পথ চেয়ে যে কেটে গেল
পথ চেয়ে যে কেটে গেল
কত দিনে রাতে।
আজ ধুলার আসন ধন্য করে
বসবে কি মোর সাথে।
রচবে তোমার মুখের ছায়া
চোখের জলে মধুর মায়া,
নীরব হয়ে তোমার পানে
চাইব গো জোড় হাতে।
এরা সবাই কী বলে যে
লাগে না মন আর,
আমার হৃদয় ভেঙে দিল
কী মাধুরীর ভার।
বাহুর ঘেরে তুমি মোরে
রাখবে না কি আড়াল করে,
তোমার আঁখি চাইবে না কি
আমার বেদনাতে।
সুরুল, ৯ ভাদ্র, ১৩২১
পথ দিয়ে কে যায় গো চলে
পথ দিয়ে কে যায় গো চলে
ডাক দিয়ে সে যায়।
আমার ঘরে থাকাই দায়।
পথের হাওয়ায় কী সুর বাজে,
বাজে আমার বুকের মাঝে
বাজে বেদনায়।
আমার ঘরে থাকাই দায়।
পূর্ণিমাতে সাগর হতে
ছুটে এল বান,
আমার লাগল প্রাণে টান।
আপন মনে মেলে আঁখি
আর কেন বা পড়ে থাকি
কিসের ভাবনায়?
আমার ঘরে থাকাই দায়।
সুরুল, ১৫ ভাদ্র, ১৩২১
পথে পথেই বাসা বাঁধি
পথে পথেই বাসা বাঁধি,
মনে ভাবি পথ ফুরালো–
কোন্ অনাদি কালের আশা
হেথায় বুঝি সব পুরালো।
কখন দেখি আঁধার ছুটে
স্বপ্ন আবার যায় যে টুটে,
পূর্বদিকের তোরণ খুলে
নাম ডেকে যায় প্রভাত-আলো।
আবার কবে নবীন ফুলে
ভরে নূতন দিনের সাজি,
পথের ধারে তরুমূলে
প্রভাতী সুর ওঠে বাজি।
কেমন করে নূতন সাথি
জোটে আবার রাতারাতি,
দেখি রথের চূড়ার ‘পরে
নূতন ধ্বজা কে উড়ালো।
বুদ্ধগয়া, ২৫ আশ্বিন, ১৩২১
পথের সাথি, নমি বারম্বার
পথের সাথি, নমি বারম্বার।
পথিকজনের লহো নমস্কার।
ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি,
ওগো দিনশেষের পতি,
ভাঙা বাসার লহো নমস্কার।
ওগো নব প্রভাত-জ্যোতি,
ওগো চিরদিনের গতি,
নূতন আশার লহো নমস্কার।
জীবন-রথের হে সারথি,
আমি নিত্য পথের পথী,
পথে চলার লহো নমস্কার।
রেল-পথে , বেলা হইতে গয়ায়, ২৫ আশ্বিন, ১৩২১
পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে
পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া।
যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে
তারি কণ্ঠে তোমারি গান গাওয়া।
চায় না সে জন পিছন-পানে ফিরে,
বায় না তরী কেবল তীরে তীরে,
তুফান তারে ডাকে অকূল নীরে
যার পরানে লাগল তোমার হাওয়া।
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া।
পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
পথিক-চিত্তে তোমার তরী বাওয়া।
দুয়ার খুলে সমুখ-পানে যে চাহে
তার চাওয়া যে তোমার পানে চাওয়া।
বিপদ বাধা কিছুই ডরে না সে,
রয় না পড়ে কোনো লাভের আশে,
যাবার লাগি মন তারি উদাসে–
যাওয়া সে যে তোমার পানে যাওয়া।
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া।
বেলা স্টেশন, ২৫ আশ্বিন, ১৩২১
পুষ্প দিয়ে মার যারে
পুষ্প দিয়ে মার যারে
চিনল না সে মরণকে।
বাণ খেয়ে যে পড়ে, সে যে
ধরে তোমার চরণকে।
সবার নীচে ধুলার ‘পরে
ফেল যারে মৃত্যু-শরে
সে যে তোমার কোলে পড়ে–
ভয় কী বা তার পড়নকে।
আরামে যার আঘাত ঢাকা,
কলঙ্ক যার সুগন্ধ,
নয়ন মেলে দেখল না সে
রুদ্র মুখের আনন্দ।
মজল না সে চোখের জলে,
পৌঁছল না চরণতলে,
তিলে তিলে পলে পলে
ম’ল যেজন পালঙ্কে।
শান্তিনিকেতন, ১৯ আশ্বিন- প্রভাত, ১৩২১
প্রভু আমার, প্রিয় আমার, পরমধন হে
প্রভু আমার, প্রিয় আমার, পরমধন হে।
চির পথের সঙ্গী আমার চিরজীবন হে।
তৃপ্তি আমার অতৃপ্তি মোর,
মুক্তি আমার বন্ধনডোর,
দুঃখসুখের চরম আমার জীবনমরণ হে।
আমার সকল গতির মাঝে পরম গতি হে।
নিত্য প্রেমের ধামে আমার পরম পতি হে।
ওগো সবার, ওগো আমার,
বিশ্ব হতে চিত্তে বিহার–
অন্তবিহীন লীলা তোমার নূতন নূতন হে।
৫ আশ্বিন, ১৩১৭
প্রেমের প্রাণে সইবে কেমন করে
প্রেমের প্রাণে সইবে কেমন করে–
তোমার যেজন সে যদি গো
দ্বারে দ্বারে ঘোরে।
কাঁদিয়ে তারে ফিরিয়ে আন,
কিছুতেই তো হার না মান,
তার বেদনায় তোমার অশ্রু
রইল যে গো ভরে।
সামান্য নয় তব প্রেমের দান–
বড়ো কঠিন ব্যথা এ যে,
বড়ো কঠিন টান।
মরণ-স্নানে ডুবিয়ে শেষে
সাজাও তবে মিলনবেশে,
সকল বাধা ঘুচিয়ে ফেলে
বাঁধ বাহুর ডোরে।
শান্তিনিকেতন, ১৬ আশ্বিন, ১৩২১
ফুল তো আমার ফুরিয়ে গেছে
ফুল তো আমার ফুরিয়ে গেছে,
শেষ হল মোর গান–
এবার প্রভু, লও গো শেষের দান।
অশ্রুজলের পদ্মখানি
চরণতলে দিলাম আনি–
ওই হাতে মোর হাত দুটি লও,
লও গো আমার প্রাণ।
এবার প্রভু, লও গো শেষের দান।
ঘুচিয়ে লও গো সকল লজ্জা,
চুকিয়ে লও গো ভয়।
বিরোধ আমার যত আছে
সব করে লও জয়।
লও গো আমার নিশীথরাতি,
লও গো আমার ঘরের বাতি,
লও গো আমার সকল শক্তি–
সকল অভিমান।
এবার প্রভু, লও গো শেষের দান।
শান্তিনিকেতন, ১৭ আশ্বিন- প্রভাত, ১৩২১
বলো, আমার সনে তোমার কী শত্রুতা
বলো, আমার সনে তোমার কী শত্রুতা।
আমায় মারতে কেন এতই ছুতা।
একে একে রতনগুলি
হার থেকে মোর নিলে খুলি,
হাতে আমার রইল কেবল সুতা।
গেয়েছি গান, দিয়েছি প্রাণ ঢেলে,
পথের ‘পরে হৃদয় দিলেম মেলে।
পাবার বেলা হাত বাড়াতেই
ফিরিয়ে দিলে শূন্য হাতেই–
জানি জানি তোমার দয়ালুতা।
৭ ভাদ্র, ১৩২১
বাঁধা দিলে বাধবে লড়াই
বাঁধা দিলে বাধবে লড়াই,
মরতে হবে।
পথ জুড়ে কী করবি বড়াই?
সরতে হবে।
লুঠ-করা ধন ক’রে জড়ো
কে হতে চাস সবার বড়ো,
এক নিমেষে পথের ধুলায়
পড়তে হবে।
নাড়া দিতে গিয়ে তোমায়
নড়তে হবে।
নীচে বসে আছিস কে রে,
কাঁদিস কেন।
লজ্জা-ডোরে আপনাকে রে
বাঁধিস কেন।
ধনী যে তুই দুঃখধনে
সেই কথাটি রাখিস মনে,
ধুলার ‘পরে স্বর্গ তোমায়
গড়তে হবে।
বিনা অস্ত্র বিনা সহায়
লড়তে হবে।
শান্তিনিকেতন, ৪ ভাদ্র, ১৩২১