এই কথাটা ধরে রাখিস
এই কথাটা ধরে রাখিস
মুক্তি তোরে পেতেই হবে,
যে পথ গেছে পারের পানে
সে পথে তোর যেতেই হবে।
অভয়-মনে কণ্ঠ ছাড়ি
গান গেয়ে তুই দিবি পাড়ি,
খুশি হয়ে ঝড়ের হাওয়ায়
ঢেউ যে তোরে খেতেই হবে।
পাকের ঘোরে ঘোরায় যদি
ছুটি তোরে পেতেই হবে।
চলার পথে কাঁটা থাকে
দ’লে তোমায় যেতেই হবে।
সুখের আশা আঁকড়ে লয়ে
মরিস নে তুই ভয়ে ভয়ে,
জীবনকে তোর ভরে নিতে
মরণ-আঘাত খেতেই হবে।
সুরুল, ২ আশ্বিন- অপরাহ্ন, ১৩২১
এই তীর্থ-দেবতার ধরণীর মন্দির-প্রাঙ্গণে
এই তীর্থ-দেবতার ধরণীর মন্দির-প্রাঙ্গণে
যে পূজার পুষ্পাঞ্জলি সাজাইনু সযত্ন চয়নে
সায়াহ্নের শেষ আয়োজন; যে পূর্ণ প্রণামখানি
মোর সারা জীবনের অন্তরের অনির্বাণ বাণী
জ্বালায়ে রাখিয়া গেনু আরতির সন্ধ্যাদীপ-মুখে
সে আমার নিবেদন তোমাদের সবার সম্মুখে
হে মোর অতিথি যত। তোমরা এসেছ এ জীবনে
কেহ প্রাতে, কেহ রাতে, বসন্তে, শ্রাবণ-বরিষনে;
কারো হাতে বীণা ছিল, কেহ বা কম্পিত দীপশিখা
এনেছিলে মোর ঘরে; দ্বার খুলে দুরন্ত ঝটিকা
বার বার এনেছ প্রাঙ্গণে। যখন গিয়েছ চলে
দেবতার পদচিহ্ন রেখে গেছ মোর গৃহতলে।
আমার দেবতা নিল তোমাদের সকলের নাম;
রহিল পূজায় মোর তোমাদের সবারে প্রণাম।
এলাহাবাদ, ৩ কার্তিক-প্রভাত, ১৩২১
এই নিমেষে গণনাহীন নিমেষ গেল টুটে
এই নিমেষে গণনাহীন
নিমেষ গেল টুটে–
একের মাঝে এক হয়ে মোর
উঠল হৃদয় ফুটে।
বক্ষে কুঁড়ির কারায় বন্ধ
অন্ধকারের কোন্ সুগন্ধ
আজ প্রভাতে পূজার বেলায়
পড়ল আলোয় লুটে।
তোমায় আমায় একটুখানি
দূর যে কোথাও নাই–
নয়ন মুদে নয়ন মেলে
এই তো দেখি তাই।
যেই খুলেছি আঁখির পাতা,
যেই তুলেছি নত মাথা,
তোমার মাঝে অমনি আমার
জয়ধ্বনি উঠে।
এলাহাবাদ, ২ কার্তিক- প্রভাত, ১৩২১
এই যে কালো মাটির বাসা
এই যে কালো মাটির বাসা
শ্যামল সুখের ধরা–
এইখানেতে আঁধার আলোয়
স্বপন-মাঝে চরা।
এরি গোপন হৃদয়-‘পরে
ব্যথার স্বর্গ বিরাজ করে
দুঃখে-আলো-করা।
বিরহী তোর সেইখানে যে
একলা বসে থাকে–
হৃদয় তাহার ক্ষণে ক্ষণে
নামটি তোমার ডাকে।
দুঃখে যখন মিলন হবে
আনন্দলোক মিলবে তবে
সুধায় সুধায় ভরা।
সুরুল, ১৬ ভাদ্র-সন্ধ্যা, ১৩২১
শরৎ-আলোর কমল-বনে
এই শরৎ-আলোর কমল-বনে
বাহির হয়ে বিহার করে
যে ছিল মোর মনে মনে।
তারি সোনার কাঁকন বাজে
আজি প্রভাত-কিরণমাঝে,
হাওয়াতে কাঁপে আঁচলখানি,
ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে।
আকুল কেশের পরিমলে
শিউলি-বনের উদাস বায়ু
পড়ে থাকে তরুর তলে।
হৃদয়মাঝে হৃদয় দুলায়,
বাহিরে সে ভুবন ভুলায়,
আজি সে তার চোখের চাওয়া।
ছড়িয়ে দিল নীল গগনে।
সুরুল, ১১ ভাদ্র, ১৩২১
এক হাতে ওর কৃপাণ আছে
এক হাতে ওর কৃপাণ আছে
আর এক হাতে হার।
ও যে ভেঙেছে তোর দ্বার।
আসে নি ও ভিক্ষা নিতে,
লড়াই করে নেবে জিতে
পরানটি তোমার।
ও যে ভেঙেছে তোর দ্বার।
মরণেরি পথ দিয়ে ওই
আসছে জীবন-মাঝে,
ও যে আসছে বীরের সাজে।
আধেক নিয়ে ফিরবে না রে,
যা আছে সব একেবারে
করবে অধিকার।
ও যে ভেঙেছে তোর দ্বার।
সুরুল, ১৪ ভাদ্র, ১৩২১
এখানে তো বাঁধা পথের
এখানে তো বাঁধা পথের
অন্ত না পাই,
চলতে গেলে পথ ভুলি যে
কেবলি তাই।
তোমার জলে, তোমার স্থলে,
তোমার সুনীল আকাশতলে,
কোনোখানে কোনো পথের
চিহ্নটি নাই।
পথের খবর পাখির পাখায়
লুকিয়ে থাকে।
তারার আগুন পথের দিশা
আপনি রাখে।
ছয় ঋতু ছয় রঙিন রথে
যায় আসে যে বিনা পথে,
নিজেরে সেই অচিন-পথের
খবর শুধাই।
বুদ্ধগয়া, ২৪ আশ্বিন, ১৩২১
এতটুকু আঁধার যদি
এতটুকু আঁধার যদি
লুকিয়ে রাখিস বুকের ‘পরে
আকাশ-ভরা সূর্যতারা
মিথ্যা হবে তোদের তরে।
শিশির-ধোওয়া এই বাতাসে
হাত বুলালো ঘাসে ঘাসে,
ব্যর্থ হবে কেবল যে সে
তোদের ছোটো কোণের ঘরে।
মুগ্ধ ওরে, স্বপ্নঘোরে
যদি প্রাণের আসনকোণে
ধুলায়-গড়া দেবতারে
লুকিয়ে রাখিস আপন-মনে–
চিরদিনের প্রভু তবে
তোদের প্রাণে বিফল হবে,
বাইরে সে যে দাঁড়িয়ে রবে
কত-না যুগযুগান্তরে।
সুরুল, ৩০ ভাদ্র, ১৩২১
এদের পানে তাকাই আমি
এদের পানে তাকাই আমি,
বক্ষে কাঁপে ভয়।
সব পেরিয়ে তোমায় দেখি,
আর তো কিছু নয়।
একটুখানি সামনে আমার আঁধার জেগে থাকে
সেইটুকুতে সূর্যতারা সবই আমার ঢাকে–
তার উপরে চেয়ে দেখি
আলোয় আলোময়।
ছোটো আমার বড়ো হয় যে
যখন টানি কাছে–
বড়ো তখন কেমন করে
লুকায় তারি পাছে।
কাছের পানে তাকিয়ে আমার দিন তো গেছে কেটে,
এবার যেন সন্ধ্যাবেলায় কাছের ক্ষুধা মেটে–
এতকাল যে রইলে দূরে
তোমারি হোক জয়।
শান্তিনিকেতন, ১৬ আশ্বিন- রাত্রি, ১৩২১
এবার আমায় ডাকলে দূরে
এবার আমায় ডাকলে দূরে
সাগরপারের গোপন পুরে।
বোঝা আমার নামিয়েছি যে,
সঙ্গে আমায় নাও গো নিজে,
স্তব্ধ রাতের স্নিগ্ধ সুধা
পান করাবে তৃষ্ণাতুরে।
আমার সন্ধ্যাফুলের মধু
এবার যে ভোগ করবে বঁধু।
তারার আলোর প্রদীপখানি
প্রাণে আমার জ্বালবে আনি,
আমার যত কথা ছিল
ভেসে যাবে তোমার সুরে।
সুরুল, ২৩ ভাদ্র, ১৩২১
ও আমার মন যখন জাগলি না রে
ও আমার মন যখন জাগলি না রে
তোর মনের মানুষ এল দ্বারে।
তার চলে যাবার শব্দ শুনে
ভাঙল রে ঘুম–
ও তোর ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে।
মাটির ‘পরে আঁচল পাতি’
একলা কাটে নিশীথ রাতি,
তার বাঁশি বাজে আঁধার-মাঝে
দেখি না যে চক্ষে তারে।
ওরে তুই যাহারে দিলি ফাঁকি
খুঁজে তারে পায় কি আঁখি?
এখন পথে ফিরে পাবি কি রে
ঘরের বাহির করলি যারে।
সুরুল, ২১ ভাদ্র, ১৩২১