বাজিয়েছিলে বীণা তোমার
বাজিয়েছিলে বীণা তোমার
দিই বা না দিই মন।
আজ প্রভাতে তারি ধ্বনি
শুনি সকল ক্ষণ।
কত সুরের লীলা সে যে
দিনে রাত্রে উঠল বেজে,
জীবন আমার গানের মালা
করেছ কল্পন।
আজ শরতের নীলাকাশে,
আজ সবুজের খেলায়,
আজ বাতাসের দীর্ঘশ্বাসে,
আজ চামেলির মেলায়–
কত কালের গাঁথা বাণী
আমার প্রাণের সে গানখানি
তোমার গলায় দোলে যেন
করিনু দর্শন।
বুদ্ধগয়া, ২৩ আশ্বিন, ১৩২১
বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ
বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ,
কেমনে দিই ফাঁকি–
আধেক ধরা পড়েছি গো,
আধেক আছে বাকি।
কেন জানি আপনা ভুলে
বারেক হৃদয় যায় যে খুলে,
বারেক তারে ঢাকি–
আধেক ধরা পড়েছি যে,
আধেক আছে বাকি।
বাহির আমার শুক্তি যেন
কঠিন আবরণ–
অন্তরে মোর তোমার লাগি
একটি কান্না-ধন।
হৃদয় বলে তোমার দিকে
রইবে চেয়ে অনিমিখে,
চায় না কেন আঁখি–
আধেক ধরা পড়েছি যে,
আধেক আছে বাকি।
শান্তিনিকেতন, ১৯ আশ্বিন- রাত্রি, ১৩২১
বৃন্ত হতে ছিন্ন করি শুভ্র কমলগুলি
বৃন্ত হতে ছিন্ন করি শুভ্র কমলগুলি
কে এনেছে তুলি।
তবু ওরা চায় যে মুখে নাই তাহে ভর্ৎসনা,
শেষ-নিমেষের পেয়ালা-ভরা অম্লান সান্ত্বনা–
মরণের মন্দিরে এসে মাধুরী-সংগীত
বাজায় ক্লান্তি ভুলি
শুভ্র কমলগুলি।
এরা তোমার ক্ষণকালের নিবিড়নন্দন
নীরব চুম্বন,
মুগ্ধ নয়ন-পল্লবেতে মিলায় মরি মরি
তোমারি সুগন্ধ-শ্বাসে সকল চিত্ত ভরি–
হে কল্যাণলক্ষ্মী, এরা আমার মর্মে তব
করুণ অঙ্গুলি
শুভ্র কমলগুলি।
শান্তিনিকেতন, ২১ আশ্বিন, ১৩২১
ব্যথার বেশে এল আমার দ্বারে
ব্যথার বেশে এল আমার দ্বারে
কোন্ অতিথি, ফিরিয়ে দেব না রে।
জাগব বসে সকল রাতি–
ঝড়ের হাওয়ায় ব্যাকুল বাতি
আগুন দিয়ে জ্বালব বারে বারে।
আমার যদি শক্তি নাহি থাকে
ধরার কান্না আমায় কেন ডাকে?
দুঃখ দিয়ে জানাও, রুদ্র,
ক্ষুদ্র আমি নই তো ক্ষুদ্র–
ভয় দিয়েছ ভয় করি নে তারে।
ব্যথা যখন এল আমার দ্বারে
তারে আমি ফিরিয়ে দেব না রে।
শান্তিনিকেতন, ২১ আশ্বিন, ১৩২১
ভেঙেছে দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়
ভেঙেছে দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়
তোমারি হউক জয়।
তিমির-বিদার উদার অভ্যুদয়,
তোমারি হউক জয়।
হে বিজয়ী বীর, নবজীবনের প্রাতে
নবীন আশার খড়গ তোমার হাতে,
জীর্ণ আবেশ কাটো সুকঠোর ঘাতে–
বন্ধন হোক ক্ষয়।
তোমারি হউক জয়।
এসো দুঃসহ, এসো এসো নির্দয়,
তোমারি হউক জয়।
এসো নির্মল, এসো এসো নির্ভয়,
তোমারি হউক জয়।
প্রভাতসূর্য, এসেছ রুদ্রসাজে,
দুঃখের পথে তোমার তূর্য বাজে,
অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্ত-মাঝে–
মৃত্যুর হোক লয়।
তোমারি হউক জয়।
এলাহাবাদ, ৩০ আশ্বিন- প্রভাত, ১৩২১
মনকে হেথায় বসিয়ে রাখিস নে
মনকে হেথায় বসিয়ে রাখিস নে।
তোর ফাটল-ধরা ভাঙা ঘরে
ধুলার ‘পরে পড়ে থাকিস নে।
ওরে অবশ, ওরে খেপা,
মাটির ‘পরে ফেলবি রে পা,
তারে নিয়ে গায়ে মাখিস নে।
ওই প্রদীপ আর জ্বালিয়ে রাখিস নে–
রাত্রি যে তোর ভোর হয়েছে,
স্বপন নিয়ে পড়ে থাকিস নে।
উঠল এবার প্রভাত-রবি,
খোলা পথে বাহির হবি,
মিথ্যা ধুলায় আকাশ ঢাকিস নে।
সুরুল, ২৯ ভাদ্র, ১৩২১
মালা হতে খসে-পড়া ফুলের একটি দল
মালা হতে খসে-পড়া ফুলের একটি দল
মাথায় আমার ধরতে দাও গো ধরতে দাও।
ওই মাধুরী-সরোবরের নাই যে কোথাও তল–
হোথায় আমায় ডুবতে দাও গো মরতে দাও।
দাও গো মুছে আমার ভালে অপমানের লিখা,
নিভৃতে আজ বন্ধু, তোমার আপন হাতের টিকা
ললাটে মোর পরতে দাও গো পরতে দাও।
বহুক তোমার ঝড়ের হাওয়া আমার ফুলবনে,
শুকনো পাতা মলিন কুসুম ঝরতে দাও।
পথ জুড়ে যা পড়ে আছে আমার এ জীবনে
দাও গো তাদের সরতে দাও গো সরতে দাও।
তোমার মহাভাণ্ডারেতে আছে অনেক ধন,
কুড়িয়ে বেড়াই মুঠা ভ’রে, ভরে না তায় মন–
অন্তরেতে জীবন আমার ভরতে দাও।
সুরুল, ২৭ ভাদ্র, ১৩২১
মুদিত আলোর কমল-কলিকাটিরে
মুদিত আলোর কমল-কলিকাটিরে
রেখেছে সন্ধ্যা আঁধার-পর্ণপুটে
উতরিবে যবে নব-প্রভাতের তীরে
তরুণ কমল আপনি উঠিবে ফুটে।
উদয়াচলের সে তীর্থপথে আমি
চলেছি একেলা সন্ধ্যার অনুগামী,
দিনান্ত মোর দিগন্তে পড়ে লুটে।
সেই প্রভাতের স্নিগ্ধ সুদূর গন্ধ
আঁধার বাহিয়া রহিয়া রহিয়া আসে।
আকাশে যে গান ঘুমাইছে নিঃস্পন্দ
তারাদীপগুলি কাঁপিছে তাহারি শ্বাসে।
অন্ধকারের বিপুল গভীর আশা,
অন্ধকারের ধ্যাননিমগ্ন ভাষা
বাণী খুঁজে ফিরে আমার চিত্তাকাশে।
জীবনের পথ দিনের প্রান্তে এসে
নিশীথের পানে গহনে হয়েছে হারা।
অঙ্গুলি তুলি তারাগুলি অনিমেষে
মাভৈঃ বলিয়া নীরবে দিতেছে সাড়া।
ম্লান দিবসের শেষের কুসুম তুলে
এ কূল হইতে নবজীবনের কূলে
চলেছি আমার যাত্রা করিতে সারা।
হে মোর সন্ধ্যা, যাহা-কিছু ছিল সাথে
রাখিনু তোমার অঞ্চলতলে ঢাকি।
আঁধারের সাথি, তোমার করুণ হাতে
বাঁধিয়া দিলাম আমার হাতের রাখি।
কত যে প্রাতের আশা ও রাতের গীতি,
কত যে সুখের স্মৃতি ও দুখের প্রীতি–
বিদায়বেলায় আজিও রহিল বাকি।
যা-কিছু পেয়েছি, যাহা-কিছু গেল চুকে,
চলিতে চলিতে পিছে যা রহিল পড়ে,
যে মণি দুলিল যে ব্যথা বিঁধিল বুকে,
ছায়া হয়ে যাহা মিলায় দিগন্তরে–
জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা–
ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা,
পূর্ণের পদ-পরশ তাদের ‘পরে।
এলাহাবাদ, ২ কার্তিক- সন্ধ্যা, ১৩২১