একটি ফটোগ্রাফ
‘এই যে আসুন, তারপর কী খরব?
আছেন তো ভালো? ছেলেমেয়ে? কিছু আলাপের পর
দেখিয়ে সফেদ দেয়ালের শান্ত ফটোগ্রাফটিকে
বললাম জিজ্ঞাসু অতিথিকে-
‘এ আমার ছোট ছেলে, যে নেই এখন,
পাথরের টুকরোর মতন
ডুবে গেছে আমাদের গ্রামের পুকুরে
বছর-তিনেক আগে কাকডাকা গ্রীষ্মের দুপুরে।
কী সহজে হয়ে গেল বলা,
কাঁপলো না গলা
এতটুকু বুক চিরে বেরুলো না দীর্ঘশ্বাস, চোখ ছলছল
করলো না এবং নিজের কণ্ঠস্বর শুনে
নিজেই চমকে উঠি, কী নিস্পৃহ, কেমন শীতল।
তিনটি বছর মাত্র তিনটি বছর
কত ঊর্ণাজাল বুনে
কেটেছে, অথচ এরই মধ্যে বাজখাঁই
কেউ যেন আমার শোকের নদীটিকে কত দ্রুত রুক্ষ চর
করে দিলো। অতিথি বিদায় নিলে আবার দাঁড়াই
এসে ফটোগ্রাফটির মুখোমুখি প্রশ্নাকুল চোখে,
ক্ষীয়মাণ শোকে।
ফ্রেমের ভেতর থেকে আমার সন্তান
চেয়ে থাকে নিষ্পলক, তার চোখে নেই রাগ কিংবা অভিমান।
কবিতাপাঠ
অনুগ্র আলোয় তুমি পড়ছিলে বিদেশী কবিতা
নিভৃত ড্রইংরুমে। ছিলাম তোমার পাশে বসে
ধ্বনিবন্দি; শব্দগুচ্ছ মায়াবী পাতার মতো খসে
উড়ছিল তোমার অনিন্দ্য স্বরায়নে, হে ঈপ্সিতা।
সে মুহূর্তে মনে হলো তুমি স্নিগ্ধ, প্রজ্ঞাপারমিতা,
শুনিয়ে অমোঘ সুর কবিতার চলেছো আমাকে
নিয়ে দূর ছায়াচ্ছন্ন নিবাসে, সেখানে যারা থাকে
তারা নয় চেনা তবু সবাই স্বজন, পরিচিতা।
কবিতাপাঠের পর কিছু অলৌকিক গুঞ্জরণ
থেকে যায় অথৈ স্তব্ধতায়, তুমি আশ্চর্য তাকালে
আবার আমার দিকে। একি দৃশ্য দেখি অপরূপ-
তোমার শরীর শবেবরাতের দীপের মতন
জ্বলে, চোখে অনন্তের আলো-ছায়া, আমিও নিশ্চুপ
বসে থাকি; দুর্লভ এ নান্দনিক লগ্ন ক্রান্তিকালে।
কবির কবর
রাস্তার সকল বাতি নিভে গেলে গভীর নিশীথে,
পৃষ্ঠপোষকতাহীন জ্বলে নেভে জোনাকির ঝাঁক,
দুলিয়ে স্বপ্নিল পাখা মেঘ চিরে সফেদ বোররাক
সপ্ত আসমান থেকে আসে নেমে এই সমাধিতে,
স্তব্ধ ঘাসমাটি ভিন্ন মানে পায় খুরের সংগীতে।
মাটিতে লুকানো যিনি স্বপ্নভস্মবৎ, তাঁরই নাম
দুরন্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
এখানে ফেরেশ্তা আসে কিছু নক্ষত্র ছিটিয়ে দিতে।
যখন ভোরের আলো বীণার ঝংকার হয়ে কাঁপে
মিনারে মাটিতে আর মানুষ চলার শব্দ ফোটে
পুনরায়, পুলিশ বাজায় বাঁশি কর্তব্যবশত,
কবির কবর কোনো দুঃখবাদী কবিতার মতো
কিছু রুক্ষ, ম্লান, কিছু খুব দ্যুতিময় হয়ে ওঠে।
কে উদাসী বাঁশিতে তুলছে তান মন্থর বিলাপে?
কুমোর
চোখে পড়বার কিছু নয়। শ্যামবর্ণ, মাঝারি গড়ন,
খাটো চুল ভাঙা গাল এবং ধরন
তার আর দশজন পাড়াপড়শিরই মতো। ডাল-ভাত খায়
প্রত্যহ দু’বেলা-মাঝে মাঝে রাত্তিরে ঘুমায়
জড়িয়ে কোমর ঘরণীর, যতদূর আছে জানা
বিড়ি ফোঁকে, কড়া দাড়ি কামায় রোজানা।
কী শীত কি গ্রীষ্ম
ঘোরে চাকা, চকচকে, গড়ে ওঠে ঢের
ঘটিবাটি, হাঁড়িকুড়ি নানান চাঁদের
হাতের খানিক চাপে। একান্ত আপন তার হাত,
নিশ্চিত জানে সে জগন্নাথ।
রত্নের ঝলক বুকে সারাক্ষণ, অথচ কী নিঃস্ব!
কী-যে হয় মাঝে মাঝে,
বসে থাকে চুপচাপ চাখানায় কিংবা গৃহকোণে;
কিছুতে লাগে না মন তার কোনো কাজে।
আবার কখনো রাত জেগে তারা গোনে,
এক ফোঁটা কেমন অনল
করে জ্বলজ্বল
হৃদয়ের ভেতরে, আঙুলগুলি বাস্তবের সীমা
পেরিয়ে চঞ্চল হতে থাকে অবিরত
প্রকৃত নাচের আগে নর্তকীর মতো,
ছুঁতে চায় দ্রুত পরাবাস্তবের গহন দ্রাঘিমা।
তখন নির্জন তার ধ্যানে প্রত্যহের ঘটিবাটি
নয়, নয় গাঢ় কি কলস, একজন অস্পষ্ট প্রতিমা
জেগে থাকে। প্রত্যহ সযত্নে জমায় সে ভিন্ন মাটি
প্রতিমা গড়বে বলে। গড়া হলে দ্যাখে ধ্যানে তার
যে চোখ, উদ্বেল স্তন উঠেছিল ভেসে
তা নেই মূর্তিতে; তাই ঘুমহীন প্রহরের শেষে
ক্ষিপ্র সে খুবলে নেয় চোখ,স্তনদ্বয়। ব্যর্থতার
বিছে তার আত্মাকে কামড়ে ধরে। আবার মাটির দলা তুলে
নেয় হাতে, অস্তিত্বের সমস্ত তীব্রতা দিয়ে গড়ে,
ভাঙে, পুনরায় গড়ে, ভাঙে ফের, ভুলে
থাকে স্রেফ নিজের সংসার। মূর্তি প্রতিবাদহীন,
আর্তনাদ করে না কখনো,
কেননা মাটির কণ্ঠস্বর নেই কোনো।
কুমোর ছোঁয় না অন্নজল, রাত্রিদিন
বুকের ভেতরে তার আলো অন্ধকার,
অলৌকিক উন্মত্ততা ঘূর্ণিনাচ নাচে সারা ঘরে।
ক্রূর বিনাশের ছলে
হৃদয় তুমি কি এই জন্মন্ধ আঁধারে
অচেনা পথের ধারে
ভুলে প্রাণীভুক পাদপের গলা প্রবল জড়িয়ে
ধরেছো আশ্রয় ভেবে? পত্রালি সরিয়ে
দ্যাখো কী ভীষণ সাপ দোলাচ্ছে চিত্রল ফণা তার।
স্বপ্নাশ্রিত পথচারী তুমি বারংবার
একই পথে পদচিহ্ন আঁকবার তীব্র অভিলাষ
পারো নি করতে ত্যাগ কিছুতেই। এ কেমন মরীয়া বিলাস
সর্বদা লালন করে
নিজেকেই নিয়ে গ্যাছো ধুধু শুশুনিয়া তেপান্তরে।
হৃদয় হলো না বিজ্ঞ তুমি
আজো, বুঝলে না, হায়, কাকে বলে বিষবাষ্পময় জলাভূমি,
কাকে রৌদ্রজ্যোৎস্নাঝলকিত সরোবর; হাতে তুলে
নিলে অবলীলাক্রমে সুহাসিনী ভুলে
সহসা আপনকার মৃত্যুদণ্ড। সেই শোভা স্বপ্নের মতোই
অস্থায়ী জেনেও গলা ডুবিয়ে অথই
প্রতারক জলে তুমি তার দিকে রইলে চেয়ে প্রহরের পর
প্রহর এবং অবেলায় নিজ ঘর
গেরস্থালি
করেছো নীলাম কী মোহন বিভ্রমের কাছে আর করতালি
প্রত্যহ বাজাচ্ছো ঝাঁ ঝাঁ বাদ্যরবে, মেতে,
নিজেরই জ্বলন্ত কুশপুত্তলিকা দেখে। যেতে যেতে
লোকে বলে,
আজন্ম খেয়ালী তুমি, মেতেছো সৃষ্টিতে ক্রূর বিনাশের ছলে।