আমার সুরের সাধন রইল পড়ে
আমার সুরের সাধন রইল পড়ে।
চেয়ে চেয়ে কাটল বেলা
কেমন করে।
দেখি সকল অঙ্গ দিয়ে,
কী যে দেখি বলব কী এ–
গানের মতো চোখে বাজে
রূপের ঘোরে।
সবুজ সুধা এই ধরণীর
অঞ্জলিতে
কেমন করে ওঠে ভরে
আমার চিতে।
আমার সকল ভাবনাগুলি
ফুলের মতো নিল তুলি,
আশ্বিনের ওই আঁচলখানি
গেল ভরে।
শান্তিনিকেতন, ১৯ আশ্বিন, ১৩২১
আমার আর হবে না দেরি
আমার আর হবে না দেরি–
আমি শুনেছি ওই বাজে তোমার ভেরী।
তুমি কি নাথ, দাঁড়িয়ে আছ আমার যাবার পথে।
মনে হয় যে ক্ষণে ক্ষণে মোর বাতায়ন হতে
তোমায় যেন হেরি–
আমার আর হবে না দেরি।
আমার কাজ হয়েছে সারা,
এখন প্রাণে বাঁশি বাজায় সন্ধ্যাতারা।
দেবার মতো যা ছিল মোর নাই কিছু আর হাতে,
তোমার আশীর্বাদের মালা নেব কেবল মাথে
আমার ললাট ঘেরি–
এখন আর হবে না দেরি।
শান্তিনিকেতন, ১৬ আশ্বিন, ১৩২১
আমি অধম অবিশ্বাসী
আমি অধম অবিশ্বাসী,
এ পাপমুখে সাজে না যে
‘তোমায় আমি ভালোবাসি’।
গুণের অভিমানে মেতে
আর চাহি না আদর পেতে,
কঠিন ধুলায় বসে এবার
চরণসেবার অভিলাষী।
হৃদয় যদি জ্বলে, তারে
জ্বলিতে দাও, জ্বলিতে দাও।
ঘুরব না আর আপন ছায়ায়,
কাঁদব না আর আপন মায়ায়–
তোমার পানে রাখব ধরে
প্রাণের অচল হাসি।
? ১৩১৭
আমি পথিক, পথ আমারি সাথি
আমি পথিক, পথ আমারি সাথি।
দিন সে কাটায় গনি গনি
বিশ্বলোকের চরণধ্বনি,
তারার আলোয় গায় সে সারা রাতি।
কত যুগের রথের রেখা
বক্ষে তাহার আঁকে লেখা,
কত কালের ক্লান্ত আশা
ঘুমায় তাহার ধুলায় আঁচল পাতি।
বাহির হলেম কবে সে নাই মনে।
যাত্রা আমার চলার পাকে
এই পথেরই বাঁকে বাঁকে
নূতন হল প্রতি ক্ষণে ক্ষণে।
যত আশা পথের আশা,
পথে যেতেই ভালোবাসা,
পথে চলার নিত্যরসে
দিনে দিনে জীবন ওঠে মাতি।
শান্তিনিকেতন, ২১ আশ্বিন, ১৩২১
আমি যে আর সইতে পারি নে
আমি যে আর সইতে পারি নে।
সুরে বাজে মনের মাঝে গো
কথা দিয়ে কইতে পারি নে।
হৃদয়-লতা নুয়ে পড়ে
ব্যথাভরা ফুলের ভরে গো,
আমি সে আর বইতে পারি নে।
আজি আমার নিবিড় অন্তরে
কী হাওয়াতে কাঁপিয়ে দিল গো
পুলক-লাগা আকুল মর্মরে।
কোন্ গুণী আজ উদাস প্রাতে
মীড় দিয়েছে কোন্ বীণাতে গো,
ঘরে যে আর রইতে পারি নে।
সুরুল, ৯ ভাদ্র, ১৩২১
আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি
আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি,
সেথায় চরণ পড়ে,
তোমার সেথায় চরণ পড়ে।
তাই তো আমার সকল পরান
কাঁপছে ব্যথার ভরে গো
কাঁপছে থরথরে।
ব্যথা-পথের পথিক তুমি,
চরণ চলে ব্যথা চুমি,
কাঁদন দিয়ে সাধন আমার
চিরদিনের তরে গো
চিরজীবন ধ’রে।
নয়নজলের বন্যা দেখে
ভয় করি নে আর,
আমি ভয় করি নে আর।
মরণ-টানে টেনে আমায়
করিয়ে দেবে পার,
আমি তরব পারাবার!
ঝড়ের হাওয়া আকুল গানে
বইছে আজি তোমার পানে,
ডুবিয়ে তরী ঝাঁপিয়ে পড়ি
ঠেকব চরণ-‘পরে,
আমি বাঁচব চরণ ধ’রে।
কলিকাতা, ৬ ভাদ্র, ১৩২১
আলো যে আজ গান করে মোর প্রাণে গো
আলো যে আজ গান করে মোর প্রাণে গো।
কে এল মোর অঙ্গনে, কে জানে গো।
হৃদয় আমার উদাস ক’রে
কেড়ে নিল আকাশ মোরে,
বাতাস আমায় আনন্দবাণ হানে গো।
দিগন্তের ওই নীল নয়নের ছায়াতে
কুসুম যেন বিকাশে মোর কায়াতে।
মোর হৃদয়ের সুগন্ধ যে
বাহির হল কাহার খোঁজে,
সকল জীবন চাহে কাহার পানে গো।
শান্তিনিকেতন, ১৪ আশ্বিন, ১৩২১
আলো যে যায় রে দেখা
আলো যে
যায় রে দেখা–
হৃদয়ের পুব-গগনে
সোনার রেখা।
এবারে ঘুচল কি ভয়।
এবারে হবে কি জয়।
আকাশে হল কি ক্ষয়
কালির লেখা।
কারে ওই
যায় গো দেখা,
হৃদয়ের সাগরতীরে
দাঁড়ায় একা?
ওরে তুই সকল ভুলে
চেয় থাক্ নয়ন তুলে–
নীরবে চরণ-মূলে
মাথা ঠেকা।
কলিকাতা, ৬ ভাদ্র, ১৩২১
» আশীর্বাদ
এই আমি একমনে সঁপিলাম তাঁরে–
তোমরা তাঁহারি ধন আলোকে আঁধারে।
যখনি আমারি ব’লে ভাবি তোমাদের
মিথ্যা দিয়ে জাল বুনি ভাবনা-ফাঁদের।
সারথি চালান যিনি জীবনের রথ
তিনিই জানেন শুধু কার কোথা পথ।
আমি ভাবি আমি বুঝি পথের প্রহরী,
পথ দেখাইতে গিয়ে পথ রোধ করি।
আমার প্রদীপখানি অতি ক্ষীণকায়া,–
যতটুকু আলো দেয় তার বেশি ছায়া।
এ প্রদীপ আজ আমি ভেঙে দিনু ফেলে,
তাঁর আলো তোমাদের নিক বাহু মেলে।
সুখী হও দুঃখী হও তাহে চিন্তা নাই;
তোমরা তাঁহারি হও, আশীর্বাদ তাই।
শান্তিনিকেতন, ১৬ আশ্বিন-রাত্রি, ১৩২১
এ দিন আজি কোন্ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার
এ দিন আজি কোন্ ঘরে গো
খুলে দিল দ্বার।
আজি প্রাতে সূর্য ওঠা
সফল হল কার।
কাহার অভিষেকের তরে
সোনার ঘটে আলোক ভরে।
উষা কাহার আশিস বহি
হল আঁধার পার।
বনে বনে ফুল ফুটেছে,
দোলে নবীন পাতা–
কার হৃদয়ের মাঝে হল
তাদের মালা গাঁথা।
বহুযুগের উপহারে
বরণ করি নিল কারে।
কার জীবনে প্রভাত আজি
ঘোচায় অন্ধকার।
বুদ্ধগয়া, ২৩ আশ্বিন- প্রভাত,১৩২১
এই আবরণ ক্ষয় হবে গো ক্ষয় হবে
এই আবরণ ক্ষয় হবে গো ক্ষয় হবে,
এ দেহ মন ভূমানন্দময় হবে।
চোখে আমার মায়ার ছায়া টুটবে গো,
বিশ্বকমল প্রাণে আমার ফুটবে গো,
এ জীবনে তোমারি নাথ, জয় হবে।
রক্ত আমার বিশ্বতালে নাচবে যে,
হৃদয় আমার বিপুল প্রাণে বাঁচবে যে।
কাঁপবে তোমার আলো-বীণার তারে সে,
দুলবে তোমার তারা-মণির হারে সে,
বাসনা তার ছড়িয়ে গিয়ে লয় হবে।
শান্তিনিকেতন, ১৮ আশ্বিন- প্রভাত, ১৩২১