মেঘ বলেছে যাব যাব
মেঘ বলেছে “যাব যাব’,
রাত বলেছে “যাই’।
সাগর বলে,”কূল মিলেছে,
আমি তো আর নাই।’
দুঃখ বলে, “রইনু চুপে
তাঁহার পায়ের চিহ্নরূপে।’
আমি বলে, “মিলাই আমি,
আর কিছু না চাই।’
ভুবন বলে, “তোমার তরে
আছে বরণমালা।’
গগন বলে, “তোমার তরে
লক্ষ প্রদীপ জ্বালা।’
প্রেম বলে যে, “যুগে যুগে
তোমার লাগি আছি জেগে।’
মরণ বলে, “আমি তোমার
জীবন-তরী বাই।’
শান্তিনিকেতন, ১৭ আশ্বিন-প্রভাত, ১৩২১
মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-‘পরে–
প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
রুদ্ধ দ্বারের বাহিরে দাঁড়ায়ে আমি
আর কতকাল এমনে কাটিবে স্বামী–
প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
রজনীর তারা উঠেছে গগন ছেয়ে,
আছে সবে মোর বাতায়ন-পানে চেয়ে–
প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
জীবনে আমার সংগীত দাও আনি,
নীরব রেখো না তোমার বীণার বাণী–
প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
মিলাব নয়ন তব নয়নের সাথে,
মিলাব এ হাত তব দক্ষিণ হাতে–
প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
হৃদয়পাত্র সুধায় পূর্ণ হবে,
তিমির কাঁপিবে গভীর আলোর রবে–
প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
সুরুল, ৮ আশ্বিন- প্রভাত , ১৩২১
মোর মরণে তোমার হবে জয়
মোর মরণে তোমার হবে জয়।
মোর জীবনে তোমার পরিচয়।
মোর দুঃখ যে রাঙা শতদল
আজ ঘিরিল তোমার পদতল,
মোর আনন্দ সে যে মণিহার
মুকুটে তোমার বাঁধা রয়।
মোর ত্যাগে যে তোমার হবে জয়।
মোর প্রেমে যে তোমার পরিচয়।
মোর ধৈর্য তোমার রাজপথ
সে যে লঙ্ঘিবে বনপর্বত,
মোর বীর্য তোমার জয়রথ
তোমারি পতাকা শিরে বয়।
সুরুল, ২২ ভাদ্র, ১৩২১
যখন তুমি বাঁধছিলে তার
যখন তুমি বাঁধছিলে তার
সে যে বিষম ব্যথা;
আজ বাজাও বীণা, ভুলাও ভুলাও
সকল দুখের কথা।
এতদিন যা সংগোপনে
ছিল তোমার মনে মনে
আজকে আমার তারে তারে
শুনাও সে বারতা।
আর বিলম্ব কোরো না গো
ওই যে নেবে বাতি।
দুয়ারে মোর নিশীথিনী
রয়েছে কান পাতি।
বাঁধলে যে সুর তারায় তারায়
অন্তবিহীন অগ্নিধারায়,
সেই সুরে মোর বাজাও প্রাণে
তোমার ব্যাকুলতা।
সুরুল, ১১ ভাদ্র, ১৩২১
যখন তোমায় আঘাত করি
যখন তোমায় আঘাত করি
তখন চিনি।
শত্রু হয়ে দাঁড়াই যখন
লও যে জিনি।
এ প্রাণ যত নিজের তরে
তোমারি ধন হরণ করে
ততই শুধু তোমার কাছে
হয় সে ঋণী।
উজিয়ে যেতে চাই যতবার
গর্বসুখে,
তোমার স্রোতের প্রবল পরশ
পাই যে বুকে।
আলো যখন আলসভরে
নিবিয়ে ফেলি আপন ঘরে
লক্ষ তারা জ্বালায় তোমার
নিশীথিনী।
এলাহাবাদ, ১ কার্তিক- সন্ধ্যা, ১৩২১
যদি আমায় তুমি বাঁচাও তবে
যদি আমায় তুমি বাঁচাও তবে
তোমার নিখিল ভুবন ধন্য হবে।
যদি আমার মলিন মনের কালি।
ঘুচাও পুণ্য সলিল ঢালি
তোমার চন্দ্র সূর্য নূতন আলোয়
জাগবে জ্যোতির মহোৎসবে।
আজো ফোটে নি মোর শোভার কুঁড়ি,
তারি বিষাদ আছে জগৎ জুড়ি।
যদি নিশার তিমির গিয়ে টুটে
আমার হৃদয় জেগে উঠে
তবে মুখর হবে সকল আকাশ
আনন্দময় গানের রবে।
? ১৩১৭
যা দেবে তা দেবে তুমি আপন হাতে
যা দেবে তা দেবে তুমি আপন হাতে
এই তো তোমার কথা ছিল আমার সাথে।
তাই তো আমার অশ্রুজলে
তোমার হাসির মুক্তা ফলে,
তোমার বীণা বাজে আমার বেদনাতে।
যা-কিছু দাও, দাও যে তুমি আপন হাতে।
পরের কথায় চলতে পথে ভয় করি যে।
জানি আমার নিজের মাঝে আছ নিজে।
ভুল আমারে বারে বারে
ভুলিয়ে আনে তোমার দ্বারে,
আপনমনে চলি গো তাই দিনে রাতে।
যা-কিছু দাও, দাও যে তুমি আপন হাতে।
বুদ্ধগয়া, ২৪ আশ্বিন, ১৩২১
যাস নে কোথাও ধেয়ে
যাস নে কোথাও ধেয়ে,
দেখ্ রে কেবল চেয়ে।
ওই যে পুরব গগন-মূলে
সোনার বরন পালটি তুলে
আসছে তরী বেয়ে–
দেখ্ রে কেবল চেয়ে।
ওই-যে আঁধার তটে
আনন্দ-গান রটে।
অনেক দিনের অভিসারে
অগম গহন জীবন-পারে
পৌঁছিল তোর নেয়ে,
দেখ্ রে কেবল চেয়ে।
ওই-যে রে তোর তরী
আলোয় গেল ভরি।
চরণে তার বরণডালা
কোন্ কাননের বহে মালা
গন্ধে গগন ছেয়ে?
দেখ্ রে কেবল চেয়ে।
এলাহাবাদ, ২ কার্তিক-প্রভাত, ১৩২১
যে থাকে থাক্-না দ্বারে
যে থাকে থাক্-না দ্বারে,
যে যাবি যা-না পারে।
যদি ওই ভোরের পাখি
তোরি নাম যায় রে ডাকি,
একা তুই চলে যা রে।
কুঁড়ি চায়, আঁধার রাতে
শিশিরের রসে মাতে।
ফোটা ফুল চায় না নিশা,
প্রাণে তার আলোর তৃষা,
কাঁদে সে অন্ধকারে।
সুরুল, ১৭ ভাদ্র-সকাল, ১৩২১
যে দিল ঝাঁপ ভবসাগর-মাঝখানে
যে দিল ঝাঁপ ভবসাগর-মাঝখানে–
কূলের কথা ভাবে না সে,
চায় না কভু তরীর আশে,
আপন সুখে সাঁতার-কাটা সেই জানে
ভবসাগর-মাঝখানে।
রক্ত যে তার মেতে ওঠে
মহাসাগর-কল্লোলে,
ওঠা-পড়ার ছন্দে হৃদয়
ঢেউয়ের সাথে ঢেউ তোলে।
অরুণ-আলোর আশিস লয়ে
অস্তরবির আদেশ বয়ে
আপন সুখে যায় যে চলে কার পানে
ভবসাগর-মাঝখানে।
বুদ্ধগয়া, ২৩ আশ্বিন, ১৩২১
যেতে যেতে একলা পথে
যেতে যেতে একলা পথে
নিবেছে মোর বাতি।
ঝড় এসেছে, ওরে, এবার
ঝড়কে পেলেম সাথি।
আকাশ-কোণে সর্বনেশে
ক্ষণে ক্ষণে উঠছে হেসে,
প্রলয় আমার কেশে বেশে
করছে মাতামাতি।
যে পথ দিয়ে যেতেছিলেম
ভুলিয়ে দিল তারে,
আবার কোথা চলতে হবে
গভীর অন্ধকারে।
বুঝি বা এই বজ্ররবে
নূতন পথের বার্তা কবে,
কোন্ পুরীতে গিয়ে তবে
প্রভাত হবে রাতি।
সুরুল, ২৬ ভাদ্র- অপরাহ্ন, ১৩২১