সুপ্রভাত
আমি তো সকাল-সন্ধ্যা থাকি নানা কাজে, ব্যস্ততার
ধূলো ওড়ে সত্তাময়। সময় খরচ হতে থাকে
যথারীতি, কিন্তু সময়ের কতটুকু কোন্ ফাঁকে
আমর নিজস্ব হয়? সময়ের মুঠো থেকে আকসার
স্বর্ণ চূর্ণ নয়, বালি ঝরে, একটি কি দুটি কণা, যার
উপস্থিতি হিরন্ময়; তার আনুকূল্যে কিছু ঘটে
রূপান্তর বাস্তবের, ভিন্ন মাত্রা লাগে প্রেক্ষাপটে।
তবু সর্বদাই ভয় থাকে সবকিছু হারাবার।
বিশেষত মধ্যরাতে কালো নিঃসঙ্গতা আরো বেশি
ব্যেপে এলে মজ্জায় আমার নানা ধ্বনি, খাপছাড়া,
শুনে কণ্টকিত হয় সত্তা, মনে হয়, অকস্মাৎ
কেউ যেন করবে ঢোকার জন্যে দিচ্ছে খুব তাড়া।
খেচরের ডাকে রাত্রি আরো দীর্ঘ হয়; হে সুকেশী
তোমাকেই ভাবি শুধু তুমিই আমার সুপ্রভাত।
সুহৃদের প্রতি
যেও না ঘাসের কাছে, ইদানীং ঘাস খুব হিংসাপরায়ণ।
যেও না নদীর কাছে, নদী তার ভুলেছে মমতা;
তাণ্ডবের মোহে স্ফীত হয়, তেড়ে আসে
অজগর হয়ে বারংবার, গিলে খায়
ঘর-গেরস্থালি।
যেও না টিলার কাছে, অতিকায় করোটির মতো
টিলা আপনার অভ্যন্তরে নিয়ত লুকিয়ে রাখে ক্রোধ।
যেও না মরুর কাছে, রাশি রাশি বালি
কর্কশ চিৎকারে করে গ্রাস সভ্যতাকে।
অরণ্যের কাছে যাবে? জানো না কি অরণ্য কেমন ভয়ংকর?
এখন তোমার জন্য হাঁ-খোলা পাতাল
জেগে আছে সবখানে। ফুলবাগানের
লতাপাতা অপরূপ লাস্যে জ্বলে উঠে
কখন সাপের ফণা হয়ে যাবে, কিছুতে পাবে না টের তুমি।
থমকে দাঁড়াও কেন হে আমার নিঃসঙ্গ সৃহৃদ?
কেন এত দ্বিধান্বিত নিজস্ব চৌকাঠ ছেড়ে দূরে
যেতে হে বিবাগী পর্যটক? বরং হে বন্ধু তুমি
যাও স্মিত যাও ট্রাউজারের পকেটে
হাত পুরে, শিস দিতে দিতে, যাও মানুষের কাছে।
কখনো বিকেল বেলা আলতো নাড়তে পারো কড়া
কারো দরজায়, কিংবা নিঃশব্দে চেয়ার টেনে নিয়ে
সহজে বসতে পারো চায়ের আসরে।
মানুষের কাছে যাও, নাও মানুষের হৃদয় গোলাপ ঘ্রাণ।
কেন না মানুষ আর হিংস্রতা কখনো
কখনো হাসির খাপে পুরে পূর্ণিমায় চিতাবাঘের মতন
অত্যন্ত উজ্জ্বল হয় সাবলীলভাবে।
এমনকি খুব মন্দ লোকও রমণীকে ভালবেসে
রাত্তিরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, রক্তজবা-পদ্য লেখে
নিষ্করুণ নিদ্রাহীনতায় কুকুরের মাথায় বুলায় হাত,
খেলা করে, শিশুদের খেলাঘরে, বিবর্ণ রোগীকে
সতেজ ফুলের তোড়া উপহার দেয়।
মৃত্যু-ঘেঁষা বিবাদের পরেও মানুষ
সবকিছু ভুলে করে শক্রকে অম্লান আলিঙ্গন।
তবু কেন আজও
কালো অবিশ্বাসের কুণ্ডলী নড়ে ওঠে
বারংবার? কেন মনে হয় প্রত্যেক মানুষ তার
নিজস্ব প্রকৃত মুখ ছিমছাম মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে
পথ হাঁটে, আস্তিনের নিচে রাখে অস্ত্রের বাহার!
যে যাই বলুক, তুমি হে আমার নিঃসঙ্গ সুহৃদ,
মানুষের দিকে উষ্ণ হাত নিয়ত বাড়িয়ে দাও।
তোমার নিকট এলে যে-কোনো অতিথি
যে-কোনো প্রহরে,
‘কেমন, ভালো তো’ বলে তাকে ঘরের ভেতরে, মানে
হৃদয়ের কাছে ডেকে নাও।
স্বপ্নাচ্ছন্ন মানুষের মতো
যখন নিঃশব্দে আমি স্বপ্নাচ্ছন্ন মানুষের মতো
পেরিয়ে গেলাম গেট, তখন কি আগের মতোই
ফুলগাছগুলি ছিল অভ্যর্থনাপরায়ণ? তুমি
কতকাল পরে পুনরায় নিয়ে গেলে শান্ত ঘরে।
সোফায় বসেই আমি চকিতে নিলাম মৃদু ঘ্রাণ
ড্রইং রুমের যেন অতীতের। যখন তাকালে
আমার চোখের দিকে তুমি, ফিরে এলো অপসৃত
যৌবন আমার নিমেষেই। যখন আশার সব
পায়রা নিশ্চিহ্ন, ঠিক তখনই আবার তুমি দিলে
ডাক, আমি ঝঞ্ঝাহত একা পথিকের মতো ফিরে
এলাম আপন ঘরে। দেখি সেই মুখ, সেই স্তন,
পবিত্র কপোতদ্বয়, যাদের করে না স্পর্শ কোনো
পুণ্যার্থী কখনও, আমি তোমার স্মৃতিকে চুমো খাই,
যেমন কায়েস খেতো হরিণের মুখে বিরানায়।
স্মৃতিময় উজ্জ্বল আঁধারে
খারাপ লাগছে এই নিস্তরঙ্গ সতেজ সকালে।
গুচ্ছ-গুচ্ছ পাতার আড়ালে
ফুল ফুটে আছে, পাখি সুন্দরের পাশে
বসে গান হয়, শৈশবের মতো কিছু মেঘ ভাসে
স্বরণমন্থনকারী আসমানে, অথচ আমার
খারাপ লাগছে খুব। যেন হৃদয়ের ঝোপঝাড়
ভীষণ বিশীর্থ আর জোনাকিবিহীন। আপতত
মুখ ধুতে রুক্ষ গালে ঘষতে বুরুশ কিংবা সুদীর্ঘ বিগত
রাত্রির জামাটা বদলাতে লাগছে না ভালো
কিছুতেই; মগজের রাশি রাশি কালো
আমাকে রেখেছে ঘিরে আপাদমস্তক, মনে হয়
ক্রমাগত যাচ্ছি ডুবে দীর্ঘ কৃষ্ণকায় ঘাসে; ভয়, তাই ভয়।
কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে পট। শত-শত কুশীলব
নব্য নায়কের করে স্তব
বেজায় পুরোনো সুরে, হয় নতজানু সারি সারি
পুরুষ ও নারী
ইস্পাতি নির্দেশে, মাঝে-মাঝে ওরা কী যেন কুড়ায়
ডানে-বামে, অকস্মাৎ যখন ফুরায়
মেকী সে উৎসব, জিভে তীব্র তেতো স্বাদ ঝুলে থাকে
সরাক্ষণ, ভাঙা দঙ্গলের ভেতরে কে কাকে ডাকে,
বোঝা দায়, এলোমেলো প্রেতারিত পদধ্বনি বাজে
চতুষ্পার্শ্বে, রুক্ষ শব্দরাশি মেশে আরো বেশি কর্কশ আওয়াজ।
খারাপ লাগছে এই নিস্তরঙ্গ সতেজ সকালে।
কী যে হয় চোখে পড়ে দূরে শুকনো ডালে
ঝুলছে তোমার জামা, যেন এক খণ্ড মেঘ, আবার হঠাৎ
প্রজাপতি হয়ে ওড়ে, ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে, শূন্য হাত
জামার ভেতরে কেলিপরায়ণ। আমার কাঁধের বারান্দায়
কে এক রঙিন পোস্টম্যান ভাসমান, ডেকে যায়
প্রহরে প্রহরে কখনও-বা পল্লবের ভিড় থেকে
সহসা বেরিয়ে আসে হলদে মসলিনে মুখ ঢেকে,
অথচ জরুরি খাম, টেলিগ্রাম, কিছুই করে না বিলি, শুধু
নাচায় বাদামি ব্যাগ ধু ধু
দিগন্তের দিকে আর একজন দলছুট অন্ধ কবি জীর্ণ রাজবেশে
চলে নিরুদ্দেশে।
আমিও বেরিয়ে পড়ি মাঝে-মাঝে চোখ-কান বুজে
মায়াবী চপ্পল পায়ে, খুঁজে
বেড়াই তোমাকে রাত্রিদিন তুমিহীন
এ শহরে, কবেকার টেলিফোন পোল, ডাকবাক্স ম্যান্ডোলিন
সময়ে মলিন হতে থাকে আর ঘরে ফেরা মানে
নিজের কাছেই ফিরে-আসা জেনে অন্তর্গত টানে
বারংবার চলে আসি স্মৃতিময় উজ্জ্বল আঁধারে একা একা,
বিরূপ হাওয়ায় লুপ্তপ্রায় পদরেখা।