Site icon BnBoi.Com

এক ফোঁটা কেমন অনল – শামসুর রাহমান

এক ফোঁটা কেমন অনল - শামসুর রাহমান

আত্মচরিত

কী করে করবো শুরু? কোনো সূত্র চিন্তার রোদ্দুরে
ঝলসে ওঠে না, শুধু ভেবে মরি। রাজরাজড়ার
তালিকায় নামগোত্র নেই কিংবা মোটরে বেড়ালে
জয়মালা হাতে জনসাধারণ থাকে দাঁড়িয়ে
মুখরিত রাস্তার দু’পাশে; আমার প্রস্তরমূর্তি
জানি এ শহরে করবেন না উদ্ঘাটন কোনোদিন
নধর নগরপালা কোনো। তবু আমি ধার-করা
ধড়াচূড়া নিয়ে হবো হাজির প্রকাশ্যে? কল্পনার
সেজবাতি জ্বেলে এক বন্ধ ঘরে কুলের ঠিকুজি
বানাবো আপন মনে প্রাচীন কবির মতো? এই
ঝলমলে রঙ্গালয়ে অতি গৌণ আমার ভূমিকা।
তবু কেন অক্ষরে অক্ষরে আত্মকথা সাজাবার
সহসা খেয়াল হলো, এ সওয়াল অসঙ্গত নয়।
জবাবে বলতে পারি, মর্ত্যের মানুষ মাঝে মাঝে
এমন অনেক কিছু করে, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই,
অথবা আদপে নয় যুক্তিসিদ্ধ। যদিও আমার
জন্ম জানি জগৎ সংসারে কোনো ঘটনা হিশেবে
এমনকি জন্মকানা ডোবায় ব্যাঙের লাফও নয়,
তবু প্রথামতো শুরুতেই জন্মবৃত্তান্তের খেই
ধরা যাক।

উনিশ শো ঊনত্রিশ সালে অক্টোবরে
জন্মেছি ঢাকায় আমি ছায়াচ্ছন্ন গলির ভেতরে
ভোরবেলা নিম্নমধ্যবিত্ত মাতামহের নিবাসে।
আমার সুদূর পূর্ব পুরুষেরা আরব ইরান
কিংবা মধ্যপ্রাচ্যস্থিত অন্য কোনো দেশ থেকে তেজী
ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অথবা উত্তাল সমুন্দরী
কিস্তিতে খাটিয়ে পাল এই বঙ্গদেশে পদার্পণ
করেছেন কিনা, এই তথ্য নিয়ে কস্মিনকালেও
তুলি নি চায়ের কাপে ঝড়। এদেশের মাটিতেই
আমার নিজস্ব সব শেকড়-বাকড় জেনে খুশি।

পাঁচটি দশক গেছে, যেন এক্সপ্রেস ট্রেন দ্রুত
যাচ্ছে ছুটে, মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্টেশন নিমেষে
ঝলসে উঠছে শুধু। সময়ের খর দন্তচিহ্ন
ভয়ানক ব্যাপ্ত আজ ঝলসানো অস্তিত্বে আমার।
অথচ সেদিন আমি ঝুলিয়ে খয়েরী ব্যাগ কাঁধে
মর্নিং ইশকুলে গেছি শিউলি ফুলের ঘ্রাণ শুঁকে,
পেরিয়ে অনেক অলিগলি ছুটি শেষে কাচবন্দি
দুলদুল ঘোড়া দেখে। বলেছি পাখির সঙ্গে কথা,
গোলাপের সঙ্গে আমি জুড়েছি আলাপ বারংবার-
বাস্তবে হরিণ না দেখেও হরিণ শব্দটি দেখে
চলে গেছি সে কোন্‌ গভীর বনে মনে মনে আর
ঝর্ণার পানিতে মুখ দেখতে পেয়েছি স্বচ্ছতায়-
দর্পণের অন্তরালে দেখেছি দর্পণ।

কখন যে
আমার নিজেরই অগোচরে খুঁজতে করেছি শুরু
বৃষ্টিভেজা সরু গলি, স্পন্দিত গাছের পাতা, জীর্ণ
জুতো, রোদ-নাওয়া গিরগিটি, পোড়োবাড়ি, স্নানরতা
তরুণীর বিহ্বল নগ্নতা, মৃত্যুপথযাত্রী চোখ,
পাখির বাসায় কী ব্যাকুল কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা।
আজকাল প্রুফকের ঢঙে পথ হাঁটি, ঢিলেঢালা
ট্রাউজারে পরাবাস্তবের চন্দ্রধূলি, শস্তা কোনো
চাখানায় বসে ঢুলি, শুনি সেই কবেকার গান,
পক্ষিরাজ উড়ে যায় মেঘের আড়ালে, বাল্যসখী
পাশে এসে হাত ধ এ দেয় টান, অথচ সে জানি,
কয়েক বছর আগে মারা গেছে, আমিও তো নিত্য
একটু একটু করে মরছি নিশ্চিত। ক্রমাগত
বড় বেশি লোভী হয়ে উঠছে চিরুনি শাদা-কালো
আমার চুলের জন্যে। চখ দুটো আগেকার মতো
নেই আর, বেশিক্ষণ বইয়ের পাতায় রাখলেই
খচ্‌খচ্‌ করে, বড় কষ্ট পাই, তখন চোখের
পাতা বুঁজে রাখলে আরা, বুঝি পঞ্চাশের পরে
এরকমই হয়, হতে থাকে। আজ আমি বড় একা,
বন্ধুরা যে-যার মতে পথে পর্যটক, কোনোখানে
জমে না তেমন আড্ডা। মেয়েরা স্বামীর ঘর করে,
ছেলেটা এড়িয়ে চলে সকল সময়। আর যিনি
জীবনসঙ্গিনী তিনি সম্প্রতি আছেন মেতে তার
নাতি নিয়ে সারাক্ষণ। আমি শুধু কাকতাড়ুয়ার
মতো থাকি এ সংসারে নির্জন নেপথ্যে। মৃত্যু যত
কাছে আসে ততই জীবনতৃষ্ণা যায়, বেড়ে যায়।
কখনো-সখনো

বই থেকে চোখ তুলে দেখি নীল
আসমান, পায়রার ওড়া, রৌদ্রে হাতের রুলির
নড়া কারো, কখনো-বা স্বদেশ ভাবনা ব্যেপে আসে।
বাংলাদেশ আমার আপন দেশ, তবু আমি নই
বাঁধা এই ভৌগোলিক সীমায় কখনো; এই বিশ্বে
যেখানে জননী তার সন্তানের মুখে তুলে দ্যায়
স্নেহার্দ্র খাবার, আর যে-দেশে প্রেমিক তার লাজ-
রক্তিম নারীর কানে কানে বলে নিত্য প্রেমকথা,
যে-দেশে শিশুরা পথে কিংবা নদীতীরে আনন্দের
ঢেউয়ে ভেসে বানায় বালির দুর্গ, যে-দেশে তরুণী
গলা ছেড়ে গান গায়, যে-দেশে এখনো পাখি ঠোঁটে
বয়ে আনে খড়কুটো, বানায় নিজস্ব বাসা আর
যে-দেশে কবির বাণী গভীর ধ্বনিত হয় প্রেমে,
শ্রমে নিত্য প্রাণে, সেই দেশই স্বদেশ আমার।

 আমাকে একটি গল্প

আমাকে একটি গল্প বলেছেন স্তব্ধ মধ্যরাতে
স্বপ্নের ভেতর শেখ ফরিদ উদ্দীন
আত্তার প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে, যেন রবারের সুর
ঝরে যায় সুরভিত উদ্যানে। সে গল্প
কেমন অচিন রাগিণীর মতো বাজে আমার সত্তায়-

“একটি ময়ূর ছিল রাজার উদ্যানে
রঙ-বেরঙের পাখি এবং ময়ূর-ময়ূরীর
সঙ্গে ঘুরে ফিরে
দেখতে নিজের কলাপের কত বসন্তবাহার, পাখিদের
গানে প্লুত দিকগুলি হতো আলোর ঝালর
কখনো এবং মাঝে-মাঝে
নিজেও উঠতো ডেকে, হতো নৃত্যপর।

“একদিন রাজাজ্ঞায় তাকে মুড়ে দেয়া হলো কালো
চামড়ার আবরণে আপাদমস্তক। কে না জানে
রাজরাজড়ার শত শত
কাহিনী অদ্ভুত খেয়ালের। চামড়ার
অত্যন্ত সংকীর্ণ কারাগারে পেতো খেতে
শস্যকণা নিয়মিত দু’বেলা। নিজের কলাপের
শোভা গেল ভুলে, ক্রমান্বয়ে উদ্যান, ময়ূরসংঘ,
সবকিছু হলো সে বিস্মৃত।
নাছোড় কুৎসিত চামড়ার অন্তরালে
কাটে তার বেলা আর কখনো সখনো
ফুলের সৌরভ ভেসে এলে
কী এক অজানা আকাঙ্ক্ষার গান হতো মঞ্জরিত
আচ্ছন্ন অস্তিত্বে তার। হঠাৎ শুনলে
কেকাধ্বনি কিংবা কোনো পাখির উদ্যানপ্লাবী গান
কেমন দিব্যতা ছুঁয়ে যেতো তাকে। এরপর কিছু
অন্যকিছু বলেন নি মরমী আত্তার।
এবং সহসা তিনি উঠে দাঁড়ালেন
আমার শিয়র থেকে স্বপ্নের ভেতরে,
কর্কশ খিরকা তাঁর সহজিয়া হাওয়ায় বিলীন
মেঘের ছায়ার মতো। তারপর আমি সে অচিন স্বপ্নস্থিত
ময়ূরের কথা
ভেবেছি অনেক দিন। হতচ্ছাড়া চামড়ার বন্দিদশা থেকে
কখনো পাবে কি মুক্তি সে আবার? এখন ভাবতে ভালো লাগে
কোনো একদিন
আকাঙ্ক্ষার গান তার লুকানো সত্তায়
প্রবল বইয়ে দেবে শক্তির নির্ঝর
এবং পড়বে খসে দেহলগ্ন চামড়ার খাঁচা অকস্মাৎ, পুনরায়
অদৃশ্য কলাপ তার হবে লীলায়িত
গুণীর তানের মতো উদ্যানের সুগন্ধি হাওয়ায়।

আমার মাতামহের টাইপরাইটার

ভাবছিলাম কবি আলাওলের চোখ আয়ত ছিলো কিনা;
ভাবছিলাম কাদম্বরী দেবী, জেদী মেয়ে,
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে যেদিন মরণ-গহন আফিম খেলেন,
সেদিন তিনি যে শাড়ি পরেছিলেন, কী রং ছিল তার;
ভাবছিলাম, আউসভিৎসের কন্সেনট্রেশনক্যাম্পে বন্দি ছিলেন যাঁরা
তাদের জীবনের চালচিত্র ছিল কী রকম, ভাবছিলাম
অনেক মুণ্ডিত মাথা আর ডোরাকাটা পোশাকের কথা;
উপনিষদ তর্জমা করবার সময়
যুবরাজ দারাশিকোর মনে মুঘল তরবারির ছায়া
নাকি বৈদিক ঋষির তপোবনের হরিণশিশুর কোমলতা
লতিয়ে উঠেছিলো। যে-পথে যীশু সুসমাচার শোনাতে শোনাতে
হেঁটে গেছেন, সে-পথের কথাই আমি ভাবছিলাম।

এমন সময় আমার মাতামহের শেরওয়ানীর রঙের মতো
মেঘমালায় কী যেন একটা জেগে ওঠে।
মুহূর্তের জন্য মনে হয়, হয়তো শরীরের গ্রন্থিগুলি
বিশ্রাম নিচ্ছে স্বপ্নাচ্ছন্নতায়; আমার মাথার ভেতরে
স্বপ্ন ফুটিয়ে চলেছে এমন ফুল, যার ঘ্রাণ স্থান-কাল-পাত্রকে গালিয়ে
সৃষ্টি করে একটি সোনালি ধারা। মেঘমালা থেকে
কোনো অনার্য দেবতার মাথার মতো
উঠে এলো আমার মাতামহের টাইপরাইটার।
কয়েক দশকের লতাগুল্ম গায়ে নিয়ে ভেসে ওঠে
কোন নিরুদ্দেশ থেকে; দেখেই চিনে ফেললাম, বলা যাবে না।
বলা যাবে না, ওকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যই আমি
প্রতীক্ষায় আছি। প্রথমে সে দুলতে শুরু করে
একটু একটু করে, কোনো ব্যালে নর্তকের পরিচিত ভঙ্গি
স্মরণ করিয়ে দিয়ে, তারপর সে বসে আমার বুকের ওপর,
আমার মাতামহের সেই কবেকার বিলুপ্ত টাইপরাইটার।
আমি সেই টাইপরাইটারের সঙ্গে মূসাবা করে
বললাম, হে প্রাচীন হে দানেশমন্দ, আমার এই
খারাগ্রস্ত সত্তায় নামুক আপনার দোয়ার বৃষ্টিধারা। আমার হাতের
স্পর্শ পেয়ে তিনি উচ্চারণ করলেন স্বপ্ন থেকে জেগে-ওঠা
সুদূর, গাঢ় কণ্ঠে-তোমার নানী তোমার বাজুতে
একটা তাবিজ পরিয়ে দিয়েছিলেন বালকবয়সে,
তোমার মনে পড়ে? খেলার মাঠে কোনো এক ঝোড়ো সন্ধ্যাবেলা
তুমি সে তাবিজ হারিয়ে ফেলেছিলে, মনে পড়ে? মনে পড়ে
কারুকাজময় পালঙ্কে পাতা বিছানার কথা? বালিশ-পাখির নীড়,
আর বালিশে-রাখা কারো মাথা-পাখি, তোমার মনে পড়ে?
মনে পড়ে বিধবা ফুফুর কথা, যিনি
তোমার মাথার ঘ্রাণ নিয়ে সুরাপূত করতেন তোমাকে
খোড়ো ঘরের চালঘেঁষা পেয়ারা গাছের নিচে? মনে পড়ে
তাঁর কথা, যিনি তোমাকে একবার দা-এ রাখা
নুন খাইয়েছিলেন, তুমি ঘুরঘুট্রি অন্ধকারে ভয় পেয়েছিলে বলে?

কতকাল তাবিজবিহীন আমি কাটিয়েছি দিন,
কী করে যে কেটে গেল পঞ্চাশ বছর।

আমার মাতামহের টাইপরাইটার আবৃত্তি করছেন
কোরানের আয়াত, আওড়াচ্ছেন ফার্সি বয়েত। আমার স্বপ্নের দ্বীপে
তিনি প্রস্পেরো
প্রজ্ঞাবান আর ঐন্দ্রজালিক, যিনি এইমাত্র ভেঙে ফেলেছেন
তার দণ্ড, সমুদ্রে ডুবিয়ে এসেছেন পুঁথি। তাঁর কিবোর্ড থেকে
অবিরাম ঝরছে জুঁই চামেলীর মতো শব্দমালা;
যে-আমি ছিলাম প্রেরণারহিত, বন্ধ্যা গুহায় কুঁকড়ে-পড়ে-থাকা
সে আমি তর্জমা করে চলেছি টাইপরাইটার-নিঃসৃত শিল্পিত শব্দমালা
কী মোহন ভূতগ্রস্ততায়! কখনো আস্তে-সুস্থে, কখনো-বা
খুব দ্রুত, যতক্ষণ না ক্লান্তি এসে ভর করে চলমান কলমের ডগায়।

আমি কি স্বপ্নের কাছে

আমি কি স্বপ্নের কাছে কলমি শাক অথবা গাঁজর
চেয়েছি কখনো? চেয়েছি কি চাল ডাল, তেল নুন
অথবা কমলালেবু; পুরুষ্ট-আপেল? গোপালনে
উৎসাহ চেয়েছি নাকি রাশি রাশি শার্ট, ট্রাউজার
অথবা নিদেনপক্ষে সিল্কের রুমাল চেয়ে আমি
অত্যন্ত উদোম ভাবে করেছি প্রকাশ কাতরতা
প্রত্যহ আপনকার স্বপ্নের নিকট? বনচর
প্রাণীদের গন্ধময় পথের হদিস কিংবা কোনো

ভূগর্ভস্থ সভ্যতার সন্ধান চাই নি কোনোদিন।
একান্ত চেয়েছি শুধু গোধূলিতে আর্ত পাখিদের
ঝড়ভ্রম ভেদ করে একটি হ্রদের তীরে পৌঁছে
যেতে, যেখানে সে বসে থাকে, মনে হয় স্বপ্নাবেশে
হাঁটুতে চিবুক রেখে। চেয়েছি স্বপ্নের কাছে শুধু
তার স্তন যুগলের ডাগরতা, অনন্য মুখশ্রী।

এই মাতোয়ালা রাইত

হালকা আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের
লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্রির খানকি
মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন
আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান
আন্দরমহলে হাঁটে। মগর জমিনে বান্ধা পাও।

আবে, কোন্‌ মাম্‌দির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার,
দেহস্‌ না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;
না অইলে হোগায় লাথ্‌থি খাবি, চটকানা গালে।
গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলতাছে বেশুমার।

আমারে হগলে কয় মইফার পোলা, জুম্মনের
বাপ, হস্না বানুর খসম, কয় সুবরাতি মিস্ত্রি।
বেহায়া গলির চাম্পা চুমাচাট্রি দিয়া কয়, ‘তুমি
ব্যাপারী মনের মানুষ আমার, দিলের হকদার।

আমার গলায় কার গীতি হুনি ঠাণ্ডা আঁসুভরা?
আসলে কেউগা আমি? কোন্‌হানতে আইছ হালায়
দাগাবাজ দুনিয়ায়? কৈবা যামু আখেরে ওস্তাদ?
চুড়িহাট্রা, চান খাঁর পুল, চকবাজার; আশক
জমাদার লেইন; বংশাল; যেহানেই মকানের
ঠিকানা থাউক, আমি হেই একই মানু, গোলগাল
মাথায় বাবরি; থুতনিতে ফুদ্দি দাড়ি, গালে দাগ,
যেমুন আধলি একখান খুব দূর জামানার।
আমার হাতের তালু জবর বেগানা লাগে আর
আমার কইলিজাখান, মনে অয়, আরেক মানুর
গতরের বিতরে ফাল পাড়ে; একটুকু চৈন নাই
মনে দিল জিঞ্জিরার জংলা, বিরান দালান। জানে
হায়বৎ জহরিলা কেঁকড়ার মতন হাঁটা-ফিরা
করে আর রাইতে এমুনবি অয় নিজেরেও বড়
ডর লাগে, মনে অয় যেমুন আমিবি জমিনের
তলা থন উইঠা আইছি বহুম জমানা বাদ।

এ কার মৈয়ত যায় আন্ধার রাইতে? কোন্‌ ব্যাটা
বিবি-বাচ্চা ফালাইয়া বেহুদা চিত্তর অইয়া আছে
একলা কাঠের খাটে বেফিকির, নোওয়াব যেমুন?
বুঝছোনি হউরের পো, এলা আজরাইল আইলে
আমিবি হান্দামু হ্যাষে আন্ধার কব্বরে। তয় মিয়া,
আমার জেবের বিতরের লোটের মতই হাচা মৌত।

এহবি জিন্দা আছি, এহনবি এই নাকে আহে
গোলাব ফুলের বাস, মাঠার মতন চান্নি দিলে
নিরালা ঝিলিক মারে। খোওয়াবের খুব খোবসুরৎ
মাইয়া, গহীন সমুন্দর, হুন্দর পিনিস আর
আসমানী হুরীর বারাত; খিড়কির রৈদ, ঝুম
কাওয়ালীর তান, পৈখ সুনসান বানায় ইয়াদ।
এহনবি জিন্দা আছি, মৌতের হোগায় লাথ্‌থি দিয়া
মৌত তক সহি সালামত জিন্দা থাকবার চাই।

তামাম দালান কোঠা, রাস্তার কিনার, মজিদের
মিনার, কলের মুখ, বেগানা মৈয়ত, ফজরের
পৈখের আওয়াজ, আন্ধা ফকিরের লাঠির জিকির-
হগলই খোওয়াব লাগে আর এই বান্দাবি খোওয়াব!

একটি ফটোগ্রাফ

‘এই যে আসুন, তারপর কী খরব?
আছেন তো ভালো? ছেলেমেয়ে? কিছু আলাপের পর
দেখিয়ে সফেদ দেয়ালের শান্ত ফটোগ্রাফটিকে
বললাম জিজ্ঞাসু অতিথিকে-
‘এ আমার ছোট ছেলে, যে নেই এখন,
পাথরের টুকরোর মতন
ডুবে গেছে আমাদের গ্রামের পুকুরে
বছর-তিনেক আগে কাকডাকা গ্রীষ্মের দুপুরে।

কী সহজে হয়ে গেল বলা,
কাঁপলো না গলা
এতটুকু বুক চিরে বেরুলো না দীর্ঘশ্বাস, চোখ ছলছল
করলো না এবং নিজের কণ্ঠস্বর শুনে
নিজেই চমকে উঠি, কী নিস্পৃহ, কেমন শীতল।
তিনটি বছর মাত্র তিনটি বছর
কত ঊর্ণাজাল বুনে
কেটেছে, অথচ এরই মধ্যে বাজখাঁই
কেউ যেন আমার শোকের নদীটিকে কত দ্রুত রুক্ষ চর
করে দিলো। অতিথি বিদায় নিলে আবার দাঁড়াই
এসে ফটোগ্রাফটির মুখোমুখি প্রশ্নাকুল চোখে,
ক্ষীয়মাণ শোকে।

ফ্রেমের ভেতর থেকে আমার সন্তান
চেয়ে থাকে নিষ্পলক, তার চোখে নেই রাগ কিংবা অভিমান।

কবিতাপাঠ

অনুগ্র আলোয় তুমি পড়ছিলে বিদেশী কবিতা
নিভৃত ড্রইংরুমে। ছিলাম তোমার পাশে বসে
ধ্বনিবন্দি; শব্দগুচ্ছ মায়াবী পাতার মতো খসে
উড়ছিল তোমার অনিন্দ্য স্বরায়নে, হে ঈপ্সিতা।
সে মুহূর্তে মনে হলো তুমি স্নিগ্ধ, প্রজ্ঞাপারমিতা,
শুনিয়ে অমোঘ সুর কবিতার চলেছো আমাকে
নিয়ে দূর ছায়াচ্ছন্ন নিবাসে, সেখানে যারা থাকে
তারা নয় চেনা তবু সবাই স্বজন, পরিচিতা।

কবিতাপাঠের পর কিছু অলৌকিক গুঞ্জরণ
থেকে যায় অথৈ স্তব্ধতায়, তুমি আশ্চর্য তাকালে
আবার আমার দিকে। একি দৃশ্য দেখি অপরূপ-
তোমার শরীর শবেবরাতের দীপের মতন
জ্বলে, চোখে অনন্তের আলো-ছায়া, আমিও নিশ্চুপ
বসে থাকি; দুর্লভ এ নান্দনিক লগ্ন ক্রান্তিকালে।

কবির কবর

রাস্তার সকল বাতি নিভে গেলে গভীর নিশীথে,
পৃষ্ঠপোষকতাহীন জ্বলে নেভে জোনাকির ঝাঁক,
দুলিয়ে স্বপ্নিল পাখা মেঘ চিরে সফেদ বোররাক
সপ্ত আসমান থেকে আসে নেমে এই সমাধিতে,
স্তব্ধ ঘাসমাটি ভিন্ন মানে পায় খুরের সংগীতে।
মাটিতে লুকানো যিনি স্বপ্নভস্মবৎ, তাঁরই নাম
দুরন্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
এখানে ফেরেশ্‌তা আসে কিছু নক্ষত্র ছিটিয়ে দিতে।

যখন ভোরের আলো বীণার ঝংকার হয়ে কাঁপে
মিনারে মাটিতে আর মানুষ চলার শব্দ ফোটে
পুনরায়, পুলিশ বাজায় বাঁশি কর্তব্যবশত,
কবির কবর কোনো দুঃখবাদী কবিতার মতো
কিছু রুক্ষ, ম্লান, কিছু খুব দ্যুতিময় হয়ে ওঠে।
কে উদাসী বাঁশিতে তুলছে তান মন্থর বিলাপে?

কুমোর

চোখে পড়বার কিছু নয়। শ্যামবর্ণ, মাঝারি গড়ন,
খাটো চুল ভাঙা গাল এবং ধরন
তার আর দশজন পাড়াপড়শিরই মতো। ডাল-ভাত খায়
প্রত্যহ দু’বেলা-মাঝে মাঝে রাত্তিরে ঘুমায়
জড়িয়ে কোমর ঘরণীর, যতদূর আছে জানা
বিড়ি ফোঁকে, কড়া দাড়ি কামায় রোজানা।

কী শীত কি গ্রীষ্ম
ঘোরে চাকা, চকচকে, গড়ে ওঠে ঢের
ঘটিবাটি, হাঁড়িকুড়ি নানান চাঁদের
হাতের খানিক চাপে। একান্ত আপন তার হাত,
নিশ্চিত জানে সে জগন্নাথ।
রত্নের ঝলক বুকে সারাক্ষণ, অথচ কী নিঃস্ব!

কী-যে হয় মাঝে মাঝে,
বসে থাকে চুপচাপ চাখানায় কিংবা গৃহকোণে;
কিছুতে লাগে না মন তার কোনো কাজে।
আবার কখনো রাত জেগে তারা গোনে,
এক ফোঁটা কেমন অনল
করে জ্বলজ্বল
হৃদয়ের ভেতরে, আঙুলগুলি বাস্তবের সীমা
পেরিয়ে চঞ্চল হতে থাকে অবিরত
প্রকৃত নাচের আগে নর্তকীর মতো,
ছুঁতে চায় দ্রুত পরাবাস্তবের গহন দ্রাঘিমা।

তখন নির্জন তার ধ্যানে প্রত্যহের ঘটিবাটি
নয়, নয় গাঢ় কি কলস, একজন অস্পষ্ট প্রতিমা
জেগে থাকে। প্রত্যহ সযত্নে জমায় সে ভিন্ন মাটি
প্রতিমা গড়বে বলে। গড়া হলে দ্যাখে ধ্যানে তার
যে চোখ, উদ্বেল স্তন উঠেছিল ভেসে
তা নেই মূর্তিতে; তাই ঘুমহীন প্রহরের শেষে
ক্ষিপ্র সে খুবলে নেয় চোখ,স্তনদ্বয়। ব্যর্থতার
বিছে তার আত্মাকে কামড়ে ধরে। আবার মাটির দলা তুলে
নেয় হাতে, অস্তিত্বের সমস্ত তীব্রতা দিয়ে গড়ে,
ভাঙে, পুনরায় গড়ে, ভাঙে ফের, ভুলে
থাকে স্রেফ নিজের সংসার। মূর্তি প্রতিবাদহীন,
আর্তনাদ করে না কখনো,
কেননা মাটির কণ্ঠস্বর নেই কোনো।
কুমোর ছোঁয় না অন্নজল, রাত্রিদিন
বুকের ভেতরে তার আলো অন্ধকার,
অলৌকিক উন্মত্ততা ঘূর্ণিনাচ নাচে সারা ঘরে।

 ক্রূর বিনাশের ছলে

হৃদয় তুমি কি এই জন্মন্ধ আঁধারে
অচেনা পথের ধারে
ভুলে প্রাণীভুক পাদপের গলা প্রবল জড়িয়ে
ধরেছো আশ্রয় ভেবে? পত্রালি সরিয়ে
দ্যাখো কী ভীষণ সাপ দোলাচ্ছে চিত্রল ফণা তার।
স্বপ্নাশ্রিত পথচারী তুমি বারংবার
একই পথে পদচিহ্ন আঁকবার তীব্র অভিলাষ
পারো নি করতে ত্যাগ কিছুতেই। এ কেমন মরীয়া বিলাস
সর্বদা লালন করে
নিজেকেই নিয়ে গ্যাছো ধুধু শুশুনিয়া তেপান্তরে।

হৃদয় হলো না বিজ্ঞ তুমি
আজো, বুঝলে না, হায়, কাকে বলে বিষবাষ্পময় জলাভূমি,
কাকে রৌদ্রজ্যোৎস্নাঝলকিত সরোবর; হাতে তুলে
নিলে অবলীলাক্রমে সুহাসিনী ভুলে
সহসা আপনকার মৃত্যুদণ্ড। সেই শোভা স্বপ্নের মতোই
অস্থায়ী জেনেও গলা ডুবিয়ে অথই
প্রতারক জলে তুমি তার দিকে রইলে চেয়ে প্রহরের পর
প্রহর এবং অবেলায় নিজ ঘর
গেরস্থালি
করেছো নীলাম কী মোহন বিভ্রমের কাছে আর করতালি
প্রত্যহ বাজাচ্ছো ঝাঁ ঝাঁ বাদ্যরবে, মেতে,
নিজেরই জ্বলন্ত কুশপুত্তলিকা দেখে। যেতে যেতে
লোকে বলে,
আজন্ম খেয়ালী তুমি, মেতেছো সৃষ্টিতে ক্রূর বিনাশের ছলে।

খেলা

আমার দু’বছরের নাতি বেজায় চঞ্চল, করে,
ছোটছুটি সকল সময়, ওর জন্যে সারাঘরে
কোনো কিছু ঠিক রাখা মুশকিল, হয়ে যায়
ওলট-পাল্ট সব চোখের পলকে। বিছানায়
লাফিয়ে পড়ে সে হয় বন্য টারজান। ছোট্র পায়ে
মারে রাঙা বল বার-বার; কখনো সে ডিঙি নায়ে
দাঁড় বায়, কখনো-বা বাগিয়ে বন্দুক তেড়ে আসে
হঠাৎ আমার দিকে। আমি কাঁপি অভিনীত ত্রাসে,
যখন সে অবিশ্বাস্য দানো হয়ে করে তছনছ
খুঁটিনাটি জিনিসপত্তর, তলোয়ারে খচ্‌খচ্‌
কাটে বায়বীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুণ্ডু। জেগে থাকে
যতক্ষণ, ততক্ষণ নানা খেলা ব্যস্ত রাখে তাকে।

আমিও তো এই নিশুটির মতো রয়েছি খেলায়
মেতে সারাক্ষণ, শব্দ নিয়ে খেলি শব্দের মেলায়।

ঠিকানা জানা নেই

কাব্যশ্রী আমাকে কিছুকাল আগে একটি চিঠিতে
লিখেছিল, “ভেবেছিলে চিরদিন থাকবো তোমার
হাত ধরে অন্ধকার ঘরে, শুধু এই চৌহদ্দিতে
লুটিয়ে আঁচল আমি আনন্দে বেড়াবো ঘুরে আর
আমাকে করবে তুমি খুচরো আদর হেলাফেলা
করে, যেন আমি পোষা বিড়াল, জঞ্জাল থেকে উঠে-
আসা?” মনে পড়ে, কতদিন তার চুলে রাত্রিবেলা
ঢেকে গেছে মুখ, বুক আমার এবং তীব্র ফুটে
উঠেছে কামের গন্ধরাজ সত্তাময়, কখনো-বা
দিয়েছি লাগিয়ে ব্রা-র হুক, দেখিয়ে কী নগ্নশোভা
নিয়েছে জড়িয়ে গায়ে শাড়ি
সাত তাড়াতাড়ি।

এখন সে নেই আর আমার নিবাসে। অকস্মাৎ
মাঝে-মধ্যে দেখি তাকে
বনানীর বাসস্টপে, হাত
নেড়ে আর উড়িয়ে আঁচল চলে যায়
কে জানে কোথায় দূরে! তখন আমার রক্তে ডাকে
একটি অচিন পাখি! যত্রতত্র ঘোরে গরবিনী
আজ এ তরুণ কাল সে যুবার সঙ্গে হাওয়ায় বেড়ায়,
কখনো জমায় গল্প কফিহাউসে, কখনো রিনিঝিনি
বেজে ওঠে রুলি তার মেথর পট্রিতে। আঁতিপাতি
খুঁজেও পাই না তার ঠিকানা নিজের কাছে। ভাবি
শুধু তাকে, যে ছিল একদা অষ্টপ্রহরের সাথী।
নেই কি আমার কোনো দাবি
আর তার কাছে? কালেভদ্রে চিঠি লেখে
ঠিকানাবিহীন দূর থেকে।

তাঁর উপদেশ সত্ত্বেও

সেই কবি আমি শার্ট আর ট্রাউজারের জঙ্গলে
প্রবেশ করেছি; বুটিদার জ্বলজ্বলে
কারুকাজময়
কত শার্ট আর কত রঙের বাহার।
চতুর্দিকে স্তূপ স্তূপ কোট, টাই, ফুল্ল জামিয়ার
আমার দু’চোখে আনে এভারেস্ট দেখার বিস্ময়।

হতভম্ব আমাকে জঙ্গলে দেখে একজন অনশনক্লিষ্ট
দরবেশ বললেন, ‘হয়ো না আবিষ্ট,
বরং গ্রহণ কর জামার সন্ন্যাস,
হও নাঙা বৃক্ষের মতন, যেন লকলকে ঘাস
তুমি, ভেবে নাও। অনন্তর আমার সে দীক্ষাগুরু,
অনশ্বর রৌদ্রে নাঙা ঘূর্ণি নাচ করলেন শুরু।

এরপরও কেটে গেছে দীর্ঘ কতকাল-
হা কপাল, এ আমার কেমন বন্ধন দশা আজো অব্যাহত!
বিশ শতকের অস্তরাগে স্বভাবত
আমার নিজস্ব মনোনীত প্রতারক বৃক্ষচ্ছায়ে
একাকী দাঁড়িয়ে আছি কশিদায় স্মিত মেরুন পাঞ্জাবি গায়ে।

তুচ্ছ মনে হয়

ক তার নিজের কাছে প্রত্যহ আপনকার ছবি তুলে ধরে,
চেয়ে চেয়ে দ্যাখে, ভালো করে, পষ্ট করে, সব কিছু
দেখে নিতে চায়।
অথচ ঝাপ্‌সা লাগে কত কিছু, কত কিছু ভীষণ বিকৃত;
চোয়াল চোয়ালে নেই, চোখ নেই চোখের কোটরে,
হস্তদ্বয় উদরসদৃশ,
মাথায় সুতীক্ষ্ণ শিং কম্পমান সারাক্ষণ। ক তার নিজের
ছবি দেখে একরত্তি হয় না বিস্মিত।
কপালে পড়ে না কোনো ভাঁজ,
একটু কাঁপে না ওষ্ঠ, চোখে নেই ঢেউ কোনো-একজন যন্ত্র
আরেক যন্ত্রকে যেন ভাবলেশহীন দ্যাখে বিভ্রান্ত আঁধারে।
‘কখন এমন পাল্টে গিয়েছি বলো তো’, নিজেকেই বারংবার
প্রশ্ন করে, নিরুত্তর বসে থাকে স্বপ্নহীন প্রহরে প্রহরে।

টিনের চেয়ারে বসে প্রায়শ ক দ্যাখে অন্তরালে
আলখাল্লা পরা ঐন্দ্রজালিক কী মায়া
গোপনে দেখায় তাকে যখন তখন। কখনো-বা
টিনের চেয়ার মেঘদেশে
মিশে যায়, খায় ঘুরপাক, রূপান্তরে সূর্যমুখী কোনোদিন,
কোনোদিন যাদুমন্ত্রে করে বশীভূত।
নইলে হাত কেন চেয়ারের হাতলের মতো, কেন
বুক টেবিলের স্তব্ধ বুকের মতন? এমনকি চশমাটাও
বড় টিন টিন হয়ে গ্যাছে!

ইদানীং ধবধবে জ্যোৎস্নাকে কম্বলে ঢেকে ক রঙিন বুদ্ধুদের মতো
পাখিদের বারে বারে দিয়েছে ফিরিয়ে, শেফালিকে
দিয়েছে বিদায়।
হঠাৎ ক শোনে, মাঝে-সাঝে, তার অস্তিত্বের সীমান্তের ধু-ধু
নির্জনতা ফুড়ে কতিপয় কর্কশ কংকাল হেঁটে যায় আর
কী যেন চেঁচিয়ে বলে, ভাষা বোঝা দায়। শোনে, কেউ
জপায় স্মৃতির মধ্যে যেন-
‘এখন নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে গহন তাৎপর্য কিছু খুঁজে নাও। চোখ বুজে
পড়ে থাকে এক কোণে, নিজেকে খোঁড়ার ইচ্ছাটুকু উদাসীন
মেঘ হয়ে উড়ে গেছে কবে। সকল ইচ্ছাই কত
তুচ্ছ মনে হয়,
তুচ্ছ মনে হয়।

তুমি বড় অসতর্ক

তুমি বড়ো অসতর্ক, বড়ো বেশি অসাবধানী হে।
নইলে কেন দেখতে পেলে না ঝকঝকে সূর্যালোকে
নৌকায় এলাহী ফুটো? কেন ভাঙা নৌকা তড়িঘড়ি
ভাসালে সমুদ্রে? পানি সেচে সেচে মাঝ দরিয়ায়
কী করে টেকাবে নৌকা? ভ্রমণের ঝোঁকে
বলো তো এভাবে কেউ কখনো ভাসায় ভগ্ন তরী
চোখ যার থাকে দূর পল্লবিত সঙ্গীতমুখর কিনারায়?

তুমি বড়ো অসতর্ক, বড়ো বেশি অসাবধনী হে।
ঔদাস্য তোমার সঙ্গী, তবু আশৈশব চেয়েছো আকাশ ছুঁতে
এবং চেয়েছো ছুটে যেতে দূরে আরো দূরে আরো,
পর্বত চূড়ায় পা রাখবে বলে উঠেছো উঁচুতে
অনেক, অথচ পিঠে বাঁধো নি জরুরি সরঞ্জাম।
যে-কোনো মুহূর্তে তুমি পা হড়কে ভয়াল
খাদে পড়ে যেতে পারো,
সারা গায়ে নিয়ে কালঘাম
গড়াতে গড়াতে নিচে হতে পারো বিচূর্ণ কংকাল।

তুমি বড়ো অসতর্ক, বড়ো বেশি অসাবধানী হে।
মায়াবী অরণ্যে তুমি করেছো প্রবেশ যে-বিকেলে
তা এখন ঘোর রাত্রি, সুতীব্র জৈবিক
গন্ধে মোহাচ্ছন্ন চতুর্দিকে।
সেই যে কখন তুমি গেলে,
কর্কশ পাতায় এলোমেলো বাজে শুধু পদধ্বনি;
তুমি তো অক্ষত বেরুনোর মন্ত্র এখনো শেখাওনি।

তোমাকে না দেখে

তোমাকে না দেখে কাটে দিন, দিন কাটে আর কত
রাত্তির ফুরায় নিদ্রাহীন। শবযাত্রীদের মতো
স্মৃতি ক্লান্ত পায়ে আসে, হাতে কিছু বিবর্ণ গোলাপ।
হঠাৎ কখনো যদি ডায়াল ঘোরাই টেলিফোন
একটানা বেজে চলে, ওপারের নীরবতা বড়ো
অত্যাচারী, দিন যায়, রাত কাটে তোমাকে না দেখে।

তোমাকে দেখি না তবু সর্বক্ষণ তোমাকেই দেখি।
দিব্যোন্মাদ মানুষের মতো দেখি তুমি পুষ্পময়
মেঘে মেঘে তুমি, তুমি ডহর পানিতে একাকিনী
সন্তরণশীল মাছ। কখনো পাখির চোখে আর
বন হরিণীর ত্বকে, কখনো-বা আমার আপন
করতলে দেখি; চোখ খুললে তুমি, বুজলেও তুমি।

এই তো দেখছি তুমি বসে আছো একা একা ঘরে,
শুনছো ক্যাসেটে গান বড় বেশি স্মৃতি-জাগানিয়া।
পড়ছো বিদেশ থেকে আসা চিঠি কিংবা আধুনিক
উপন্যাস দিচ্ছ ডুবসাঁতার, দেখছি বিছানায়
শুয়ে আছে বাইশটি বন্দনীয় উদ্ভিন্ন বছর,-
পাশে নিঃসঙ্গতা, কালো বিচ্ছিন্নতা বিলি কাটে চুলে।

সে শয্যার চারপাশে ঝর্ণাধারা বয়ে যায়, ঝরে
জুঁই চামেলীর বৃষ্টি খুশি মাখা শ্যামা ও দোয়েল
দ্যায় শিস ঘুরে ফিরে। আমার কবিতা অতিথির
মতো এসে দাঁড়ায় ব্যাকুল বড়ো তোমার চৌকাঠে-
দ্যাখো না তাকিয়ে, দৃষ্টি নত টানা গদ্যের বিন্যাসে,
তোমার চিবুকে স্তনে পড়ে তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস।

কবিতার খুব কাছে যেতে যেতে দ্যাখো আজ আমি
তোমার কাছেই পৌঁছে গেছি। কুয়াশার কারাগার
ভেদ করে তুমি চন্দ্রোদয়ের মতন ফুটে ওঠো
আমার এ অন্ধকারে। তোমাকে না দেখে কাটে দিন,
বস্তুত তোমাকে ভেবে ভেবে দীর্ঘ রাত রক্তজবা
ভোর হয়ে যায় বারে বারে। রাত্রি চেপে থাকে বুকে।

প্রায়শ ভয়ের নখ ভীষণ আঁচড় কাটে বুকে,
মাথার ওপর ঝোলে সর্বদা সিদূরে মেঘ; যদি
তোমার বাগান থেকে আমাকে ফিরিয়ে দাও, আমি
দাঁড়াবার জায়গা আর পাবো না কোথাও এতটুকু।
ছাওয়ার বিলাপময় দুর্যোগের ঘাটে আমি আজ
আমার সকল নৌকা দ্বিধাহীন এসেছি পুড়িয়ে।

ত্র্যামনেশিয়া

ইদানীং কী যে আমার হয়েছে, আমার একদিন এবং
অন্যদিনের মধ্যে নানা ফাঁক-ফোকর
তৈরি হতে থাকে। দিনের পর দিন চুপচাপ
বসে থাকি, হাতের কলম হাতেই থেকে যায়, কোনো কিছু লেখা
হয় না, ক্রমাগত দাড়ি বেড়ে যায়, চুলের যত্ন নিতে
মনেই থাকে না।

দাড়াও বলছি কী কী যে আমার ছিল,
কী কী যে লুকিয়ে রেখেছিলাম অনেক কৌতূহলী
চোখের আড়ালে। ভয় হয়, পাছে গুলিয়ে ফেলি সব।
আস্তে-সুস্থে আমাকে মনে করতে দাও।

সে কবে যেন দুপুরকে সন্ধ্যা করে বইলো
দুরন্ত ধূলিঝড়। পেরেকবিদ্ধ হাত-পা থেকে চুইয়ে চুইয়ে
পড়ছিলো রক্ত, আমি লাল আলখাল্লার ওপর
পাশার দান ফেলছিলাম, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী রোমক সৈনিক।
খেলা সাঙ্গ হবার পর সেই আলখাল্লা
হাতে হাতে কোথায় যে উধাও হলো, আজ আর
মনে পড়ছে না আমার।

আমি ঢাকা পড়ে গিয়েছিলাম লতাগুল্ম
আর পাতায় পাতায়, পাখিতে পাখিতে। রঙ-বেরঙের
ছোট ছোট পশুপাখি আসতো আমার কাছে
খাবারের আশায়। কী করে যে সেই জটিল আচ্ছাদন থেকে
বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম, মনে নেই।
নিঝুম বিরানায় পথপ্রদর্শক ছিল না কেউ, আমার ঢ্যাঙা
কামনাকেই মুর্শিদ ভেবে
কুড়াল দিয়ে দুর্গম কোহে বেসতুন কেটে পথ চলছিলাম একা
একটি মধুর নামের গান গাইতে গাইতে। হঠাৎ
হাতের কুড়াল কোথায় হারিয়ে গেল, কিছুতেই
মনে করতে পারছি না আর।
বহু পথ পরিক্রমার পর ক্লান্ত হয়ে
আশ্রয় নিয়েছিলাম এক সরাইখানায়। সেই
সরাইখানার যিনি মালিক, তারা অষ্টাদশী আত্মজাকে
দেখে আমার হৃদয় ডানা-ঝটপটানো
পাখি। আমার বাম চোখ কাঁপলো পাঁচবার
আর পাঁচটি অন্ধ পায়রা,
পাঁচটি অন্ধ পায়রা
পাঁচটি অন্ধ পায়রা উড়তে গিয়ে সরাইখানার
পুরোনো দেয়ালে মাথা ঠুকে এলেমেলো পড়তে থাকে
বারংবার; তারপর যা হলো তা আগাগোড়াই
কুয়াশাচ্ছন্ন, যেখানে স্মৃতির রোদ ঝলসে ওঠে না কখনো।

সত্যের উপত্যকার আশেপাশে আমি ঘুরেছি, উপোসে শীর্ণ
সন্তদের মুখমণ্ডলের আভা
আমার সীমা-সরহদে ছড়িয়ে পড়েও পড়লো না,
আমার কপালে রেখাগুলি শতকের অস্তরাগে
রঞ্জিত হলো বিয়োগান্ত মহিমায়, আমার জীবনে আততায়ীর মতো
সওয়ার হলো দুঃখ, একটি হাত আমার দিকে
প্রসারিত হতে হতে স্তব্ধ হয়ে গেল মধ্যপথে। শূন্যতা নিয়ে
ফেরার পথে কাঁটাতারে ঘেরা বেগানা অঞ্চলে
শুধু আমি আর খড়গাঘাত, আমি আর খড়গাঘাত।
প্রতিদিন সকালে আয়নায় যাকে দেখি, তাকেই
মুখ্যচরিত্র ভেবে একটি নাটক লিখছি নিভৃতে।
কিছু কিছু দৃশ্যের পরিকল্পনা
লতিয়ে ওঠে দ্রুত, অথচ পুরো চরিত্রলিপি কিছুতেই
তৈরি হয় না। দৃশ্য ক্রমাগত ওলট-পালট,
অনিবার্য সংলাপ আধলেখা হয়ে থাকে। যাকে
তন্বী নায়িকা করতে চাই, সে কী ভীষণ স্থূলাঙ্গিনী
হয়ে ওঠে নিমেষে। কাহিনীর খেই হারিয়ে
নিশ্চুপ বসে থাকি বিস্মৃতির ধূসর পর্দার ঘেরাটোপে।
ইদানীয় মৃতের জন্যে ফুল নিতে চেয়ে ভুলে ফুল ছাড়াই
চলে যাই গোরস্তানে, চেনা কেউ নড করলে তাকে অচেনা জ্ঞানে
নিঃসাড় থাকি। অতীতভুক কোনো প্রাণী
ক্রমাগত চেটে চেটে নিঃশেষ করছে আমার স্মৃতির মেদমজ্জা।

অথচ এমন কিছু আছে যা ভুলে যেতে পারলে আমি বাঁচতাম।
যদি আমি ভুলে যেতে পারতাম তরুণ, কান্তিমান
নুরুল আবসারের মুখ, যে-মুখ আরো অনেক মুখের সঙ্গে
মুছে গ্যাছে একাত্তরের ব্যাপক তাণ্ডবে, যদি আমি
ভুলে যেতে পারতাম অজস্র শিশু-করোটির চোখের শূন্য কোটর,
দুঃস্বপ্নের গহ্বরের মতো গণকবরের কথা
যদি আমি ভুলে থাকতে পারতাম। যে প্লেন
তোমাকে নিয়ে বিপুল উড়াল দিয়েছিল কোন মধ্যরাতে,
তার কথা আমি মনে করতে চাই না, তবু মনে পড়ে,
আমার আর তোমার হাতের মধ্যেকার
চিরায়ত ব্যবধানের কথা ভুলতে পারি না,
দরবেশের অভিশাপের মতো
দশদিক থেকে উঠে-আসা ক্রমাগত ভাঙনের শব্দ
স্মৃতির এই দুঃসহ মড়কেও ভুলতে পারি না।

দুঃখ স্বচ্ছন্দে আমাকে

দুঃখ স্বচ্ছন্দে আমার মাথার ঘ্রাণ নিয়ে বলে-
এই দ্যাখো, তোমার কপালে
রেখেছি আমার ওষ্ঠ।
এই স্পর্শ তোমার মধ্যে জাগিয়ে তুলবে
বাদশাহী আমলের ঝাড় লণ্ঠনের মতো স্মৃতিঃ
তুমি দেখবে মেরুন রঙের একটি বাড়ি
আর সেই বাড়িটার দরজায় দাঁড়িয়ে
কে যেন কাউকে খুঁজছে সর্বক্ষণ (একজন
মানুষ অন্য একজনকে খোঁজে চিরদিন)
রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে। আয়নার অজস্র গুড়ো
পথে পথে ছড়িয়ে থাকবে;
একজন অন্ধ গায়কের বিশীর্ণ হাত ধরে
এক সুন্দরী, অথচ মুক, আস্তে সুস্থে
এগোতে থাকবে ভিড়ভাট্রায়।

তুমি দেখবে
কে একজন, না যুবক না কিশোর, বসে আছে খুব একলা,
উদাসীন তার অস্তিত্ব বেজে চলেছে অলৌকিক বাদ্যযন্ত্রের মতো।
তার পিঠে জ্যোৎস্নার আলখাল্লা;
তুমি দেখবে
সেই মরুবাসিনীকে, যার মুঠোয়
বন্দি তোমার পরমায়ু;
একটা গুহা তোমার চোখে পড়বে-যেখানে
সিংহের গা থেকে ক্রমাগত খসে পড়ছে
রাশি রাশি সোনালি ছাল।

এই যে তোমার দৃষ্টিপথে দুলে উঠেছে একটা গাছ,
ত্রিভুবনে অন্য কেউ তাকে দ্যাখে না,
তার নাম সবার অজানা।
তুমি শুধু তুমি দেখবে, জানবে।
তোমার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়
অদূরে ফুটে আছে আশ্চর্য এক ফুল।
অন্য কেউ তা দ্যাখে না কস্মিনকালেও,
জানে না তার নাম।
তুমি শুধু তুমি দেখবে পাও,
শুধু তোমারই কণ্ঠে উচ্চারিত হতে পারে সে-নাম।

তোমার কপালে আমার ওষ্ঠের চিহ্ন
রয়েছে বলেই তোমার সান্নিধ্যে শিলাখণ্ড গান গায়,
পানির ডহরে নিশিপ্রহরে
দুলে ওঠে কখনো-না দেখা জলযান।
তোমার কপালে আমার গাঢ় চুম্বন
আছে বলেই তুমি দ্যাখো
কবরের নিচে সন্তের মুখের মতো
কোনো মুখাবয়ব, ঝর্ণার স্বচ্ছ পানিতে ভেজা চুলের গুচ্ছ।

দ্যাখো আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম,
ঘরের কোণে মনহুশ অন্ধকারে ঘাড় গুঁজে
বসে থাকলে তোমার চলবে না,
বেরোতে হবে আমার হাত ধরে, পাশাপাশি।
তুমি বাইরে পা না বাড়ালেও পুবদিকে
উঠবে জ্যোতিশ্চক্র, কবরেও ফুটবে ফুল, গেরস্তের প্রাঙ্গণে
বাগ দেবে তরুণ মোরগ, হাঁস চঞ্চু ঘষবে পাখনায়,
রুটিবিজয়ী বেরোবে তার নিজস্ব ধান্ধায়।

এসো,
আমার হাত ধরে পা বাড়াও তুমি।

দূরাগত বিনষ্ট ভেলায়

একজন সম্প্রতি নিজের মধ্যে কিছু স্বপ্নহীন
প্রহরের অত্যন্ত ফ্যাকাশে
আলোড়ন অনুভব করে। তার চারপাশে কত
কিছু হচ্ছে প্রতিদিন, ঐ
হল্‌দে বাড়িটার ছাদে পাখি নেমে আসে আলগোছে
একটি সবুজ পোকা খেলা করে গাছের পাতায়,
কুমোর গড়ছে মূর্তি হরেক রকম, নব্য যুবা শিস দিয়ে
ঘরে ফেরে মধ্যরাতে,
মধ্যবিত্ত খাটে
ঘুমিয়ে তরুণী দ্যাখে সাত মহলের স্বপ্নচ্ছবি।

সে নিজে এসব থেকে অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন, আজ শুধু
মনে পড়ে তার
একদা সে চেয়েছিল পটারির কারুকাজে মগ্ন হয়ে দূর
নীল মিনারেটে পৌছে যেতে।
দু’-তিন সপ্তাহ ধরে কাটে না সে দাড়ি, পড়ে না কেশরে তেল
কতদিন, চুল তার কেশর বলেই খ্যাত! বৈফল্যের শ্মশানের কালো
ধোঁয়ায় সতত উপদ্রুত ইদানীং, রাত্তির গভীর হলে
কী এক নিজের খেলা তাকে
ভীষণ জাগিয়ে রাখে, বস্তুবোধ থেকে খানিক আড়ালে রাখে,
কেমন ভূপর্যটন চলে সারাক্ষণ আস্তে সুস্থে
মনের ভিতরে,
কখনো হিংস্রতা, যোগসূত্রহীন, তড়াক লাফিয়ে ওঠে
এবং আয়ুর পাতা ওড়ে চোখের পাতায়, পটারির
কথা ভাবে মাঝে-মাঝে, মন
ভারাক্রান্ত হয়-কোন্‌ মৃগ ডেকে নিয়ে গেছে গভীর জঙ্গলে
তাকে, সে এখন ভাবে। যাত্রা করে বারংবার মানুষের
দ্বীপপুঞ্জে, খোঁজে
যোগসূত্র অস্তিত্বের সঙ্গে দ্যুলোক ভূলোক ইত্যাদির।
প্রত্যহ চুম্বন নিয়ে গ্রন্থের পাতার জেনে গেছে
বৃথাই বুঝতে চাওয়া সব খুঁটিনাটি।
বোধের ওপারে আছে জলরাশি, অগাধ রহস্যে খলখলে।
সে তার নিজের কাছ থেকে কবে যে হারিয়ে গেছে,
বুঝতে পারে নি নিজে। কিছু ভস্ম, পদচিহ্ন কিছু
দেখে দেখে ক্লান্ত লাগে, বড়ো ক্লান্ত লাগে, কী বিমুখ
মুখচ্ছবি করে আনাগোনা অন্তর্লীন কুয়াশায়,
বুকের ওপরে তার একরাশ শুক্‌নো পাতা বড়ো
দীর্ঘস্থায়ী হয়, গুহাস্থিত ঝাঁক ঝাঁক কালো পাখি
নিয়ত ঠোকর মারে। নিজের ভিতরে তার ক্ষিপ্র তেজস্ক্রিয়া,
ভস্মরাশি অন্তর্গত ল্যান্ডস্কেপ পাল্টে ফ্যালে, যেম অন্য কেউ
চোখ মেলে দূরাগত বিনষ্ট ভেলায়।
বাড়িয়ে নিঃসঙ্গ হাত অবেলায় কাকে খোঁজে ঠোঁটে নিয়ে নুন?

নিভৃত অক্ষরে

মাঝে-মধ্যে হল্‌দে অপরাহ্নে এই যে দুজন আসে
নিরিবিলি, বসে পার্কে ঘাসে,
হাত ধরে পরস্পর কিংবা চুমো খায় অন্ধকার
খুলে দিলে ছাতা, বারংবার
করে আলিঙ্গন
অথবা কখনো খুব লুকিয়ে চুরিয়ে কিছুক্ষণ
বস্তুত ভাড়াটে ঘরে শোয়া যুগ্মতায়-
এসব তেমন কিছু নয়; বলা যায়
অতি সাধারণ আর পুনরাবৃত্তিতে স্বাভাবিক।
কখনো কখনো হয়ে ওঠে অলৌকিক।
কোনো কোনো দৃশ্য কোনো শিল্পীর দৃষ্টিতে অকস্মাৎ।

যতই সামান্য হোক এই হাতে হাত
রাখা দৃষ্টি বিনিময়, আলিঙ্গন, সঙ্গমকালীন উচ্ছলতা,
এইসব খুঁটিনাটি দৃশ্য, বহু-ব্যবহৃত কথা,
এমন প্রসঙ্গ জানি বৃথা নয় কবির জীবনে;
মোহন চুল্লিতে তার পরিশুদ্ধ হয়ে ক্ষণে ক্ষণে
উঠে আসা প্রগাঢ় প্রস্বরে
হৃৎস্পন্দনের মতো কবিতার জ্বলজ্বলে নিভৃত অক্ষরে।

নিয়তি আমার প্রতিপক্ষ

আজ এ-কথা তো বলতেই পারি-শোনো,
নিয়তি-টিয়তি আমি মানি না এখনো।
মানি না বলেই পঞ্চাশোর্ধে পথ হাঁটি কী উজ্জ্বল
আশার গোলাপ নিয়ে বুকের ভেতর আর দুরন্ত ঈগল
দেখি আশমানে।
অতিদূর নীলিমার গানে
মাতাল সে পাখি আয় আয়
বলে ডানা নেড়ে-নেড়ে আমাকে শেখায়
অভীপ্সার মানে। নিয়তির তূণ থেকে
যতই আসুক ছুটে বান, যাক ঢেকে
চতুর্দিক,
দেখে নিও ঠিক
আমি ভয় পাবো না কখনো। অন্ধকার
ব্যাপক তুলতে পারে ফণা, পা পিছলে যেতে পারে বারবার,
হঠাৎ কখনো ধস্‌ নেমে
এলে আসতেও পারে, কখনো হাঁটতে পারি থেমে থেমে
খোঁড়ার মতন, তবু পাহাড় ডিঙিয়ে যাবো সুখে
তুড়ি মেরে নিয়তির মুখে।

আড়ালে কে যেন হেসে ওঠে। আমাকে দেখায় শক্ত কব্জি তার,
তুলে ধরে অস্ত্রের সম্ভার।
মতিচ্ছন্ন ঝোঁকে
তাকেই কি বলে লোকে
নিয়তি? প্রবল প্রতিপক্ষ সুনিশ্চিত।
কিন্তু দ্যাখো, দর্জির ধরনে দ্যাখো, সাহসের ভিত
আমার অটুট আজো; তাই
কস্মিনকালেও জানি নিয়তির সঙ্গে বন্ধ হবে না লড়াই।
বারংবার হেরে গিয়ে নিয়তি আবার অন্তরালে
সড়কি ও ঢালে
সুসজ্জিত হয়ে ফের লড়াইয়ের নতুন কৌশল কিংবা কোনো ছল
রাতারাতি তৈরি করে নেবে কিনা,
আমি তা জানি না।

পান্থজন

বহু পথ হেঁটে ওরা পাঁচজন গোধূলিতে
এসে বসে প্রবীণ বৃক্ষের নিচে ক্লান্তি মুছে নিতে।
গাছের একটি পাখি শুধায় ওদের-
‘বলতো তোমরা কারা?’ প্রশ্ন শুনে পান্থজন
ঝুঁকে পড়ে নিজের বোধের
কাছে; বলে একজন, ‘হিন্দুত্বের প্রতি আজন্ম আমার টান।
দ্বিতীয় জনের কণ্ঠ বাঁশির মতন
বাজে, ‘আমি বৌদ্ধ, হীনযান।
এবং তৃতীয় জন বলে, ‘আমি এক নিষ্ঠাবান
বিনীত খ্রিস্টান।
চতুর্থ পথিক করে উচ্চারণ, আমার ঈমান
করেছি অর্পণ আমি খোদার আরশে,
আমি তো মুসলমান।
পঞ্চম পথিক খুব কৌতূহলবশে
কুড়িয়ে পতঙ্গ এক বলে স্মিত স্বরে, ‘আমি মানব সন্তান।

পাস্তারনাকের কবরে

হঠাৎ গেলাম পৌঁছে একদিন; ছিল না প্রস্তুতি
এক রত্তি, দীর্ঘকায় রুশ যুবা নিরিবিলি পথ
নিশ্চুপ দেখিয়ে নিয়ে যায়, হাঁটি আমি ছায়াবৎ,
শুনি ফুল করে স্তব নিরালায়, পাখি গায় স্তুতি।
আছেন ঘাসের নিচে শুয়ে একা, বড় একা কবি
অনন্তের আলিঙ্গনে অতিশয় অগোচরে। খোঁজ
সহজে মেলে না যত্নহীন কবরের, শুধু রোজ
সেখানে নিঝুম বাজে নিসর্গের ভৈরবী, পূরবী।
নিঃশব্দে দাঁড়াই ছায়াচ্ছন্নতায়; কিছু ঝরাপাতা
কবরকে চুমো খায়, তন্বী লতা রাষ্ট্ররোষে দগ্ধ
নিঃসঙ্গ কবিকে দ্যায় চুপিসারে ঠাণ্ডা ছায়াঞ্জলি।
তাঁর জন্ম জয়ন্তীতে তরুণ তরুণী শান্ত, স্তব্ধ
পায়ে আসে এ নিষিদ্ধ তীর্থে এবং নোয়ায় মাথা,
রাখে কিছু ফুলের স্তবক, নিবেদিত পদাবলী।

ফিরে আমি তোমার কাছেই

পথক্লেশ আছে, আছে তৃষ্ণা, ক্ষয়ক্ষতি, ক্ষয়চিহ্ন
নিয়ে তবু ফিরে আসি তোমার কাছেই।

একদা যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, হয়েছিল চেনাশোনা,
তারা কি হারিয়ে গেছে অলক্ষ্যে সবাই? এতকাল
পরে আজো যখন নিভৃত
জানালায় এসে বসে প্রজাপতি কিংবা ছাদের কার্নিশে পাখি
গান হয়, অকস্মাৎ কারো
অস্পষ্ট মুখের রেখা মনে পড়ে যায়, কখনো-বা
চায়ের বাটিতে ঠোঁট রাখার সময় মনে পড়ে আগেকার
সুগন্ধি চুম্বন অগণন;
মনে পড়ে, নজরুলী গজলের মোহন ছায়ায়,
রবীন্দ্রানাথের
অলৌকিক গীতবিতানের সীমাহীন মানবিক মমতায়
আমাদের ভালোবাসা পেয়েছিল সঞ্জীবনী সুর
মারী ও মড়কে দাঙ্গা হাঙ্গামায়, ক্রুর খুনখারাবির কালে।
এখন সকল কিছু ছাপিয়ে তোমার মুখ পিকাসোর দীপ্র
নানান আয়তনিক নারীর মুখশ্রী হয়ে যায়
হৃদয়ে আমার।

আমার উঠোনে ঘরে যাচ্ছে বয়ে পড়স্ত বেলার
রৌদ্রের ঢেউয়ের মতো বিশ শতকের
গহন পূরবী।
কখনো একটি হাত গীতিকবিতার মতো সুস্মিত স্পন্দনে
আমার নির্জন কাঁধে নেমে আসে, সে-হাতে চিত্রিত প্রজাপতি,
আদিম পত্রালি কিছু দেখা যায়। কখনো আমার
রুটিতে স্বপ্নের মধু ঝরে, ঝরে বিন্দু বিন্দু, হা-ভাতে বেলায়।

সুপ্রভাত, ফ্যাক্টরিতে তৈরি হচ্ছে বিপুল ব্যান্ডেজ
রাশি রাশি;
সুপ্রভাত, ফ্যাক্টরি উগরে দিচ্ছে ক্রাচ কোটি কোটি;
সুপ্রভাত, ফ্যাক্টরি উগরে দিচ্ছে অস্ত্র, মারণাস্ত্র, টন টন;
সুপ্রভাত দিকে দিকে মৃত্যুর চোখের মতো চকচক করে
জেনারেলদের বুট পৃথিবীর ম্যাপের ওপর;
সুপ্রভাত, ভীষণ উঠছে দুলে বাসুকির ফণা বারংবার;
সুপ্রভাত, নারীর কোমল হাত দৈনিক সংবাদপত্র
হয়ে যায় ধুধু;
সুপ্রভাত আমার অনামিকায় আজ
হঠাৎ দিলেন নৃত্য জুড়ে নটরাজ!

পথক্লেশ আছে, আছে তৃষ্ণা, ক্ষয়ক্ষতি, ক্ষয়চিহ্ন
নিয়ে তবু ফিরে আসি তোমার কাছেই।
সন্তের ধরনে ধ্যানী চেতনায় জ্বলে
চোখের বদলে চোখ, অধরের বদলে অধর, হৃদয়ের
গহন ধ্বনির মতো
শব্দের বিন্যাসে এনে তোমাকেই কবিতা বানাই।

বদ্ধ এ ঘরে

এই তো এখানে দোর-আঁটা এক
নিশ্চুপ ঘরে একা একা বসে আছি।
মুহূর্তগুলি কাঁপে চোখে মুখে,
স্বপ্নের সাথে খেলি রোজ কানামাছি।
নিচে রাস্তায় প্রহরে প্রহরে
চলে অবিরাম ট্রাফিকের মাতলামি।
নৈরাশ তোলে কালো হারপুন,
এদিকে বয়স ভীষণ অস্তগামী।

ইতোমধ্যেই সাত কাপ চায়ে
নিয়েছি ভিজিয়ে বেজায় তৃষিত গলা,
পলায়নপর যৌবন, তবু
থামে নি শিরায় দুরন্ত-হীরে-জ্বলা।

ওমোট গরমে কেমন বন্য
গন্ধ ছড়ায়, মেঝেতে দীর্ঘ ঘাস
এবং আমার সত্তায় লাগে
তামাটে ঘোড়ার জ্বলন্ত নিশ্বাস।

বদ্ধ এ ঘরে চকিতে স্মৃতিতে
স্পেনের কবিতা দ্রাক্ষার মতো দোলে।
সুদূর সুনীল গীটারের সুরে
অন্ধ এ মন অস্ফুট চোখ খোলে।

বদ্ধ এ ঘর হঠাৎ কখনো
উঠবে কি হেসে নামহীন বৈভবে?
যদি তুমি আসো, নিমেষে এ ঘর
মায়াকাননের চির প্রতিযোগী হবে।

বলবেন চিরদিনই

সন্ধ্যাও এমন হয় কখনো ভাবি নি কোনোদিন।
আমি একা বড় একা, উপেক্ষিত, ভাবলেশহীন
কাঠের চেয়ারে বসে থাকি এক ভিড়
মানুষের মাঝে; দিনগত কায়ক্লেশ বাড়ে, কখনো নিবিড়
দয়ার্দ্র নক্ষত্রগুচ্ছ খুঁজি, নানা টুকরো কথা, যেন স্বপ্নে বলা
ভেসে আসে। কেউ খুব গলা
চড়ায় না, শিষ্টাচারে মসৃণ সবাই, বলা যায়।
কেউ কেউ আশপাশে খানিক তাকায়,

এবং অনেক দূর থেকে
হঠাৎ তোমাকে দেখি, যেন তুমি নিজেকে রহস্যে ঢেকে
বসে আছো কোনো গ্রিক দেবীর ধরনে
পারিপার্শ্বিকের প্রতি উদাসীন। চক্ষু-তৃষ্ণা বাড়ে, ক্ষণে ক্ষণে,
আমার ব্যাকুল দৃষ্টি তোমার দিকেই যেতে চায়,
যেমন দিনান্তে ক্লান্ত পাখি তার নিজস্ব ডেরায়।

সন্ধ্যা পাপড়ি মেলে সরোদের অলৌকিক
রাগশ্রী আলাপে, চতুর্দিক
আলী আকবরময়। গেরস্তের বাড়িঘর, ইটকাঠ আর
পুঁইমাচা, ফুলকপি, মঞ্চ শামিয়ানা, সারি সারি সুদৃশ্য মোটরকার
চকিতে সরোদবন্দি। মনে হয়, তুমি আর আমি অকস্মাৎ
রুপোর পাতের মতো সরোবরে কাটছি সাঁতার-
তোমার দু’হাত
আমার আপন হাতে খেলা করে, আমি বারংবার
তোমার জলজ ঠোঁটে ঠোঁট রাখি, শুনি হৃৎস্পন্দন
তোমার এবং আমাদের ওষ্ঠের যুগলবন্দি শেষ হলে
সুরে সুরে, ক্ষিপ্র বোলে বোলে
ভেসে যাই দূর পরাবাস্তব নিঃসীম নীলিমায় দীগ্র আমরা দুজন।
কখনো তোমাকে দেখি ছুটে যাচ্ছো, ছুটে যাচ্ছো শুধু
হাওয়ায় উড়ছে চুল, আমি একা ধু ধু
বালির পাহাড়ে পড়ে থাকি; ইচ্ছে হয় তোমার সান্নিধ্যে গিয়ে,
চেনা, আধচেনা মানুষের ভিড়ে হিল্লোল জাগিয়ে
গূঢ় দৈববাণীর মতোই বলে আসি-
ভালোবাসি, আজো তোমাকেই ভালোবাসি।
আমার হয় না বলা, আমার হয়েই বলছেন ঐ যে তিনি,
সাধক সরোদ, বারে বারে, ‘ভালোবাসি’, বলবেন চিরদিনই।

মোটেই যথেষ্ট নয়

নেভানো ঘরের আলো, আধপড়া ক্লেদজ কুসুম
বিছানায় শুয়ে আছে এক প্রস্থ স্বপ্নের মতন।
মনে মনে, ‘মোটেই যথেষ্ট নয় একটি জীবন’,
বলে আমি নীলিমার অনুগ্রহ চাই। চোখে ঘুম

নেই এক ফোঁটা, শুয়ে শুয়ে ভাবি আকাশ-পাতাল,
মুহূর্তের কুঁড়ি কত দ্রুত ঝরে যায়। মোমবাতি
ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলে হাওয়ায় ধোঁয়ায় মাতামাতি
যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণই বাঁচা, স্মৃতিময় কাল।

একটি গহন নৌকো দুলে দুলে আসে বহুদূর
থেকে, যেন স্বপ্ন করবে বিলি, মাঝিটার দাড়িময়
মুখ আলো-আঁধারিতে অত্যন্ত রহস্যময়। সুর
সে কোন্‌ দ্বীপবাসিনী মোহিনীর, ভেসে আসে। নয়

সে আমার কিংবা অন্য কারো। না-লেখা কবিতা ফের
দেয় হানা মগজের কোষে, দেবদূতী ডানা
ঝলসিত অন্ধকারে। দেয়ালের সংকীর্ণ সীমানা
বেড়ে যায়, মুখ ভেসে ওঠে অজানা সুন্দরীদের।

হাতের তালুর মতো নিজস্ব শয্যায় ছটফট
করি, যেন জালে-পড়া মাছ। অতিদূর কাল থেকে
কে বীণাবাদক আসে, তার সুরে ক্রমে যায় ঢেকে
ঘরবাড়ি, আসবাব; জেগে ওঠে ভিন্ন প্রেক্ষাপট।

একটি উদ্যান পুষ্পস্বপ্নে খুব বিভোর বিহ্বল;
জীয়ন-মন্ত্রের ধ্বনি ছিল ওষ্ঠে যার, সেকি আসে
উদ্যানে ফিরোজা শাড়ি গায়ে নম্র পায়ে, মধুমাসে?
আমার সমাজদ্রোহী বুকে লাগে চোখের কাজল?
সহসা ঝলসে ওঠে কবেকার দেখা শান্ত ঝিল,
নিঝুম দুপুরে রৌদ্রে রঙিন সাইনবোর্ড, নিম
গাছ, তাকে রাখা বাঁশি, জলছবি, পিতল পিদিম-
অতীতের দিনগুলি পিকাসোর অনশ্বর নীল।

উঠোনে খুঁটছে পাখা একজোড়া হাঁস, রোদ ঝরে
গাছের পাতায়, পাখি-চোখে, আর সুঠাম তরুণী
বিড়ালছানাকে খেতে দিচ্ছে দুধ, সুনীল চিরুনি
পোহায় সুস্নিগ্ধ ছায়া ড্রেসিং টেবিলে ছোট ঘরে।

আবেশে তাকিয়ে থাকি, বস্তুগলি বস্তুকে ছাড়িয়ে
পৃথক আকৃতি পায়, রেকাবিতে আপেলের মধ্যে
জন্ম নেয় আরেক আপেল, দোল লাগে স্থলপদ্মে-
পড়ে না চোখের পাতা, পাছে যায় এ দৃশ্য হারিয়ে।

স্বপ্নময় এই দেখা কতটুকু দেখা? এ বীক্ষণ
নিমেষে ফুরায়, শুধু কিছু মিশ্র স্মৃতি পড়ে থাকে
বাবুই পাখিই ভাঙা বাসার ধরনে। প্রতি বাঁকে
মনে হয়, মোটেই যথেষ্ট নয় একটি জীবন।

মৌনব্রত

আমার উদারচেতা পিতামহ, যাঁকে আমি কখনো দেখি নি,
শুনেছি সর্বদা তিনি থাকতেন অত্যন্ত নিশ্চুপ,
এমনকি তাঁর অঙ্কশায়িনী ছিলেন যিনি, তিনি
কোনোকালে তাঁকে অপরূপ
অন্তরঙ্গ প্রহরে প্রগল্‌ভ হতে দেখেছেন, এমন প্রমাণ
রাখেন নি আমাদের পরিবারে সে সিংহপুরুষ। পুত্র তাঁর,
আমার জনক, মাঝে মাঝে মুখ খুললেও, জোটে নি সম্মান
তাঁর বাক্যবাগীশের কোনোদিন। আর
আমি সেই কবে থেকে জিভের জড়তা
নিয়ে আছি অসহায়, অত্যন্ত বিব্রিত
বাক্‌পটুদের ভিড়ে। এবং আমার পুত্র কথা
বলতেই শিখলো না, তার কী ভীষণ মৌনব্রত!

 যাবার মুহূর্তে

একজন লোক
যতই খেয়ালী, নির্বিকার, যতই উদাস হোক
যখন সে আপন নিবাস ছেড়ে দূরে, বহুদূরে চলে যায়,
যদি তাকে চলে যেতে হয় ভিন্ন দেশে,
তখন সে ম্লান হেসে

কী-যে ভাবে, বলা দায়।
সে কি তার বিষয় আশয় নিয়ে খুব বিচলিত
বোধ করে? নাকি ভীত,
সন্ত্রস্ত বিদায় নিতে পারলেই বাঁচে সব ছেড়ে-ছুড়ে?
সকল ভাবনা জুড়ে
তাঁর দামি আসবাব নয়, অথবা দলিল-দস্তাবেজও নয়,
ভয়, শুধু নামহীন ভয়।
নিজের নিবাস থেকে যাবার মুহূর্তে কেন যেন বারবার
মনে পড়ে তার
রেকাবিতে রাখা কিছু ফুল
স্টেনলেস চায়ের চামচ, তালা, ছাইদানি, দরজার কড়া
আর খাঁচাবন্দি পাখিটির কী ব্যাকুল
নিয়ন্ত্রিত ওড়াউড়ি, কোণে রাখা ঘড়া-
যারা জানবে আন কোনোদিন,
কোথায় যে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এমন সম্বলহীন

 যেমন মায়ের ডাক

যেমন মায়ের ডাক মধ্যবয়সেও শৈশবকে
ডেকে আনে বাগানের ছায়া, পেয়ারা গাছের পাতা,
ঘুমপাড়ানিয়া গান, তিন পয়সার বাঁশি আর
পাখির বাসার ঘ্রাণসহ, তেম্নি উচ্চারিত হলে
বাংলাভাষা, অস্তিত্বের তন্তুজালে কী মোহন ঢেউ
বয়ে যায়, নীল পাখি গান গায় শিরায় শিরায়,
ব্যাপক খরায় নামে বৃষ্টিধারা, করুণা-কোমল,
আবার নতুন করে ফুটে ওঠে বাঁচার বিস্ময়।

মাতৃময় মমতার চোখের পাতায় উন্মীলিত
বিদ্যাসাগরের বর্ণবোধ, পিতার হাতের তালু,
খড়িমাটি-অক্ষরের চিরকেলে স্লেট। বুঝি তাই
প্রহরে প্রহরে হরিণের চোখে, ঘরের দেয়ালে,
পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার চোয়ালে, অন্ধ গায়কের তানে,
এমনকি স্তব্ধতার কাছেও চেয়েছি বর্ণমালা।

 রন্ধনশিল্পের খুঁটিনাটি

ছিলাম লেখার কাজে ডুবে, পলাতক শব্দ খুঁজে
বেলা যায়, উপমার মৃগষূথ অদৃশ্য বেড়ায়
জটিল অরণ্যে, পরাবাস্তবের গহন ডেরায়
হানা দিয়ে পাই না কিছুই, তাই আমি মাথা গুঁজে
পড়ে থাকি সুনসান মনোনীত নিজস্ব গম্বজে।
হঠাৎ দাঁড়ালে তুমি টেবিলের ধার ঘেষে মন
ভীষণ মেঘলা করে। কেননা, কিচেনে সারাক্ষণ
খেটেও হাঁসের রোস্ট পুড়ে খাক, এত বুঝে-সুঝে

রান্না স্রেফ পণ্ডশ্রম। অথচ তুমিও মক্ষিরাণী
প্রকৃত রন্ধনশিল্পী; ভাবি পাচক এবং কবি
দুজন অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। কত চিত্রকল্প জানি
নিমেষেই পুড়ে যায় অতিরিক্ত আঁচে আর ভুল
ফোড়নে অনেক বাক্য কেমন বিস্বাদ লাগে। ফুল
নেই শব্দে ছন্দে, তবু মাঝে মাঝে স্ফুরিত সুরভি।

সে-রাতে পার্টিতে তুমি

সে-রাতে পার্টিতে তুমি ছিলে খুব প্রফুল্ল মেজাজে
প্রায় সারাক্ষণ, খোলাছাদে মৃদু কথোপকথন
নারী পুরুষের আর জোৎস্নার মদির বিচ্ছুরণ
দেহমনে; তুমি ছিলে রূপসী মহিলাদের মাঝে
আশ্চর্য সুদীপ্ত, ছিলে সুসজ্জিতা রুচিস্নিগ্ধ সাজে।
আবহাওয়া, রাজনীতি, চিত্রকলা, ফ্যাশান, দর্শন
জিভের ডগায় ঘোরে কারো কারো, মেধার কর্ষণ
চলে অবিরাম, বারান্দায় ক্যাসেটে সরোদ বাজে।

তবেক গপ্পে ছিলে মেতে। কী-যে হলো, হঠাৎ নিশ্চুপ
হয়ে গেলে তুমি, যেন পার্টি ছেড়ে চলে গেছো দূরে
বহু দূরে। নিভৃত শরীর দেখলাম নগ্নতায়
উদ্ভাসিত এবং তোমার ঊরু, স্মিত যোনিকূপ
সতেজ ঘাসের স্পর্শ মাটির আঘ্রাণ পেতে চায়,
স্তনচূড়া, নাভিমূল শিহরিত আরণ্যক সুরে।

স্পন্দমান শ্যামল পল্লব

পুরিয়া ধানেশ্রী শুনে অপরাহ্নে তিনটি হরিণ
কোমল আসবে বলে বসে আছো নিরালায় হাত-পা
ছড়িয়ে, উঠোনে উর্দি পোহাচ্ছে নিস্তেজ রোদ, তুমি
ক্লান্তমনে চিঠি লেখো। পত্রে মৃত কবিদের কিছু
পংক্তি অবেলায় খুব মোহন সজীব হয়ে ওঠে।
নানা ফটোগ্রাফে বন্দি শৈশব কৈশোর কিং। হৈ হৈ
যৌবন সহসা জ্বলজ্বলে গান গায় গলা ছেড়ে।
চিঠিতে ইমন বাজে, সেতু ভাঙে, সারি সারি বাড়ি
ধূলিসাৎ, ত্র্যামবুলেন্স দ্রুত ছোটে, সঙ্গীর আঙ্গুলে
নিভে-যাওয়া সিগারেট, চোখ নীলিমায় কী হিমেল
ওল্টানো এবং কারো উষ্ণ রমণীয় ঠোঁট স্মৃতি
হয়ে গলে যায় আর চোখের পাতায় বৃষ্টি নিয়ে
পথ হাঁটে একজন। বন্দুকের নল স্বপ্ন দ্যাখে
রূপসীর হাতে মৃদু স্পন্দমান শ্যামল পল্লব।

স্বপ্নের কাঙাল

লোকটার আপন বলতে কেউ নেই এ জগতে।
ঘোরে পথে পথে
সারাদিনমান একা-একা। থাকে না সে সাতে পাঁচে
কারো, নেই তার সড়কি ও ঢাল খোল কি কর্তাল, আছে
শুধু দুটি হাত আর যা যা থাকে খুব সাধারণ
একটি লোকের। তাকে করলে বারণ
কোথাও বসতে কিংবা সামান্য দু’-চার কথা বলতে, সে মাথা
হেঁট করে চলে যায় চুপচাপ। কোনো ছুতোনাতা
ধরে কারো দাক্ষিণ্যের হাত
ধরবার সাধ নেই তার, দু’বেলা দু’মুঠো ভাত,
পিঠ রাখবার মতো একটা মাদুর আর
মাথা পাতবার
একটি বালিশ পেলে দিব্যি তার দিন কেটে যায়
যে-কোনো সংকীর্ণ আস্তানায়।
এক ঢিলে দু’পাখি শিকার করে যারা প্রায়শই
সে নয় তাদের দলে। মই
বেয়ে তরতর
অনেক উপরে উঠে শিস বাজানোর
কায়দা অজানা তার। রুচি
নেই খয়রাতি অন্নে। আর জেনেছ অশুচি
বলে চুরিচামারিকে। কিছুই চাহিদা নেই, চায় সে কেবল
একটি আকাশ পর্যটক মেঘদল
দেখবার, তারা গুণবার। মাঝে-মধ্যে এক অলৌকিক ডাল
থেকে পাড়ে স্বপ্নফল, লোকটা নিরীহ আর স্বপ্নের কাঙাল।

স্মৃতিময় সুর

চলে যাই অবচেতনের বনে, নিমজ্জিত দিকে
মাঝে মাঝে; রঙিন পেন্সিল কিছু ঘুমের ভেতরে
নিরিবিলি লাল নীল বারান্দায়, শান্ত ছোট ঘরে
কেবল গড়িয়ে যায়। কতিপয় এলেবেলে, ফিকে
ফটোগ্রাফ নৃত্যপর; কে কিশোরী জানালার শিকে
কপাল ঠেকিয়ে চেয়ে আছে, মেঘের নানান স্তরে
বাঁশি-অলা হেঁটে হেঁটে ডাকে স্বপ্নজাগানিয়া স্বরে,
মায়াবী খাতায় কারা কিছু নাম রেখে যায় লিখে।

এখন কোথায় তারা এই শতকের গোধূলিতে?
কতকাল দেখি না তাদের, কণ্ঠস্বর কোন্‌ দূর
মেঘের আড়ালে লুপ্ত। কারো ভেলা ভাসে নিরুদ্দেশে,
কেউ কেউ রাজনীতি নিয়ে মাতে, কেউ-বা নিমেষে
বর্ধিষ্ণু সমাজপতি; আমি শুধু গভীর নিশীথে
জন্মকানা ঘরে একা কলমে তুলছি স্মৃতিময় সুর।

 হাসান এবং পক্ষিরাজ

এই পঙ্‌ক্তিমালা
তোমার উদ্দেশে লেখা, একটি যুগের সূর্যোদয়
সূর্যাস্তের গহন উদ্দেশে লেখা। এই শব্দাবলি
তোমার চোখের কাছে, সুস্মিত ঠোঁটের কাছ যদি
প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়, চায় হৃদয়ের বসন্ত-উচ্ছ্বাস,
তাহলে ফিরিয়ে তুমি নিও না তোমার
কালদগ্ধ ঋদ্ধ মুখ।

তোমাকে প্রথম দেখি,
মনে পড়ে, সেই কবে আমাদের প্রিয় উন্মাতাল
এই শহরের চৌরাস্তায়, বুড়িগঙ্গা নদীটির
খুব কাছে দ্বিপ্রহরে। কমলালেবুর দোকানের প্রান্ত ঘেঁষে
আমরা সেদিন রৌদ্রপায়ী যে সুনীল আকাশের নিচে
দাঁড়িয়ে বলেছি নানা কথা এলোমেলো, সে আকাশ
এখনো আকাশ একই।

অথচ আমরা দ্যাখো
কী দ্রুত বদলে গেছি, দশকে দশকে পাল্টে গেছি; চুলে
আমার ধরেছে পাক, তোমার মাথায় প্রতিশ্রুতিশীল টাক,
তেমন মসৃণ নেই আর ত্বক; তুমি, কী আশ্চর্য, বেলাবেলি
ছুঁয়েছো পঞ্চাশ সদ্য, আমি
খবরের কাগজ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সম্প্রতি হাঁটে শেখা
নাতির মোহন নাচ দেখি!

বন্ধু, মনে পড়ে
আমাদের দুজনের কবিতা ক্লাশের দুই প্রতিযোগী অথচ সুহৃদ
শিক্ষার্থীর মতো গলাগলি হেঁটে গেছে কতকাল।
মধুর ক্যান্টিন, আমতলা কতবেলা
দেখেছে তরুণ শত শত; সেই ভিড়ে তুমি ছিলে
উজ্জ্বল শ্যামল তলোয়ার,
মনীষা মৌলিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ সতত।

দ্বান্দ্বিক হেগেল, মার্কস আর
ফ্রয়েডের মেধার কিরণে উদ্ভাসিত, দাঙ্গার পাঁচটি গল্পে
নিমগ্ন বিষণ্ন আর এলিয়টি পঙ্‌ক্তি-আওড়ানো
ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় পথে তুমি আর আমি, কখনো জীবনানন্দে,
কখনো সুধীন্দ্র দত্তে, কখনো-বা বুদ্ধদের বসুতে আপ্লুত
ভাসিয়ে দিয়েছি ভেলা নিরুদ্দেশে দেখেছি বিজন মরুদ্বীপ,
নাবিকের করোটি, প্রবীণ প্রস্পেরোর গুহামুখ।

তোমার কি মনে পড়ে আজ
রাজনীতি নাম্নী এক চণ্ডীর দুন্দুভি? মনে পড়ে রাত জেগে
অজস্র ভূতলবাসী ইশতেহার পাঠ? মনে পড়ে বায়ান্নোর
ভয়ংকর সুন্দর সে রক্তপদ্মে অধীর চুম্বন? তুমি গ্যাছো
অন্ধকার প্রেসে একা জ্বালাতে নিষিদ্ধ দিপাবলী
এবং গলির মোড়ে জ্বলজ্বলে চোখে পক্ষিরাজ খুঁজে খুঁজে
কেটেছে আমার সন্ধ্যা, কত মধ্যরাত।

বসে আছে লোকটা একাকী;
অস্ত গোধূলির দিকে চোখ রেখে ভাবে, একদা সে
যেসব কপোত হেসে উড়িয়ে দিয়েছে আসমানে,
কখনো আসে নি ফিরে ওরা, ফলিয়েছে যে-ফসল, অবেলায়
তা-ও গ্যাছে নষ্ট হয়ে পঙ্গপালী তুমুল তাণ্ডবে। আজ তার
সত্তাময় হরিণের পদচ্ছাপ, হরিণ উধাও ধূলিঝড়ে।
একাকী লোকটা সিংহমূর্তির ছায়ায় বসে ভাবে।

একাকী লোকটা আমি, নাকি
তুমি! মৃত্যু-গোঁজা অন্ধকারে চলে খোঁজা অবিরাম;
আমার সম্মুখে চোরাবালি, তোমার অনুপস্থিতি;
তোমার সম্মুখে বালিয়াড়ি, আমিহীন
আমার দুঃখিত পদচ্ছাপ। জীবনকে মনে হয়
দীর্ঘশ্বাসময় ডাকঘর, শূন্য স্তব্ধ নিরালোকে;
ছিঁড়ি শুধু পত্রহীন হলুদ লেফাফা।

বিমুখ প্রান্তরে, হে সতীর্থ, হে সুহৃদ,
এখনো আমরা আছি; এখনো সম্বল শুধু আর্ত শব্দাবলি।
অক্ষরে উঠেছো গড়ে স্তরে স্তরে তুমি প্রতিষ্ঠান
এবং হাসান হাফিজুর রহমান যিনি, তাঁকে
এড়িয়ে এখনো আমি মাঝে-মধ্যে সেই কবেকার
হাসানকে খুঁজে ফিরি, যেমন একদা খুঁজতাম পক্ষিরাজ;
তখন নিজেকে, বন্ধু একা, বড় একা মনে হয়।

হাসি

যার ইন্তেকাল
হলো আজ, তিনি খুব একাকী এখন।
একটি কাফন
তার আর পৃথিবীর মাঝখানে গূঢ় অন্তরাল
দিয়েছে নিপুণ বুনে। কাঠের চেয়ারে বসে তিনি
পড়তেন খবরের কাগজ, কোরান,
কখনো নিতেন ঘ্রাণ
ফুলের, কখনো শুনতেন রিনিঝিনি
কাচের চূড়ির আর দিতেন চুমুক
দুধের গেলাশে ঘুমোবার আগে; কী-যে সুখ
পেতেন বালিশে মাথা রেখে,
স্বপ্নের ছায়ায় যেত দু’চোখের পাতা ঢেকে।

এখন এ-ঘরে কেউ নেই, শুধু,
আস্তেসুস্থে যাচ্ছে পুড়ে বিবাগী লোবান।
এত কিছু আছে ঘরে-আসবাব, বই তবু এ-ঘর বিরান
মাঠ, আদিগন্ত ধুধু!
কলতলা ভরে আছে শূন্য মাটির কলসে, পথে
যাচ্ছে ঠেলাগাড়ি খুব কাতরাতে কাতরাতে,
কেশর নাড়ছে ঘোড়া, নীল মাছি এসে বনে ভিখিরীর ক্ষতে,
আয়াতের ধ্বনি লগ্ন ধোঁয়া-ধোঁয়া সুগন্ধের সাথে।

দেয়ালে মৃতের ফটোগ্রাফ,
পড়েছে ধুলোর কিছু ছাপ,
ছবির দু’চোখ দ্যাখে চেয়ে কৌতূহলে
নিজেকে কাফন মোড়া, টেবিলে রয়েছে পড়ে বসি
বেলফুল কিছু, শিয়রে স্মৃতির মতো জ্বলে
নিভৃত আগরবাতি, ফটোর সস্মিত ঠোঁটে কেমন রহস্যময় হাসি।

Exit mobile version