- বইয়ের নামঃ গীতালি
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অগ্নিবীণা বাজাও তুমি
অগ্নিবীণা বাজাও তুমি
কেমন করে।
আকাশ কাঁপে তারার আলোর
গানের ঘোরে।
তেমনি করে আপন হাতে
ছুঁলে আমার বেদনাতে,
নূতন সৃষ্টি জাগল বুঝি
জীবন-‘পরে।
বাজে বলেই বাজাও তুমি–
সেই গরবে
ওগো প্রভু,আমার প্রাণে
সকল স’বে।
বিষম তোমার বহ্নিঘাতে
বারে বারে আমার রাতে
জ্বালিয়ে দিলে নূতন তারা
ব্যথায় ভরে।
শান্তিনিকেতন, ১৩ আশ্বিন- রাত্রি, ১৩২১
অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে
অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে।
অচেনাকেই চিনে চিনে
উঠবে জীবন ভরে।
জানি জানি আমার চেনা
কোনো কালেই ফুরাবে না,
চিহ্নহারা পথে আমায়
টানবে অচিন-ডোরে।
ছিল আমার মা অচেনা,
নিল আমায় কোলে।
সকল প্রেমই অচেনা গো,
তাই তো হৃদয় দোলে।
অচেনা এই ভুবন-মাঝে
কত সুরেই হৃদয় বাজে,
অচেনা এই জীবন আমার–
বেড়াই তারি ঘোরে।
বুদ্ধগয়া, ২৩ আশ্বিন, ১৩২১\
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো।
সকল দ্বন্দ্ব-বিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো,
সেই তো তোমার ভালো।
পথের ধুলায় বক্ষ পেতে রয়েছে যেই গেহ
সেই তো তোমার গেহ।
সমর-ঘাতে অমর করে রুদ্র নিঠুর স্নেহ
সেই তো তোমার স্নেহ।
সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দান
সেই তো তোমার দান।
মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ
সেই তো তোমার প্রাণ।
বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি
সেই তো স্বর্গভূমি।
সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি
সেই তো আমার তুমি।
এলাহাবাদ, ২৯ আশ্বিন- প্রভাত, ১৩২১
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
আগুনের
পরশমণি
ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন
পুণ্য করো
দহন-দানে।
আমার এই
দেহখানি
তুলে ধরো,
তোমার ওই
দেবালয়ের
প্রদীপ করো,
নিশিদিন
আলোক-শিখা
জ্বলুক গানে।
আগুনের
পরশমণি
ছোঁয়াও প্রাণে।
আঁধারের
গায়ে গায়ে
পরশ তব
সারা রাত
ফোটাক তারা
নব নব।
নয়নের
দৃষ্টি হতে
ঘুচবে কালো,
যেখানে
পড়বে সেথায়
দেখবে আলো,
ব্যথা মোর
উঠবে জ্বলে
ঊর্ধ্ব-পানে।
আগুনের
পরশমণি
ছোঁয়াও প্রাণে।
সুরুল, ১১ ভাদ্র, ১৩২১
আঘাত করে নিলে জিনে
আঘাত করে নিলে জিনে,
কাড়িলে মন দিনে দিনে।
সুখের বাধা ভেঙে ফেলে
তবে আমার প্রাণে এলে,
বারে বারে মরার মুখে
অনেক দুখে নিলাম চিনে।
তুফান দেখে ঝড়ের রাতে
ছেড়েছি হাল তোমার হাতে।
বাটের মাঝে হাটের মাঝে
কোথাও আমায় ছাড়লে না যে,
যখন আমার সব বিকালো
তখন আমায় নিলে কিনে।
সুরুল, ৮ ভাদ্র, ১৩২১
আজি নির্ভয়নিদ্রিত ভুবনে জাগে কে জাগে
আজি নির্ভয়নিদ্রিত ভুবনে জাগে কে জাগে।
ঘন সৌরভমন্থর পবনে জাগে কে জাগে।
কত নীরব বিহঙ্গ-কুলায়ে
মোহন অঙ্গুলি বুলায়ে জাগে কে জাগে।
কত অস্ফুট পুষ্পের গোপনে জাগে কে জাগে।
এই অপার অম্বর-পাথারে
স্তম্ভিত গম্ভীর আঁধারে জাগে কে জাগে।
মম গম্ভীর অন্তর-বেদনে জাগে কে জাগে।
শিলাইদহ, অগ্রহায়ণ, ১৩১৭
আপন হতে বাহির হয়ে
আপন হতে বাহির হয়ে
বাইরে দাঁড়া,
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের
পাবি সাড়া।
এই-যে বিপুল ঢেউ লেগেছে
তোর মাঝেতে উঠুক নেচে,
সকল পরান দিক-না নাড়া–
বাইরে দাঁড়া, বাইরে দাঁড়া।
বোস্-না ভ্রমর এই নীলিমায়
আসন লয়ে
অরুণ-আলোর স্বর্ণরেণু
মাখা হয়ে।
যেখানেতে অগাধ ছুটি
মেল্ সেথা তোর ডানা দুটি,
সবার মাঝে পাবি ছাড়া–
বাইরে দাঁড়া, বাইরে দাঁড়া।
শান্তিনিকেতন, ১৭ আশ্বিন- সন্ধ্যা, ১৩২১
আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে
আবার যদি ইচ্ছা কর
আবার আসি ফিরে
দুঃখসুখের-ঢেউ-খেলানো
এই সাগরের তীরে।
আবার জলে ভাসাই ভেলা,
ধুলার ‘পরে করি খেলা,
হাসির মায়ামৃগীর পিছে
ভাসি নয়ন-নীরে।
কাঁটার পথে আঁধার রাতে
আবার যাত্রা করি–
আঘাত খেয়ে বাঁচি কিম্বা
আঘাত খেয়ে মরি।
আবার তুমি ছদ্মবেশে
আমার সাথে খেলাও হেসে,
নূতন প্রেমে ভালোবাসি
আবার ধরণীরে।
বুদ্ধগয়া, ২৩ আশ্বিন, ১৩২১
আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে
আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে,
মেঘ-আঁচলে নিলে ঘিরে।
সূর্য হারায়, হারায় তারা,
আঁধারে পথ হয় যে হারা,
ঢেউ দিয়েছে নদীর নীরে।
সকল আকাশ, সকল ধরা,
বর্ষণেরি বাণী-ভরা।
ঝরঝর ধারায় মাতি
বাজে আমার আঁধার রাতি,
বাজে আমার শিরে শিরে।
সুরুল, ১০ ভাদ্র, ১৩২১
আমার বোঝা এতই করি ভারী
আমার বোঝা এতই করি ভারী–
তোমার ভার যে বইতে নাহি পারি।
আমারি নাম সকল গায়ে লিখা,
হয় নি পরা তব নামের টিকা–
তাই তো আমায় দ্বার ছাড়ে না দ্বারী।
আমার ঘরে আমিই শুধু থাকি,
তোমার ঘরে লও আমারে ডাকি।
বাঁচিয়ে রাখি যা-কিছু মোরে আছে
তার ভাবনায় প্রাণ তো নাহি বাঁচে–
সব যেন মোর তোমার কাছে হারি।
শান্তিনিকেতন, ১৫ আশ্বিন, ১৩২১
আমার সকল রসের ধারা
আমার সকল রসের ধারা
তোমাতে আজ হোক-না হারা।
জীবন জুড়ে লাগুক পরশ,
ভুবন ব্যেপে জাগুক হরষ,
তোমার রূপে মরুক ডুবে
আমার দুটি আঁখিতারা।
হারিয়ে-যাওয়া মনটি আমার
ফিরিয়ে তুমি আনলে আবার।
ছড়িয়ে-পড়া আশাগুলি
কুড়িয়ে তুমি লও গো তুলি,
গলার হারে দোলাও তারে
গাঁথা তোমার করে সারা।
সুরুল, ১০ ভাদ্র, ১৩২১