যেতে যেতে চায় না যেতে
যেতে যেতে চায় না যেতে
ফিরে ফিরে চায়,
সবাই মিলে পথে চলা
হল আমার দায়।
দুয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে,
দেয় না সাড়া হাজার ডাকে–
বাঁধন এদের সাধন-ধন,
ছিঁড়তে যে ভয় পায়।
আবেশভরে ধুলায় প’ড়ে
কতই করে ছল,
যখন বেলা যাবে চলে
ফেলবে আঁখিজল।
নাই ভরসা, নাই যে সাহস,
চিত্ত অবশ, চরণ অলস–
লতার মতো জড়িয়ে ধরে
আপন বেদনায়।
শান্তিনিকেতন, ২৮ ভাদ্র, ১৩২১
লক্ষ্মী যখন আসবে তখন
লক্ষ্মী যখন আসবে তখন
কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই–
দেখ্ রে চেয়ে আপন-পানে
পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই।
ফিরছে কেঁদে প্রভাত-বাতাস,
আলোক যে তার ম্লান হতাশ,
মুখে চেয়ে আকাশ তোরে
শুধায় আজি নীরবে তাই।
কত গোপন আশা নিয়ে
কোন্ সে গহন রাত্রিশেষে
অগাধ জলের তলা হতে
অমল কুঁড়ি উঠল ভেসে।
হল না তার ফুটে ওঠা,
কখন ভেঙে পড়ল বোঁটা,
মর্ত-কাছে স্বর্গ যা চায়
সেই মাধুরী কোথা রে পাই।
সুরুল, ২ আশ্বিন- অপরাহ্ন, ১৩২১
শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে,
বনের-পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।
মানিক-গাঁথা ওই যে তোমার কঙ্কণে
ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে।
কুঞ্জ-ছায়া গুঞ্জরণের সংগীতে
ওড়না ওড়ায় এ কী নাচের ভঙ্গিতে,
শিউলি-বনের বুক যে ওঠে আন্দোলি’।
সুরুল, ১৯ ভাদ্র, ১৩২১
শুধু তোমার বাণী নয় গো
শুধু তোমার বাণী নয় গো
হে বন্ধু, হে প্রিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশখানি দিয়ো।
সারা পথের ক্লান্তি আমার
সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মেটাব যে
খুঁজে না পাই দিশা।
এ আঁধার যে পূর্ণ তোমায়
সেই কথা বলিয়ো।
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশখানি দিয়ো।
হৃদয় আমার চায় যে দিতে,
কেবল নিতে নয়,
ব’য়ে ব’য়ে বেড়ায় সে তার
যা-কিছু সঞ্চয়।
হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো,
দাও গো আমার হাতে,
ধরব তারে, ভরব তারে,
রাখব তারে সাথে–
একলা পথের চলা আমার
করব রমণীয়।
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশখানি দিয়ো।
শান্তিনিকেতন, ১৮ ভাদ্র, ১৩২১
শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে
শেষ নাহি যে
শেষ কথা কে বলবে।
আঘাত হয়ে দেখা দিল,
আগুন হয়ে জ্বলবে।
সাঙ্গ হলে মেঘের পালা
শুরু হবে বৃষ্টি ঢালা,
বরফ জমা সারা হলে
নদী হয়ে গলবে।
ফুরায় যা, তা
ফুরায় শুধু চোখে–
অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার
যায় চলে আলোকে।
পুরাতনের হৃদয় টুটে
আপনি নূতন উঠবে ফুটে,
জীবনে ফুল ফোটা হলে
মরণে ফল ফলবে।
সুরুল, ২৮ ভাদ্র- অপরাহ্ন, ১৩২১
সন্ধ্যা হল, একলা আছি ব’লে
সন্ধ্যা হল, একলা আছি ব’লে
এই-যে চোখে অশ্রু পড়ে গ’লে
ওগো বন্ধু, বলো দেখি
শুধু কেবল আমার এ কি।
এর সাথে যে তোমার অশ্রু দোলে।
থাক্-না তোমার লক্ষ গ্রহতারা,
তাদের মাঝে আছ আমায়-হারা।
সইবে না সে, সইবে না সে,
টানতে আমায় হবে পাশে–
একলা তুমি, আমি একলা হলে।
শান্তিনিকেতন, ১৯ আশ্বিন- সন্ধ্যা, ১৩২১
সন্ধ্যাতারা যে ফুল দিল তোমার চরণ-তলে
সন্ধ্যাতারা যে ফুল দিল
তোমার চরণ-তলে
তারে আমি ধুয়ে দিলেম
আমার নয়নজলে।
বিদায়-পথে যাবার বেলা ম্লান রবির রেখা
সারা দিনের ভ্রমণ-বাণী লিখল সোনার লেখা,
আমি তাতেই সুর বসালেম
আপন গানের ছলে।
স্বর্ণ আলোর রথে চ’ড়ে
নেমে এল রাতি–
তারি আঁধার ভ’রে আমার
হৃদয় দিনু পাতি।
মৌন-পারাবারের তলে হারিয়ে-যাওয়া কথায়,
বিশ্বহৃদয়-পূর্ণ-করা বিপুল নীরবতায়
আমার বাণীর স্রোত মিলিছে
নীরব কোলাহলে।
বুদ্ধগয়া, ২৩ আশ্বিন- সন্ধ্যা, ১৩২১
সরিয়ে দিয়ে আমার ঘুমের
সরিয়ে দিয়ে আমার ঘুমের
পর্দাখানি
ডেকে গেল নিশীথরাতে
কে না জানি।
কোন্ গগনের দিশাহারা
তন্দ্রাবিহীন একটি তারা?
কোন্ রজনীর দুঃস্বপনের
আর্তবাণী?
ডেকে গেল নিশীথরাতে
কে না জানি।
আঁধার রাতে ভয় এসেছে
কোন্ সে নীড়ে?
বোঝাই তরী ডুবল কোথায়
পাষাণ-তীরে?
এই ধরণীর বক্ষ টুটে
এ কী রোদন এল ছুটে
আমার বক্ষে বিরামহারা
বেদন হানি?
ডেকে গেল নিশীথরাতে
কে না জানি।
শান্তিনিকেতন, ২১ আশ্বিন, ১৩২১
সহজ হবি সহজ হবি
সহজ হবি সহজ হবি
ওরে মন, সহজ হবি।
কাছের জিনিস দূরে রাখে
তার থেকে তুই দূরে র’বি।
কেন রে তোর দু হাত পাতা।
দান তো না চাই, চাই যে দাতা–
সহজে তুই দিবি যখন
সহজে তুই সকল লবি।
সহজ হবি সহজ হবি
ওরে মন, সহজ হবি–
আপন বচন-রচন হতে
বাহির হয়ে আয় রে কবি।
সকল কথার বাহিরেতে
ভুবন আছে হৃদয় পেতে,
নীরব ফুলের নয়ন-পানে
চেয়ে আছে প্রভাতরবি।
সুরুল, ৯ আশ্বিন- প্রভাত, ১৩২১
সারা জীবন দিল আলো
সারা জীবন দিল আলো
সূর্য গ্রহ চাঁদ–
তোমার আশীর্বাদ হে প্রভু,
তোমার আশীর্বাদ।
মেঘের কলস ভরে ভরে
প্রসাদবারি পড়ে ঝরে,
সকল দেহে প্রভাতবায়ু
ঘুচায় অবসাদ–
তোমার আশীর্বাদ হে প্রভু,
তোমার আশীর্বাদ।
তৃণ যে এই ধুলার ‘পরে
পাতে আঁচলখানি,
এই-যে আকাশ চিরনীরব
অমৃতময় বাণী–
ফুল যে আসে দিনে দিনে
বিনা রেখার পথটি চিনে,
এই-যে ভুবন দিকে দিকে
পুরায় কত সাধ–
তোমার আশীর্বাদ হে প্রভু,
তোমার আশীর্বাদ।
শান্তিনিকেতন, ১৭ আশ্বিন- প্রভাত, ১৩২১