দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো
দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো–
গভীর শান্তি এ যে,
আমার সকল ছাড়িয়ে গিয়ে
উঠল কোথায় বেজে।
ছাড়িয়ে গৃহ, ছাড়িয়ে আরাম, ছাড়িয়ে আপনারে
সাথে করে নিল আমায় জন্মমরণপারে–
এল পথিক সেজে।
দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো–
গভীর শান্তি এ যে।
চরণে তার নিখিল ভুবন নীরব গগনেতে
আলো-আঁধার আঁচলখানি আসন দিল পেতে।
এত কালের ভয় ভাবনা কোথায় যে যায় সরে,
ভালোমন্দ ভাঙাচোরা আলোয় ওঠে ভরে,
কালিমা যায় মেজে।
দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো–
গভীর শান্তি এ যে।
শান্তিনিকেতন, ১৬ আশ্বিন- রাত্রি, ১৩২১
দুঃখ যদি না পাবে তো
দুঃখ যদি না পাবে তো
দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে
দহন করে মারতে হবে।
জ্বলতে দে তোর আগুনটারে,
ভয় কিছু না করিস তারে,
ছাই হয়ে সে নিভবে যখন
জ্বলবে না আর কভু তবে।
এড়িয়ে তাঁরে পালাস না রে
ধরা দিতে হোস না কাতর।
দীর্ঘ পথে ছুটে কেবল
দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর
মরতে মরতে মরণটারে
শেষ করে দে একেবারে,
তার পরে সেই জীবন এসে
আপন আসন আপনি লবে।
শান্তিনিকেতন, ১ আশ্বিন, ১৩২১
দুঃখ যে তোর নয় রে চিরন্তন
দুঃখ যে তোর নয় রে চিরন্তন।
পার আছে এর– এই সাগরের
বিপুল ক্রন্দন।
এই জীবনের ব্যথা যত
এইখানে সব হবে গত–
চিরপ্রাণের আলয়-মাঝে
বিপুল সান্ত্বন।
মরণ যে তোর নয় রে চিরন্তন।
দুয়ার তাহার পেরিয়ে যাবি,
ছিঁড়বে রে বন্ধন।
এ বেলা তোর যদি ঝড়ে
পূজার কুসুম ঝরে পড়ে
যাবার বেলায় ভরবি থালায়
মালা ও চন্দন।
সুরুল, ১ আশ্বিন, ১৩২১
দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামল
দুঃখের বরষায়
চক্ষের জল যেই
নামল
বক্ষের দরজায়
বন্ধুর রথ সেই
থামল।
মিলনের পাত্রটি
পূর্ণ যে বিচ্ছেদে
বেদনায়;
অর্পিনু হাতে তাঁর,
খেদ নাই, আর মোর
খেদ নাই।
বহুদিন-বঞ্চিত
অন্তরে সঞ্চিত
কী আশা,
চক্ষের নিমেষেই
মিটল সে পরশের
তিয়াষা।
এতদিনে জানলেম
যে কাঁদন কাঁদলেম
সে কাহার জন্য।
ধন্য এ জাগরণ,
ধন্য এ ক্রন্দন,
ধন্য রে ধন্য।
শান্তিনিকেতন, শ্রাবণ, ১৩২১
না গো, এই যে ধুলা আমার না এ
না গো, এই যে ধুলা আমার না এ,
তোমার ধুলার ধরার ‘পরে
উড়িয়ে যাব সন্ধ্যাবায়ে।
দিয়ে মাটি আগুন জ্বালি’
রচলে দেহ পূজার থালি,
শেষ আরতি সারা করে
ভেঙে যাব তোমার পায়ে।
ফুল যা ছিল পূজার তরে,
যেতে পথে ডালি হতে
অনেক যে তার গেছে পড়ে।
কত প্রদীপ এই থালাতে
সাজিয়েছিলে আপন হাতে,
কত যে তার নিবল হাওয়ায়–
পৌঁছোল না চরণ-ছায়ে।
সুরুল, ২ আশ্বিন- প্রভাত , ১৩২১
না বাঁচাবে আমায় যদি
না বাঁচাবে আমায় যদি
মারবে কেন তবে?
কিসের তরে এই আয়োজন
এমন কলরবে?
অগ্নিবাণে তূণ যে ভরা,
চরণভরে কাঁপে ধরা,
জীবনদাতা মেতেছ যে
মরণ-মহোৎসবে।
বক্ষ আমার এমন ক’রে
বিদীর্ণ যে কর
উৎস যদি না বাহিরায়
হবে কেমনতরো?
এই যে আমার ব্যথার খনি
জোগাবে ওই মুকুটমণি–
মরণ-দুখে জাগাব মোর
জীবন-বল্লভে।
সুরুল হইতে শান্তিনিকেতনের পথে, ২৬ ভাদ্র, ১৩২১
না রে, তোদের ফিরতে দেব না রে
না রে, তোদের ফিরতে দেব না রে–
মরণ যেথায় লুকিয়ে বেড়ায়
সেই আরামের দ্বারে।
চলতে হবে সামনে সোজা,
ফেলতে হবে মিথ্যা বোঝা,
টলতে আমি দেব না যে
আপন ব্যথাভারে।
না রে, তোদের রইতে দেব না রে–
দিবানিশি ধুলাখেলায়
খেলাঘরের দ্বারে।
চলতে হবে আশার গানে
প্রভাত-আলোর উদয়-পানে,
নিমেষতরে পাবি নেকো
বসতে পথের ধারে।
না রে, তোদের থামতে দেব না রে–
কানাকানি করতে কেবল
কোণের ঘরের দ্বারে।
ওই যে নীরব বজ্রবাণী
আগুন বুকে দিচ্ছে হানি–
সইতে হবে, বইতে হবে,
মানতে হবে তারে।
সুরুল, ২৮ ভাদ্র- অপরাহ্ন, ১৩০১
না রে, না রে, হবে না তোর স্বর্গসাধন
না রে, না রে, হবে না তোর স্বর্গসাধন–
সেখানে যে মধুর বেশে
ফাঁদ পেতে রয় সুখের বাঁধন।
ভেবেছিলি দিনের শেষে
তপ্ত পথের প্রান্তে এসে
সোনার মেঘে মিলিয়ে যাবে
সারা দিনের সকল কাঁদন।
না রে, না রে, হবে না তোর হবে না তা–
সন্ধ্যাতারার হাসির নীচে
হবে না তোর শয়ন পাতা।
পথিক বঁধু পাগল ক’রে
পথে বাহির করবে তোরে,
হৃদয় যে তোর ফেটে গিয়ে
ফুটবে তবে তাঁর আরাধন।
শান্তিনিকেতন, ১ আশ্বিন, ১৩২১
নাই কি রে তীর, নাই কি রে তোর তরী
নাই কি রে তীর, নাই কি রে তোর তরী?
কেবলি কি ঢেউ আছে তোর?
হায় রে লাজে মরি।
ঝড়ের কালো মেঘের পানে
তাকিয়ে আছিস আকুল প্রাণে,
দেখিস নে কি কাণ্ডারী তোর
হাসে যে হাল ধরি’।
নিশার স্বপ্ন তোর
সেই কি এতই সত্য হল,
ঘুচল না তোর ঘোর?
প্রভাত আসে তোমার পানে
আলোর রথে, আশার গানে;
সে খবর কি দেয় নি কানে
আঁধার বিভাবরী?
শান্তিনিকেতন, ২৪ ভাদ্র, ১৩২১
নাই বা ডাক, রইব তোমার দ্বারে
নাই বা ডাক, রইব তোমার দ্বারে;
মুখ ফিরালে ফিরব না এইবারে।
বসব তোমার পথের ধুলার ‘পরে
এড়িয়ে আমায় চলবে কেমন করে?
তোমার তরে যে জন গাঁথে মালা
গানের কুসুম জুগিয়ে দেব তারে।
রইব তোমার ফসল-খেতের কাছে
যেথায় তোমার পায়ের চিহ্ন আছে।
জেগে রব গভীর উপবাসে
অন্ন তোমার আপনি যেথায় আসে।
যেথায় তুমি লুকিয়ে প্রদীপ জ্বাল
বসে রব সেথায় অন্ধকারে।
সুরুল হইতে শান্তিনিকেতনের পথে গোরুর গাড়িতে, ২৬ ভাদ্র, ১৩২১