মোটেই যথেষ্ট নয়
নেভানো ঘরের আলো, আধপড়া ক্লেদজ কুসুম
বিছানায় শুয়ে আছে এক প্রস্থ স্বপ্নের মতন।
মনে মনে, ‘মোটেই যথেষ্ট নয় একটি জীবন’,
বলে আমি নীলিমার অনুগ্রহ চাই। চোখে ঘুম
নেই এক ফোঁটা, শুয়ে শুয়ে ভাবি আকাশ-পাতাল,
মুহূর্তের কুঁড়ি কত দ্রুত ঝরে যায়। মোমবাতি
ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলে হাওয়ায় ধোঁয়ায় মাতামাতি
যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণই বাঁচা, স্মৃতিময় কাল।
একটি গহন নৌকো দুলে দুলে আসে বহুদূর
থেকে, যেন স্বপ্ন করবে বিলি, মাঝিটার দাড়িময়
মুখ আলো-আঁধারিতে অত্যন্ত রহস্যময়। সুর
সে কোন্ দ্বীপবাসিনী মোহিনীর, ভেসে আসে। নয়
সে আমার কিংবা অন্য কারো। না-লেখা কবিতা ফের
দেয় হানা মগজের কোষে, দেবদূতী ডানা
ঝলসিত অন্ধকারে। দেয়ালের সংকীর্ণ সীমানা
বেড়ে যায়, মুখ ভেসে ওঠে অজানা সুন্দরীদের।
হাতের তালুর মতো নিজস্ব শয্যায় ছটফট
করি, যেন জালে-পড়া মাছ। অতিদূর কাল থেকে
কে বীণাবাদক আসে, তার সুরে ক্রমে যায় ঢেকে
ঘরবাড়ি, আসবাব; জেগে ওঠে ভিন্ন প্রেক্ষাপট।
একটি উদ্যান পুষ্পস্বপ্নে খুব বিভোর বিহ্বল;
জীয়ন-মন্ত্রের ধ্বনি ছিল ওষ্ঠে যার, সেকি আসে
উদ্যানে ফিরোজা শাড়ি গায়ে নম্র পায়ে, মধুমাসে?
আমার সমাজদ্রোহী বুকে লাগে চোখের কাজল?
সহসা ঝলসে ওঠে কবেকার দেখা শান্ত ঝিল,
নিঝুম দুপুরে রৌদ্রে রঙিন সাইনবোর্ড, নিম
গাছ, তাকে রাখা বাঁশি, জলছবি, পিতল পিদিম-
অতীতের দিনগুলি পিকাসোর অনশ্বর নীল।
উঠোনে খুঁটছে পাখা একজোড়া হাঁস, রোদ ঝরে
গাছের পাতায়, পাখি-চোখে, আর সুঠাম তরুণী
বিড়ালছানাকে খেতে দিচ্ছে দুধ, সুনীল চিরুনি
পোহায় সুস্নিগ্ধ ছায়া ড্রেসিং টেবিলে ছোট ঘরে।
আবেশে তাকিয়ে থাকি, বস্তুগলি বস্তুকে ছাড়িয়ে
পৃথক আকৃতি পায়, রেকাবিতে আপেলের মধ্যে
জন্ম নেয় আরেক আপেল, দোল লাগে স্থলপদ্মে-
পড়ে না চোখের পাতা, পাছে যায় এ দৃশ্য হারিয়ে।
স্বপ্নময় এই দেখা কতটুকু দেখা? এ বীক্ষণ
নিমেষে ফুরায়, শুধু কিছু মিশ্র স্মৃতি পড়ে থাকে
বাবুই পাখিই ভাঙা বাসার ধরনে। প্রতি বাঁকে
মনে হয়, মোটেই যথেষ্ট নয় একটি জীবন।
মৌনব্রত
আমার উদারচেতা পিতামহ, যাঁকে আমি কখনো দেখি নি,
শুনেছি সর্বদা তিনি থাকতেন অত্যন্ত নিশ্চুপ,
এমনকি তাঁর অঙ্কশায়িনী ছিলেন যিনি, তিনি
কোনোকালে তাঁকে অপরূপ
অন্তরঙ্গ প্রহরে প্রগল্ভ হতে দেখেছেন, এমন প্রমাণ
রাখেন নি আমাদের পরিবারে সে সিংহপুরুষ। পুত্র তাঁর,
আমার জনক, মাঝে মাঝে মুখ খুললেও, জোটে নি সম্মান
তাঁর বাক্যবাগীশের কোনোদিন। আর
আমি সেই কবে থেকে জিভের জড়তা
নিয়ে আছি অসহায়, অত্যন্ত বিব্রিত
বাক্পটুদের ভিড়ে। এবং আমার পুত্র কথা
বলতেই শিখলো না, তার কী ভীষণ মৌনব্রত!
যাবার মুহূর্তে
একজন লোক
যতই খেয়ালী, নির্বিকার, যতই উদাস হোক
যখন সে আপন নিবাস ছেড়ে দূরে, বহুদূরে চলে যায়,
যদি তাকে চলে যেতে হয় ভিন্ন দেশে,
তখন সে ম্লান হেসে
কী-যে ভাবে, বলা দায়।
সে কি তার বিষয় আশয় নিয়ে খুব বিচলিত
বোধ করে? নাকি ভীত,
সন্ত্রস্ত বিদায় নিতে পারলেই বাঁচে সব ছেড়ে-ছুড়ে?
সকল ভাবনা জুড়ে
তাঁর দামি আসবাব নয়, অথবা দলিল-দস্তাবেজও নয়,
ভয়, শুধু নামহীন ভয়।
নিজের নিবাস থেকে যাবার মুহূর্তে কেন যেন বারবার
মনে পড়ে তার
রেকাবিতে রাখা কিছু ফুল
স্টেনলেস চায়ের চামচ, তালা, ছাইদানি, দরজার কড়া
আর খাঁচাবন্দি পাখিটির কী ব্যাকুল
নিয়ন্ত্রিত ওড়াউড়ি, কোণে রাখা ঘড়া-
যারা জানবে আন কোনোদিন,
কোথায় যে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এমন সম্বলহীন
যেমন মায়ের ডাক
যেমন মায়ের ডাক মধ্যবয়সেও শৈশবকে
ডেকে আনে বাগানের ছায়া, পেয়ারা গাছের পাতা,
ঘুমপাড়ানিয়া গান, তিন পয়সার বাঁশি আর
পাখির বাসার ঘ্রাণসহ, তেম্নি উচ্চারিত হলে
বাংলাভাষা, অস্তিত্বের তন্তুজালে কী মোহন ঢেউ
বয়ে যায়, নীল পাখি গান গায় শিরায় শিরায়,
ব্যাপক খরায় নামে বৃষ্টিধারা, করুণা-কোমল,
আবার নতুন করে ফুটে ওঠে বাঁচার বিস্ময়।
মাতৃময় মমতার চোখের পাতায় উন্মীলিত
বিদ্যাসাগরের বর্ণবোধ, পিতার হাতের তালু,
খড়িমাটি-অক্ষরের চিরকেলে স্লেট। বুঝি তাই
প্রহরে প্রহরে হরিণের চোখে, ঘরের দেয়ালে,
পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার চোয়ালে, অন্ধ গায়কের তানে,
এমনকি স্তব্ধতার কাছেও চেয়েছি বর্ণমালা।
রন্ধনশিল্পের খুঁটিনাটি
ছিলাম লেখার কাজে ডুবে, পলাতক শব্দ খুঁজে
বেলা যায়, উপমার মৃগষূথ অদৃশ্য বেড়ায়
জটিল অরণ্যে, পরাবাস্তবের গহন ডেরায়
হানা দিয়ে পাই না কিছুই, তাই আমি মাথা গুঁজে
পড়ে থাকি সুনসান মনোনীত নিজস্ব গম্বজে।
হঠাৎ দাঁড়ালে তুমি টেবিলের ধার ঘেষে মন
ভীষণ মেঘলা করে। কেননা, কিচেনে সারাক্ষণ
খেটেও হাঁসের রোস্ট পুড়ে খাক, এত বুঝে-সুঝে
রান্না স্রেফ পণ্ডশ্রম। অথচ তুমিও মক্ষিরাণী
প্রকৃত রন্ধনশিল্পী; ভাবি পাচক এবং কবি
দুজন অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। কত চিত্রকল্প জানি
নিমেষেই পুড়ে যায় অতিরিক্ত আঁচে আর ভুল
ফোড়নে অনেক বাক্য কেমন বিস্বাদ লাগে। ফুল
নেই শব্দে ছন্দে, তবু মাঝে মাঝে স্ফুরিত সুরভি।
সে-রাতে পার্টিতে তুমি
সে-রাতে পার্টিতে তুমি ছিলে খুব প্রফুল্ল মেজাজে
প্রায় সারাক্ষণ, খোলাছাদে মৃদু কথোপকথন
নারী পুরুষের আর জোৎস্নার মদির বিচ্ছুরণ
দেহমনে; তুমি ছিলে রূপসী মহিলাদের মাঝে
আশ্চর্য সুদীপ্ত, ছিলে সুসজ্জিতা রুচিস্নিগ্ধ সাজে।
আবহাওয়া, রাজনীতি, চিত্রকলা, ফ্যাশান, দর্শন
জিভের ডগায় ঘোরে কারো কারো, মেধার কর্ষণ
চলে অবিরাম, বারান্দায় ক্যাসেটে সরোদ বাজে।
তবেক গপ্পে ছিলে মেতে। কী-যে হলো, হঠাৎ নিশ্চুপ
হয়ে গেলে তুমি, যেন পার্টি ছেড়ে চলে গেছো দূরে
বহু দূরে। নিভৃত শরীর দেখলাম নগ্নতায়
উদ্ভাসিত এবং তোমার ঊরু, স্মিত যোনিকূপ
সতেজ ঘাসের স্পর্শ মাটির আঘ্রাণ পেতে চায়,
স্তনচূড়া, নাভিমূল শিহরিত আরণ্যক সুরে।