কেমন করে তড়িৎ-আলোয়
কেমন করে তড়িৎ-আলোয়
দেখতে পেলেম মনে
তোমার বিপুল সৃষ্টি চলে
আমার এই জীবনে।
সে সৃষ্টি যে কালের পটে
লোকে লোকান্তরে রটে,
একটু তারি আভাস কেবল
দেখি ক্ষণে ক্ষণে।
মনে ভাবি, কান্নাহাসি
আদর অবহেলা
সবই যেন আমায় নিয়ে
আমারি ঢেউ-খেলা।
সেই আমি তো বাহনমাত্র,
যায় সে ভেঙে মাটির পাত্র–
যা রেখে যায় তোমার সে ধন
রয় তা তোমার সনে।
তোমার বিশ্বে জড়িয়ে থাকে
আমার চাওয়া পাওয়া।
ভরিয়ে তোলে নিত্যকালের
ফাল্গুনেরই হাওয়া।
জীবন আমার দুঃখে সুখে
দোলে ত্রিভুবনের বুকে,
আমার দিবানিশির মালা
জড়ায় শ্রীচরণে।
আপন-মাঝে আপন জীবন
দেখে যে মন কাঁদে।
নিমেষগুলি শিকল হয়ে
আমায় তখন বাঁধে।
মিটল দুঃখ, টুটল বন্ধ–
আমার মাঝে হে আনন্দ,
তোমার প্রকাশ দেখে মোহ
ঘুচল এ নয়নে।
এলাহাবাদ, ১ কার্তিক- সন্ধ্যা, ১৩২১
কোন্ বরতা পাঠালে মোর পরানে
কোন্ বরতা পাঠালে মোর পরানে
আজি তোমার অরুণ-আলোয় কে জানে।
বাণী তোমার ধরে না মোর গগনে,
পাতায় পাতায় কাঁপে হৃদয়-কাননে,
বাণী তোমার ফোটে লতাবিতানে।
তোমার বাণী বাতাসে সুর লাগালো,
নদীতে মোর ঢেউয়ের মাতন জাগালো।
তরী আমার আজ প্রভাতের আলোকে
এই বাতাসে পাল তুলে দিক পুলকে,
তোমার পানে যাক সে ভেসে উজানে।
সুরুল, ২৮ ভাদ্র, ১৩২১
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু,
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু।
এই-যে হিয়া থরথর
কাঁপে আজি এমনতরো
এই বেদনা ক্ষমা করো
ক্ষমা করো প্রভু।
এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,
পিছন-পানে তাকাই যদি কভু।
দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায়
শুকায় মালা পূজার থালায়,
সেই ম্লানতা ক্ষমা করো
ক্ষমা করো প্রভু।
শান্তিনিকেতন, ১৬ আশ্বিন, ১৩২১
খুশি হ তুই আপন মনে
খুশি হ তুই আপন মনে।
রিক্ত হাতে চল্-না রাতে
নিরুদ্দেশের অন্বেষণে।
চাস নে কিছু, কোস নে কিছু,
করিস নে তোর মাথা নিচু,
আছে রে তোর হৃদয় ভরা
শূন্য ঝুলির অলখ ধনে।
নাচুক-না ওই আঁধার আলো–
তুলুক-না ঢেউ দিবানিশি
চার দিকে তোর মন্দ ভালো।
তোর তরী তুই দে খুলে দে,
গান গেয়ে তুই পাল তুলে দে–
অকূল-পানে ভাসবি রে তুই,
হাসবি রে তুই অকারণে।
সুরুল, ৮ আশ্বিন- সন্ধ্যা, ১৩২১
গতি আমার এসে ঠেকে যেথায় শেষে
গতি আমার এসে
ঠেকে যেথায় শেষে
অশেষ সেথা খোলে আপন দ্বার।
যেথা আমার গান
হয় গো অবসান
সেথা গানের নীরব পারাবার।
যেথা আমার আঁখি
আঁধারে যায় ঢাকি
অলখ-লোকের আলোক সেথা জ্বলে।
বাইরে কুসুম ফুটে
ধুলায় পড়ে টুটে,
অন্তরে তো অমৃত-ফল ফলে।
কর্ম বৃহৎ হয়ে
চলে যখন বয়ে
তখন সে পায় বৃহৎ অবকাশ।
যখন আমার আমি
ফুরায়ে যায় থামি
তখন আমার তোমাতে প্রকাশ।
এলাহাবাদ, ২৯ আশ্বিন, ১৩২১
ঘরের থেকে এনেছিলেম
ঘরের থেকে এনেছিলেম
প্রদীপ জ্বেলে–
ডেকেছিলেম, “আয় রে তোরা
পথের ছেলে।’
বলেছিলেম, “সন্ধ্যা হল,
তোমরা পূজার কুসুম তোলো,
আমার প্রদীপ দেবে পথে
কিরণ মেলে।’
পথের আঁধার পথে রেখে
এলেম ফিরে,
প্রদীপ হাতে পথ দেখানো
ছেড়েছি রে।
এবার বলি, “ওগো আলো,
আমায় তুমি আপনি জ্বালো,
ভাঙা প্রদীপ পথের ধুলায়
দিলেম ফেলে।’
শান্তিনিকেতন, ১৯ আশ্বিন, ১৩২১
ঘুম কেন নেই তোরি চোখে
ঘুম কেন নেই তোরি চোখে?
কে রে এমন জাগায় তোকে?
চেয়ে আছিস আপন মনে
ওই যে দূরে গগন-কোণে,
রাত্রি মেলে রাঙা নয়ন
রুদ্রদেবের দীপ্তালোকে!
রক্তশতদলের সাজি
সাজিয়ে কেন রাখিস আজি?
কোন্ সাহসে একেবারে
শিকল খুলে দিলি দ্বারে,
জোড়-হাতে তুই ডাকিস কারে?
প্রলয় যে তোর ঘরে ঢোকে।
সুরুল, ৯ ভাদ্র, ১৩২১
চোখে দেখিস, প্রাণে কানা
চোখে দেখিস, প্রাণে কানা।
হিয়ার মাঝে দেখ্-না ধরে
ভুবনখানা।
প্রাণের সাথে সে যে গাঁথা,
সেথায় তারি আসন পাতা,
বাইরে তারে রাখিস তবু–
অন্তরে তার যেতে মানা?
তারি কণ্ঠে তোমার বাণী,
তোরি রঙে রঙিন তারি
বসনখানি।
যে জন তোমার বেদনাতে
লুকিয়ে খেলে দিনে রাতে
সামনে যে ওই রূপে রসে
সেই অজানা হল জানা।
শান্তিনিকেতন, ১১ আশ্বিন, ১৩২১
জাগো নির্মল নেত্রে রাত্রির পরপারে
জাগো নির্মল নেত্রে
রাত্রির পরপারে,
জাগো অন্তরক্ষেত্রে
মুক্তির অধিকারে।
জাগো ভক্তির তীর্থে
পূজাপুষ্পের ঘ্রাণে,
জাগো উন্মুখ চিত্তে,
জাগো অম্লান প্রাণে।
জাগো নন্দননৃত্যে
সুধাসিন্ধুর ধারে,
জাগো স্বার্থের প্রান্তে
প্রেমমন্দিরদ্বারে।
জাগো উজ্জ্বল পুণ্যে,
জাগো নিশ্চল আশে,
জাগো নিঃসীম শূন্যে
পূর্ণের বাহুপাশে।
জাগো নির্ভয়ধামে,
জাগো সংগ্রামসাজে,
জাগো ব্রহ্মের নামে,
জাগো কল্যাণকাজে।
জাগো দুর্গমযাত্রী,
দুঃখের অভিসারে,
জাগো স্বার্থের প্রান্তে
প্রেমমন্দিরদ্বারে।
৪ আশ্বিন, ১৩১৭
জীবন আমার যে অমৃত
জীবন আমার যে অমৃত
আপন-মাঝে গোপন রাখে
প্রতিদিনের আড়াল ভেঙে
কবে আমি দেখব তাকে।
তাহারি স্বাদ ক্ষণে ক্ষণে
পেয়েছি তো আপন মনে,
গন্ধ তারি মাঝে মাঝে
উদাস ক’রে আমায় ডাকে।
নানা রঙের ছায়ায় বোনা
এই আলোকের অন্তরালে
আনন্দরূপ লুকিয়ে আছে
দেখব না কি যাবার কালে।
যে নিরালায় তোমার দৃষ্টি
আপনি দেখে আপন সৃষ্টি
সেইখানে কি বারেক আমায়
দাঁড় করাবে সবার ফাঁকে।
পাল্কি-পথে, ২৫ আশ্বিন-বেলা, ১৩২১