খেলা
আমার দু’বছরের নাতি বেজায় চঞ্চল, করে,
ছোটছুটি সকল সময়, ওর জন্যে সারাঘরে
কোনো কিছু ঠিক রাখা মুশকিল, হয়ে যায়
ওলট-পাল্ট সব চোখের পলকে। বিছানায়
লাফিয়ে পড়ে সে হয় বন্য টারজান। ছোট্র পায়ে
মারে রাঙা বল বার-বার; কখনো সে ডিঙি নায়ে
দাঁড় বায়, কখনো-বা বাগিয়ে বন্দুক তেড়ে আসে
হঠাৎ আমার দিকে। আমি কাঁপি অভিনীত ত্রাসে,
যখন সে অবিশ্বাস্য দানো হয়ে করে তছনছ
খুঁটিনাটি জিনিসপত্তর, তলোয়ারে খচ্খচ্
কাটে বায়বীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুণ্ডু। জেগে থাকে
যতক্ষণ, ততক্ষণ নানা খেলা ব্যস্ত রাখে তাকে।
আমিও তো এই নিশুটির মতো রয়েছি খেলায়
মেতে সারাক্ষণ, শব্দ নিয়ে খেলি শব্দের মেলায়।
ঠিকানা জানা নেই
কাব্যশ্রী আমাকে কিছুকাল আগে একটি চিঠিতে
লিখেছিল, “ভেবেছিলে চিরদিন থাকবো তোমার
হাত ধরে অন্ধকার ঘরে, শুধু এই চৌহদ্দিতে
লুটিয়ে আঁচল আমি আনন্দে বেড়াবো ঘুরে আর
আমাকে করবে তুমি খুচরো আদর হেলাফেলা
করে, যেন আমি পোষা বিড়াল, জঞ্জাল থেকে উঠে-
আসা?” মনে পড়ে, কতদিন তার চুলে রাত্রিবেলা
ঢেকে গেছে মুখ, বুক আমার এবং তীব্র ফুটে
উঠেছে কামের গন্ধরাজ সত্তাময়, কখনো-বা
দিয়েছি লাগিয়ে ব্রা-র হুক, দেখিয়ে কী নগ্নশোভা
নিয়েছে জড়িয়ে গায়ে শাড়ি
সাত তাড়াতাড়ি।
এখন সে নেই আর আমার নিবাসে। অকস্মাৎ
মাঝে-মধ্যে দেখি তাকে
বনানীর বাসস্টপে, হাত
নেড়ে আর উড়িয়ে আঁচল চলে যায়
কে জানে কোথায় দূরে! তখন আমার রক্তে ডাকে
একটি অচিন পাখি! যত্রতত্র ঘোরে গরবিনী
আজ এ তরুণ কাল সে যুবার সঙ্গে হাওয়ায় বেড়ায়,
কখনো জমায় গল্প কফিহাউসে, কখনো রিনিঝিনি
বেজে ওঠে রুলি তার মেথর পট্রিতে। আঁতিপাতি
খুঁজেও পাই না তার ঠিকানা নিজের কাছে। ভাবি
শুধু তাকে, যে ছিল একদা অষ্টপ্রহরের সাথী।
নেই কি আমার কোনো দাবি
আর তার কাছে? কালেভদ্রে চিঠি লেখে
ঠিকানাবিহীন দূর থেকে।
তাঁর উপদেশ সত্ত্বেও
সেই কবি আমি শার্ট আর ট্রাউজারের জঙ্গলে
প্রবেশ করেছি; বুটিদার জ্বলজ্বলে
কারুকাজময়
কত শার্ট আর কত রঙের বাহার।
চতুর্দিকে স্তূপ স্তূপ কোট, টাই, ফুল্ল জামিয়ার
আমার দু’চোখে আনে এভারেস্ট দেখার বিস্ময়।
হতভম্ব আমাকে জঙ্গলে দেখে একজন অনশনক্লিষ্ট
দরবেশ বললেন, ‘হয়ো না আবিষ্ট,
বরং গ্রহণ কর জামার সন্ন্যাস,
হও নাঙা বৃক্ষের মতন, যেন লকলকে ঘাস
তুমি, ভেবে নাও। অনন্তর আমার সে দীক্ষাগুরু,
অনশ্বর রৌদ্রে নাঙা ঘূর্ণি নাচ করলেন শুরু।
এরপরও কেটে গেছে দীর্ঘ কতকাল-
হা কপাল, এ আমার কেমন বন্ধন দশা আজো অব্যাহত!
বিশ শতকের অস্তরাগে স্বভাবত
আমার নিজস্ব মনোনীত প্রতারক বৃক্ষচ্ছায়ে
একাকী দাঁড়িয়ে আছি কশিদায় স্মিত মেরুন পাঞ্জাবি গায়ে।
তুচ্ছ মনে হয়
ক তার নিজের কাছে প্রত্যহ আপনকার ছবি তুলে ধরে,
চেয়ে চেয়ে দ্যাখে, ভালো করে, পষ্ট করে, সব কিছু
দেখে নিতে চায়।
অথচ ঝাপ্সা লাগে কত কিছু, কত কিছু ভীষণ বিকৃত;
চোয়াল চোয়ালে নেই, চোখ নেই চোখের কোটরে,
হস্তদ্বয় উদরসদৃশ,
মাথায় সুতীক্ষ্ণ শিং কম্পমান সারাক্ষণ। ক তার নিজের
ছবি দেখে একরত্তি হয় না বিস্মিত।
কপালে পড়ে না কোনো ভাঁজ,
একটু কাঁপে না ওষ্ঠ, চোখে নেই ঢেউ কোনো-একজন যন্ত্র
আরেক যন্ত্রকে যেন ভাবলেশহীন দ্যাখে বিভ্রান্ত আঁধারে।
‘কখন এমন পাল্টে গিয়েছি বলো তো’, নিজেকেই বারংবার
প্রশ্ন করে, নিরুত্তর বসে থাকে স্বপ্নহীন প্রহরে প্রহরে।
টিনের চেয়ারে বসে প্রায়শ ক দ্যাখে অন্তরালে
আলখাল্লা পরা ঐন্দ্রজালিক কী মায়া
গোপনে দেখায় তাকে যখন তখন। কখনো-বা
টিনের চেয়ার মেঘদেশে
মিশে যায়, খায় ঘুরপাক, রূপান্তরে সূর্যমুখী কোনোদিন,
কোনোদিন যাদুমন্ত্রে করে বশীভূত।
নইলে হাত কেন চেয়ারের হাতলের মতো, কেন
বুক টেবিলের স্তব্ধ বুকের মতন? এমনকি চশমাটাও
বড় টিন টিন হয়ে গ্যাছে!
ইদানীং ধবধবে জ্যোৎস্নাকে কম্বলে ঢেকে ক রঙিন বুদ্ধুদের মতো
পাখিদের বারে বারে দিয়েছে ফিরিয়ে, শেফালিকে
দিয়েছে বিদায়।
হঠাৎ ক শোনে, মাঝে-সাঝে, তার অস্তিত্বের সীমান্তের ধু-ধু
নির্জনতা ফুড়ে কতিপয় কর্কশ কংকাল হেঁটে যায় আর
কী যেন চেঁচিয়ে বলে, ভাষা বোঝা দায়। শোনে, কেউ
জপায় স্মৃতির মধ্যে যেন-
‘এখন নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে গহন তাৎপর্য কিছু খুঁজে নাও। চোখ বুজে
পড়ে থাকে এক কোণে, নিজেকে খোঁড়ার ইচ্ছাটুকু উদাসীন
মেঘ হয়ে উড়ে গেছে কবে। সকল ইচ্ছাই কত
তুচ্ছ মনে হয়,
তুচ্ছ মনে হয়।
তুমি বড় অসতর্ক
তুমি বড়ো অসতর্ক, বড়ো বেশি অসাবধানী হে।
নইলে কেন দেখতে পেলে না ঝকঝকে সূর্যালোকে
নৌকায় এলাহী ফুটো? কেন ভাঙা নৌকা তড়িঘড়ি
ভাসালে সমুদ্রে? পানি সেচে সেচে মাঝ দরিয়ায়
কী করে টেকাবে নৌকা? ভ্রমণের ঝোঁকে
বলো তো এভাবে কেউ কখনো ভাসায় ভগ্ন তরী
চোখ যার থাকে দূর পল্লবিত সঙ্গীতমুখর কিনারায়?
তুমি বড়ো অসতর্ক, বড়ো বেশি অসাবধনী হে।
ঔদাস্য তোমার সঙ্গী, তবু আশৈশব চেয়েছো আকাশ ছুঁতে
এবং চেয়েছো ছুটে যেতে দূরে আরো দূরে আরো,
পর্বত চূড়ায় পা রাখবে বলে উঠেছো উঁচুতে
অনেক, অথচ পিঠে বাঁধো নি জরুরি সরঞ্জাম।
যে-কোনো মুহূর্তে তুমি পা হড়কে ভয়াল
খাদে পড়ে যেতে পারো,
সারা গায়ে নিয়ে কালঘাম
গড়াতে গড়াতে নিচে হতে পারো বিচূর্ণ কংকাল।
তুমি বড়ো অসতর্ক, বড়ো বেশি অসাবধানী হে।
মায়াবী অরণ্যে তুমি করেছো প্রবেশ যে-বিকেলে
তা এখন ঘোর রাত্রি, সুতীব্র জৈবিক
গন্ধে মোহাচ্ছন্ন চতুর্দিকে।
সেই যে কখন তুমি গেলে,
কর্কশ পাতায় এলোমেলো বাজে শুধু পদধ্বনি;
তুমি তো অক্ষত বেরুনোর মন্ত্র এখনো শেখাওনি।