দৃশ্যাবলী দেখা তোমারই তো কাজ;
হে নবীন বন্ধু, দাও বলে দাও, এই জীবলোক
বিধ্বংসী ভয়াল নাট্যে কে হবে জল্লাদ, কে-বা বলি!
এরকম হলে
এরকম হলে হাঁসের পংক্তি শিশুর আনাড়ি
হাতে আঁকা রেখা হয়ে যায় নির্ঘাৎ।
মানে, অতিশয় ত্রঁকেবেঁকে যায়, আকাশের ভুল
সীমানায় ওড়ে যেনবা হংসদল।
এরকম হলে ঘনঘন কাঁপে এপাড়ার কালো
রজস্বলা সে মেয়েটির বাম চোখ।
এরকম হলে বাড়ি খুঁজে-খুঁজে কাটে সারাবেলা,
পা চলে না আর; ঠিকানা-চিহ্নহীন।
এরকম হলে উদাস দুপুরে নিশুত নিশীথে
বার-বার ছেঁড়ে মীর কাশিমের তার,
গ্রীষ্ম-দুপুরে মুর্ছিত স্বরে দিন দিন বলে
কৃষিঋণ চায় জয়নুলী শত কাক।
এরকম হলে পার্কে কি মাঠে পেনশনভোগী
বয়স্কজন চুষিকাঠি নেন হাতে,
বারোয়ারি কত পার্টি অফিসে দোতারা বাজিয়ে
অন্ধ বাউল গায় লালনের গান।
এরকম হলে চৌরাস্তায় সন্ধ্যাবেলায়
ওড়ে সুবিশাল কৃশপুতুলের ছাই,
দূর শতকের কারুকাজময় পত্র চকিতে
রুক্ষ ধুলায় হয় সানকির নাচ।
এরকম হলে এ শহর ঢাকা বড় অভিমানী,
ভীষণ অসুখী; আঁধারে লুকায় মুখ।
এ শহর ঢাকা কখনও আবার এক নিমেষেই
দীপ্র তরুণ নজরুল ইসলাম।
এরকম হলে আহত বিবেকও লোকচক্ষুর
আড়ালে নিখুঁত পরে নেয় পরচুলা;
মনন, বিবাগী মরালের মতো
ডানা ঝাপটায় অকূল শূন্যতায়।
এরকম হলে বাক্যের ভীরু খরগোশ যেন,
এদিক-ওদিক তাকায় আর্তচোখে।
নিদাঘবেলায় দ্রুত উবে যায় আনন্দসুর,
কাব্যকলার রোদেলা অনুগ্রহে।
ঐতিহাসিক
বাইরে হার্মাদ ঝড়। যেন খুব বদরাগী কেউ
বারংবার গর্জে উঠে গাছপালা, ল্যাম্পেস্ট ঘরের
চাল, খুঁট পাখিদের ডেরা, বেবাক ফেলছে ছিঁড়ে
খুঁড়ে কাগজের মতো। তিনি, প্রাজ্ঞ একজন, একা
ঘরের ভেতরে বাতি জ্বেলে পড়ছেন ইতিহাস আর
মাঝে-মাঝে ঝাড়ছেন ছাই ত্র্যাশট্রেতে। অকস্মাৎ
দৃষ্টিপথে তাঁর ভাসে অগ্নিদগ্ধ বিপন্ন শহর-
এবং ছাড়ছে হ্রেষা চেঙ্গিসের ক্ষিপ্রগতি ঘোড়া
পাহাড়ে, প্রান্তরে, জনপথে। এণক্লান্ত, পরাভূত
নেপোলিয়নের তেজী ঘোড়ার শরীরে যত্রযত্র,
তুষার কামড় আর লাঞ্ছিতা পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরিতে
ট্যাঙ্কের ঘর্ঘর আর একাত্তরে বাংলাদেশে ক্রূর
বর্ষরের কী ব্যাপক নিপীড়ন, বই বন্ধ করে
ভাবেন প্রবীণ গবেষক, ইতিহাস তালেবর
তাশ জোচ্চোরের মতো হাত সাফাইয়ের কেরদানি
দেখায় প্রচুর আর নমস্য গিবন বলে সাত
তাড়াতাড়ি খাতা খুলে তিনিও লিখতে বসে যান
অতীতের ছায়াতলে ফরমায়েসি ভ্রষ্ট ইতিহাস।