তব গানের সুরে হৃদয় মম রাখো হে রাখো ধরে
তব গানের সুরে হৃদয় মম রাখো হে রাখো ধরে,
তারে দিয়ো না কভু ছুটি।
তব আদেশ দিয়ে রজনীদিন দাও হে দাও ভরে,
প্রভু, আমার বাহু দুটি।
তব পলকহারা আলোক-দিঠি মরম-‘পরে রাখো,
যত শরমে মোর শরম দিয়ে নীরবে চেয়ে থাকো,
প্রভু, সকল-ভরা ক্ষমায় তব রাখো আবৃত করে
মোর যেখানে যত ত্রুটি।
মোরে দিয়ো না দিন সুখের আশে করিতে দিন গত
শুধু শয়ন-‘পরে লুটি।
আমি চাই নি যাহা তাই দিয়ো হে আপন ইচ্ছামতো
আমার ভরিয়া দুই মুঠি।
মোর যতই তৃষা ততই কৃপা-বরষা এসো নেমে,
মোর যত গভীর দৈন্য তত ভরিয়া তোলো প্রেমে,
মোর যত কঠিন গর্ব তারে হানো ততই বলে–
তাহা পড়ুক পায়ে টুটি।
১৯ আশ্বিন, ১৩১৭
তুমি আড়াল পেলে কেমনে
তুমি আড়াল পেলে কেমনে
এই মুক্ত আলোর গগনে?
কেমন করে শূন্য সেজে
ঢাকা দিলে আপনাকে যে,
সেই খেলাটি উঠল বেজে
বেদনে–
আমার প্রাণের বেদনে।
আমি এই বেদনার আলোকে
তোমায় দেখব দ্যুলোক-ভূলোকে।
সকল গগন বসুন্ধরা
বন্ধুতে মোর আছে ভরা,
সেই কথাটি দেবে ধরা
জীবনে–
আমার গভীর জীবনে।
শান্তিনিকেতন, ৪ ভাদ্র, ১৩২১
তোমার কাছে এ বর মাগি
তোমার কাছে এ বর মাগি
মরণ হতে যেন জাগি
গানের সুরে।
যেমনি নয়ন মেলি, যেন
মাতার স্তন্যসুধা-হেন
নবীন জীবন দেয় না পূরে
গানের সুরে।
সেথায় তরু তৃণ যত
মাটির বাঁশি হতে ওঠে
গানের মতো।
আলোক সেথা দেয় গো আনি
আকাশের আনন্দবাণী,
হৃদয়-মাঝে বেড়ায় ঘুরে
গানের সুরে।
শান্তিনিকেতন, ১৭ আশ্বিন- সন্ধ্যা, ১৩২১
তোমার কাছে চাই নে আমি অবসর
তোমার কাছে চাই নে আমি
অবসর।
আমি গান শোনাব গানের পর।
বাইরে হোথায় দ্বারের কাছে
কাজের লোকে দাঁড়িয়ে আছে,
আশা ছেড়ে যাক-না ফিরে
আপন ঘর।
আমি গান শোনাব গানের পর।
জানি না এর কোন্টা ভালো কোন্টা নয়।
জানি না কে কোন্টা রাখে কোন্টা লয়।
চলবে হৃদয় তোমার পানে
শুধু আপন চলার গানে,
ঝরার সুখে ঝরবে সুরের
এ নির্ঝর।
আমি গান শোনাব গানের পর।
বুদ্ধগয়া, ২৪ আশ্বিন, ১৩২১
তোমার দুয়ার খোলার ধ্বনি
তোমার দুয়ার খোলার ধ্বনি
ওই গো বাজে
হৃদয়-মাঝে।
তোমার ঘরে নিশিভোরে
আগল যদি গেল সরে
আমার ঘরে রইব তবে
কিসের লাজে।
অনেক বলা বলেছি, সে
মিথ্যা বলা।
অনেক চলা চলেছি,সে
মিথ্যা চলা।
আজ যেন সব পথের শেষে
তোমার দ্বারে দাঁড়াই এসে,
ভুলিয়ে যেন নেয় না মোরে
আপন কাজে।
শান্তিনিকেতন, ১৬ আশ্বিন, ১৩২১
তোমার ভুবন মর্মে আমার লাগে
তোমার ভুবন মর্মে আমার লাগে।
তোমার আকাশ অসীম কমল
অন্তরে মোর জাগে।
এই সবুজ এই নীলের পরশ
সকল দেহ করে সরস–
রক্ত আমার রঙিয়ে আছে
তব অরুণরাগে।
আমার মনে এই শরতের
আকুল আলোখানি
এক পলকে আনে যেন
বহুযুগের বাণী।
নিশীথরাতে নিমেষহারা
তোমার যত নীরব তারা
এমন ক’রে হৃদয়দ্বারে
আমায় কেন মাগে।
শান্তিনিকেতন, ১৭ আশ্বিন- প্রভাত, ১৩২১
তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে
তোমার মোহন রূপে
কে রয় ভুলে?
জানি না কি মরণ নাচে
নাচে গো ওই চরণ-মূলে?
শরৎ-আলোর আঁচল টুটে
কিসের ঝলক নেচে উঠে,
ঝড় এনেছ এলোচুলে।
মোহন রূপে কে রয় ভুলে?
কাঁপন ধরে বাতাসেতে,
পাকা ধানের তরাস লাগে
শিউরে ওঠে ভরা খেতে।
জানি গো আজ হাহারবে
তোমার পূজা সারা হবে
নিখিল-অশ্রুসাগর-কূলে।
মোহন রূপে কে রয় ভুলে?
সুরুল, ১১ ভাদ্র, ১৩২১
তোমার এই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশ ঝরবে
তোমার এই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশ ঝরবে,
আমার প্রাণে নইলে সে কি কোথাও ধরবে?
এই যে আলো সূর্যে গ্রহে তারায়
ঝরে পড়ে শত লক্ষ ধারায়
পূর্ণ হবে এ প্রাণ যখন ভরবে।
তোমার ফুলে যে রঙ ঘুমের মতো লাগল
আমার মনে লেগে তবে সে যে জাগল।
যে প্রেম কাঁপায় বিশ্ববীণায় পুলকে
সংগীতে সে উঠবে ভেসে পলকে
যেদিন আমার সকল হৃদয় হরবে।
সুরুল, ১ আশ্বিন- সন্ধ্যা, ১৩২১
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে
টুকরো ক’রে কাছি
ডুবতে রাজি আছি
আমি ডুবতে রাজি আছি।
সকাল আমার গেল মিছে,
বিকেল যে যায় তারি পিছে;
রেখো না আর, বেঁধো না আর
কূলের কাছাকাছি।
মাঝির লাগি আছি জাগি
সকল রাত্রিবেলা,
ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে
করে কেবল খেলা।
ঝড়কে আমি করব মিতে,
ডরব না তার ভ্রূকুটিতে;
দাও ছেড়ে দাও ওগো, আমি
তুফান পেলে বাঁচি।
শান্তিনিকেতন, ১৭ ভাদ্র-বিকাল, ১৩২১
তোমায় ছেড়ে দূরে চলার
তোমায় ছেড়ে দূরে চলার
নানা ছলে
তোমার মাঝে পড়ি এসে
দ্বিগুণ বলে।
নানান পথে আনাগোনা
মিলনেরই জাল সে বোনা,
যতই চলি ধরা পড়ি
পলে পলে।
শুধু যখন আপন কোণে
পড়ে থাকি
তখনি সেই স্বপন-ঘোরে
কেবল ফাঁকি।
বিশ্ব তখন কয় না বাণী,
মুখেতে দেয় বসন টানি,
আপন ছায়া দেখি, আপন
নয়ন-জলে।
এলাহাবাদ, ১ কার্তিক, ১৩২১
তোমায় সৃষ্টি করব আমি
তোমায় সৃষ্টি করব আমি
এই ছিল মোর পণ।
দিনে দিনে করেছিলেম
তারি আয়োজন।
তাই সাজালেম আমার ধুলো,
আমার ক্ষুধাতৃষ্ণাগুলো,
আমার যত রঙিন আবেশ,
আমার দুঃস্বপন।
"তুমি আমায় সৃষ্টি করো’
আজ তোমারে ডাকি–
"ভাঙো আমার আপন মনের
মায়া-ছায়ার ফাঁকি।
তোমার সত্য, তোমার শান্তি,
তোমার শুভ্র অরূপ কান্তি,
তোমার শক্তি, তোমার বহ্নি
ভরুক এ জীবন।’
শান্তিনিকেতন, ১৭ আশ্বিন- প্রভাত, ১৩২১