বিচ্ছেদ
তোমার বীণার সাথে আমি
সুর দিয়ে যে যাব
তারে তারে খুঁজে বেড়াই
সে সুর কোথায় পাব ।
যেমন সহজ ভোরের জাগা ,
স্রোতের আনাগোনা ,
যেমন সহজ পাতায় শিশির ,
মেঘের মুখে সোনা ,
যেমন সহজ জ্যোৎস্নাখানি
নদীর বালু – পাড়ে ,
গভীর রাতে বৃষ্টিধারা
আষাঢ় – অন্ধকারে
খুঁজে মরি তেমনি সহজ ,
তেমনি ভরপুর ,
তেমনিতরো অর্থ – ছোটা
আপনি – ফোটা সুর—
তেমনিতরো নিত্য নবীন ,
অফুরন্ত প্রাণ ,
বহুকালের পুরানো সেই
সবার জানা গান ।
আমার যে এই নূতন – গড়া
নূতন বাঁধা তার
নূতন সুরে করতে সে যায়
সৃষ্টি আপনার ।
মেশে না তাই চারি দিকের
সহজ সমীরণে ,
মেলে না তাই আকাশ – ডোবা
স্তব্ধ আলোর সনে ।
জীবন আমার কাঁদে যে তাই
দণ্ডে পলে পলে ,
যত চেষ্টা করি কেবল
চেষ্টা বেড়ে চলে ।
ঘটিয়ে তুলি কত কী যে
বুঝি না এক তিল ,
তোমার সঙ্গে অনায়াসে
হয় না সুরের মিল ।
বিদায়
বিদায় দেহো , ক্ষম আমায় ভাই ।
কাজের পথে আমি তো আর নাই ।
এগিয়ে সবে যাও – না দলে দলে ,
জয়মাল্য লও – না তুলি গলে ,
আমি এখন বনচ্ছায়াতলে
অলক্ষিতে পিছিয়ে যেতে চাই ।
তোমরা মোরে ডাক দিয়ো না ভাই ।
অনেক দূরে এলেম সাথে সাথে ,
চলেছিলেম সবাই হাতে হাতে ।
এইখানেতে দুটি পথের মোড়ে
হিয়া আমার উঠল কেমন করে
জানি নে কোন্ ফুলের গন্ধ – ঘোরে
সৃষ্টিছাড়া ব্যাকুল বেদনাতে ।
আর তো চলা হয় না সাথে সাথে ।
তোমরা আজি ছুটেছ যার পাছে
সে – সব মিছে হয়েছে মোর কাছে—
রত্ন খোঁজা , রাজ্য ভাঙা – গড়া ,
মতের লাগি দেশ – বিদেশে লড়া ,
আলবালে জলসেচন করা
উচ্চশাখা স্বর্ণচাঁপার গাছে ।
পারি নে আর চলতে সবার পাছে ।
আকাশ ছেয়ে মন – ভোলানো হাসি
আমার প্রাণে বাজালো আজ বাঁশি ।
লাগল আলস পথে চলার মাঝে ,
হঠাৎ বাধা পড়ল সকল কাজে ,
একটি কথা পরান জুড়ে বাজে
‘ ভালোবাসি , হায় রে ভালোবাসি ‘ —
সবার বড়ো হৃদয় – হরা হাসি ।
তোমরা তবে বিদায় দেহো মোরে—
অকাজ আমি নিয়েছি সাধ করে ।
মেঘের পথের পথিক আমি আজি
হাওয়ার মুখে চলে যেতেই রাজি ,
অকূল – ভাসা তরীর আমি মাঝি
বেড়াই ঘুরে অকারণের ঘোরে ।
তোমরা সবে বিদায় দেহো মোরে ।
বৈশাখে
তপ্ত হাওয়া দিয়েছে আজ
আমলাগাছের কচি পাতায় ,
কোথা থেকে ক্ষণে ক্ষণে
নিমের ফুলে গন্ধে মাতায় ।
কেউ কোথা নেই মাঠের’পরে ,
কেউ কোথা নেই শূন্য ঘরে ,
আজ দুপুরে আকাশতলে
রিমিঝিমি নূপুর বাজে ।
বারে বারে ঘুরে ঘুরে
মৌমাছিদের গুঞ্জসুরে
কার চরণের নৃত্য যেন
ফিরে আমার বুকের মাঝে ।
রক্তে আমার তালে তালে
রিমিঝিমি নূপুর বাজে ।
ঘন মহুল – শাখার মতো
নিশ্বসিয়া উঠিছে প্রাণ ,
গায়ে আমার লেগেছে কার
এলোচুলের সুদূর ঘ্রাণ ।
আজি রোদের প্রখর তাপে
বাঁধের জলে আলো কাঁপে ,
বাতাস বাজে মর্মরিয়া
সারি – বাঁধা তালের বনে ।
আমার মনের মরীচিকা
আকাশপারে পড়ল লিখা ,
লক্ষ্যবিহীন দূরের’পরে
চেয়ে আছি আপন – মনে ।
অলস ধেনু চরে বেড়ায়
সারি – বাঁধা তালের বনে ।
আজিকার এই তপ্ত দিনে
কাটল বেলা এমনি করে ,
গ্রামের ধারে ঘাটের পথে
এল গভীর ছায়া পড়ে ।
সন্ধ্যা এখন পড়ছে হেলে
শালবনেতে আঁচল মেলে ,
আঁধার – ঢালা দিঘির ঘাটে
হয়েছে শেষ কলস ভরা ।
মনের কথা কুড়িয়ে নিয়ে
ভাবি মাঠের মধ্যে গিয়ে—
সারা দিনের অকাজে আজ
কেউ কি মোরে দেয় নি ধরা ।
আমার কি মন শূন্য , যখন
হল বধূর কলস ভরা ।
ভার
তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার
করিয়া দিয়েছ সোজা ,
আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি
সকলি হয়েছে বোঝা ।
এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু ,
নামাও—
ভারের বেগেতে চলেছি , আমার
এ যাত্রা তুমি থামাও ।
যে তোমার ভার বহে কভু তার
সে ভারে ঢাকে না আঁখি ,
পথে বাহিরিলে জগৎ তারে তো
দেয় না কিছুই ফাঁকি ।
অবারিত আলো ধরে আসি তার
হাতে—
বনে পাখি গায় , নদীধারা ধায় ,
চলে সে সবার সাথে ।
তুমি কাজ দিলে কাজেরই সঙ্গে
দাও যে অসীম ছুটি ,
তোমার আদেশ আবরণ হয়ে
আকাশ লয় না লুটি ।
বাসনায় মোরা বিশ্বজগৎ
ঢাকি—
তোমা – পানে চেয়ে যত করি ভোগ
তত আরো থাকে বাকি ।
আপনি যে দুখ ডেকে আনি সে যে
জ্বালায় বজ্রানলে—
অঙ্গার করে রেখে যায় , সেথা
কোনো ফল নাহি ফলে ।
তুমি যাহা দাও সে যে দুঃখের
দান ,
শ্রাবণধারায় বেদনার রসে
সার্থক করে প্রাণ ।
যেখানে যা – কিছু পেয়েছি কেবলি
সকলি করেছি জমা—
যে দেখে সে আজ মাগে যে হিসাব ,
কেহ নাহি করে ক্ষমা ।
এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু ,
নামাও ।
ভারের বেগেতে ঠেলিয়া চলেছে ,
এ যাত্রা মোর থামাও ।
মিলন
আমি কেমন করিয়া জানাব আমার
জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো— আমার
জুড়ালো হৃদয় প্রভাতে ।
আমি কেমন করিয়া জানাব আমার
পরান কী নিধি কুড়ালো— ডুবিয়া
নিবিড় নীরব শোভাতে ।
আজ গিয়েছি সবার মাঝারে , সেথায়
দেখেছি একেলা আলোকে— দেখেছি
আমার হৃদয় – রাজারে ।
আমি দু – একটি কথা কয়েছি তা – সনে
সে নীরব সভা – মাঝারে— দেখেছি
চিরজনমের রাজারে ।
ওগো , সে কি মোরে শুধু দেখেছিল চেয়ে
অথবা জুড়ালো পরশে— তাহার
কমলকরের পরশে—
আমি সে কথা সকলি গিয়েছি যে ভুলে
ভুলেছি পরম হরষে ।
আমি জানি না কী হল , শুধু এই জানি
চোখে মোর সুখ মাখালো— কে যেন
সুখ – অঞ্জন মাখালো—
কার আঁখিভরা হাসি উঠিল প্রকাশি
যে দিকেই আঁখি তাকালো ।