ও নিঠুর, আরো কি বাণ
ও নিঠুর, আরো কি বাণ
তোমার তূণে আছে?
তুমি মর্মে আমায়
মারবে হিয়ার কাছে?
আমি পালিয়ে থাকি, মুদি আঁখি,
আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি,
কোথাও কিছু আঘাত লাগে পাছে।
মারকে তোমার
ভয় করেছি বলে
তাই তো এমন
হৃদয় ওঠে জ্বলে।
যেদিন সে ভয় ঘুচে যাবে
সেদিন তোমার বাণ ফুরাবে,
মরণকে প্রাণ বরণ করে বাঁচে।
শান্তিনিকেতন, ৭ ভাদ্র, ১৩২১
ওই-যে সন্ধ্যা খুলিয়া ফেলিল তার
ওই-যে সন্ধ্যা খুলিয়া ফেলিল তার
সোনার অলংকার।
ওই সে আকাশে লুটায়ে আকুল চুল
অঞ্জলি ভরি ধরিল তারার ফুল,
পূজায় তাহার ভরিল অন্ধকার।
ক্লান্তি আপন রাখিয়া দিল সে ধীরে
স্তব্ধ পাখির নীড়ে।
বনের গহনে জোনাকি-রতন-জ্বালা
লুকায়ে বক্ষে শান্তির জপমালা
জপিল সে বারবার।
ওই-যে তাহার লুকানো ফুলের বাস
গোপনে ফেলিল শ্বাস।
ওই-যে তাহার প্রাণের গভীর বাণী
শান্ত পবনে নীরবে রাখিল আনি
আপন বেদনাভার।
ওই-যে নয়ন অবগুণ্ঠনতলে
ভাসিল শিশিরজলে।
ওই-যে তাহার বিপুল রূপের ধন
অরূপ আঁধারে করিল সমর্পণ
চরম নমস্কার।
শান্তিনিকেতন, ১৬ আশ্বিন- সন্ধ্যা, ১৩২১
ওই অমল হাতে রজনী প্রাতে
ওই অমল হাতে রজনী প্রাতে
আপনি জ্বাল’
এই তো আলো–
এই তো আলো।
এই তো প্রভাত, এই তো আকাশ,
এই তো পূজার পুষ্পবিকাশ,
এই তো বিমল, এই তো মধুর,
এই তো ভালো–
এই তো আলো–
এই তো আলো।
আঁধার মেঘের বক্ষে জেগে
আপনি জ্বাল’
এই তো আলো–
এই তো আলো।
এই তো ঝঞ্ঝা তড়িৎ-জ্বালা,
এই তো দুখের অগ্নিমালা,
এই তো মুক্তি, এই তো দীপ্তি,
এই তো ভালো–
এই তো আলো–
এই তো আলো।
সুরুল হইতে শান্তিনিকেতনের পথে, ৭ আশ্বিন, ১৩২১
ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর
ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর,
তোমার প্রেম তোমারে এমন ক’রে
করেছে নিষ্ঠুর।
তুমি বসে থাকতে দেবে না যে,
দিবানিশি তাই তো বাজে
পরান-মাঝে এমন কঠিন সুর।
ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর,
তোমার লাগি দুঃখ আমার
হয় যেন মধুর।
তোমার খোঁজা খোঁজায় মোরে,
তোমার বেদন কাঁদায় ওরে,
আরাম যত করে কোথায় দূর।
সুরুল, ৮ ভাদ্র। বুধবার, ১৩২১
ওগো আমার হৃদয়বাসী
ওগো আমার হৃদয়বাসী,
আজ কেন নাই তোমার হাসি।
সন্ধ্যা হল কালো মেঘে,
চাঁদের চোখে আঁধার লেগে–
বাজল না আজ প্রাণের বাঁশি।
রেখেছি এই প্রদীপ মেজে,
জ্বালিয়ে দিলেই জ্বলবে সে যে।
একটুকু মন দিলেই তবে
তোমার মালা গাঁথা হবে,
তোলা আছে ফুলের রাশি।
শান্তিনিকেতন, ১৮ আশ্বিন- সন্ধ্যা, ১৩২১
ওরে ভীরু তোমার হাতে
ওরে ভীরু তোমার হাতে
নাই ভুবনের ভার।
হালের কাছে মাঝি আছে,
করবে তরী পার।
তুফান যদি এসে থাকে
তোমার কিসের দায়–
চেয়ে দেখো ঢেউয়ের খেলা,
কাজ কী ভাবনায়।
আসুক-নাকো গহন রাতি,
হোক-না অন্ধকার–
হালের কাছে মাঝি আছে,
করবে তরী পার।
পশ্চিমে তুই তাকিয়ে দেখিস
মেঘে আকাশ ডোবা–
আনন্দে তুই পুবের দিকে
দেখ্-না তারার শোভা।
সাথি যারা আছে, তারা
তোমার আপন ব’লে
ভাব’ কি তাই রক্ষা পাবে
তোমারি ওই কোলে?
উঠবে রে ঝড়, দুলবে রে বুক,
জাগবে হাহাকার–
হালের কাছে মাঝি আছে,
করবে তরী পার।
শান্তিনিকেতন, ৯ আশ্বিন- অপরাহ্ন, ১৩২১
কাঁচা ধানের ক্ষেতে যেমন
কাঁচা ধানের ক্ষেতে যেমন
শ্যামল সুধা ঢেলেছ গো,
তেমনি করে আমার প্রাণে
নিবিড় শোভা মেলেছ গো।
যেমন করে কালো মেঘে
তোমার আভা গেছে লেগে
তেমনি করে হৃদয়ে মোর
চরণ তোমার ফেলেছ গো।
বসন্তে এই বনের বায়ে
যেমন তুমি ঢাল ব্যথা
তেমনি করে অন্তরে মোর
ছাপিয়ে ওঠে ব্যাকুলতা।
দিয়ে তোমার রুদ্র আলো
বজ্র-আগুন যেমন জ্বাল
তেমনি তোমার আপন তাপে
প্রাণে আগুন জ্বেলেছ গো।
সুরুল, ৩১ ভাদ্র, ১৩২১
কাণ্ডারী গো, যদি এবার
কাণ্ডারী গো, যদি এবার
পৌঁছে থাক কূলে
হাল ছেড়ে দাও, এখন আমার
হাত ধরে লও তুলে।
ক্ষণেক তোমার বনের ঘাসে
বসাও আমায় তোমার পাশে,
রাত্রি আমার কেটে গেছে
ঢেউয়ের দোলায় দুলে।
কাণ্ডারী গো, ঘর যদি মোর
না থাকে আর দূরে,
ওই যদি মোর ঘরের বাঁশি
বাজে ভোরের সুরে,
শেষ বাজিয়ে দাও গো চিতে
অশ্রুজলের রাগিণীতে
পথের বাঁশিখানি তোমার
পথতরুর মূলে।
শান্তিনিকেতন, ১৭ আশ্বিন- প্রভাত, ১৩২১
কূল থেকে মোর গানের তরী
কূল থেকে মোর গানের তরী
দিলেম খুলে–
সাগর-মাঝে ভাসিয়ে দিলেম
পালটি তুলে।
যেখানে ওই কোকিল ডাকে ছায়াতলে–
সেখানে নয়।
যেখানে ওই গ্রামের বধূ আসে জলে–
সেখানে নয়।
যেখানে নীল মরণলীলা উঠছে দুলে
সেখানে মোর গানের তরী দিলেম খুলে।
এবার, বীণা, তোমায় আমায়
আমরা একা।
অন্ধকারে নাই বা কারে
গেল দেখা।
কুঞ্জবনের শাখা হতে যে ফুল তোলে
সে ফুল এ নয়।
বাতায়নের লতা হতে যে ফুল দোলে
সে ফুল এ নয়।
দিশাহারা আকাশভরা সুরের ফুলে
সেই দিকে মোর গানের তরী দিলেম খুলে।
শান্তিনিকেতন, ১৯ আশ্বিন, ১৩২১
কেমন করে এমন বাধা ক্ষয় হবে
কেমন করে এমন বাধা ক্ষয় হবে।
আপনাকে যে আপনি হারায়
কেমনে তার জয় হবে।
শত্রু বাঁধা আলিঙ্গনে
যত প্রণয় তারি সনে–
মুক্ত উদার কোন্ প্রেমে তার লয় হবে।
কেমন করে এমন বাধা ক্ষয় হবে।
যে মত্ততা বারে বারে
ছোটে সর্বনাশের পারে
কোন্ শাসনে কবে তাহার ভয় হবে।
কুহেলিকার অন্ত না পাই,
কাটবে কখন ভাবি যে তাই–
এক নিমেষে তুমি হৃদয়ময় হবে।
কেমন করে এমন বাধা ক্ষয় হবে।
বোলপুর, ৩ শ্রাবণ, ১৩১৭