স্পন্দমান শ্যামল পল্লব
পুরিয়া ধানেশ্রী শুনে অপরাহ্নে তিনটি হরিণ
কোমল আসবে বলে বসে আছো নিরালায় হাত-পা
ছড়িয়ে, উঠোনে উর্দি পোহাচ্ছে নিস্তেজ রোদ, তুমি
ক্লান্তমনে চিঠি লেখো। পত্রে মৃত কবিদের কিছু
পংক্তি অবেলায় খুব মোহন সজীব হয়ে ওঠে।
নানা ফটোগ্রাফে বন্দি শৈশব কৈশোর কিং। হৈ হৈ
যৌবন সহসা জ্বলজ্বলে গান গায় গলা ছেড়ে।
চিঠিতে ইমন বাজে, সেতু ভাঙে, সারি সারি বাড়ি
ধূলিসাৎ, ত্র্যামবুলেন্স দ্রুত ছোটে, সঙ্গীর আঙ্গুলে
নিভে-যাওয়া সিগারেট, চোখ নীলিমায় কী হিমেল
ওল্টানো এবং কারো উষ্ণ রমণীয় ঠোঁট স্মৃতি
হয়ে গলে যায় আর চোখের পাতায় বৃষ্টি নিয়ে
পথ হাঁটে একজন। বন্দুকের নল স্বপ্ন দ্যাখে
রূপসীর হাতে মৃদু স্পন্দমান শ্যামল পল্লব।
স্বপ্নের কাঙাল
লোকটার আপন বলতে কেউ নেই এ জগতে।
ঘোরে পথে পথে
সারাদিনমান একা-একা। থাকে না সে সাতে পাঁচে
কারো, নেই তার সড়কি ও ঢাল খোল কি কর্তাল, আছে
শুধু দুটি হাত আর যা যা থাকে খুব সাধারণ
একটি লোকের। তাকে করলে বারণ
কোথাও বসতে কিংবা সামান্য দু’-চার কথা বলতে, সে মাথা
হেঁট করে চলে যায় চুপচাপ। কোনো ছুতোনাতা
ধরে কারো দাক্ষিণ্যের হাত
ধরবার সাধ নেই তার, দু’বেলা দু’মুঠো ভাত,
পিঠ রাখবার মতো একটা মাদুর আর
মাথা পাতবার
একটি বালিশ পেলে দিব্যি তার দিন কেটে যায়
যে-কোনো সংকীর্ণ আস্তানায়।
এক ঢিলে দু’পাখি শিকার করে যারা প্রায়শই
সে নয় তাদের দলে। মই
বেয়ে তরতর
অনেক উপরে উঠে শিস বাজানোর
কায়দা অজানা তার। রুচি
নেই খয়রাতি অন্নে। আর জেনেছ অশুচি
বলে চুরিচামারিকে। কিছুই চাহিদা নেই, চায় সে কেবল
একটি আকাশ পর্যটক মেঘদল
দেখবার, তারা গুণবার। মাঝে-মধ্যে এক অলৌকিক ডাল
থেকে পাড়ে স্বপ্নফল, লোকটা নিরীহ আর স্বপ্নের কাঙাল।
স্মৃতিময় সুর
চলে যাই অবচেতনের বনে, নিমজ্জিত দিকে
মাঝে মাঝে; রঙিন পেন্সিল কিছু ঘুমের ভেতরে
নিরিবিলি লাল নীল বারান্দায়, শান্ত ছোট ঘরে
কেবল গড়িয়ে যায়। কতিপয় এলেবেলে, ফিকে
ফটোগ্রাফ নৃত্যপর; কে কিশোরী জানালার শিকে
কপাল ঠেকিয়ে চেয়ে আছে, মেঘের নানান স্তরে
বাঁশি-অলা হেঁটে হেঁটে ডাকে স্বপ্নজাগানিয়া স্বরে,
মায়াবী খাতায় কারা কিছু নাম রেখে যায় লিখে।
এখন কোথায় তারা এই শতকের গোধূলিতে?
কতকাল দেখি না তাদের, কণ্ঠস্বর কোন্ দূর
মেঘের আড়ালে লুপ্ত। কারো ভেলা ভাসে নিরুদ্দেশে,
কেউ কেউ রাজনীতি নিয়ে মাতে, কেউ-বা নিমেষে
বর্ধিষ্ণু সমাজপতি; আমি শুধু গভীর নিশীথে
জন্মকানা ঘরে একা কলমে তুলছি স্মৃতিময় সুর।
হাসান এবং পক্ষিরাজ
এই পঙ্ক্তিমালা
তোমার উদ্দেশে লেখা, একটি যুগের সূর্যোদয়
সূর্যাস্তের গহন উদ্দেশে লেখা। এই শব্দাবলি
তোমার চোখের কাছে, সুস্মিত ঠোঁটের কাছ যদি
প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়, চায় হৃদয়ের বসন্ত-উচ্ছ্বাস,
তাহলে ফিরিয়ে তুমি নিও না তোমার
কালদগ্ধ ঋদ্ধ মুখ।
তোমাকে প্রথম দেখি,
মনে পড়ে, সেই কবে আমাদের প্রিয় উন্মাতাল
এই শহরের চৌরাস্তায়, বুড়িগঙ্গা নদীটির
খুব কাছে দ্বিপ্রহরে। কমলালেবুর দোকানের প্রান্ত ঘেঁষে
আমরা সেদিন রৌদ্রপায়ী যে সুনীল আকাশের নিচে
দাঁড়িয়ে বলেছি নানা কথা এলোমেলো, সে আকাশ
এখনো আকাশ একই।
অথচ আমরা দ্যাখো
কী দ্রুত বদলে গেছি, দশকে দশকে পাল্টে গেছি; চুলে
আমার ধরেছে পাক, তোমার মাথায় প্রতিশ্রুতিশীল টাক,
তেমন মসৃণ নেই আর ত্বক; তুমি, কী আশ্চর্য, বেলাবেলি
ছুঁয়েছো পঞ্চাশ সদ্য, আমি
খবরের কাগজ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সম্প্রতি হাঁটে শেখা
নাতির মোহন নাচ দেখি!
বন্ধু, মনে পড়ে
আমাদের দুজনের কবিতা ক্লাশের দুই প্রতিযোগী অথচ সুহৃদ
শিক্ষার্থীর মতো গলাগলি হেঁটে গেছে কতকাল।
মধুর ক্যান্টিন, আমতলা কতবেলা
দেখেছে তরুণ শত শত; সেই ভিড়ে তুমি ছিলে
উজ্জ্বল শ্যামল তলোয়ার,
মনীষা মৌলিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ সতত।
দ্বান্দ্বিক হেগেল, মার্কস আর
ফ্রয়েডের মেধার কিরণে উদ্ভাসিত, দাঙ্গার পাঁচটি গল্পে
নিমগ্ন বিষণ্ন আর এলিয়টি পঙ্ক্তি-আওড়ানো
ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় পথে তুমি আর আমি, কখনো জীবনানন্দে,
কখনো সুধীন্দ্র দত্তে, কখনো-বা বুদ্ধদের বসুতে আপ্লুত
ভাসিয়ে দিয়েছি ভেলা নিরুদ্দেশে দেখেছি বিজন মরুদ্বীপ,
নাবিকের করোটি, প্রবীণ প্রস্পেরোর গুহামুখ।
তোমার কি মনে পড়ে আজ
রাজনীতি নাম্নী এক চণ্ডীর দুন্দুভি? মনে পড়ে রাত জেগে
অজস্র ভূতলবাসী ইশতেহার পাঠ? মনে পড়ে বায়ান্নোর
ভয়ংকর সুন্দর সে রক্তপদ্মে অধীর চুম্বন? তুমি গ্যাছো
অন্ধকার প্রেসে একা জ্বালাতে নিষিদ্ধ দিপাবলী
এবং গলির মোড়ে জ্বলজ্বলে চোখে পক্ষিরাজ খুঁজে খুঁজে
কেটেছে আমার সন্ধ্যা, কত মধ্যরাত।
বসে আছে লোকটা একাকী;
অস্ত গোধূলির দিকে চোখ রেখে ভাবে, একদা সে
যেসব কপোত হেসে উড়িয়ে দিয়েছে আসমানে,
কখনো আসে নি ফিরে ওরা, ফলিয়েছে যে-ফসল, অবেলায়
তা-ও গ্যাছে নষ্ট হয়ে পঙ্গপালী তুমুল তাণ্ডবে। আজ তার
সত্তাময় হরিণের পদচ্ছাপ, হরিণ উধাও ধূলিঝড়ে।
একাকী লোকটা সিংহমূর্তির ছায়ায় বসে ভাবে।
একাকী লোকটা আমি, নাকি
তুমি! মৃত্যু-গোঁজা অন্ধকারে চলে খোঁজা অবিরাম;
আমার সম্মুখে চোরাবালি, তোমার অনুপস্থিতি;
তোমার সম্মুখে বালিয়াড়ি, আমিহীন
আমার দুঃখিত পদচ্ছাপ। জীবনকে মনে হয়
দীর্ঘশ্বাসময় ডাকঘর, শূন্য স্তব্ধ নিরালোকে;
ছিঁড়ি শুধু পত্রহীন হলুদ লেফাফা।
বিমুখ প্রান্তরে, হে সতীর্থ, হে সুহৃদ,
এখনো আমরা আছি; এখনো সম্বল শুধু আর্ত শব্দাবলি।
অক্ষরে উঠেছো গড়ে স্তরে স্তরে তুমি প্রতিষ্ঠান
এবং হাসান হাফিজুর রহমান যিনি, তাঁকে
এড়িয়ে এখনো আমি মাঝে-মধ্যে সেই কবেকার
হাসানকে খুঁজে ফিরি, যেমন একদা খুঁজতাম পক্ষিরাজ;
তখন নিজেকে, বন্ধু একা, বড় একা মনে হয়।