পান্থজন
বহু পথ হেঁটে ওরা পাঁচজন গোধূলিতে
এসে বসে প্রবীণ বৃক্ষের নিচে ক্লান্তি মুছে নিতে।
গাছের একটি পাখি শুধায় ওদের-
‘বলতো তোমরা কারা?’ প্রশ্ন শুনে পান্থজন
ঝুঁকে পড়ে নিজের বোধের
কাছে; বলে একজন, ‘হিন্দুত্বের প্রতি আজন্ম আমার টান।
দ্বিতীয় জনের কণ্ঠ বাঁশির মতন
বাজে, ‘আমি বৌদ্ধ, হীনযান।
এবং তৃতীয় জন বলে, ‘আমি এক নিষ্ঠাবান
বিনীত খ্রিস্টান।
চতুর্থ পথিক করে উচ্চারণ, আমার ঈমান
করেছি অর্পণ আমি খোদার আরশে,
আমি তো মুসলমান।
পঞ্চম পথিক খুব কৌতূহলবশে
কুড়িয়ে পতঙ্গ এক বলে স্মিত স্বরে, ‘আমি মানব সন্তান।
পাস্তারনাকের কবরে
হঠাৎ গেলাম পৌঁছে একদিন; ছিল না প্রস্তুতি
এক রত্তি, দীর্ঘকায় রুশ যুবা নিরিবিলি পথ
নিশ্চুপ দেখিয়ে নিয়ে যায়, হাঁটি আমি ছায়াবৎ,
শুনি ফুল করে স্তব নিরালায়, পাখি গায় স্তুতি।
আছেন ঘাসের নিচে শুয়ে একা, বড় একা কবি
অনন্তের আলিঙ্গনে অতিশয় অগোচরে। খোঁজ
সহজে মেলে না যত্নহীন কবরের, শুধু রোজ
সেখানে নিঝুম বাজে নিসর্গের ভৈরবী, পূরবী।
নিঃশব্দে দাঁড়াই ছায়াচ্ছন্নতায়; কিছু ঝরাপাতা
কবরকে চুমো খায়, তন্বী লতা রাষ্ট্ররোষে দগ্ধ
নিঃসঙ্গ কবিকে দ্যায় চুপিসারে ঠাণ্ডা ছায়াঞ্জলি।
তাঁর জন্ম জয়ন্তীতে তরুণ তরুণী শান্ত, স্তব্ধ
পায়ে আসে এ নিষিদ্ধ তীর্থে এবং নোয়ায় মাথা,
রাখে কিছু ফুলের স্তবক, নিবেদিত পদাবলী।
ফিরে আমি তোমার কাছেই
পথক্লেশ আছে, আছে তৃষ্ণা, ক্ষয়ক্ষতি, ক্ষয়চিহ্ন
নিয়ে তবু ফিরে আসি তোমার কাছেই।
একদা যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, হয়েছিল চেনাশোনা,
তারা কি হারিয়ে গেছে অলক্ষ্যে সবাই? এতকাল
পরে আজো যখন নিভৃত
জানালায় এসে বসে প্রজাপতি কিংবা ছাদের কার্নিশে পাখি
গান হয়, অকস্মাৎ কারো
অস্পষ্ট মুখের রেখা মনে পড়ে যায়, কখনো-বা
চায়ের বাটিতে ঠোঁট রাখার সময় মনে পড়ে আগেকার
সুগন্ধি চুম্বন অগণন;
মনে পড়ে, নজরুলী গজলের মোহন ছায়ায়,
রবীন্দ্রানাথের
অলৌকিক গীতবিতানের সীমাহীন মানবিক মমতায়
আমাদের ভালোবাসা পেয়েছিল সঞ্জীবনী সুর
মারী ও মড়কে দাঙ্গা হাঙ্গামায়, ক্রুর খুনখারাবির কালে।
এখন সকল কিছু ছাপিয়ে তোমার মুখ পিকাসোর দীপ্র
নানান আয়তনিক নারীর মুখশ্রী হয়ে যায়
হৃদয়ে আমার।
আমার উঠোনে ঘরে যাচ্ছে বয়ে পড়স্ত বেলার
রৌদ্রের ঢেউয়ের মতো বিশ শতকের
গহন পূরবী।
কখনো একটি হাত গীতিকবিতার মতো সুস্মিত স্পন্দনে
আমার নির্জন কাঁধে নেমে আসে, সে-হাতে চিত্রিত প্রজাপতি,
আদিম পত্রালি কিছু দেখা যায়। কখনো আমার
রুটিতে স্বপ্নের মধু ঝরে, ঝরে বিন্দু বিন্দু, হা-ভাতে বেলায়।
সুপ্রভাত, ফ্যাক্টরিতে তৈরি হচ্ছে বিপুল ব্যান্ডেজ
রাশি রাশি;
সুপ্রভাত, ফ্যাক্টরি উগরে দিচ্ছে ক্রাচ কোটি কোটি;
সুপ্রভাত, ফ্যাক্টরি উগরে দিচ্ছে অস্ত্র, মারণাস্ত্র, টন টন;
সুপ্রভাত দিকে দিকে মৃত্যুর চোখের মতো চকচক করে
জেনারেলদের বুট পৃথিবীর ম্যাপের ওপর;
সুপ্রভাত, ভীষণ উঠছে দুলে বাসুকির ফণা বারংবার;
সুপ্রভাত, নারীর কোমল হাত দৈনিক সংবাদপত্র
হয়ে যায় ধুধু;
সুপ্রভাত আমার অনামিকায় আজ
হঠাৎ দিলেন নৃত্য জুড়ে নটরাজ!
পথক্লেশ আছে, আছে তৃষ্ণা, ক্ষয়ক্ষতি, ক্ষয়চিহ্ন
নিয়ে তবু ফিরে আসি তোমার কাছেই।
সন্তের ধরনে ধ্যানী চেতনায় জ্বলে
চোখের বদলে চোখ, অধরের বদলে অধর, হৃদয়ের
গহন ধ্বনির মতো
শব্দের বিন্যাসে এনে তোমাকেই কবিতা বানাই।
বদ্ধ এ ঘরে
এই তো এখানে দোর-আঁটা এক
নিশ্চুপ ঘরে একা একা বসে আছি।
মুহূর্তগুলি কাঁপে চোখে মুখে,
স্বপ্নের সাথে খেলি রোজ কানামাছি।
নিচে রাস্তায় প্রহরে প্রহরে
চলে অবিরাম ট্রাফিকের মাতলামি।
নৈরাশ তোলে কালো হারপুন,
এদিকে বয়স ভীষণ অস্তগামী।
ইতোমধ্যেই সাত কাপ চায়ে
নিয়েছি ভিজিয়ে বেজায় তৃষিত গলা,
পলায়নপর যৌবন, তবু
থামে নি শিরায় দুরন্ত-হীরে-জ্বলা।
ওমোট গরমে কেমন বন্য
গন্ধ ছড়ায়, মেঝেতে দীর্ঘ ঘাস
এবং আমার সত্তায় লাগে
তামাটে ঘোড়ার জ্বলন্ত নিশ্বাস।
বদ্ধ এ ঘরে চকিতে স্মৃতিতে
স্পেনের কবিতা দ্রাক্ষার মতো দোলে।
সুদূর সুনীল গীটারের সুরে
অন্ধ এ মন অস্ফুট চোখ খোলে।
বদ্ধ এ ঘর হঠাৎ কখনো
উঠবে কি হেসে নামহীন বৈভবে?
যদি তুমি আসো, নিমেষে এ ঘর
মায়াকাননের চির প্রতিযোগী হবে।
বলবেন চিরদিনই
সন্ধ্যাও এমন হয় কখনো ভাবি নি কোনোদিন।
আমি একা বড় একা, উপেক্ষিত, ভাবলেশহীন
কাঠের চেয়ারে বসে থাকি এক ভিড়
মানুষের মাঝে; দিনগত কায়ক্লেশ বাড়ে, কখনো নিবিড়
দয়ার্দ্র নক্ষত্রগুচ্ছ খুঁজি, নানা টুকরো কথা, যেন স্বপ্নে বলা
ভেসে আসে। কেউ খুব গলা
চড়ায় না, শিষ্টাচারে মসৃণ সবাই, বলা যায়।
কেউ কেউ আশপাশে খানিক তাকায়,
এবং অনেক দূর থেকে
হঠাৎ তোমাকে দেখি, যেন তুমি নিজেকে রহস্যে ঢেকে
বসে আছো কোনো গ্রিক দেবীর ধরনে
পারিপার্শ্বিকের প্রতি উদাসীন। চক্ষু-তৃষ্ণা বাড়ে, ক্ষণে ক্ষণে,
আমার ব্যাকুল দৃষ্টি তোমার দিকেই যেতে চায়,
যেমন দিনান্তে ক্লান্ত পাখি তার নিজস্ব ডেরায়।
সন্ধ্যা পাপড়ি মেলে সরোদের অলৌকিক
রাগশ্রী আলাপে, চতুর্দিক
আলী আকবরময়। গেরস্তের বাড়িঘর, ইটকাঠ আর
পুঁইমাচা, ফুলকপি, মঞ্চ শামিয়ানা, সারি সারি সুদৃশ্য মোটরকার
চকিতে সরোদবন্দি। মনে হয়, তুমি আর আমি অকস্মাৎ
রুপোর পাতের মতো সরোবরে কাটছি সাঁতার-
তোমার দু’হাত
আমার আপন হাতে খেলা করে, আমি বারংবার
তোমার জলজ ঠোঁটে ঠোঁট রাখি, শুনি হৃৎস্পন্দন
তোমার এবং আমাদের ওষ্ঠের যুগলবন্দি শেষ হলে
সুরে সুরে, ক্ষিপ্র বোলে বোলে
ভেসে যাই দূর পরাবাস্তব নিঃসীম নীলিমায় দীগ্র আমরা দুজন।
কখনো তোমাকে দেখি ছুটে যাচ্ছো, ছুটে যাচ্ছো শুধু
হাওয়ায় উড়ছে চুল, আমি একা ধু ধু
বালির পাহাড়ে পড়ে থাকি; ইচ্ছে হয় তোমার সান্নিধ্যে গিয়ে,
চেনা, আধচেনা মানুষের ভিড়ে হিল্লোল জাগিয়ে
গূঢ় দৈববাণীর মতোই বলে আসি-
ভালোবাসি, আজো তোমাকেই ভালোবাসি।
আমার হয় না বলা, আমার হয়েই বলছেন ঐ যে তিনি,
সাধক সরোদ, বারে বারে, ‘ভালোবাসি’, বলবেন চিরদিনই।