নিধু বাঁকা ক’রে ঘাড় ওড়নাটা উড়িয়ে
বলে, “মোর পাকা হাড়, যাব নাকো বুড়িয়ে।
যে যা খুশি করুক-না,
মারুক-না, ধরুক-না,
তাকিয়াতে দিয়ে ঠেস দেব সব তুড়িয়ে।’
গালি তারে দিল লোকে
হাসে নিধু আড়চোখে;
বলে, “দাদা, আরো বলো, কান গেল জুড়িয়ে।’
পিসে হয় কুলদার, ভুলুদার কাকা সে–
আড়চোখে হাসে আর করে ঘাড় বাঁকা সে।
যবে গিয়ে শালিখায়
সাহেবের গালি খায়,
“কেয়ার করিনে’ ব’লে তুড়ি মারে আকাশে।
যেদিন ফয়জাবাদে
পত্নী ফুঁপিয়ে কাঁদে,
“তবে আসি’ ব’লে হাসি চলে যায় ঢাকা সে।
নিষ্কাম পরহিতে কে ইহারে সামলায়
নিষ্কাম পরহিতে কে ইহারে সামলায়–
স্বার্থেরে নিঃশেষে-মুছে-ফেলা মামলায়।
চলেছে উদারভাবে সম্বল-খোয়ানি–
গিনি যায়, টাকা যায়, সিকি যায় দোয়ানি,
হল সারা বাঁটোয়ারা উকিলে ও আমলায়।
গিয়েছে পরের লাগি অন্নের শেষ গুঁড়ো–
কিছু খুঁটে পাওয়া যায় ভূষি তুঁষ খুদকুঁড়ো
গোরুহীন গোয়ালের তলাহীন গামলায়।
নীলুবাবু বলে শোনো নেয়ামৎ দর্জি
নীলুবাবু বলে, “শোনো
নেয়ামৎ দর্জি,
পুরোনো ফ্যাশানটাতে
নয় মোর মর্জি।’
শুনে নিয়ামৎ মিঞা যতনে পঁচিশটে
সম্মুখে ছিদ্র, বোতাম দিল পৃষ্ঠে।
লাফ দিয়ে বলে নীলু, “এ কী আশ্চর্যি!’
ঘরের গৃহিণী কয়, “রয় না তো ধর্যি।’
পণ্ডিত কুমিরকে ডেকে বলে
পণ্ডিত কুমিরকে
ডেকে বলে, “নক্র,
প্রখর তোমার দাঁত,
মেজাজটা বক্র।
আমি বলি নখ তব
করো তুমি কর্তন,
হিংস্র স্বভাব তবে
হবে পরিবর্তন
আমিষ ছাড়িয়া যদি
শুধু খাও তক্র।’
পাঁচদিন ভাত নেই, দুধ একরত্তি
পাঁচদিন ভাত নেই, দুধ একরত্তি–
জ্বর গেল, যায় না যে তবু তার পথ্যি।
সেই চলে জলসাবু, সেই ডাক্তারবাবু,
কাঁচা কুলে আমড়ায় তেমনি আপত্তি।
ইস্কুলে যাওয়া নেই সেইটে যা মঙ্গল–
পথ খুঁজে ঘুরিনেকো গণিতের জঙ্গল।
কিন্তু যে বুক ফাটে দূর থেকে দেখি মাঠে
ফুটবল-ম্যাচে জমে ছেলেদের দঙ্গল।
কিনুরাম পণ্ডিত, মনে পড়ে, টাক তার–
সমান ভীষণ জানি চুনিলাল ডাক্তার।
খুলে ওষুধের ছিপি হেসে আসে টিপিটিপি–
দাঁতের পাটিতে দেখি, দুটো দাঁত ফাঁক তার।
জ্বরে বাঁধে ডাক্তারে, পালাবার পথ নেই;
প্রাণ করে হাঁসফাঁস যত থাকি যত্নেই।
জ্বর গেলে মাস্টারে গিঁঠ দেয় ফাঁসটারে–
আমারে ফেলেছে সেরে এই দুটি রত্নেই।
উদয়ন, শান্তিনিকেতন, ১৫। ৯। ৩৮
পাখিওয়ালা বলে এটা কালোরঙ চন্দনা
পাখিওয়ালা বলে, “এটা
কালোরঙ চন্দনা।’
পানুলাল হালদার
বলে, “আমি অন্ধ না–
কাক ওটা নিশ্চিত,
হরিনাম ঠোঁটে নাই।’
পাখিওয়ালা বলে, “বুলি
ভালো করে ফোটে নাই–
পারে না বলিতে বাবা,
কাকা নামে বন্দনা।’
পাঠশালে হাই তোলে
পাঠশালে হাই তোলে
মতিলাল নন্দী;
বলে, “পাঠ এগোয় না
যত কেন মন দি।’
শেষকালে একদিন
গেল চড়ি টঙ্গায়,
পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে
ভাসালো মা-গঙ্গায়,
সমাস এগিয়ে গেল,
ভেসে গেল সন্ধি–
পাঠ এগোবার তরে
এই তার ফন্দি।
পাতালে বলিরাজার যত বলীরামরা
পাতালে বলিরাজার যত বলীরামরা,
ভূতলেতে ঘাসিরাম আর ঘনশ্যামরা,
লড়াই লাগালো বেগে; ভূমিকম্পন লেগে
চারিদিকে হাহাকার করে ওঠে গ্রামরা।
মানুষ কহিল, “ক্রমে খবর উঠছে জমে,
সেটা খুব মজা, তবু মরি কেন আমরা।’
পাবনায় বাড়ি হবে
পাবনায় বাড়ি হবে, গাড়ি গাড়ি ইঁট কিনি,
রাঁধুনিমহল-তরে করোগেট-শীট্ কিনি।
ধার ক’রে মিস্ত্রির সিকি বিল চুকিয়েছি,
পাওনাদারের ভয়ে দিনরাত লুকিয়েছি,
শেষে দেখি জানলায় লাগে নাকো ছিট্কিনি।
দিনরাত দুড়্দাড়্ কী বিষম শব্দ যে,
তিনটে পাড়ার লোক হয়ে গেল জব্দ যে,
ঘরের মানুষ করে খিট্ খিট্ খিট্কিনি।
কী করি না ভেবে পেয়ে মথুরায় দিনু পাড়ি,
বাজে খরচের ভয়ে আরেকটা পাকাবাড়ি
বানাবার মতলবে পোড়ো এক ভিট কিনি।
তিনতলা ইমারত শোভা পায় নবাবেরই,
সিঁড়িটা রইল বাকি চিহ্ন সে অভাবেরই,
তাই নিয়ে গৃহিণীর কী যে নাক-সিট্কিনি।
শান্তিনিকেতন, ৫ বৈশাখ, ১৩৪৪
পাড়াতে এসেছে এক
পাড়াতে এসেছে এক
নাড়িটেপা ডাক্তার,
দূর থেকে দেখা যায়
অতি উঁচু নাক তার।
নাম লেখে ওষুধের,
এ দেশের পশুদের
সাধ্য কী পড়ে তাহা
এই বড়ো জাঁক তার।
যেথা যায় বাড়ি বাড়ি
দেখে যে ছেড়েছে নাড়ী,
পাওনাটা আদায়ের
মেলে না যে ফাঁক তার।
গেছে নির্বাকপুরে
ভক্তের ঝাঁক তার।
পেঁচোটাকে মাসি তার
পেঁচোটাকে মাসি তার
যত দেয় আস্করা,
মুশকিল ঘটে তত
এক সাথে বাস করা।
হঠাৎ চিমটি কাটে
কপালের চামড়ায়–
বলে সে, “এমনি ক’রে
ভিমরুল কামড়ায়।’
আমার বিছানা নিয়ে
খেলা ওর চাষ-করা–
মাথার বালিশ থেকে
তুলোগুলো হ্রাস-করা।
পেন্সিল টেনেছিনু হপ্তায় সাতদিন
পেন্সিল টেনেছিনু হপ্তায় সাতদিন,
রবার ঘষেছি তাহে তিনমাস রাতদিন।
কাগজ হয়েছে সাদা; সংশোধনের বাধা
ঘুচে গেছে, এইবার শিক্ষক হাত দিন
কিন্তু ছবির কোণে স্বাক্ষর বাদ দিন।
প্রাইমারি ইস্কুলে
প্রাইমারি ইস্কুলে
প্রায়-মারা পণ্ডিত
সব কাজ ফেলে রেখে
ছেলে করে দণ্ডিত।
নাকে খত দিয়ে দিয়ে
ক্ষয়ে গেল যত নাক,
কথা-শোনবার পথ
টেনে টেনে করে ফাঁক;
ক্লাসে যত কান ছিল
সব হল খণ্ডিত,
বেঞ্চিটেঞ্চিগুলো
লণ্ডিত ভণ্ডিত।
বউ নিয়ে লেগে গেল
বউ নিয়ে লেগে গেল বকাবকি
রোগা ফণী আর মোটা পঞ্চিতে,
মণিকর্ণিকা-ঘাটে ঠকাঠকি
যেন বাঁশে আর সরু কঞ্চিতে।
দুজনে না জানে এই বউ কার,
মিছেমিছি ভাড়া বাড়ে নৌকার,
পঞ্চি চেঁচায় শুধু হাউহাউ,–
“পারবিনে তুই মোরে বঞ্চিতে।’
বউ বলে, “বুঝে নিই দাউদাউ
মোর তরে জ্বলে ঐ কোন্ চিতে।’
বটে আমি উদ্ধত
বটে আমি উদ্ধত,
নই তবু ক্রুদ্ধ তো,
শুধু ঘরে মেয়েদের সাথে মোর যুদ্ধ তো।
যেই দেখি গুণ্ডায়
ক্ষমি হেঁটমুণ্ডায়,
দুর্জন মানুষেরে ক্ষমেছেন বুদ্ধ তো।
পাড়ায় দারোগা এলে দ্বার করি রুদ্ধ তো–
সাত্ত্বিক সাধকের এ আচার শুদ্ধ তো।
বরের বাপের বাড়ি
বরের বাপের বাড়ি
যেতেছে বৈবাহিক,
সাথে সাথে ভাঁড় হাতে
চলেছে দই-বাহিক।
পণ দেবে কত টাকা
লেখাপড়া হবে পাকা,
দলিলের খাতা নিয়ে
এসেছে সই-বাহিক।
বলিয়াছিনু মামারে
বলিয়াছিনু মামারে–
তোমারি ঐ চেহারাখানি কেন গো দিলে আমারে।
তখনো আমি জন্মিনি তো, নেহাত ছিনু অপরিচিত,
আগেভাগেই শাস্তি এমন, এ কথা মনে ঘা মারে।
হাড় ক’খানা চামড়া দিয়ে ঢেকেছে যেন চামারে।
বশীরহাটেতে বাড়ি
বশীরহাটেতে বাড়ি
বশ-মানা ধাত তার,
ছেলে বুড়ো যে যা বলে
কথা শোনে যার-তার।
দিনরাত সর্বথা
সাধে নিজ খর্বতা,
মাথা আছে হেঁট-করা,
সদা জোড়-হাত তার,
সেই ফাঁকে কুকুরটা
চেটে যায় পাত তার।
বহু কোটি যুগ পরে
বহু কোটি যুগ পরে
সহসা বাণীর বরে
জলচর প্রাণীদের
কণ্ঠটা পাওয়া যেই
সাগর জাগর হল
কতমতো আওয়াজেই।
তিমি ওঠে গাঁ গাঁ করে;
চিঁ চিঁ করে চিংড়ি;
ইলিস বেহাগ ভাঁজে
যেন মধু নিংড়ি;
শাঁখগুলো বাজে, বহে
দক্ষিণে হাওয়া যেই;
গান গেয়ে শুশুকেরা
লাগে কুচ-কাওয়াজেই।
বাংলাদেশের মানুষ হয়ে
বাংলাদেশের মানুষ হয়ে
ছুটিতে ধাও চিতোরে,
কাঁচড়াপাড়ার জলহাওয়াটা
লাগল এতই তিতো রে?
মরিস ভয়ে ঘরের প্রিয়ার,
পালাস ভয়ে ম্যালেরিয়ার,
হায় রে ভীরু, রাজপুতানার
ভূত পেয়েছে কী তোরে।
লড়াই ভালোবাসিস, সে তো
আছেই ঘরের ভিতরে।
বাদশার মুখখানা গুরুতর গম্ভীর
বাদশার মুখখানা
গুরুতর গম্ভীর,
মহিষীর হাসি নাহি ঘুচে;
কহিলা বাদশা-বীর,–
“যতগুলো দম্ভীর
দম্ভ মুছিব চেঁচে-পুঁছে।’