তিনশো বছর কোথায় গেল ,
তবু বুঝি নাকো
আজো কেন ওরে কোকিল
তেমনি সুরেই ডাকো ।
ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে গেছে ,
ফেটেছে সেই ছাদ—
রূপকথা আজ কাহার মুখে
শুনবে সাঁঝের চাঁদ ।
শহর থেকে ঘণ্টা বাজে ,
সময় নাই রে হায়
ঘর্ঘরিয়া চলেছি আজ
কিসের ব্যর্থতায় ।
আর কি বধূ , গাঁথ ‘ মালা—
চোখে কাজল আঁক ‘ ?
পুরানো সেই দিনের সুরে
কোকিল কেন ডাক ‘ ।
খেয়া
তুমি এ পার – ও পার কর কে গো ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
আমি ঘরের দ্বারে বসে বসে
দেখি যে তাই চেয়ে ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
ভাঙিলে হাট দলে দলে
সবাই যবে ঘাটে চলে
আমি তখন মনে করি
আমিও যাই ধেয়ে ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
তুমি সন্ধ্যাবেলা ও পার – পানে
তরণী যাও বেয়ে ,
দেখে মন আমার কেমন সুরে
ওঠে যে গান গেয়ে
ওগো খেয়ার নেয়ে !
কালো জলের কলোকলে
আঁখি আমার ছলোছলে ,
ও পার হতে সোনার আভা
পরান ফেলে ছেয়ে ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
দেখি তোমার মুখে কথাটি নেই ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
কী যে তোমার চোখে লেখা আছে
দেখি যে তাই চেয়ে ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
আমার মুখে ক্ষণতরে
যদি তোমার আঁখি পড়ে
আমি তখন মনে করি
আমিও যাই ধেয়ে ,
ওগো খেয়ার নেয়ে ।
গান শোনা
আমার এ গান শুনবে তুমি যদি
শোনাই কখন বলো ।
ভরা চোখের মতো যখন নদী
করবে ছলছল ,
ঘনিয়ে যখন আসবে মেঘের ভার
বহু কালের পরে ,
না যেতে দিন সজল অন্ধকার
নামবে তোমার ঘরে ,
যখন তোমার কাজ কিছু নেই হাতে ,
তবুও বেলা আছে ,
সাথি তোমার আসত যারা রাতে
আসে নি কেউ কাছে ,
তখন আমায় মনে পড়ে যদি
গাইতে যদি বল—
নবমেঘের ছায়ায় যখন নদী
করবে ছলছল ।
ম্লান আলোয় দখিন – বাতায়নে
বসবে তুমি একা—
আমি গাব বসে ঘরের কোণে ,
যাবে না মুখ দেখা ।
ফুরাবে দিন , আঁধার ঘন হবে ,
বৃষ্টি হবে শুরু—
উঠবে বেজে মৃদুগভীর রবে
মেঘের গুরুগুরু ।
ভিজে পাতার গন্ধ আসবে ঘরে ,
ভিজে মাটির বাস—
মিলিয়ে যাবে বৃষ্টির ঝর্ঝরে
বনের নিশ্বাস ।
বাদল – সাঁঝে আঁধার বাতায়নে
বসবে তুমি একা—
আমি গেয়ে যাব আপন – মনে ,
যাবে না মুখ দেখা ।
জলের ধারা ঝরবে দ্বিগুণ বেগে ,
বাড়বে অন্ধকার—
নদীর ধারে বনের সঙ্গে মেঘে
ভেদ রবে না আর ।
কাঁসর ঘণ্টা দূরে দেউল হতে
জলের শব্দে মিশে
আঁধার পথে ঝোড়ো হাওয়ার স্রোতে
ফিরবে দিশে দিশে ।
শিরীষফুলের গন্ধ থেকে থেকে
আসবে জলের ছাঁটে ,
উচ্চরবে পাইক যাবে হেঁকে
গ্রামের শূন্য বাটে ।
জলের ধারা ঝরবে বাঁশের বনে ,
বাড়বে অন্ধকার—
গানের সাথে বাদলা রাতের সনে
ভেদ রবে না আর ।
ও ঘর হতে যবে প্রদীপ জ্বেলে
আনবে আচম্বিত
সেতারখানি মাটির’পরে ফেলে
থামাব মোর গীত ।
হঠাৎ যদি মুখ ফিরিয়ে তবে
চাহ আমার পানে
এক নিমিষে হয়তো বুঝে লবে
কী আছে মোর গানে ।
নামায়ে মুখ নয়ন করে নিচু
বাহির হয়ে যাব ,
একলা ঘরে যদি কোনো – কিছু
আপন – মনে ভাব ।
থামিয়ে গান আমি চলে গেলে
যদি আচম্বিত
বাদল – রাতে আঁধারে চোখ মেলে
শোন আমার গীত ।
গোধূলিলগ্ন
আমার গোধূলিলগন এল বুঝি কাছে—
গোধূলিলগন রে ।
বিবাহের রঙে রাঙা হয়ে আসে
সোনার গগন রে ।
শেষ করে দিল পাখি গান গাওয়া ,
নদীর উপরে পঞ্চড়ে এল হাওয়া ,
ও পারের তীর , ভাঙা মন্দির
আঁধারে মগন রে ।
আসিছে মধুর ঝিল্লিনূপুরে
গোধূলিলগন রে ।
আমার দিন কেটে গেছে কখনো খেলায় ,
কখনো কত কী কাজে ।
এখন কি শুনি পূরবীর সুরে
কোন্ দূরে বাঁশি বাজে ।
বুঝি দেরি নাই , আসে বুঝি আসে ,
আলোকের আভা লেগেছে আকাশে ,
বেলাশেষে মোরে কে সাজাবে ওরে
নবমিলনের সাজে ।
সারা হল কাজ , মিছে কেন আজ
ডাক মোরে আর কাজে ।
এখন নিরিবিলি ঘরে সাজাতে হবে রে
বাসকশয়ন যে ।
ফুলশেজ লাগি রজনীগন্ধা
হয় নি চয়ন যে ।
সারা যামিনীর দীপ সযতনে
জ্বালায়ে তুলিতে হবে বাতায়নে ,
যূথীদল আনি গুণ্ঠনখানি
করিব বয়ন যে ।
সাজাতে হবে রে নিবিড় রাতের
বাসকশয়ন যে ।
প্রাতে এসেছিল যারা কিনিতে বেচিতে
চলে গেছে তারা সব ।
রাখালের গান হল অবসান ,
না শুনি ধেনুর রব ।
এই পথ দিয়ে প্রভাতে দুপুরে
যারা এল আর যারা গেল দূরে
কে তারা জানিত আমার নিভৃত
সন্ধ্যার উৎসব ।
কেনাবেচা যারা করে গেল সারা
চলে গেল তারা সব ।
আমি জানি যে আমার হয়ে গেছে গণা
গোধূলিলগন রে ।
ধূসর আলোকে মুদিবে নয়ন
অস্তগগন রে—
তখন এ ঘরে কে খুলিবে দ্বার ,
কে লইবে টানি বাহুটি আমার ,
আমায় কে জানে কী মন্ত্রে গানে
করিবে মগন রে—
সব গান সেরে আসিবে যখন
গোধূলিলগন রে ।
ঘাটে
বাউলের সুর
আমার নাই – বা হল পারে যাওয়া ।
যে হাওয়াতে চলত তরী
অঙ্গেতে সেই লাগাই হাওয়া ।
নেই যদি – বা জমল পাড়ি
ঘাট আছে তো বসতে পারি ,
আমার আশার তরী ডুবল যদি
দেখব তোদের তরী বাওয়া ।
হাতের কাছে কোলের কাছে
যা আছে সেই অনেক আছে ,
আমার সারা দিনের এই কি রে কাজ
ও পার – পানে কেঁদে চাওয়া ।
কম কিছু মোর থাকে হেথা
পুরিয়ে নেব প্রাণ দিয়ে তা ,
আমার সেইখানেতেই কল্পলতা
যেখানে মোর দাবি – দাওয়া ।
চাঞ্চল্য