- বইয়ের নামঃ কড়ি ও কোমল
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অক্ষমতা
এ যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা —
সলিল রয়েছে প ‘ ড়ে , শুধু দেহ নাই ।
এ কেবল হৃদয়ের দুর্বল দুরাশা
সাধের বস্তুর মাঝে করে চাই – চাই ।
দুটি চরণেতে বেঁধে ফুলের শৃঙ্খল
কেবল পথের পানে চেয়ে বসে থাকা!
মানবজীবন যেন সকলি নিষ্ফল —
বিশ্ব যেন চিত্রপট , আমি যেন আঁকা !
চিরদিন বুভুক্ষিত প্রাণহুতাশন
আমারে করিছে ছাই প্রতি পলে পলে ,
মহত্ত্বের আশা শুধু ভারের মতন
আমারে ডুবায়ে দেয় জড়ত্বের তলে ।
কোথা সংসারের কাজে জাগ্রত হৃদয়!
কোথা রে সাহস মোর অস্থিমজ্জাময় !
অঞ্চলের বাতাস
পাশ দিয়ে গেল চলি চকিতের প্রায় ,
অঞ্চলের প্রান্তখানি ঠেকে গেল গায় ,
শুধু দেখা গেল তার আধখানি পাশ —
শিহরি পরশি গেল অঞ্চলের বায় ।
অজানা হৃদয়বনে উঠেছে উচ্ছ্বাস ,
অঞ্চলে বহিয়া এল দক্ষিণবাতাস ,
সেথা যে বেজেছে বাঁশি তাই শুনা যায় ,
সেথায় উঠিছে কেঁদে ফুলের সুবাস ।
কার প্রাণখানি হতে করি হায় – হায়
বাতাসে উড়িয়া এল পরশ – আভাস !
ওগো কার তনুখানি হয়েছে উদাস ,
ওগো কে জানাতে চাহে মরম বারতা !
দিয়ে গেল সর্বাঙ্গের আকুল নিশ্বাস ,
বলে গেল সর্বাঙ্গের কানে কানে কথা ।।
অস্তমান রবি
আজ কি , তপন , তুমি যাবে অস্তাচলে
না শুনে আমার মুখে একটিও গান !
দাঁড়াও গো , বিদায়ের দুটি কথা বলে
আজিকার দিন আমি করি অবসান ।
থামো ওই সমুদ্রের প্রান্তরেখা -‘ পরে ,
মুখে মোর রাখো তব একমাত্র আঁখি ।
দিবসের শেষ পলে নিমেষের তরে
তুমি চেয়ে থাকো আর আমি চেয়ে থাকি ।
দুজনের আঁখি -‘ পরে সায়াহ্ন – আঁধার
আঁখির পাতার মতো আসুক মুদিয়া ,
গভীর তিমিরস্নিগ্ধ শান্তির পাথার
নিবায়ে ফেলুক আজি দুটি দীপ্ত হিয়া ।
শেষ গান সাঙ্গ করে থেমে গেছে পাখি ,
আমার এ গানখানি ছিল শুধু বাকি ।
» অস্তাচলের পরপারে
সন্ধ্যাসূর্যের প্রতি
আমার এ গান তুমি যাও সাথে করে
নূতন সাগরতীরে দিবসের পানে ।
সায়াহ্নের কূল হতে যদি ঘুমঘোরে
এ গান উষার কূলে পশে কারো কানে!
সারা রাত্রি নিশীথের সাগর বাহিয়া
স্বপনের পরপারে যদি ভেসে যায় ,
প্রভাত – পাখিরা যবি উঠিবে গাহিয়া
আমার এ গান তারা যদি খুঁজে পায় ।
গোধূলির তীরে বসে কেঁদেছে যে জন ,
ফেলেছে আকাশে চেয়ে অশ্রুজল কত ,
তার অশ্রু পড়িবে কি হইয়া নূতন
নবপ্রভাতের মাঝে শিশিরের মতো ।
সায়াহ্নের কুঁড়িগুলি আপনা টুটিয়া
প্রভাতে কি ফুল হয়ে উঠে না ফুটিয়া !
আকাঙ্ক্ষা
আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে
কী জানি পরান কী যে চায় !
ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে
বিহগবিহগী কী যে গায় !
আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে ,
রহে না আবাসে মন হায় !
কোন্ কুসুমের আশে , কোন্ ফুলবাসে
সুনীল আকাশে মন ধায় !
আজি কে যেন গো নাই , এ প্রভাতে তাই
জীবন বিফল হয় গো !
তাই চারি দিকে চায় , মন কেঁদে গায় —
‘ এ নহে , এ নহে , নয় গো ! ‘
কোন্ স্বপনের দেশে আছে এলোকেশে
কোন্ ছায়াময়ী অমরায় !
আজি কোন্ উপবনে বিরহবেদনে
আমারি কারণে কেঁদে যায় !
আমি যদি গাঁথি গান অথির – পরান
সে গান শুনাব কারে আর !
আমি যদি গাঁথি মালা লয়ে ফুলডালা
কাহারে পরাব ফুলহার !
আমি আমার এ প্রাণ যদি করি দান
দিব প্রাণ তবে কার পায় !
সদা ভয় হয় মনে পাছে অযতনে
মনে মনে কেহ ব্যথা পায় !
আত্ম-অপমান
মোছো তবে অশ্রুজল , চাও হাসিমুখে
বিচিত্র এ জগতের সকলের পানে ।
মানে আর অপমানে সুখে আর দুখে
নিখিলের ডেকে লও প্রসন্ন পরানে ।
কেহ ভালোবাসে কেহ নাহি ভালোবাসে ,
কেহ দূরে যায় কেহ কাছে চলে আসে —
আপনার মাঝে গৃহ পেতে চাও যদি
আপনারে ভুলে তবে থাকো নিরবধি ।
ধনীর সন্তান আমি , নহি গো ভিখারি ,
হৃদয়ে লুকানো আছে প্রেমের ভাণ্ডার —
আমি ইচ্ছা করি যদি বিলাইতে পারি
গভীর সুখের উৎস হৃদয় আমার ।
দুয়ারে দুয়ারে ফিরি মাগি অন্নপান
কেন আমি করি তবে আত্ম-অপমান !
আত্মাভিমান
আপনি কণ্টক আমি , আপনি জর্জর ।
আপনার মাঝে আমি শুধু ব্যথা পাই ।
সকলের কাছে কেন যাচি গো নির্ভর —
গৃহ নাই , গৃহ নাই , মোর গৃহ নাই !
অতি তীক্ষ্ম অতি ক্ষুদ্র আত্ম – অভিমান
সহিতে পারে না হায় তিল অসম্মান ।
আগেভাগে সকলের পায়ে ফুটে যায়
ক্ষুদ্র ব ‘ লে পাছে কেহ জানিতে না পায় ।
বরঞ্চ আঁধারে রব ধুলায় মলিন ,
চাহি না চাহি না এই দীন অহংকার —
আপন দারিদ্র্যে আমি রহিব বিলীন ,
বেড়াব না চেয়ে চেয়ে প্রসাদ সবার ।
আপনার মাঝে যদি শান্তি পায় মন
বিনীত ধুলার শয্যা সুখের শয়ন ।
আহ্বানগীত
পৃথিবী জুড়িয়া বেজেছে বিষাণ ,
শুনিতে পেয়েছি ওই —
সবাই এসেছে লইয়া নিশান ,
কই রে বাঙালি কই !
সুগভীর স্বর কাঁদিয়া বেড়ায়
বঙ্গসাগরের তীরে ,
‘ বাঙালির ঘরে কে আছিস আয়‘
ডাকিতেছে ফিরে ফিরে ।
ঘরে ঘরে কেন দুয়ার ভেজানো ,
পথে কেন নাই লোক ,
সারা দেশ ব্যাপি মরেছে কে যেন —
বেঁচে আছে শুধু শোক ।
গঙ্গা বহে শুধু আপনার মনে ,
চেয়ে থাকে হিমগিরি ,
রবি শশী উঠে অনন্ত গগনে
আসে যায় ফিরি ফিরি ।
কত – না সংকট , কত – না সন্তাপ
মানবশিশুর তরে ,
কত – না বিবাদ কত – না বিলাপ
মানবশিশুর ঘরে !
কত ভায়ে ভায়ে নাহি যে বিশ্বাস ,
কেহ কারে নাহি মানে ,
ঈর্ষা নিশাচরী ফেলিছে নিশ্বাস
হৃদয়ের মাঝখানে ।
হৃদয়ে লুকানো হৃদয়বেদনা ,
সংশয় – আঁধারে যুঝে ,
কে কাহারে আজি দিবে গো সান্ত্বনা —
কে দিবে আলয় খুঁজে !
মিটাতে হইবে শোক তাপ ত্রাস ,
করিতে হইবে রণ ,
পৃথিবী হইতে উঠেছে উচ্ছ্বাস —
শোনো শোনো সৈন্যগণ !
পৃথিবী ডাকিছে আপন সন্তানে ,
বাতাস ছুটেছে তাই —
গৃহ তেয়াগিয়া ভায়ের সন্ধানে
চলিয়াছে কত ভাই ।
বঙ্গের কুটিরে এসেছে বারতা ,
শুনেছে কি তাহা সবে ?
জেগেছে কি কবি শুনাতে সে কথা
জালদগম্ভীর রবে ?
হৃদয় কি কারো উঠেছে উথলি ?
আঁখি খুলেছে কি কেহ ?
ভেঙেছে কি কেহ সাধের পুতলি ?
ছেড়েছে খেলার গেহ ?
কেন কানাকানি , কেন রে সংশয় ?
কেন মরো ভয়ে লাজে ?
খুলে ফেলো দ্বার , ভেঙে ফেলো ভয় ,
চলো পৃথিবীর মাঝে ।
ধরাপ্রান্তভাগে ধুলিতে লুটায়ে ,
জড়িমাজড়িত তনু ,
আপনার মাঝে আপনি গুটায়ে
ঘুমায় কীটের অণু ।
চারি দিকে তার আপন – উল্লাসে
জগৎ ধাইছে কাজে ,
চারি দিকে তার অনন্ত আকাশে
স্বরগসংগীত বাজে !
চারি দিকে তার মানবমহিমা
উঠিছে গগনপানে ,
খুঁজিছে মানব আপনার সীমা
অসীমের মাঝখানে !
সে কিছুই তার করে না বিশ্বাস ,
আপনারে জানে বড়ো —
আপনি গণিছে আপন নিশ্বাস ,
ধুলা করিতেছে জড়ো ।
সুখদুঃখ লয়ে অনন্ত সংগ্রাম ,
জগতের রঙ্গভূমি —
হেথায় কে চায় ভীরুর বিশ্রাম ,
কেন গো ঘুমাও তুমি ।
ডুবিছ ভাসিছ অশ্রুর হিল্লোলে ,
শুনিতেছ হাহাকার —
তীর কোথা আছে দেখো মুখ তুলে ,
এ সমুদ্র করো পার ।
মহা কলরবে সেতু বাঁধে সবে ,
তুমি এসো , দাও যোগ —
বাধার মতন জড়াও চরণ
এ কী রে করম – ভোগ ।
তা যদি না পারো সরো তবে সরো ,
ছড়ে দাও তবে স্থান ,
ধুলায় পড়িয়া মরো তবে মরো —
কেন এ বিলাপগান !
ওরে চেয়ে দেখ্ মুখ আপনার ,
ভেবে দেখ্ তোরা কারা ,
মানবের মতো ধরিয়া আকার ,
কেন রে কীটের পারা ?
আছে ইতিহাস , আছে কুলমান ,
আছে মহত্ত্বের খনি —
পিতৃপিতামহ গেয়েছে যে গান
শোন্ তার প্রতিধ্বনি ।
খুঁজেছেন তাঁরা চাহিয়া আকাশে
গ্রহতারকার পথ ,
জগৎ ছাড়ায়ে অসীমের আশে
উড়াতেন মনোরথ ।
চাতকের মতো সত্যের লাগিয়া
তৃষিত – আকুল – প্রাণে
দিবসরজনী ছিলেন জাগিয়া
চাহিয়া বিশ্বের পানে ।
তবে কেন সবে বধির হেথায় ,
কেন অচেতন প্রাণ —
বিফল উচ্ছ্বাসে কেন ফিরে যায়
বিশ্বের আহ্বানগান !
মহত্ত্বের গাথা পশিতেছে কানে ,
কেন রে বুঝি নে ভাষা ?
তীর্থযাত্রী যত পথিকের গানে
কেন রে জাগে না আশা ?
উন্নতির ধ্বজা উড়িছে বাতাসে ,
কেন রে নাচে না প্রাণ ?
নবীন কিরণ ফুটেছে আকাশে ,
কেন রে জাগে না গান ?
কেন আছি শুয়ে , কেন আছি চেয়ে ,
পড়ে আছি মুখোমুখি —
মানবের স্রোত চলে গান গেয়ে ,
জগতের সুখে সুখী !
চলো দিবালোকে , চলো লোকালয়ে ,
চলো জনকোলাহলে —
মিশাব হৃদয় মানবহৃদয়ে
অসীম আকাশতলে ।
তরঙ্গ তুলিব তরঙ্গের’পরে ,
নৃত্যগীত নব নব —
বিশ্বের কাহিনী কোটি কণ্ঠস্বরে
এককণ্ঠ হয়ে কব ।
মানবের সুখ মানবের আশা
বাজিবে আমার প্রাণে ,
শত লক্ষ কোটি মানবের ভাষা
ফুটিবে আমার গানে ।
মানবের কাজে মানবের মাঝে
আমরা পাইব ঠাঁই ,
বঙ্গের দুয়ারে তাই শিঙা বাজে —
শুনিতে পেয়েছি ভাই !
মুছে ফেলো ধুলা , মুছ অশ্রুজল ,
ফেলো ভিখারির চীর —
পরো নব সাজ , ধরো নব বল ,
তোলো তোলো নত শির ।
তোমাদের কাছে আজি আসিয়াছে
জগতের নিমন্ত্রণ —
দীনহীন বেশ ফেলে যেয়ো পাছে ,
দাসত্বের আভরণ ।
সভার মাঝারে দাঁড়াবে যখন ,
হাসিয়া চাহিবে ধীরে ,
পুরবরবির হিরণ কিরণ
পড়িবে তোমার শিরে ।
বাঁধন টুটিয়া উঠিবে ফুটিয়া
হৃদয়ের শতদল ,
জগতমাঝারে যাইবে লুটিয়া
প্রভাতের পরিমল ।
উঠ বঙ্গকবি , মায়ের ভাষায়
মুমূর্ষুরে দাও প্রাণ —
জগতের লোক সুধার আশায়
সে ভাষা করিবে পান ।
চাহিবে মোদের মায়ের বদনে ,
ভাসিবে নয়নজলে —
বাঁধিবে জগৎ গানের বাঁধনে
মায়ের চরণতলে ।
বিশ্বের মাঝারে ঠাঁই নাই বলে
কাঁদিতেছে বঙ্গভূমি ,
গান গেয়ে কবি জগতের তলে
স্থান কিনে দাও তুমি ।
এক বার কবি মায়ের ভাষায়
গাও জগতের গান —
সকল জগৎ ভাই হয়ে যায় ,
ঘুচে যায় অপমান ।
উপকথা
মেঘের আড়ালে বেলা কখন যে যায়।
বৃষ্টি পড়ে সারাদিন থামিতে না চায় ।
আর্দ্র – পাখা পাখিগুলি গীতগান গেছে ভুলি ,
নিস্তব্ধে ভিজিছে তরুলতা ।
বসিয়া আঁধার ঘরে বরষার ঝরঝরে
মনে পড়ে কত উপকথা ।
কভু মনে লয় হেন এ – সব কাহিনী যেন
সত্য ছিল নবীন জগতে ।
উড়ন্ত মেঘের মতো ঘটনা ঘটিত কত ,
সংসার উড়িত মনোরথে ।
রাজপুত্র অবহেলে কোন্ দেশে যেত চলে
কত নদী কত সিন্ধু – পার ।
সরোবর – ঘাট আলা, মণি হাতে নাগবালা
বসিয়া বাঁধিত কেশভার ।
সিন্ধুতীরে কত দূরে কোন্ রাক্ষসের পুরে
ঘুমাইত রাজার ঝিয়ারি ।
হাসি তার মণিকণা কেহ তাহা দেখিত না ,
মুকুতা ঢালিত অশ্রুবারি ।
সাত ভাই একত্তরে চাঁপা হয়ে ফুটিত রে ,
এক বোন ফুটিত পারুল ।
সম্ভব কি অসম্ভব একত্রে আছিল সব —
দুটি ভাই সত্য আর ভুল ।
বিশ্ব নাহি ছিল বাঁধা, না ছিল কঠিন বাধা ,
নাহি ছিল বিধির বিধান ,
হাসিকান্না লঘুকায়া শরতের আলোছায়া ,
কেবল সে ছুঁয়ে যেত প্রাণ !
আজি ফুরায়েছে বেলা , জগতের ছেলেখেলা
গেছে আলো – আঁধারের দিন ।
আর তো নাই রে ছুটি , মেঘরাজ্য গেছে টুটি ,
পদে পদে নিয়ম – অধীন ।
মধ্যাহ্নে রবির দাপে বাহিরে কে রবে তাপে,
আলয় গড়িতে সবে চায় ।
যবে হায় প্রাণপণ করে তাহা সমাপন
খেলারই মতন ভেঙে যায় ।
কবির অহংকার
গান গাহি বলে কেন অহংকার করা !
শুধু গাহি বলে কেন কাঁদি না শরমে !
খাঁচার পাখির মতো গান গেয়ে মরা ,
এই কি , মা , আদি অন্ত মানবজনমে !
সুখ নাই , সুখ নাই , শুধু মর্মব্যথা —
মরীচিকা – পানে শুধু মরি পিপাসায় ।
কে দেখালে প্রলোভন , শূন্য অমরতা —
প্রাণে ম’রে গানে কি রে বেঁচে থাকা যায় !
কে আছ মলিন হেথা , কে আছ দুর্বল ,
মোরে তোমাদের মাঝে করো গো আহ্বান —
বারেক একত্রে বসে ফেলি অশ্রুজল ,
দূর করি হীন গর্ব , শূন্য অভিমান
তার পরে একসাথে এস কাজ করি
কেবলি বিলাপগান দূরে পরিহরি ।।
কল্পনামধুপ
প্রতিদিন প্রাতে শুধু গুন্ গুন্ গান ,
লালসে অলস-পাখা অলির মতন ।
বিকল হৃদয় লয়ে পাগল পরান
কোথায় করিতে যায় মধু অন্বেষণ ।
বেলা বহে যায় চলে — শ্রান্ত দিনমান ,
তরুতলে ক্লান্ত ছায়া করিছে শয়ন ,
মুরছিয়া পড়িতেছে বাঁশরির তান ,
সেঁউতি শিথিলবৃন্ত মুদিছে নয়ন ।
কুসুমদলের বেড়া , তারি মাঝে ছায়া ,
সেথা বসে করি আমি কল্পমধু পান —
বিজনে সৌরভময়ী মধুময়ী মায়া ,
তাহারি কুহকে আমি করি আত্মদান —
রেণুমাখা পাখা লয়ে ঘরে ফিরে আসি
আপন সৌরভে থাকি আপনি উদাসী ।
কল্পনার সাথি
যখন কুসুমবনে ফির একাকিনী ,
ধরায় লুটায়ে পড়ে পূর্ণিমাযামিনী ,
দক্ষিণবাতাসে আর তটিনীর গানে
শোন যবে আপনার প্রাণের কাহিনী —
যখন শিউলি ফুলে কোলখানি ভরি
দুটি পা ছড়ায়ে দিয়ে আনতবয়ানে
ফুলের মতন দুটি অঙ্গুলিতে ধরি
মালা গাঁথ ভোরবেলা গুন্ গুন্ তানে —
মধ্যাহ্নে একেলা যবে বাতয়নে ব ‘ সে
নয়নে মিলাতে চায় সুদূর আকাশ ,
কখন আঁচলখানি প ‘ ড়ে যায় খ ‘ সে ,
কখন হৃদয় হতে উঠে দীর্ঘশ্বাস ,
কখন অশ্রুটি কাঁপে নয়নের পাতে —
তখন আমি কি , সখী , থাকি তব সাথে !
কাঙালিনী
আনন্দময়ীর আগমনে ,
আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে ।
হেরো ওই ধনীর দুয়ারে
দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে ।
উৎসবের হাসি – কোলাহল
শুনিতে পেয়েছে ভোরবেলা ,
নিরানন্দ গৃহ তেয়াগিয়া
তাই আজ বাহির হইয়া
আসিয়াছে ধনীর দুয়ারে
দেখিবারে আনন্দের খেলা ।
বাজিতেছে উৎসবের বাঁশি ,
কানে তাই পশিতেছে আসি ,
ম্লান চোখে তাই ভাসিতেছে
দুরাশার সুখের স্বপন ;
চারি দিকে প্রভাতের আলো
নয়নে লেগেছে বড়ো ভালো ,
আকাশেতে মেঘের মাঝারে
শরতের কনক তপন ।
কত কে যে আসে , কত যায় ,
কেহ হাসে , কেহ গান গায় ,
কত বরনের বেশভূষা —
ঝলকিছে কাঞ্চন – রতন ,
কত পরিজন দাসদাসী ,
পুষ্প পাতা কত রাশি রাশি
চোখের উপরে পড়িতেছে
মরীচিকা – ছবির মতন ।
হেরো তাই রহিয়াছে চেয়ে
শূন্যমনা কাঙালিনী মেয়ে ।
শুনেছে সে , মা এসেছে ঘরে ,
তাই বিশ্ব আনন্দে ভেসেছে ,
মার মায়া পায় নি কখনো ,
মা কেমন দেখিতে এসেছে ।
তাই বুঝি আঁখি ছলছল ,
বাষ্পে ঢাকা নয়নের তারা !
চেয়ে যেন মার মুখ পানে
বালিকা কাতর অভিমানে
বলে , ‘ মা গো এ কেমন ধারা ।
এত বাঁশি , এত হাসিরাশি ,
এত তোর রতন – ভূষণ ,
তুই যদি আমার জননী ,
মোর কেন মলিন বসন !’
ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলি
ভাইবোন করি গলাগলি ,
অঙ্গনেতে নাচিতেছে ওই ;
বালিকা দুয়ারে হাত দিয়ে
তাদের হেরিছে দাঁড়াইয়ে ,
ভাবিতেছে নিশ্বাস ফেলিয়ে —
আমি তো ওদের কেহ নই ।
স্নেহ ক ‘ রে আমার জননী
পরায়ে তো দেয় নি বসন ,
প্রভাতে কোলেতে করে নিয়ে
মুছায়ে তো দেয় নি নয়ন ।
আপনার ভাই নেই বলে
ওরে কি রে ডাকিবে না কেহ ?
আর কারো জননী আসিয়া
ওরে কি রে করিবে না স্নেহ ?
ও কি শুধু দুয়ার ধরিয়া
উৎসবের পানে রবে চেয়ে
শূন্যমনা কাঙালিনী মেয়ে ?
ওর প্রাণ আঁধার যখন
করুণ শুনায় বড়ো বাঁশি ,
দুয়ারেতে সজল নয়ন ,
এ বড়ো নিষ্ঠুর হাসিরাশি ।
আজি এই উৎসবের দিনে
কত লোক ফেলে অশ্রুধার ,
গেহ নেই , স্নেহ নেই , আহা ,
সংসারেতে কেহ নেই তার ।
শূন্য হাতে গৃহে যায় কেহ ,
ছেলেরা ছুটিয়া আসে কাছে ,
কী দিবে কিছুই নেই তার ,
চোখে শুধু অশ্রুজল আছে ।
অনাথ ছেলেরে কোলে নিবি
জননীরা, আয় তোরা সব ।
মাতৃহারা মা যদি না পায়
তবে আজ কিসের উৎসব !
দ্বারে যদি থাকে দাঁড়াইয়া
ম্লানমুখ বিষাদে বিরস ,
তবে মিছে সহকার – শাখা
তবে মিছে মঙ্গল – কলস ।
কেন
কেন গো এমন স্বরে বাজে তব বাঁশি ,
মধুর সুন্দর রূপে কেঁদে ওঠে হিয়া ,
রাঙা অধরের কোণে হেরি মধুহাসি
পুলকে যৌবন কেন উঠে বিকশিয়া !
কেন তনু বাহুডোরে ধরা দিতে চায় ,
ধায় প্রাণ দুটি কালো আঁখির উদ্দেশে ,
হায় যদি এত লজ্জা কথায় কথায় ,
হায় যদি এত শ্রান্তি নিমেষে নিমেষে !
কেন কাছে ডাকে যদি মাঝে অন্তরাল ,
কেন রে কাঁদায় প্রাণ সবই যদি ছায়া ,
আজ হাতে তুলে নিয়ে ফেলে দিবে কাল —
এরি তরে এত তৃষ্ণা , এ কাহার মায়া !
মানবহৃদয় নিয়ে এত অবহেলা ,
খেলা যদি , কেন হেন মর্মভেদী খেলা !
কোথায়
হায় কোথা যাবে !
অনন্ত অজানা দেশ , নিতান্ত যে একা তুমি ,
পথ কোথা পাবে !
হায় , কোথা যাবে !
কঠিন বিপুল এ জগৎ ,
খুঁজে নেয় যে যাহার পথ ।
স্নেহের পুতলি তুমি সহসা অসীমে গিয়ে
কার মুখে চাবে ।
হায় , কোথা যাবে !
মোরা কেহ সাথে রহিব না ,
মোরা কেহ কথা কহিব না ।
নিমেষ যেমনি যাবে , আমাদের ভালোবাসা
আর নাহি পাবে ।
হায় , কোথা যাবে !
মোরা বসে কাঁদিব হেথায় ,
শূন্যে চেয়ে ডাকিব তোমায় ;
মহা সে বিজন মাঝে হয়তো বিলাপধ্বনি
মাঝে মাঝে শুনিবারে পাবে ,
হায় , কোথা যাবে !
দেখো , এই ফুটিয়াছে ফুল ,
বসন্তেরে করিছে আকুল ,
পুরানো সুখের স্মৃতি বাতাস আনিছে নিতি
কত স্নেহভাবে ,
হায় , কোথা যাবে !
খেলাধূলা পড়ে না কি মনে ,
কত কথা স্নেহের স্মরণে ।
সুখে দুখে শত ফেরে সে – কথা জড়িত যে রে ,
সেও কি ফুরাবে !
হায় , কোথা যাবে !
চিরদিন তরে হবে পর ,
এ – ঘর রবে না তব ঘর ।
যারা ওই কোলে যেত , তারাও পরের মতো ,
বারেক ফিরেও নাহি চাবে ।
হায় , কোথা যাবে !
হায় , কোথা যাবে !
যাবে যদি , যাও যাও , অশ্রু তব মুছে যাও ,
এইখানে দুঃখ রেখে যাও ।
যে বিশ্রাম চেয়েছিলে , তাই যেন সেথা মিলে —
আরামে ঘুমাও ।
যাবে যদি , যাও ।
ক্ষণিক মিলন
আকাশের দুই দিক হতে দুইখানি মেঘ এল ভেসে ,
দুইখানি দিশাহারা মেঘ — কে জানে এসেছে কোথা হতে !
সহসা থামিল থমকিয়া আকাশের মাঝখানে এসে।
দোঁহাপানে চাহিল দুজনে চতুর্থীর চাঁদের আলোতে ।
ক্ষীণালোকে বুঝি মনে পড়ে দুই অচেনার চেনাশোনা ,
মনে পড়ে কোন্ ছায়া দ্বীপে , কোন্ কুহেলিকা – ঘের দেশে ,
কোন্ সন্ধ্যাসাগরের কূলে দুজনের ছিল আনাগোনা !
মেলে দোঁহে তবুও মেলে না , তিলেক বিরহ রহে মাঝে —
চেনা বলে মিলিবারে চায় , অচেনা বলিয়া মরে লাজে ।
মিলনের বাসনার মাঝে আধখানি চাঁদের বিকাশ —
দুটি চুম্বনের ছোঁয়াছুয়ি , মাঝে যেন শরমের হাস!
দুখানি অলস আঁখিপাতা , মাঝে সুখস্বপন – আভাস !
দোঁহার পরশ লয়ে দোঁহে ভেসে গেল , কহিল না কথা —
বলে গেল সন্ধ্যার কাহিনী , লয়ে গেল উষার বারতা ।
ক্ষুদ্র অনন্ত
অনন্ত দিবসরাত্রি কালের উচ্ছ্বাস —
তারি মাঝখানে শুধু একটি নিমেষ ,
একটি মধুর সন্ধ্যা , একটু বাতাস ,
মৃদু আলো – আঁধারের মিলন – আবেশ —
তারি মাঝখানে শুধু একটুকু জুঁই
একটুকু হাসিমাখা সৌরভের লেশ ,
একটু অধর তার ছুঁই কি না – ছুঁই ,
আপন আনন্দ লয়ে উঠিতেছে ফুটে
আপন আনন্দ লয়ে পড়িতেছে টুটে ।
সমগ্র অনন্ত ওই নিমেষের মাঝে
একটি বনের প্রান্তে জুঁই হয়ে উঠে ।
পলকের মাঝখানে অনন্ত বিরাজে ।
যেমনি পলক টুটে ফুল ঝরে যায় ,
অনন্ত আপনা – মাঝে আপনি মিলায় ।।
ক্ষুদ্র আমি
বুঝেছি বুঝেছি , সখা , কেন হাহাকার ,
আপনার’পরে মোর কেন সদা রোষ ।
বুঝেছি বিফল কেন জীবন আমার —
আমি আছি , তুমি নাই , তাই অসন্তোষ ।
সকল কাজের মাঝে আমারেই হেরি —
ক্ষুদ্র আমি জেগে আছে ক্ষুধা লয়ে তার ,
শীর্নবাহু – আলিঙ্গনে আমারেই ঘেরি
করিছে আমার হায় অস্থিচর্ম সার ।
কোথা নাথ , কোথা তব সুন্দর বদন —
কোথায় তোমার নাথ , বিশ্ব – ঘেরা হাসি ।
আমারে কাড়িয়া লও , করো গো গোপন —
আমারে তোমারে মাঝে করো গো উদাসী ।
ক্ষুদ্র আমি করিতেছে বড়ো অহংকার ,
ভাঙো নাথ , ভাঙো নাথ , অভিমান তার ।।
খেলা
পথের ধারে অশথতলে
মেয়েটি খেলা করে ;
আপন-মনে আপনি আছে
সারাটি দিন ধরে ।
উপর-পানে আকাশ শুধু ,
সমুখ-পানে মাঠ ,
শরৎকালে রোদ পড়েছে ,
মধুর পথঘাট ।
দুটি-একটি পথিক চলে ,
গল্প করে , হাসে ।
লজ্জাবতী বধূটি গেল
ছায়াটি নিয়ে পাশে ।
আকাশ-ঘেরা মাঠের ধারে
বিশাল খেলাঘরে
একটি মেয়ে আপন-মনে
কতই খেলা করে ।
মাথার’পরে ছায়া পড়েছে ,
রোদ পড়েছে কোলে ,
পায়ের কাছে একটি লতা
বাতাস পেয়ে দোলে ।
মাঠের থেকে বাছুর আসে ,
দেখে নূতন লোক ,
ঘাড় বেঁকিয়ে চেয়ে থাকে
ড্যাবা ড্যাবা চোখ ।
কাঠবিড়ালি উসুখুসু
আশেপাশে ছোটে ,
শব্দ পেলে লেজটি তুলে
চমক খেয়ে ওঠে ।
মেয়েটি তাই চেয়ে দেখে
কত যে সাধ যায় —
কোমল গায়ে হাত বুলায়ে
চুমো খেতে চায় !
সাধ যেতেছে কাঠবিড়ালি
তুলে নিয়ে বুকে ,
ভেঙে ভেঙে টুকুটুকু
খাবার দেবে মুখে ।
মিষ্টি নামে ডাকবে তারে
গালের কাছে রেখে ,
বুকের মধ্যে রেখে দেবে
আঁচল দিয়ে ঢেকে ।
‘‘ আয় আয়”’ ডাকে সে তাই —
করুণ স্বরে কয় ,
‘‘ আমি কিছু বলব না তো
আমায় কেন ভয় ! ”
মাথা তুলে চেয়ে থাকে
উঁচু ডালের পানে —
কাঠবিড়ালি ছুটে পালায়
ব্যথা সে পায় প্রাণে ।
রাখাল ছেলের বাঁশি বাজে
সুদূর তরুছায় ,
খেলতে খেলতে মেয়েটি তাই
খেলা ভুলে যায় ।
তরুর মূলে মাথা রেখে
চেয়ে থাকে পথে ,
না জানি কোন্ পরীর দেশে
ধায় সে মনোরথে ।
একলা কোথায় ঘুরে বেড়ায়
মায়াদ্বীপে গিয়ে —
হেনকালে চাষী আসে
দুটি গোরু নিয়ে ।
শব্দ শুনে কেঁপে ওঠে ,
চমক ভেঙে চায় ।
আঁখি হতে মিলায় মায়া ,
স্বপন টুটে যায় ।
গান
ওগো কে যায় বাঁশরি বাজায়ে !
আমার ঘরে কেহ নাই যে !
তারে মনে পড়ে যারে চাই যে !
তার আকুল পরান বিরহের গান
বাঁশি বুঝি গেল জানায়ে !
আমি আমার কথা তারে জানাব কী করে ,
প্রাণ কাঁদে মোর তাই যে !
কুসুমের মালা গাঁথা হল না ,
ধূলিতে পড়ে শুকায় রে !
নিশি হয় ভোর , রজনীর চাঁদ
মলিন মুখ লুকায় রে !
সারা বিভাবরী কার পূজা করি
যৌবনডালা সাজায়ে !
ওই বাঁশিস্বরে হায় প্রাণ নিয়ে যায় ,
আমি কেন থাকি হায় রে !
গান-রচনা
এ শুধু অলস মায়া , এ শুধু মেঘের খেলা ,
এ শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন —
এ শুধু আপন মনে মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা
নিমেষের হাসিকান্না গান গেয়ে সমাপন ।
শ্যামল পল্লবপাতে রবিকরে সারাবেলা
আপনার ছায়া লয়ে খেলা করে ফুলগুলি ,
এও সেই ছায়া – খেলা বসন্তের সমীরণে ।
কুহকের দেশে যেন সাধ করে পথ ভুলি
হেথা হোথা ঘুরি ফিরি সারাদিন আনমনে ।
কারে যেন দেব ব’লে কোথা যেন ফুল তুলি ,
সন্ধ্যায় মলিন ফুল উড়ে যায় বনে বনে ।
এ খেলা খেলিবে হায় খেলার সাথি কে আছে ?
ভুলে ভুলে গান গাই — কে শোনে , কে নাই শোনে —
যদি কিছু মনে পড়ে , যদি কেহ আসে কাছে !
গীতোচ্ছ্বাস
নীরব বাঁশরিখানি বেজেছে আবার ।
প্রিয়ার বারতা বুঝি এসেছে আমার
বসন্তকাননমাঝে বসন্তসমীরে !
তাই বুঝি মনে পড়ে ভোলা গান যত !
তাই বুঝি ফুলবনে জাহ্নবীর তীরে
পুরাতন হাসিগুলি ফুটে শত শত !
তাই বুঝি হৃদয়ের বিস্মৃত বাসনা
জাগিছে নবীন হয়ে পল্লবের মতো !
জগতকমলবনে কমল – আসনা
কতদিন পরে বুঝি তাই এল ফিরে !
সে এল না , এল তার মধুর মিলন !
বসন্তের গান হয়ে এল তার স্বর !
দৃষ্টি তার ফিরে এল , কোথা সে নয়ন ?
চুম্বন এসেছে তার , কোথা সে অধর ?
চরণ
দুখানি চরণ পড়ে ধরণীর গায় —
দুখানি অলস রাঙা কোমল চরণ ।
শত বসন্তের স্মৃতি জাগিছে ধরায় ,
শত লক্ষ কুসুমের পরশস্বপন ।
শত বসন্তের যেন ফুটন্ত অশোক
ঝরিয়া মিলিয়া গেছে দুটি রাঙা পায় ।
প্রভাতের প্রদোষের দুটি সূর্যলোক
অস্ত গেছে যেন দুটি চরণছায়ায় ।
যৌবনসংগীত পথে যেতেছে ছড়ায়ে ,
নূপুর কাঁদিয়া মরে চরণ জড়ায়ে ,
নৃত্য সদা বাঁধা যেন মধুর মায়ায় ।
হোথা যে নিঠুর মাটি , শুষ্ক ধরাতল —
এসো গো হৃদয়ে এসো , ঝুরিছে হেথায়
লাজরক্ত লালসার রাঙা শতদল ।
চিঠি
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু
স্টীমার ‘ রাজহংস ‘ । গঙ্গা
চিঠি লিখব কথা ছিল ,
দেখছি সেটা ভারি শক্ত ।
তেমন যদি খবর থাকে
লিখতে পারি তক্ত তক্ত ।
খবর বয়ে বেড়ায় ঘুরে
খবরওয়ালা ঝাঁকা-মুটে ।
আমি বাপু ভাবের ভক্ত
বেড়াই নাকো খবর খুঁটে ।
এত ধুলো , এত খবর
কলকাতাটার গলিতে!
নাকে চোকে খবর ঢোকে
দু-চার কদম চলিতে ।
এত খবর সয় না আমার
মরি আমি হাঁপোষে ।
ঘরে এসেই খবরগুলো
মুছে ফেলি পাপোষে ।
আমাকে তো জানই বাছা!
আমি একজন খেয়ালি ।
কথাগুলো যা বলি , তার
অধিকাংশই হেঁয়ালি ।
আমার যত খবর আসে
ভোরের বেলা পুব দিয়ে ।
পেটের কথা তুলি আমি
পেটের মধ্যে ডুব দিয়ে ।
আকাশ ঘিরে জাল ফেলে
তারা ধরাই ব্যাবসা ।
থাক্ গে তোমার পাটের হাটে
মথুর কুণ্ডু শিবু সা ।
কল্পতরুর তলায় থাকি
নই গো আমি খবুরে ।
হাঁ করিয়ে চেয়ে আছি
মেওয়া ফলে সবুরে ।
তবে যদি নেহাত কর
খবর নিয়ে টানাটানি ।
আমি বাপু একটি কেবল
দুষ্টু মেয়ের খবর জানি!
দুষ্টুমি তার শোনো যদি
অবাক হবে সত্যি!
এত বড়ো বড়ো কথা তার
মুখখানি একরত্তি ।
মনে মনে জানেন তিনি
ভারি মস্ত লোকটা ।
লোকের সঙ্গে না-হক কেবল
ঝগড়া করবার ঝোঁকটা ।
আমার সঙ্গেই যত বিবাদ
কথায় কথায় আড়ি ।
এর নাম কি ভদ্র ব্যাভার!
বড্ড বাড়াবাড়ি ।
মনে করেছি তার সঙ্গে
কথাবার্তা বন্দ করি ।
প্রতিজ্ঞা থাকে না পাছে
সেইটে ভারি সন্দ করি ।
সে না হলে সকাল বেলায়
চামেলি কি ফুটবে!
সে নইলে কি সন্ধে বেলায়
সন্ধেতারা উঠবে ।
সে না হলে দিনটা ফাঁকি
আগাগোড়াই মস্কারা ।
পোড়ারমুখী জানে সেটা
তাই এত তার আস্কারা ।
চুড়ি-পরা হাত দুখানি
কতই জানে ফন্দি ।
কোনোমতে তার সাথে তাই
করে আছি সন্ধি ।
নাম যদি তার জিগেস কর
নামটি বলা হবে না ।
কী জানি সে শোনে যদি
প্রাণটি আমার রবে না ।
নামের খবর কে রাখে তার
ডাকি তারে যা খুশি ।
দুষ্টু বলো , দস্যি বলো ,
পোড়ারমুখী , রাক্ষুসী!
বাপ মায়ে যে নাম দিয়েছে
বাপ মায়েরি থাক্ সে ।
ছিষ্টি খুঁজে মিষ্টি নামটি
তুলে রাখুন বাক্সে!
এক জনেতে নাম রাখবে
অন্নপ্রাশনে ।
বিশ্বসুদ্ধ সে নাম নেবে
বিষম শাসন এ!
নিজের মনের মত সবাই
করুক নামকরণ ।
বাবা ডাকুন ‘ চন্দ্রকুমার ‘
খুড়ো ‘ রামচরণ ‘ !
ধার-করা নাম নেব আমি
হবে না তো সিটি ।
জানই আমার সকল কাজে
Originality ।
ঘরের মেয়ে তার কি সাজে
সঙস্কৃত নাম ।
এতে কেবল বেড়ে ওঠে
অভিধানের দাম ।
আমি বাপু ডেকে বসি
যেটা মুখে আসে ,
যারে ডাকি সেই তা বোঝে
আর সকলে হাসে!
দুষ্টু মেয়ের দুষ্টুমি — তায়
কোথায় দেব দাঁড়ি!
অকূল পাথার দেখে শেষে
কলমের হাল ছাড়ি!
শোনো বাছা , সত্যি কথা
বলি তোমার কাছে —
ত্রিজগতে তেমন মেয়ে
একটি কেবল আছে!
বর্ণিমেটা কারো সঙ্গে
মিলে পাছে যায় —
তুমুল ব্যাপার উঠবে বেধে
হবে বিষম দায়!
হপ্তাখানেক বকাবকি
ঝগড়াঝাঁটির পালা ,
একটু চিঠি লিখে , শেষে
প্রাণটা ঝালাফালা ।
আমি বাপু ভালোমানুষ
মুখে নেইকো রা ।
ঘরের কোণে বসে বসে
গোঁফে দিচ্ছি তা ।
আমি যত গোলে পড়ি
শুনি নানান বাক্যি ।
খোঁড়ার পা যে খানায় পড়ে
আমিই তাহার সাক্ষী ।
আমি কারো নাম করি নি
তবু ভয়ে মরি ।
তুই পাছে নিস গায়ে পেতে
সেইটো বড়ো ডরি!
কথা একটা উঠলে মনে
ভারি তোরা জ্বালাস ।
আমি বাপু আগে থাকতে
বলে হলুম খালাস!
চিরদিন
কোথা রাত্রি , কোথা দিন , কোথা ফুটে চন্দ্র সূর্য তারা ,
কে বা আসে কে বা যায় , কোথা বসে জীবনের মেলা ,
কে বা হাসে কে বা গায় , কোথা খেলে হৃদয়ের খেলা ,
কোথা পথ , কোথা গৃহ , কোথা পান্থ , কোথা পথহারা !
কোথা খ ‘ সে পড়ে পত্র জগতের মহাবৃক্ষ হতে ,
উড়ে উড়ে ঘুরে মরে অসীমেতে না পায় কিনারা ,
বহে যায় কালবায়ু অবিশ্রাম আকাশের পথে ,
ঝর ঝর মর মর শুষ্ক পত্র শ্যাম পত্রে মিলে !
এত ভাঙা এত গড়া , আনাগোনা জীবন্ত নিখিলে ,
এত গান এত তান এত কান্না এত কলরব —
কোথা কে বা , কোথা সিন্ধু , কোথা ঊর্মি , কোথা তার বেলা —
গভীর অসীম গর্ভে নির্বাসিত নির্বাপিত সব !
জনপূর্ণ সুবিজনে , জ্যোতির্বিদ্ধ আঁধারে বিলীন
আকাশমণ্ডপে শুধু বসে আছে এক ‘চিরদিন’ ।
২
কী লাগিয়া বসে আছ , চাহিয়া রয়েছ কার লাগি ,
প্রলয়ের পরপারে নেহারিছ কার আগমন ,
কার দূর পদধ্বনি চিরদিন করিছ শ্রবণ ,
চিরবিরহীর মতো চিররাত্রি রহিয়াছ জাগি !
অসীম অতৃপ্তি লয়ে মাঝে মাঝে ফেলিছ নিশ্বাস ,
আকাশপ্রান্তরে তাই কেঁদে উঠে প্রলয়বাতাস ,
জগতের ঊর্ণাজাল ছিঁড়ে টুটে কোথা যায় ভাগি !
অনন্ত আঁধার – মাঝে কেহ তব নাহিক দোসর ,
পশে না তোমার প্রাণে আমাদের হৃদয়ের আশ ,
পশে না তোমার কানে আমাদের পাখিদের স্বর ।
সহস্র জগতে মিলি রচে তব বিজন প্রবাস ,
সহস্র শবদে মিলি বাঁধে তব নিঃশব্দের ঘর —
হাসি , কাঁদি , ভালোবাসি , নাই তব হাসি কান্না মায়া —
আসি , থাকি , চলে যাই কত ছায়া কত উপছায়া !
৩
তাই কি ? সকলি ছায়া ? আসে , থাকে , আর মিলে যায় ?
তুমি শুধু একা আছ , আর সব আছে আর নাই ?
যুগযুগান্তর ধরে ফুল ফুটে , ফুল ঝরে তাই ?
প্রাণ পেয়ে প্রাণ দিই , সে কি শুধু মরণের পায় ?
এ ফুল চাহে না কেহ ? লহে না এ পূজা – উপহার ?
এ প্রাণ , প্রাণের আশা , টুটে কি অসীম শূন্যতায় ।
বিশ্বের উঠিছে গান , বধিরতা বহি সিংহাসনে ?
বিশ্বের কাঁদিছে প্রাণ , শূন্যে ঝরে অশ্রুবারিধার ?
যুগযুগান্তের প্রেম কে লইবে , নাই ত্রিভুবনে ?
চরাচর মগ্ন আছে নিশিদিন আশার স্বপনে —
বাঁশি শুনি চলিয়াছে , সে কি হায় বৃথা অভিসার !
বলো না সকলি স্বপ্ন , সকলি এ মায়ার ছলন —
বিশ্ব যদি স্বপ্ন দেখে , সে স্বপন কাহার স্বপন ?
সে কি এই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকার ?
৪
ধ্বনি খুঁজে প্রতিধ্বনি , প্রাণ খুঁজে মরে প্রতিপ্রাণ ।
জগৎ আপনা দিয়ে খুঁজিছে তাহার প্রতিদান ।
অসীমে উঠিছে প্রেম শুধিবারে অসীমের ঋণ —
যত দেয় তত পায় , কিছুতে না হয় অবসান ।
যত ফুল দেয় ধরা তত ফুল পায় প্রতিদিন —
যত প্রাণ ফুটাইছে ততই বাড়িয়া উঠে প্রাণ ।
যাহা আছে তাই দিয়ে ধনী হয়ে উঠে দীনহীন ,
অসীমে জগতে একি পিরিতির আদান – প্রদান !
কাহারে পূজিছে ধরা শ্যামল যৌবন – উপহারে ,
নিমেষে নিমেষে তাই ফিরে পায় নবীন যৌবন ।
প্রেমে টেনে আনে প্রেম , সে প্রেমের পাথার কোথা রে !
প্রাণ দিলে প্রাণ আসে , কোথা সেই অনন্ত জীবন !
ক্ষুদ্র আপনারে দিলে , কোথা পাই অসীম আপন —
সে কি ওই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকারে !
চুম্বন
অধরের কানে যেন অধরের ভাষা ।
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে ।
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সংগমে ।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে ।
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে ,
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা ।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে
অধরেতে থর থরে চুম্বনের লেখা ।
দুখানি অধর হতে কুসুমচয়ন ,
মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে ।
দুটি অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসরশয়ন ।
ছোটো ফুল
আমি শুধু মালা গাঁথি ছোটো ছোটো ফুলে ,
সে ফুল শুকায়ে যায় কথায় কথায় !
তাই যদি , তাই হোক , দুঃখ নাহি তায় —
তুলিব কুসুম আমি অনন্তের কূলে ।
যারা থাকে অন্ধকারে , পাষাণকারায় ,
আমার এ মালা যদি লহে গলে তুলে ,
নিমেষের তরে তারা যদি সুখ পায় ,
নিষ্ঠুর বন্ধনব্যথা যদি যায় ভুলে !
ক্ষুদ্র ফুল , আপনার সৌরভের সনে
নিয়ে আসে স্বাধীনতা , গভীর আশ্বাস —
মনে আনে রবিকর নিমেষস্বপনে ,
মনে আনে সমুদ্রের উদার বাতাস ।
ক্ষুদ্র ফুল দেখে যদি কারো পড়ে মনে
বৃহৎ জগৎ , আর বৃহৎ আকাশ !
জন্মতিথির উপহার
একটি কাঠের বাক্স
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু
স্নেহ-উপহার এনেছি রে দিতে
লিখেও এনেছি দু-তিন ছত্তর ।
দিতে কত কী যে সাধ যায় তোরে
দেবার মতো নেই জিনিস-পত্তর!
টাকাকড়িগুলো ট্যাঁকশালে আছে
ব্যাঙ্কে আছে সব জমা ,
ট্যাঁকে আছে খালি গোটা দুত্তিন ,
এবার করো বাছ ক্ষমা!
হীরে জহরাৎ যত ছিল মোর
পোঁতা ছিল সব মাটিতে ,
জহরী যে যেত সন্ধান পেয়ে
নে গেছে যে যার বাটীতে!
দুনিয়া শহর জমিদারি মোর ,
পাঁচ ভূতে করে কাড়াকাড়ি ,
হাতের কাছেতে যা-কিছু পেলুম ,
নিয়ে এনু তাই তাড়াতাড়ি!
স্নেহ যদি কাছে রেখে যাওয়া যেত
চোখে যদি দেখা যেত রে ,
বাজারে-জিনিস কিনে নিয়ে এসে
বল্ দেখি দিত কে তোরে!
জিনিসটা অতি যৎসামান্য
রাখিস ঘরের কোণে ,
বাক্সখানি ভরে স্নেহ দিনু তোরে
এইটে থাকে যেন মনে!
বড়োসড়ো হবি ফাঁকি দিয়ে যাবি ,
কোন্খেনে রবি নুকিয়ে ,
কাকা-ফাকা সব ধুয়ে-মুছে ফেলে
দিবি একেবারে চুকিয়ে ।
তখন যদি রে এই কাঠখানা
মনে একটুকু তোলে ঢেউ —
একবার যদি মনে পড়ে তোর
‘ বুজি ‘ বলে বুঝি ছিল কেউ!
এই-যে সংসারে আছি মোরা সবে
এ বড়ো বিষম দেশটা!
ফাঁকিফুঁকি দিয়ে দূরে চলে যেতে
ভুলে যেতে সবার চেষ্টা!
ভয়ে ভয়ে তাই সবারে সবাই
কত কী যে এনে দিচ্ছে ,
এটা-ওটা দিয়ে স্মরণ জাগিয়ে
বেঁধে রাখিবার ইচ্ছে!
মনে রাখতে যে মেলাই কাঠ-খড় চাই ,
ভুলে যাবার ভারি সুবিধে ,
ভালোবাস যারে কাছে রাখ তারে
যাহা পাস তারে খুবি দে!
বুঝে কাজ নেই এত শত কথা ,
ফিলজফি হোক ছাই!
বেঁচে থাকো তুমি সুখে থাকো বাছা
বালাই নিয়ে মরে যাই!
জাগিবার চেষ্টা
মা কেহ কি আছ মোর , কাছে এসো তবে ,
পাশে বসে স্নেহ ক’রে জাগাও আমায় ।
স্বপ্নের সমাধি – মাঝে বাঁচিয়া কী হবে ,
যুঝিতেছি জাগিবারে — আঁখি রুদ্ধ হায় ,
ডেকো না ডেকো না মোরে ক্ষুদ্রতার মাঝে ,
স্নেহময় আলস্যেতে রেখো না বাঁধিয়া ,
আশীর্বাদ করে মোরে পাঠাও গো কাজে —
পিছনে ডেকো না আর কাতরে কাঁদিয়া ।
মোর বলে কাহারেও দেব না কি বল!
মোর প্রাণে পাবে না কি কেহ নবপ্রাণ
করুণা কি শুধু ফেলে নয়নের জল ,
প্রেম কি ঘরের কোণে গাহে শুধু গান!
তবেই ঘুচিবে মোর জীবনের লাজ
যদি মা করিতে পারি কারো কোনো কাজ ।
তনু
ওই তনুখানি তব আমি ভালোবাসি ।
এ প্রাণ তোমার দেহে হয়েছে উদাসী।
শিশিরেতে টলমল ঢলঢল ফুল
টুটে পড়ে থরে থরে যৌবন বিকাশি ।
চারি দিকে গুঞ্জরিছে জগৎ আকুল ,
সারানিশি সারাদিন ভ্রমর পিপাসী ।
ভালোবেসে বায়ু এসে দুলাইছে দুল ,
মুখে পড়ে মোহভরে পূর্ণিমার হাসি ।
পূর্ণ দেহখানি হতে উঠিছে সুবাস ।
মরি মরি কোথা সেই নিভৃত নিলয়
কোমল শয়নে যেথা ফেলিছে নিশ্বাস
তনুঢাকা মধুমাখা বিজন হৃদয় ।
ওই দেহখানি বুকে তুলে নেব বালা ,
পঞ্চদশ বসন্তের একগাছি মালা ।।
তুমি
তুমি কোন্ কাননের ফুল ,
তুমি কোন্ গগনের তারা !
তোমায় কোথায় দেখেছি
যেন কোন্ স্বপনের পারা !
কবে তুমি গেয়েছিলে ,
আঁখির পানে চেয়েছিলে
ভুলে গিয়েছি ।
শুধু মনের মধ্যে জেগে আছে ,
ঐ নয়নের তারা ।।
তুমি কথা কয়ো না ,
তুমি চেয়ে চলে যাও ।
এই চাঁদের আলোতে
তুমি হেসে গলে যাও ।
আমি ঘুমের ঘোরে চাঁদের পানে
চেয়ে থাকি মধুর প্রাণে ,
তোমার আঁখির মতন দুটি তারা
ঢালুক কিরণ – ধারা ।।
দেহের মিলন
প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ – তরে ।
প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন ।
হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে
মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ -‘ পরে ।
তোমার নয়ন পানে ধাইছে নয়ন ,
অধর মরিতে চায় তোমার অধরে ।
তৃষিত পরান আজি কাঁদিছে কাতরে
তোমারে সর্বাঙ্গ দিয়ে করিতে দর্শন ।
হৃদয় লুকানো আছে দেহের সায়রে ,
চিরদিন তীরে বসি করি গো ক্রন্দন ।
সর্বাঙ্গ ঢালিয়া আজি আকুল অন্তরে
দেহের রহস্য – মাঝে হইব মগন ।
আমার এ দেহমন চির রাত্রিদিন
তোমার সর্বাঙ্গে যাবে হইয়া বিলীন !
নিদ্রিতার চিত্র
মায়ায় রয়েছে বাঁধা প্রদোষ – আঁধার ;
চিত্রপটে সন্ধ্যাতারা অস্ত নাহি যায় ।
এলাইয়া ছড়াইয়া গুচ্ছ কেশভার
বাহুতে মাথাটি রেখে রমণী ঘুমায় ।
চারি দিকে পৃথিবীতে চিরজাগরণ ,
কে ওরে পাড়ালে ঘুম তারি মাঝখানে !
কোথা হতে আহরিয়া নীরব গুঞ্জন
চিরদিন রেখে গেছে ওরই কানে কানে !
ছবির আড়ালে কোথা অনন্ত নির্ঝর
নীরব ঝর্ঝর – গানে পড়িছে ঝরিয়া ।
চিরদিন কাননের নীরব মর্মর ,
লজ্জা চিরদিন আছে দাঁড়ায়ে সমুখে —
যেমনি ভাঙিবে ঘুম , মরমে মরিয়া
বুকের বসনখানি তুলে দিবে বুকে ।
নূতন
হেথাও তো পশে সূর্যকর ।
ঘোর ঝটিকার রাতে দারুণ অশনিপাতে
বিদীরিল যে গিরিশিখর —
বিশাল পর্বত কেটে , পাষাণহৃদয় ফেটে ,
প্রকাশিল যে ঘোর গহ্বর —
প্রভাতে পুলকে ভাসি বহিয়া নবীন হাসি ,
হেথাও তো পশে সূর্যকর !
দুয়ারেতে উঁকি মেরে ফিরে তো যায় না সে রে ,
শিহরি উঠে না আশঙ্কায় ,
ভাঙা পাষাণের বুকে খেলা করে কোন্ সুখে
হেসে আসে , হেসে চলে যায় ।
হেরো হেরো হায় হায় , যত প্রতিদিন যায় —
কে গাঁথিয়া দেয় তৃণজাল ।
লতাগুলি লতাইয়া বাহুগুলি বিথাইয়া
ঢেকে ফেলে বিদীর্ণ কঙ্কাল ।
বজ্রদগ্ধ অতীতের নিরাশার অতিথের
ঘোর স্তব্ধ সমাধি – আবাস ,
ফুল এসে , পাতা এসে কেড়ে নেয় হেসে হেসে ,
অন্ধকারে করে পরিহাস ।
এরা সব কোথা ছিল , কেই বা সংবাদ দিল ,
গৃহহারা আনন্দের দল —
বিশ্বে তিল শূন্য হলে অনাহূত আসে চলে ,
বাসা বাঁধে করি কোলাহল ।
আনে হাসি , আনে গান , আনে রে নূতন প্রাণ ,
সঙ্গে করে আনে রবিকর —
অশোক শিশুর প্রায় এত হাসে এত গায়
কাঁদিতে দেয় না অবসর ।
বিষাদ বিশালকায়া ফেলেছে আঁধার ছায়া ,
তারে এরা করে না তো ভয় —
চারি দিক হতে তারে ছোটো ছোটো হাসি মারে ,
অবশেষে করে পরাজয় ।
এই যে রে মরুস্থল , দাবদগ্ধ ধরাতল ,
এইখানে ছিল ‘পুরাতন’ —
একদিন ছিল তার শ্যামল যৌবনভার ,
ছিল তার দক্ষিণপবন ।
যদি রে সে চলে গেল , সঙ্গে যদি নিয়ে গেল
গীত গান হাসি ফুল ফল —
শুষ্ক স্মৃতি কেন মিছে রেখে তবে গেল পিছে ,
শুষ্ক শাখা শুষ্ক ফুলদল ।
সে কি চায় শুষ্ক বনে গাহিবে বিহঙ্গগণে
আগে তারা গাহিত যেমন।
আগেকার মতো করে স্নেহে তার নাম ধরে
উচ্ছ্বসিবে বসন্তপবন ?
নহে নহে , সে কি হয় ! সংসার জীবনময় ,
নাহি হেথা মরণের স্থান ।
আয় রে , নূতন , আয় , সঙ্গে করে নিয়ে আয় ,
তোর সুখ , তোর হাসি গান ।
ফোটা নব ফুলচয় , ওঠা নব কিশলয় ,
নবীন বসন্ত আয় নিয়ে ।
যে যায় সে চলে যাক , সব তার নিয়ে যাক ,
নাম তার যাক মুছে দিয়ে ।
এ কি ঢেউ – খেলা হায় , এক আসে , আর যায় ,
কাঁদিতে কাঁদিতে আসে হাসি ,
বিলাপের শেষ তান না হইতে অবসান
কোথা হতে বেজে ওঠে বাঁশি ।
আয় রে কাঁদিয়া লই শুকাবে দু – দিন বই
এ পবিত্র অশ্রুবারিধারা ।
সংসারে ফিরিব ভুলি , ছোটো ছোটো সুখগুলি ,
রচি দিবে আনন্দের কারা ।
না রে , করিব না শোক , এসেছে নূতন লোক ,
তারে কে করিবে অবহেলা ।
সেও চলে যাবে কবে , গীত গান সাঙ্গ হবে ,
ফুরাইবে দু – দিনের খেলা ।
পত্র
নৌকাযাত্রা হইতে ফিরিয়া আসিয়া লিখিত
সুহৃদ্বর শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ সেন স্থলচরবরেষু
জলে বাসা বেঁধেছিলেম , ডাঙায় বড়ো কিচিমিচি ।
সবাই গলা জাহির করে , চেঁচায় কেবল মিছিমিছি ।
সস্তা লেখক কোকিয়ে মরে , ঢাক নিয়ে সে খালি পিটোয় ,
ভদ্রলোকের গায়ে পড়ে কলম নেড়ে কালি ছিটোয় ।
এখানে যে বাস করা দায় ভনভনানির বাজারে ,
প্রাণের মধ্যে গুলিয়ে উঠে হট্টগোলের মাঝারে ।
কানে যখন তালা ধরে , উঠি যখন হাঁপিয়ে
কোথায় পালাই , কোথায় পালাই — জলে পড়ি ঝাঁপিয়ে
গঙ্গাপ্রাপ্তির আশা করে গঙ্গাযাত্রা করেছিলেম ।
তোমাদের না বলে কয়ে আস্তে আস্তে সরেছিলেম ।
দুনিয়ার এ মজলিসেতে এসেছিলেম গান শুনতে ,
আপন মনে গুনগুনিয়ে রাগ – রাগিণীর জাল বুনতে ।
গান শোনে সে কাহার সাধ্যি , ছোঁড়াগুলো বাজায় বাদ্যি ,
বিদ্যেখানা ফাটিয়ে ফেলে থাকে তারা তুলো ধুনতে ।
ডেকে বলে , হেঁকে বলে , ভঙ্গি করে বেঁকে বলে —
‘‘ আমার কথা শোনো সবাই , গান শোনো আর নাই শোনো।
গান যে কাকে বলে সেইটে বুঝিয়ে দেব , তাই শোনে । ”
টীকে করেন ব্যখ্যা করেন , জেঁকে ওঠে বক্তিমে —
কে দেখে তার হাত – পা নাড়া , চক্ষু দুটোর রক্তিমে !
চন্দ্রসূর্য জ্বলছে মিছে আকাশখানার চালাতে —
তিনি বলেন , ‘‘ আমিই আছি জ্বলতে এবং জ্বালাতে । ”’
কুঞ্জবনের তানপুরোতে সুর বেঁধেছে বসন্ত ,
সেটা শুনে নাড়েন কর্ণ , হয় নাকো তাঁর পছন্দ ।
তাঁরি সুরে গাক – না সবাই টপ্পা খেয়াল ধুরবোধ —
গায় না যে কেউ , আসল কথা নাইকো কারো সুর – বোধ !
কাগজওয়ালা সারি সারি নাড়ছে কাগজ হাতে নিয়ে —
বাঙলা থেকে শান্তি বিদায় তিনশো কুলোর বাতাস দিয়ে ।
কাগজ দিয়ে নৌকা বানায় বেকার যত ছেলেপিলে ,
কর্ণ ধরে পার করবেন দু – এক পয়সা খেয়া দিলে ।
সস্তা শুনে ছুটে আসে যত দীর্ঘকর্ণগুলো —
বঙ্গদেশের চতুর্দিকে তাই উড়ছে এত ধুলো ।
খুদে খুদে ‘আর্য’ গুলো ঘাসের মতো গজিয়ে ওঠে ,
ছুঁচোলো সব জিবের ডগা কাঁটার মতো পায়ে ফোটে ।
তাঁরা বলেন , ‘‘ আমিই কল্কি” — গাঁজার কল্কি হবে বুঝি !
অবতারে ভরে গেল যত রাজ্যের গলিঘুঁজি ।
পাড়ার এমন কত আছে কত কব তার !
বঙ্গদেশে মেলাই এল বরা ‘- অবতার ।
দাঁতের জোরে হিন্দুশাস্ত্র তুলবে তারা পাঁকের থেকে ,
দাঁতকপাটি লাগে তাদের দাঁত – খিঁচুনির ভঙ্গি দেখে ।
আগাগোড়াই মিথ্যে কথা , মিথ্যেবাদীর কোলাহল ,
জিব নাচিয়ে বেড়ায় যত জিহ্বাওয়ালা সঙের দল ।
বাক্যবন্যা ফেনিয়ে আসে , ভাসিয়ে নে যায় তোড়ে —
কোনোক্রমে রক্ষে পেলাম মা – গঙ্গারই ক্রোড়ে ।
হেথায় কিবা শান্তি – ঢালা কুলুকুলু তান !
সাগর – পানে বহন করে গিরিরাজের গান ।
ধীরি ধীরি বাতাসটি দেয় জলের গায়ে কাঁটা ।
আকাশেতে আলো – আঁধার খেলে জোয়ারভাঁটা ।
তীরে তীরে গাছের সারি পল্লবেরই ঢেউ ।
সারা দিবস হেলে দোলে , দেখে না তো কেউ ।
পূর্বতীরে তরুশিরে অরুণ হেসে চায় —
পশ্চিমেতে কুঞ্জমাঝে সন্ধ্যা নেমে যায় ।
তীরে ওঠে শঙ্খধ্বনি , ধীরে আসে কানে ,
সন্ধ্যাতারা চেয়ে থাকে ধরণীর পানে ।
ঝাউবনের আড়ালেতে চাঁদ ওঠে ধীরে ,
ফোটে সন্ধ্যাদীপগুলি অন্ধকার তীরে ।
এই শান্তি – সলিলেতে দিয়েছিলেম ডুব ,
হট্টগোলটা ভুলেছিলেম , সুখে ছিলেম খুব ।
জান তো ভাই আমি হচ্ছি জলচরের জাত ,
আপন মনে সাঁতরে বেড়াই — ভাসি যে দিনরাত ।
রোদ পোহাতে ডাঙায় উঠি , হাওয়াটি খাই চোখ বুজে ,
ভয়ে ভয়ে কাছে এগোই তেমন তেমন লোক বুঝে ।
গতিক মন্দ দেখলে আবার ডুবি অগাধ জলে ,
এমনি করেই দিনটা কাটাই লুকোচুরির ছলে ।
তুমি কেন ছিপ ফেলেছ শুকনো ডাঙায় বসে ?
বুকের কাছে বিদ্ধ করে টান মেরেছ কষে ।
আমি তোমায় জলে টানি , তুমি ডাঙায় টানো —
অটল হয়ে বসে আছ , হার তো নাহি মানো ।
আমারি নয় হার হয়েছে , তোমারি নয় জিত —
খাবি খাচ্ছি ডাঙায় পড়ে হয়ে পড়ে চিত ।
আর কেন ভাই , ঘরে চলো ছিপ গুটিয়ে নাও ,
রবীন্দ্রনাথ পড়ল ধরা ঢাক পিটিয়ে দাও ।
পত্র
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু
স্টীমার । খুলনা
মাগো আমার লক্ষ্মী ,
মনিষ্যি না পক্ষী!
এই ছিলেম তরীতে ,
কোথায় এনু ত্বরিতে!
কাল ছিলেম খুলনায় ,
তাতে তো আর ভুল নাই ,
কলকাতায় এসেছি সদ্য ,
বসে বসে লিখছি পদ্য ।
তোদের ফেলে সারাটা দিন
আছি অমনি এক রকম ,
খোপে বসে পায়রা যেন
করছি কেবল বক্বকম!
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
মেঘ করেছে আকাশে ,
উষার রাঙা মুখখানি গো
কেমন যেন ফ্যাকাশে!
বাড়িতে যে কেউ কোথা নেই
দুয়োরগুলো ভেজানো ,
ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়াই
ঘরে আছে কে যেন!
পক্ষীটি সেই ঝুপসি হয়ে
ঝিমচ্ছে রে খাঁচাতে ,
ভুলে গেছে নেচে নেচে
পুচ্ছটি তার নাচাতে ।
ঘরের কোণে আপন মনে
শূন্য পড়ে বিছেনা ,
কাহার তরে কেঁদে মরে
সে কথাটা মিছে না!
বইগুলো সব ছড়িয়ে প ‘ ড়ে
নাম লেখা তায় কার গো!
এমনি তারা রবে কি রে
খুলবে না কেউ আর গো!
এটা আছে সেটা আছে
অভাব কিছু নেই তো ,
স্মরণ করে দেয় রে যারে
থাকে নাকো সেই তো!
বাগানে ওই দুটো গাছে
ফুল ফুটেছে রাশি রাশি ,
ফুলের গন্ধে মনে পড়ে
ফুল কে আমায় দিত মেলা ,
বিছেনায় কার মুখটি দেখে
সকাল হত সকালবেলা!
জল থেকে তুই আসবি কবে
মাটির লক্ষ্মী মাটিতে
ঠাকুরবাবুর ছয় নম্বর
জোড়াসাঁকোর বাটীতে!
ইস্টিম ওই রে ফুরিয়ে এল
নোঙর তবে ফেলি অদ্য ।
অবিদিত নেই তো তোমার
রবিকাকা কুঁড়ের হদ্দ!
আজকে নাকি মেঘ করেছে
ঠেকছে কেমন ফাঁকা-ফাঁকা ,
তাই খানিকটা ফোঁসফোঁসিয়ে
বিদায় হল —
রবিকাকা ।
পত্র
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু
স্টীমার । খুলনা
বসে বসে লিখলেম চিঠি
পুরিয়ে দিলাম চারটি পিঠই ,
পেলেম না তার জবাবই
এমনি তোমার নবাবী!
দুটো ছত্র লিখবি পত্র
একলা তোমার ‘ রব্-কা ‘ যে!
পোড়ারমুখী তাও হবে না
আলিস্যি তোর সব কাজে!
ঝগড়াটে নয় স্বভাব আমার
নইলে দেখতে কারখানা ,
গলার চোটে আকাশ ফেটে
হয়ে যেত চারখানা ,
বাছা আমার দেখতে পেতে
এই কলমের ধারখানা!
তোমার মতো এমনি মা তো
দেখি নি এ বঙ্গে গো ,
মায়া দয়া যা-কিছু সে
যদিন থাকে সঙ্গে গো!
চোখের আড়াল প্রাণের আড়াল
কেমনতরো ঢঙ এ গো!
তোমার প্রাণ যে পাষাণ-সম
জানি সেটা Long ago!
সংসারে যে সবি মায়া
সেটা নেহাত গল্প না!
বাইরেতে এক ভিতরে এক
এ যেন কার খল-পনা!
সত্যি বলে যেটা দেখি
সেটা আমার কল্পনা!
ভেবে একবার দেখো বাছা
ফিলজফি অল্প না!
মস্ত একটা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ
কে রেখেছে সাজিয়ে
যা করি তা কেবল ‘ থোড়া
জমির বাস্তে কাজিয়ে! ‘
বৃষ্টি পড়ে চিঠি না পাই ,
মনটা নিয়ে ততই হাঁপাই ,
শূন্যে চেয়ে ততই ভাবি
সকলি ভোজ-বাজি এ!
ফিলজফি মনের মধ্যে
ততই ওঠে গাঁজিয়ে!
দূর হোক গে , এত কথা
কেনই বলি তোমাকে!
ভরা নায়ে পা দিয়েছ ,
আছ তুমি দেমাকে!
—
তোমার সঙ্গে আর কথা না ,
তুমি এখন লোকটা মস্ত ,
কাজ কি বাপু , এইখেনেতেই
রবীন্দ্রনাথ হলেন অস্ত ।
পত্র (সম্পাদক সমীপেষু)
শ্রীমান্ দামু বসু এবং চামু বসু
সম্পাদক সমীপেষু ।
দামু বোস আর চামু বোসে
কাগজ বেনিয়েছে
বিদ্যেখানা বড্ড ফেনিয়েছে!
(আমার দামু আমার চামু!)
কোথায় গেল বাবা তোমার
মা জননী কই!
সাত-রাজার-ধন মানিক ছেলের
মুখে ফুটছে খই!
(আমার দামু আমার চামু!)
দামু ছিল একরত্তি
চামু তথৈবচ ,
কোথা থেকে এল শিখে
এতই খচমচ!
(আমার দামু আমার চামু!)
দামু বলেন ‘ দাদা আমার ‘
চামু বলেন ‘ ভাই ‘,
আমাদের দোঁহাকার মতো
ত্রিভুবনে নাই!
(আমার দামু আমার চামু!)
গায়ে পড়ে গাল পাড়ছে
বাজার সরগরম ,
মেছুনি-সংহিতায় ব্যাখ্যা
হিঁদুর ধরম!
(দামু আমার চামু!)
দামুচন্দ্র অতি হিঁদু
আরো হিঁদু চামু
সঙ্গে সঙ্গে গজায় হিঁদু
রামু বামু শামু
(দামু আমার চামু!)
রব উঠেছে ভারতভূমে
হিঁদু মেলা ভার ,
দামু চামু দেখা দিয়েছেন
ভয় নেইকো আর ।
(ওরে দামু , ওরে চামু!)
নাই বটে গোতম অত্রি
যে যার গেছে সরে ,
হিঁদু দামু চামু এলেন
কাগজ হাতে করে ।
(আহা দামু আহা চামু!)
লিখছে দোঁহে হিঁদুশাস্ত্র
এডিটোরিয়াল ,
দামু বলছে মিথ্যে কথা
চামু দিচ্ছে গাল ।
(হায় দামু হায় চামু!)
এমন হিঁদু মিলবে না রে
সকল হিঁদুর সেরা ,
বোস বংশ আর্যবংশ
সেই বংশের এঁরা!
(বোস দামু বোস চামু!)
কলির শেষে প্রজাপতি
তুলেছিলেন হাই ,
সুড়সুড়িয়ে বেড়িয়ে এলেন
আর্য দুটি ভাই ;
(আর্য দামু চামু!)
দন্ত দিয়ে খুঁড়ে তুলছে
হিঁদু শাস্ত্রের মূল ,
মেলাই কচুর আমদানিতে
বাজার হুলুস্থুল ।
(দামু চামু অবতার!)
মনু বলেন ‘ মনু আমি ‘
বেদের হল ভেদ ,
দামু চামু শাস্ত্র ছাড়ে ,
রইল মনে খেদ!
(ওরে দামু ওরে চামু!)
মেড়ার মত লড়াই করে
লেজের দিকটা মোটা ,
দাপে কাঁপে থরথর
হিঁদুয়ানির খোঁটা!
(আমার হিঁদু দামু চামু!)
দামু চামু কেঁদে আকুল
কোথায় হিঁদুয়ানি!
ট্যাকে আছে গোঁজ ‘ যেথায়
সিকি দুয়ানি ।
(থলের মধ্যে হিঁদুয়ানি!)
দামু চামু ফুলে উঠল
হিঁদুয়ানি বেচে ,
হামাগুড়ি ছেড়ে এখন
বেড়ায় নেচে নেচে!
(ষেটের বাছা দামু চামু!)
আদর পেয়ে নাদুস নুদুস
আহার করছে কসে ,
তরিবৎটা শিখলে নাকো
বাপের শিক্ষাদোষে!
(ওরে দামু চামু!)
এসো বাপু কানটি নিয়ে ,
শিখবে সদাচার ,
কানের যদি অভাব থাকে
তবেই নাচার!
(হায় দামু হায় চামু!)
পড়াশুনো করো , ছাড়ো
শাস্ত্র আষাঢ়ে ,
মেজে ঘষে তোল্ রে বাপু
স্বভাব চাষাড়ে ।
(ও দামু ও চামু!)
ভদ্রলোকের মান রেখে চল্
ভদ্র বলবে তোকে ,
মুখ ছুটোলে কুলশীলটা
জেনে ফেলবে লোকে!
(হায় দামু হায় চামু!)
পয়সা চাও তো পয়সা দেব
থাকো সাধুপথে ,
তাবচ্চ শোভতে কেউ কেউ
যাবৎ ন ভাষতে!
(হে দামু হে চামু!)
পবিত্র জীবন
মিছে হাসি , মিছে বাঁশি , মিছে এ যৌবন ,
মিছে এই দরশের পরশের খেলা ।
চেয়ে দেখো , পবিত্র এ মানবজীবন ,
কে ইহারে অকাতরে করে অবহেলা !
ভেসে ভেসে এই মহা চরাচরস্রোতে
কে জানে গো আসিয়াছে কোন্খান হতে ,
কোথা হতে নিয়ে এল প্রেমের আভাস ,
কোন্ অন্ধকার ভেদি উঠিল আলোতে !
এ নহে খেলার ধন , যৌবনের আশ —
বোলো না ইহার কানে আবেশের বাণী !
নহে নহে এ তোমার বাসনার দাস ,
তোমার ক্ষুধার মাঝে আনিয়ো না টানি !
এ তোমার ঈশ্বরের মঙ্গল – আশ্বাস ,
স্বর্গের আলোক তব এই মুখখানি ।
পবিত্র প্রেম
ছুঁয়ো না , ছুঁয়ো না ওরে , দাঁড়াও সরিয়া ।
ম্লান করিয়ো না আর মলিন পরশে ।
ওই দেখো তিলে তিলে যেতেছে মরিয়া ,
বাসনানিশ্বাস তব গরল বরষে ।
জান না কি হৃদিমাঝে ফুটেছে যে ফুল ,
ধুলায় ফেলিলে তারে ফুটিবে না আর ।
জান না কি সংসারের পাথার অকূল ,
জান না কি জীবনের পথ অন্ধকার ।
আপনি উঠেছে ওই তব ধ্রুবতারা ,
আপনি ফুটেছে ফুল বিধির কৃপায় ,
সাধ করে কে আজি রে হবে পথহারা —
সাধ করে এ কুসুম কে দলিবে পায় !
যে প্রদীপ আলো দেবে তাহে ফেল শ্বাস ,
যারে ভালোবাস তারে করিছ বিনাশ !
পাষাণী মা
হে ধরণী , জীবের জননী ,
শুনেছি যে মা তোমায় বলে ,
তবে কেন তোর কোলে সবে
কেঁদে আসে , কেঁদে যায় চলে ।
তবে কেন তোর কোলে এসে
সন্তানের মেটে না পিয়াসা ।
কেন চায় , কেন কাঁদে সবে ,
কেন কেঁদে পায় না ভালোবাসা ।
কেন হেথা পাষাণ – পরান ,
কেন সবে নীরস নিষ্ঠুর ,
কেঁদে কেঁদে দুয়ারে যে আসে
কেন তারে করে দেয় দূর ।
কাঁদিয়া যে ফিরে চলে যায়
তার তরে কাঁদিস নে কেহ ,
এই কি মা , জননীর প্রাণ ,
এই কি মা , জননীর স্নেহ !
পুরাতন
হেথা হতে যাও , পুরাতন ।
হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে ।
আবার বাজিছে বাঁশি , আবার উঠিছে হাসি ,
বসন্তের বাতাস বয়েছে ।
সুনীল আকাশ -‘ পরে শুভ্র মেঘ থরে থরে
শ্রান্ত যেন রবির আলোকে ,
পাখিরা ঝাড়িছে পাখা , কাঁপিছে তরুর শাখা ,
খেলাইছে বালিকা বালকে ।
সমুখের সরোবরে আলো ঝিকিমিকি করে ,
ছায়া কাঁপিতেছে থরথর ,
জলের পানেতে চেয়ে ঘাটে বসে আছে মেয়ে ,
শুনিছে পাতার মরমর ।
কী জানি কত কী আশে চলিয়াছে চারি পাশে
কত লোক কত সুখে দুখে ,
সবাই তো ভুলে আছে , কেহ হাসে কেহ নাচে ,
তুমি কেন দাঁড়াও সমুখে ।
বাতাস যেতেছে বহি , তুমি কেন রহি রহি
তারি মাঝে ফেল দীর্ঘশ্বাস ।
সুদূরে বাজিছে বাঁশি , তুমি কেন ঢাল আসি
তারি মাঝে বিলাপ – উচ্ছ্বাস ।
উঠেছে প্রভাতরবি , আঁকিছে সোনার ছবি ,
তুমি কেন ফেল তাহে ছায়া ।
বারেক যে চলে যায় তারে তো কেহ না চায় ,
তবু তার কেন এত মায়া ।
তবু কেন সন্ধ্যাকালে জলদের অন্তরালে
লুকায়ে ধরার পানে চায় —
নিশীথের অন্ধকারে পুরানো ঘরের দ্বারে
কেন এসে পুন ফিরে যায় ।
কী দেখিতে আসিয়াছ যাহা কিছু ফেলে গেছ
কে তাদের করিবে যতন !
স্মরণের চিহ্ন যত ছিল পড়ে দিন – কত
ঝরে – পড়া পাতার মতন
আজি বসন্তের বায় একেকটি করে হায়
উড়ায়ে ফেলিছে প্রতিদিন —
ধূলিতে মাটিতে রহি হাসির কিরণে দহি
ক্ষণে ক্ষণে হতেছে মলিন ।
ঢাকো তবে ঢাকো মুখ , নিয়ে যাও দুঃখ সুখ ,
চেয়ো না চেয়ো না ফিরে ফিরে ।
হেথায় আলয় নাহি , অনন্তের পানে চাহি
আঁধারে মিলাও ধীরে ধীরে ।
পূর্ণ মিলন
নিশিদিন কাঁদি , সখী , মিলনের তরে
যে মিলন ক্ষুধাতুর মৃত্যুর মতন ।
লও লও বেঁধে লও কেড়ে লও মোরে —
লও লজ্জা , লও বস্ত্র , লও আবরণ ।
এ তরুণ তনুখানি লহ চুরি করে —
আঁখি হতে লও ঘুম , ঘুমের স্বপন ।
জাগ্রত বিপুল বিশ্ব লও তুমি হরে
অনন্তকালের মোর জীবন – মরণ ।
বিজন বিশ্বের মাঝে মিলনশ্মশানে
নির্বাপিতসূর্যালোক লুপ্ত চরাচর ,
লাজমুক্ত বাসমুক্ত দুটি নগ্ন প্রাণে
তোমাতে আমাতে হই অসীম সুন্দর ।
এ কী দুরাশার স্বপ্ন হায় গো ঈশ্বর ,
তোমা ছাড়া এ মিলন আছে কোন্খানে !
প্রত্যাশা
সকলে আমার কাছে যত কিছু চায়
সকলেরে আমি তাহা পেরেছি কি দিতে !
আমি কি দিই নি ফাঁকি কত জনে হায় ,
রেখেছি কত – না ঋণ এই পৃথিবীতে ।
আমি তবে কেন বকি সহস্র প্রলাপ ,
সকলের কাছে চাই ভিক্ষা কুড়াইতে !
এক তিল না পাইলে দিই অভিশাপ ,
অমনি কেন রে বসি কাতরে কাঁদিতে !
হা ঈশ্বর , আমি কিছু চাহি নাকো আর ,
ঘুচাও আমার এই ভিক্ষার বাসনা ।
মাথায় বহিয়া লয়ে চির ঋণভার
‘ পাইনি’ ‘পাইনি’ বলে আর কাঁদিব না ।
তোমারেও মাগিব না , অলস কাঁদনি —
আপনারে দিলে তুমি আসিবে আপনি ।
প্রাণ
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে ,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই ।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয় – মাঝে যদি স্থান পাই ।
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত ,
বিরহ মিলন কত হাসি – অশ্রু – ময় ,
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর – আলয় ।
তা যদি না পারি তবে বাঁচি যত কাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই ,
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই ।
হাসিমুখে নিয়ো ফুল , তার পরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল , যদি সে ফুল শুকায় ।
প্রার্থনা
তুমি কাছে নাই ব’লে হেরো , সখা , তাই
‘আমি বড়ো’ ‘আমি বড়ো’ করিছে সবাই ।
সকলেই উঁচু হয়ে দাঁড়ায়ে সমুখে
বলিতেছে , ‘ এ জগতে আর কিছু নাই । ‘
নাথ , তুমি একবার এসো হাসিমুখে
এরা সবে ম্লান হয়ে লুকাক লজ্জায় —
সুখদুঃখ টুটে যাক তব মহাসুখে ,
যাক আলো-অন্ধকার তোমার প্রভায় ।
নহিলে ডুবেছি আমি , মরেছি হেথায় ,
নহিলে ঘুচে না আর মর্মের ক্রন্দন —
শুষ্ক ধূলি তুলি শুধু সুধাপিপাসায় ,
প্রেম ব’লে পরিয়াছি মরণবন্ধন ।
কভু পড়ি কভু উঠি , হাসি আর কাঁদি —
খেলাঘর ভেঙে প’ড়ে রচিবে সমাধি ।
বঙ্গবাসীর প্রতি
আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না ।
এ কি শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা
শুধু মিছে কথা ছলনা !
আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না ।
এ যে নয়নের জল , হতাশের শ্বাস ,
কলঙ্কের কথা দরিদ্রের আশ ,
এ যে বুক – ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে
গভীর মরমবেদনা ।
এ কি শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা ,
শুধু মিছে কথা ছলনা !
এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি
কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি ,
মিছে কথা কয়ে মিছে যশ লয়ে
মিছে কাজে নিশিযাপনা !
কে জাগিবে আজ , কে করিবে কাজ ,
কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ —
কাতরে কাঁদিবে , মা ‘ র পায়ে দিবে
সকল প্রাণের কামনা ।
এ কি শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা ,
শুধু মিছে কথা ছলনা !
বঙ্গভূমির প্রতি
কেন চেয়ে আছ , গো মা , মুখপানে !
এরা চাহে না তোমারে চাহে না যে ,
আপন মায়েরে নাহি জানে !
এরা তোমায় কিছু দেবে না , দেবে না —
মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভানে !
তুমি তো দিতেছ মা , যা আছে তোমারি —
স্বর্ণশস্য তব , জাহ্নবীবারি ,
জ্ঞান ধর্ম কত পুণ্যকাহিনী ।
এরা কী দেবে তোরে , কিছু না , কিছু না —
মিথ্যা কবে শুধু হীন পরানে !
মনের বেদনা রাখো , মা , মনে ,
নয়নবারি নিবারো নয়নে ,
মুখ লুকাও , মা , ধূলিশয়নে —
ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে ।
শূন্যপানে চেয়ে প্রহর গণি গণি
দেখো কাটে কি না দীর্ঘ রজনী
দুঃখ জানায়ে কী হবে , জননী ,
নির্মম চেতনহীন পাষাণে !
» বঙ্গভূমির প্রতি
কেন চেয়ে আছ , গো মা , মুখপানে !
এরা চাহে না তোমারে চাহে না যে ,
আপন মায়েরে নাহি জানে !
এরা তোমায় কিছু দেবে না , দেবে না —
মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভানে !
তুমি তো দিতেছ মা , যা আছে তোমারি —
স্বর্ণশস্য তব , জাহ্নবীবারি ,
জ্ঞান ধর্ম কত পুণ্যকাহিনী ।
এরা কী দেবে তোরে , কিছু না , কিছু না —
মিথ্যা কবে শুধু হীন পরানে !
মনের বেদনা রাখো , মা , মনে ,
নয়নবারি নিবারো নয়নে ,
মুখ লুকাও , মা , ধূলিশয়নে —
ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে ।
শূন্যপানে চেয়ে প্রহর গণি গণি
দেখো কাটে কি না দীর্ঘ রজনী
দুঃখ জানায়ে কী হবে , জননী ,
নির্মম চেতনহীন পাষাণে !
বনের ছায়া
কোথা রে তরুর ছায়া , বনের শ্যামল স্নেহ ।
তট-তরু কোলে কোলে সারাদিন কলরোলে
স্রোতস্বিনী যায় চলে সুদূরে সাধের গেহ ;
কোথা রে তরুর ছায়া , বনের শ্যামল স্নেহ ;
কোথা রে সুনীল দিশে বনান্ত রয়েছে মিশে
অনন্তের অনিমিষে নয়ন নিমেষ-হারা ।
দূর হতে বায়ু এসে চলে যায় দূর-দেশে
গীত – গান যায় ভেসে , কোন্ দেশে যায় তারা ।
হাসি , বাঁশি , পরিহাস , বিমল সুখের শ্বাস ,
মেলামেশা বারো মাস নদীর শ্যামল তীরে ;
কেহ খেলে , কেহ দোলে , ঘুমায় ছায়ার কোলে ,
বেলা শুধু যায় চলে কুলুকুলু নদীনীরে ।
বকুল কুড়োয় কেহ , কেহ গাঁথে মালাখানি ;
ছায়াতে ছায়ার প্রায় বসে বসে গান গায় ,
করিতেছে কে কোথায় চুপিচুপি কানাকানি ।
খুলে গেছে চুলগুলি , বাঁধিতে গিয়েছে ভুলি ,
আঙুলে ধরেছে তুলি আঁখি পাছে ঢেকে যায় ,
কাঁকন খসিয়া গেছে , খুঁজিছে গাছের ছায় ।
বনের মর্মের মাঝে বিজনে বাঁশরি বাজে ,
তারি সুরে মাঝে মাঝে ঘুঘু দুটি গান গায় ।
ঝুরু ঝুরু কত পাতা গাহিছে বনের গাথা ,
কত-না মনের কথা তারি সাথে মিশে যায় ।
লতাপাতা কত শত খেলে কাঁপে কত মতো
ছোটো ছোটো আলোছায়া ঝিকিমিকি বন ছেয়ে ,
তারি সাথে তারি মতো খেলে কত ছেলেমেয়ে ।
কোথায় সে গুন গুন ঝরঝর মরমর ,
কোথা সে মাথার’পরে লতাপাতা থরথর ।
কোথায় সে ছায়া আলো , ছেলেমেয়ে খেলাধূলি ,
কোথা সে ফুলের মাঝে এলোচুলে হাসিগুলি ।
কোথা রে সরল প্রাণ , গভীর আনন্দ – গান ,
অসীম শান্তির মাঝে প্রাণের সাধের গেহ ,
তরুর শীতল ছায়া , বনের শ্যামল স্নেহ ।
বন্দী
দাও খুলে দাও , সখী , ওই বাহুপাশ —
চুম্বনমদিরা আর করায়ো না পান ।
কুসুমের কারাগারে রুদ্ধ এ বাতাস —
ছেড়ে দাও , ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান ।
কোথায় উষার আলো , কোথায় আকাশ —
এ চির পূর্ণিমারাত্রি হোক অবসান ।
আমারে ঢেকেছে তব মুক্ত কেশপাশ ,
তোমার মাঝারে আমি নাহি দেখি ত্রাণ !
আকুল অঙ্গুলিগুলি করি কোলাকুলি
গাঁথিছে সর্বাঙ্গে মোর পরশের ফাঁদ ।
ঘুমঘোরে শূন্যপানে দেখি মুখ তুলি
শুধু অবিশ্রামহাসি একখানি চাঁদ ।
স্বাধীন করিয়া দাও , বেঁধো না আমায় —
স্বাধীন হৃদয়খানি দিব তার পায় ।
বসন্ত-অবসান
কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান!
কখন বকুল-মূল ছেয়েছিল ঝরা ফুল ,
কখন যে ফুল-ফোটা হয়ে গেল অবসান !
কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান !
এবার বসন্তে কি রে যুথীগুলি জাগে নি রে !
অলিকুল গুঞ্জরিয়া করে নি কি মধুপান !
এবার কি সমীরণ জাগয় নি ফুলবন ,
সাড়া দিয়ে গেল না তো , চলে গেল ম্রিয়মাণ !
কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান!
যতগুলি পাখি ছিল গেয়ে বুঝি চলে গেল ,
সমীরণে মিলে গেল বনের বিলাপতান ।
ভেঙেছে ফুলের মেলা , চলে গেছে হাসি – খেলা ,
এতক্ষণে সন্ধ্যাবেলা জাগিয়া চাহিল প্রাণ ।
কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান !
বসন্তের শেষ রাতে এসেছি রে শূন্য হাতে ,
এবার গাঁথি নি মালা , কী তোমারে করি দান !
কাঁদিছে নীরব বাঁশি , অধরে মিলায় হাসি ,
তোমার নয়নে ভাসে ছলছল অভিমান ।
এবার বসন্ত গেল , হল না , হল না গান !
বাঁশি
ওগো , শোনো কে বাজায় !
বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়।
অধর ছুঁয়ে বাঁশিখানি চুরি করে হাসিখানি ,
বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায় ।
ওগো শোনো কে বাজায় !
কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে ,
বকুলগুলি আকুল হয়ে বাঁশির গানে মুঞ্জরে ।
যমুনারই কলতান কানে আসে , কাঁদে প্রাণ ,
আকাশে ঐ মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায় !
ওগো শোনো কে বাজায় !
বাকি
কুসুমের গিয়েছে সৌরভ,
জীবনের গিয়েছে গৌরব।
এখন যা-কিছু সব ফাঁকি,
ঝরিতে মরিতে শুধু বাকি।
বাসনার ফাঁদ
যারে চাই তার কাছে আমি দিই ধরা ,
সে আমার না হইতে আমি হই তার ।
পেয়েছি বলিয়ে মিছে অভিমান করা ,
অন্যেরে বাঁধিতে গিয়ে বন্ধন আমার ।
নিরখিয়া দ্বারমুক্ত সাধের ভাণ্ডার
দুই হাতে লুটে নিই রত্ন ভূরি ভূরি —
নিয়ে যাব মনে করি , ভারে চলা ভার ,
চোরা দ্রব্য বোঝা হয়ে চোরে করে চুরি ।
চিরদিন ধরণীর কাছে ঋণ চাই ,
পথের সম্বল ব ‘ লে জমাইয়া রাখি ,
আপনারে বাঁধা রাখি সেটা ভুলে যাই —
পাথেয় লইয়া শেষে কারাগারে থাকি ।
বাসনার বোঝা নিয়ে ডোবে – ডোবে তরী —
ফেলিতে সরে না মন , উপায় কী করি!
বাহু
কাহারে জড়াতে চাহে দুটি বাহুলতা ,
কাহারে কাঁদিয়া বলে ‘যেয়ো না যেয়ো না’।
কেমনে প্রকাশ করে ব্যাকুল বাসনা ,
কে শুনেছে বাহুর নীরব আকুলতা!
কোথা হতে নিয়ে আসে হৃদয়ের কথা ,
গায়ে লিখে দিয়ে যায় পুলক – অক্ষরে ।
পরশে বহিয়া আনে মরমবারতা ,
মোহ মেখে রেখে যায় প্রাণের ভিতরে ।
কণ্ঠ হতে উতারিয়া যৌবনের মালা
দুইটি আঙুলে ধরি তুলি দেয় গলে ।
দুটি বাহু বহি আনে হৃদয়ের ডালা ,
রেখে দিয়ে যায় যেন চরণের তলে ।
লতায়ে থাকুক বুকে চির আলিঙ্গন ,
ছিঁড়ো না ছিঁড়ো না দুটি বাহুর বন্ধন ।
বিজনে
আমারে ডেকো না আজি , এ নহে সময় —
একাকী রয়েছি হেথা গভীর বিজন ,
রুধিয়া রেখেছি আমি অশান্ত হৃদয় ,
দুরন্ত হৃদয় মোর করিব শাসন ।
মানবের মাঝে গেলে এ যে ছাড়া পায় ,
সহস্রের কোলাহলে হয় পথহারা ,
লুব্ধ মুষ্টি যাহা পায় আঁকড়িতে চায় ,
চিরদিন চিররাত্রি কেঁদে কেঁদে সারা ।
ভর্ৎসনা করিব তারে বিজনে বিরলে ,
একটুকু ঘুমাক সে কাঁদিয়া কাঁদিয়া ,
শ্যামল বিপুল কোলে আকাশ – অঞ্চলে
প্রকৃতি জননী তারে রাখুন বাঁধিয়া ।
শান্ত স্নেহকোলে বসে শিখুক সে স্নেহ ,
আমারে আজিকে তোরা ডাকিস নে কেহ ।
বিবসনা
ফেলো গো বসন ফেলো — ঘুচাও অঞ্চল ।
পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ
সুরবালিকার বেশ কিরণবসন ।
পরিপূর্ণ তনুখানি বিকচ কমল ,
জীবনের যৌবনের লাবণ্যের মেলা ।
বিচিত্র বিশ্বের মাঝে দাঁড়াও একেলা ।
সর্বাঙ্গে পড়ুক তব চাঁদের কিরণ ,
সর্বাঙ্গে মলয় – বায়ু করুক সে খেলা ।
অসীম নীলিমা – মাঝে হও নিমগন
তারাময়ী বিবসনা প্রকৃতির মতো ।
অতনু ঢাকুক মুখ বসনের কোণে
তনুর বিকাশ হেরি লাজে শির নত ।
আসুক বিমল উষা মানবভবনে ,
লাজহীনা পবিত্রতা — শুভ্র বিবসনে ।
বিরহ
আমি নিশি – নিশি কত রচিব শয়ন
আকুলনয়ন রে !
কত নিতি – নিতি বনে করিব যতনে
কুসুমচয়ন রে !
কত শারদ যামিনী হইবে বিফল ,
বসন্ত যাবে চলিয়া !
কত উদিবে তপন আশার স্বপন ,
প্রভাতে যাইবে ছলিয়া !
এই যৌবন কত রাখিব বাঁধিয়া ,
মরিব কাঁদিয়া রে !
সেই চরণ পাইলে মরণ মাগিব
সাধিয়া সাধিয়া রে ।
আমি কার পথ চাহি এ জনম বাহি ,
কার দরশন যাচি রে !
যেন আসিবে বলিয়া কে গেছে চলিয়া ,
তাই আমি বসে আছি রে ।
তাই মালাটি গাঁথিয়া পরেছি মাথায়
নীলবাসে তনু ঢাকিয়া ,
তাই বিজন আলয়ে প্রদীপ জ্বালায়ে
একেলা রয়েছি জাগিয়া ।
ওগো তাই কত নিশি চাঁদ ওঠে হাসি ,
তাই কেঁদে যায় প্রভাতে ।
ওগো তাই ফুলবনে মধুসমীরণে
ফুটে ফুল কত শোভাতে !
ওই বাঁশিস্বর তার আসে বার বার ,
সেই শুধু কেন আসে না !
এই হৃদয় – আসন শূন্য যে থাকে ,
কেঁদে মরে শুধু বাসনা ।
মিছে পরশিয়া কায় বায়ু বহে যায় ,
বহে যমুনার লহরী ,
কেন কুহু কুহু পিক কুহরিয়া ওঠে —
যামিনী যে ওঠে শিহরি ।
ওগো যদি নিশিশেষে আসে হেসে হেসে ,
মোর হাসি আর রবে কি !
এই জাগরণে ক্ষীণ বদন মলিন
আমারে হেরিয়া কবে কী !
আমি সারা রজনীর গাঁথা ফুলমালা
প্রভাতে চরণে ঝরিব ,
ওগো আছে সুশীতল যমুনার জল —
দেখে তারে আমি মরিব ।
বিরহীর পত্র
হয় কি না হয় দেখা , ফিরি কি না ফিরি ,
দূরে গেলে এই মনে হয় ;
দুজনার মাঝখানে অন্ধকারে ঘিরি
জেগে থাকে সতত সংশয় ।
এত লোক , এত জন , এত পথ গলি ,
এমন বিপুল এ সংসার —
ভয়ে ভয়ে হাতে হাতে বেঁধে বেঁধে চল , ি
ছাড়া পেলে কে আর কাহার ।
তারায় তারায় সদা থাকে চোখে চোখে
অন্ধকারে অসীম গগনে ।
ভয়ে ভয়ে অনিমেষে কম্পিত আলোকে
বাঁধা থাকে নয়নে নয়নে ।
চৌদিকে অটল স্তব্ধ সুগভীর রাত্রি ,
তরুহীন মরুময় ব্যোম —
মুখে মুখে চেয়ে তাই চলে যত যাত্রী
চলে গ্রহ রবি তারা সোম ।
নিমেষের অন্তরালে কী আছে কে জানে ,
নিমেষে অসীম পড়ে ঢাকা —
অন্ধ কালতুরঙ্গম রাশ নাহি মানে ,
বেগে ধায় অদৃষ্টের চাকা ।
কাছে কাছে পাছে পাছে চলিবারে চাই ,
জেগে জেগে দিতেছি পাহারা ,
একটু এসেছে ঘুম — চমকি তাকাই
গেছে চলে কোথায় কাহারা !
ছাড়িয়ে চলিয়া গেলে কাঁদি তাই একা
বিরহের সমুদ্রের তীরে ।
অনন্তের মাঝখানে দু – দন্ডের দেখা
তাও কেন রাহু এসে ঘিরে !
মৃত্যু যেন মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যায় ,
পাঠায় সে বিরহের চর ।
সকলেই চলে যাবে , পড়ে রবে হায়
ধরণীর শূন্য খেলাঘর ।
গ্রহ তারা ধূমকেতু কত রবি শশী
শূন্য ঘেরি জগতের ভিড় ,
তারি মাঝে যদি ভাঙে , যদি যায় খসি
আমাদের দু – দন্ডের নীড় —
কোথায় কে হারাইব! কোন্ রাত্রিবেলা
কে কোথায় হইব অতিথি !
তখন কি মনে রবে দু – দিনের খেলা ,
দরশের পরশের স্মৃতি !
তাই মনে করে কি রে চোখে জল আসে
একটুকু চোখের আড়ালে !
প্রাণ যারে প্রাণের অধিক ভালোবাসে
সেও কি রবে না এক কালে !
আশা নিয়ে এ কি শুধু খেলাই কেবল —
সুখ দুঃখ মনের বিকার !
ভালোবাসা কাঁদে , হাসে , মোছে অশ্রুজল ,
চায় , পায় , হারায় আবার ।
বিলাপ
ওগো এত প্রেম – আশা প্রাণের তিয়াষা
কেমনে আছে সে পাসরি !
তবে সেথা কি হাসে না চাঁদিনী যামিনী ,
সেথা কি বাজে না বাঁশরি !
সখী , হেথা সমীরণ লুটে ফুলবন ,
সেথা কি পবন বহে না !
সে যে তার কথা মোরে কহে অনুক্ষণ
মোর কথা তারে কহে না !
যদি আমারে আজি সে ভুলিবে সজনী
আমারে ভুলাল কেন সে !
ওগো এ চির জীবন করিব রোদন
এই ছিল তার মানসে !
যবে কুসুমশয়নে নয়নে নয়নে
কেটেছিল সুখরাতি রে ,
তবে কে জানিত তার বিরহ আমার
হবে জীবনের সাথী রে !
যদি মনে নাহি রাখে , সুখে যদি থাকে ,
তোরা একবার দেখে আয় —
এই নয়নের তৃষা পরানের আশা
চরণের তলে রেখে আয় ।
আর নিয়ে যা রাধার বিরহের ভার ,
কত আর ঢেকে রাখি বল্ ।
আর পারিস যদি তো আনিস হরিয়ে
এক – ফোঁটা তার আঁখিজল ।
না না , এত প্রেম সখী ভুলিতে যে পারে
তারে আর কেহ সেধো না ।
আমি কথা নাহি কব , দুখ লয়ে রব ,
মনে মনে স ‘ ব বেদনা ।
ওগো মিছে , মিছে সখী , মিছে এই প্রেম ,
মিছে পরানের বাসনা ।
ওগো সুখদিন হায় যবে চলে যায়
আর ফিরে আর আসে না ।।
বৈতরণী
অশ্রুস্রোতে স্ফীত হয়ে বহে বৈতরণী ,
চৌদিকে চাপিয়া আছে আঁধার রজনী ।
পূর্ব তীর হতে হু হু আসিছে নিশ্বাস ,
যাত্রী লয়ে পশ্চিমেতে চলেছে তরণী ।
মাঝে মাঝে দেখা দেয় বিদ্যুৎ – বিকাশ ,
কেহ কারে নাহি চেনে ব’সে নতশিরে ।
গলে ছিল বিদায়ের অশ্রুকণা – হার ,
ছিন্ন হয়ে একে একে ঝ’রে পড়ে নীরে ।
ওই বুঝি দেখা যায় ছায়া – পরপার ,
অন্ধকারে মিটিমিটি তারা – দীপ জ্বলে ।
হোথায় কি বিস্মরণ , নিঃস্বপ্ন নিদ্রার
শয়ন রচিয়া দিবে ঝরা ফুলদলে !
অথবা অকূলে শুধু অনন্ত রজনী
ভেসে চলে কর্ণধারবিহীন তরণী !
ভবিষ্যতের রঙ্গভূমি
সম্মুখে রয়েছে পড়ি যুগ – যুগান্তর ।
অসীম নীলিমে লুটে ধরণী ধাইবে ছুটে ,
প্রতিদিন আসিবে , যাইবে রবিকর ।
প্রতিদিন প্রভাতে জাগিবে নরনারী ,
প্রতিসন্ধ্যা শ্রান্তদেহে ফিরিয়া আসিবে গেহে ,
প্রতিরাত্রে তারকা ফুটিবে সারি সারি ।
কত আনন্দের ছবি , কত সুখ আশা
আসিবে যাইবে হায় , সুখ – স্বপনের প্রায়
কত প্রাণে জাগিবে , মিলাবে ভালোবাসা ।
তখনো ফুটিবে হেসে কুসুম – কানন ,
তখনো রে কত লোকে কত স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে
আঁকিবে আকাশ – পটে সুখের স্বপন ।
নিবিলে দিনের আলো , সন্ধ্যা হলে , নিতি
বিরহী নদীর ধারে না জানি ভাবিবে কারে ,
না – জানি সে কী কাহিনী , কী সুখ , কী স্মৃতি ।
দূর হতে আসিতেছে , শুন কান পেতে —
কত গান , সেই মহা – রঙ্গভূমি হতে
কত যৌবনের হাসি , কত উৎসবের বাঁশি ,
তরঙ্গের কলধ্বনি প্রমোদের স্রোতে ।
কত মিলনের গীত , বিরহের শ্বাস ,
তুলেছে মর্মর তান বসন্ত – বাতাস ,
সংসারের কোলাহল ভেদ করি অবিরল
লক্ষ নব কবি ঢালে প্রাণের উচ্ছ্বাস ।
ওই দূর খেলাঘরে খেলাইছ কারা !
উঠেছে মাথার’পরে আমাদেরি তারা ।
আমাদেরি ফুলগুলি সেথাও নাচিছে দুলি ,
আমাদেরি পাখিগুলি গেয়ে হল সারা ।
ওই দূর খেলাঘরে করে আনাগোনা
হাসে কাঁদে কত কে যে নাহি যায় গণা ।
আমাদের পানে হায় ভুলেও তো নাহি চায় ,
মোদের ওরা তো কেউ ভাই বলিবে না
ওই – সব মধুমুখ অমৃত – সদন ,
না জানি রে আর কারা করিবে চুম্বন ।
শরমময়ীর পাশে বিজড়িত আধ – ভাষে
আমরা তো শুনাব না প্রাণের বেদন ।
আমাদের খেলাঘরে কারা খেলাইছ !
সাঙ্গ না হইতে খেলা চলে এনু সন্ধেবেলা ,
ধূলির সে ঘর ভেঙে কোথা ফেলাইছ ।
হোথা , যেথা বসিতাম মোরা দুই জন ,
হাসিয়া কাঁদিয়া হত মধুর মিলন ,
মাটিতে কাটিয়া রেখা কত লিখিতাম লেখা ,
কে তোরা মুছিলি সেই সাধের লিখন ।
সুধাময়ী মেয়েটি সে হোথায় লুটিত ,
চুমো খেলে হাসিটুকু ফুটিয়া উঠিত ।
তাই রে মাধবীলতা মাথা তুলেছিল হোথা ,
ভেবেছিনু চিরদিন রবে মুকুলিত ।
কোথায় রে , কে তাহারে করিলি দলিত ।
ওই যে শুকানো ফুল ছুঁড়ে ফেলে দিলে
উহার মরম – কথা বুঝিতে নারিলে ।
ও যেদিন ফুটেছিল নব রবি উঠেছিল ,
কানন মাতিয়াছিল বসন্ত – অনিলে ।
ওই যে শুকায় চাঁপা পড়ে একাকিনী ,
তোমরা তো জানিবে না উহার কাহিনী ।
কবে কোন্ সন্ধেবেলা ওরে তুলেছিল বালা
ওরি মাঝে বাজে কোন্ পূরবীরাগিণী ।
যারে দিয়েছিল ওই ফুল উপহার
কোথায় সে গেছে চলে , সে তো নেই আর ।
একটু কুসুমকণা তাও নিতে পারিল না ,
ফেলে রেখে যেতে হল মরণের পার ;
কত সুখ , কত ব্যথা , সুখের দুখের কথা
মিশিছে ধূলির সাথে ফুলের মাঝার ।
মিছে শোক , মিছে এই বিলাপ কাতর ,
সম্মুখে রয়েছে পড়ে যুগ – যুগান্তর ।
মঙ্গলগীত
শ্রীমতী ইন্দিরা । প্রাণাধিকাসু । নাসিক
এতবড়ো এ ধরণী মহাসিন্ধু-ঘেরা
দুলিতেছে আকাশসাগরে —
দিন – দুই হেথা রহি মোরা মানবেরা
শুধু কি, মা, যাব খেলা করে ।
তাই কি ধাইছে গঙ্গা ছাড়ি হিমগিরি ,
অরণ্য বহিছে ফুল-ফল —
শত কোটি রবি তারা আমাদের ঘিরি
গণিতেছে প্রতি দণ্ড পল !
শুধু কি , মা , হাসিখেলা প্রতি দিন রাত
দিবসের প্রত্যেক প্রহর !
প্রভাতের পরে আসি নূতন প্রভাত
লিখিছে কি একই অক্ষর !
কানাকানি হাসাহাসি কোণেতে গুটায়ে ,
অলস নয়ননিমীলন ,
দণ্ড – দুই ধরণীর ধূলিতে লুটায়ে
ধূলি হয়ে ধূলিতে শয়ন !
নাই কি , মা , মানবের গভীর ভাবনা ,
হৃদয়ের সীমাহীন আশা !
জেগে নাই অন্তরেতে অনন্ত চেতনা ,
জীবনের অনন্ত পিপাসা !
হৃদয়েতে শুষ্ক কি , মা , উৎস করুণার ,
শুনি না কি দুখীর ক্রন্দন !
জগৎ শুধু কি , মা গো , তোমার আমার
ঘুমাবার কুসুম – আসন !
শুনো না কাহারা ওই করে কানাকানি
অতি তুচ্ছ ছোটো ছোটো কথা ।
পরের হৃদয় লয়ে করে টানাটানি ,
শকুনির মতো নির্মমতা।
শুনো না করিছে কারা কথা – কাটাকাটি
মাতিয়া জ্ঞানের অভিমানে ,
রসনায় রসনায় ঘোর লাঠালাঠি ,
আপনার বুদ্ধিরে বাখানে ।
তুমি এস দূরে এস , পবিত্র নিভৃতে ,
ক্ষুদ্র অভিমান যাও ভুলি ।
সযতনে ঝেড়ে ফেলো বসন হইতে
প্রতি নিমেষের যত ধূলি !
নিমেষের ক্ষুদ্র কথা ক্ষুদ্র রেণুজাল
আচ্ছন্ন করিছে মানবেরে ,
উদার অনন্ত তাই হতেছে আড়াল
তিল তিল ক্ষুদ্রতার ঘেরে ।
আছে মা , তোমার মুখে স্বর্গের কিরণ ,
হৃদয়েতে উষার আভাস ,
খুঁজিছে সরল পথ ব্যাকুল নয়ন —
চারি দিকে মর্ত্যের প্রবাস ।
আপনার ছায়া ফেলি আমরা সকলে
পথ তোর অন্ধকারে ঢাকি —
ক্ষুদ্র কথা , ক্ষুদ্র কাজে , ক্ষুদ্র শত ছলে ,
কেন তোরে ভুলাইয়া রাখি ।
কেন , মা , তোমারে কেহ চাহে না জানাতে
মানবের উচ্চ কুলশীল —
অনন্তজগৎ – ব্যাপী ঈশ্বরের সাথে
তোমার যে সুগভীর মিল ।
কেন কেহ দেখায় না — চারি দিকে তব
ঈশ্বরের বাহুর বিস্তার !
ঘেরি তোরে , ভোগসুখ ঢালি নব নব
গৃহ বলি রচে কারাগার ।
অনন্তের মাঝখানে দাঁড়াও , মা আসি ,
চেয়ে দেখো আকাশের পানে —
পড়ুক বিমলবিভা পূর্ণ রূপরাশি
স্বর্গমুখী কমলনয়ানে ।
আনন্দে ফুটিয়া ওঠো শুভ্র সূর্যোদয়ে
প্রভাতের কুসুমের মতো ,
দাঁড়াও সায়াহ্নমাঝে পবিত্র হৃদয়ে
মাথাখানি করিয়া আনত ।
শোনো শোনো উঠিতেছে সুগম্ভীর বাণী ,
ধ্বনিতেছে আকাশ পাতাল !
বিশ্ব – চরাচর গাহে কাহারে বাখানি
আদিহীন অন্তহীন কাল !
যাত্রী সবে ছুটিয়াছে শূন্যপথ দিয়া ,
উঠেছে সংগীতকোলাহল ,
ওই নিখিলের সাথে কণ্ঠ মিলাইয়া
মা , আমরা যাত্রা করি চল্ ।
যাত্রা করি বৃথা যত অহংকার হতে ,
যাত্রা করি ছাড়ি হিংসাদ্বেষ ,
যাত্রা করি স্বর্গময়ী করুণার পথে ,
শিরে ধরি সত্যের আদেশ ।
যাত্রা করি মানবের হৃদয়ের মাঝে
প্রাণে লয়ে প্রেমের আলোক ,
আয় , মা গো , যাত্রা করি জগতের কাজে
তুচ্ছ করি নিজ দুঃখশোক ।
জেনো , মা , এ সুখে – দুঃখে – আকুল সংসারে
মেটে না সকল তুচ্ছ আশ —
তা বলিয়া অভিমানে অনন্ত তাঁহারে
কোরো না , কোরো না অবিশ্বাস ।
সুখ ব ‘ লে যাহা চাই সুখ তাহা নয় ,
কী যে চাই জানি না আপনি —
আঁধারে জ্বলিছে ওই ওরে কোরো ভয় ,
ভুজঙ্গের মাথার ও মণি ।
ক্ষুদ্র সুখ ভেঙে যায় না সহে নিশ্বাস ,
ভাঙে বালুকার খেলাঘর —
ভেঙে গিয়ে বলে দেয় এ নহে আবাস ,
জীবনের এ নহে নির্ভর ।
সকলে শিশুর মতো কত আবদার
আনিছে তাঁহার সন্নিধান —
পূর্ণ যদি নাহি হল , অমনি তাহার
ঈশ্বরে করিছে অপমান !
কিছুই চাব না , মা গো , আপনার তরে ,
পেয়েছে যা শুধিব সে ঋণ —
পেয়েছি যে প্রেমসুধা হৃদয় – ভিতরে ,
ঢালিয়া তা দিব নিশিদিন ।
সুখ শুধু পাওয়া যায় সুখ না চাহিলে ,
প্রেম দিলে প্রেমে পুরে প্রাণ ,
নিশিদিশি আপনার ক্রন্দন গাহিলে
ক্রন্দনের নাহি অবসান ।
মধুপাত্রে হতপ্রাণ পিপীলির মতো
ভোগসুখে জীর্ণ হয়ে থাকা ,
ঝুলে থাকা বাদুড়ের মতো শির নত
আঁকড়িয়া সংসারের শাখা ,
জগতের হিসাবেতে শূন্য হয়ে হায়
আপনারে আপনি ভক্ষণ ,
ফুলে উঠে ফেটে যাওয়া জলবিম্ব প্রায় —
এই কি রে সুখের লক্ষণ ।
এই অহিফেনসুখ কে চায় ইহাকে !
মানবত্ব এ নয় এ নয় ।
রাহুর মতন সুখ গ্রাস করে রাখে
মানবের মানবহৃদয় ।
মানবেরে বল দেয় সহস্র বিপদ ,
প্রাণ দেয় সহস্র ভাবনা ,
দারিদ্র্যে খুঁজিয়া পাই মনের সম্পদ ,
শোকে পাই অনন্ত সান্ত্বনা ।
চিরদিবসের সুখ রয়েছে গোপন
আপনার আত্মার মাঝার ।
চারি দিকে সুখ খুঁজে শ্রান্ত প্রাণমন —
হেথা আছে , কোথা নেই আর ।
বাহিরের সুখ সে , সুখের মরীচিকা —
বাহিরেতে নিয়ে যায় ছ ‘ লে ,
যখন মিলায়ে যায় মায়াকুহেলিকা
কেন কাঁদি সুখ নেই ব ‘ লে ।
দাঁড়াও সে অন্তরের শান্তিনিকেতনে
চিরজ্যোতি চিরছায়াময় —
ঝড়হীন রৌদ্রহীন নিভৃত সদনে
জীবনের অনন্ত আলয় ।
পুণ্যজ্যোতি মুখে লয়ে পুণ্য হাসিখানি ,
অন্নপূর্ণা জননী – সমান ,
মহাসুখে সুখ দুঃখ কিছু নাহি মানি
কর সবে সুখশান্তি দান ।
মা , আমার এই জেনো হৃদয়ের সাধ
তুমি হও লক্ষ্মীর প্রতিমা —
মানবেরে জ্যোতি দাও , করো আশীর্বাদ ,
অকলঙ্ক মূর্তি মধুরিমা ।
কাছে থেকে এত কথা বলা নাহি হয় ,
হেসে খেলে দিন যায় কেটে ,
দূরে ভয় হয় পাছে না পাই সময় ,
বলিবার সাধ নাহি মেটে ।
কত কথা বলিবারে চাহি প্রাণপণে,
কিছুতে, মা, বলিতে না পারি —
স্নেহমুখখানি তোর পড়ে মোর মনে ,
নয়নে উথলে অশ্রুবারি ।
সুন্দর মুখেতে তোর মগ্ন আছে ঘুমে
একখানি পবিত্র জীবন;
ফলুক সুন্দর ফল সুন্দর কুসুমে
আশীর্বাদ করো , মা , গ্রহণ ।
২
শ্রীমতী ইন্দিরা। প্রাণাধিকাসু । নাসিক
চারি দিকে তর্ক উঠে সাঙ্গ নাহি হয় ,
কথায় কথায় বাড়ে কথা ।
সংশয়ের উপরেতে চাপিছে সংশয় ,
কেবলি বাড়িছে ব্যাকুলতা ।
ফেনার উপরে ফেনা , ঢেউ -‘ পরে ঢেউ ,
গরজনে বধির শ্রবণ —
তীর কোন্ দিকে আছে নাহি জানে কেউ ,
হা হা করে আকুল পবন ।
এই কল্লোলের মাঝে নিয়ে এস কেহ
পরিপূর্ণ একটি জীবন ,
নীরবে মিটিয়া যাবে সকল সন্দেহ ,
থেমে যাবে সহস্র বচন ।
তোমার চরণে আসি মাগিবে মরণ
লক্ষ্যহারা শত শত মত ,
যে দিকে ফিরাবে তুমি দুখানি নয়ন
সে দিকে হেরিবে সবে পথ ।
অন্ধকার নাহি যায় বিবাদ করিলে ,
মানে না বাহুর আক্রমণ ।
একটি আলোকশিখা সমুখে ধরিলে
নীরবে করে সে পলায়ন ।
এস মা , উষার আলো , অকলঙ্ক প্রাণ ,
দাঁড়াও এ সংসার – আঁধারে ।
জাগাও জাগ্রত হৃদে আনন্দের গান ,
কূল দাও নিদ্রার পাথারে ।
চারি দিকে নৃশংসতা করে হানাহানি ,
মানবের পাষাণ পরান ।
শাণিত ছুরির মতো বিঁধাইয়া বাণী ,
হৃদয়ের রক্ত করে পান ।
তৃষিত কাতর প্রাণী মাগিতেছে জল ,
উল্কাধারা করিছে বর্ষণ —
শ্যামল আশার ক্ষেত্র করিয়া বিফল
স্বার্থ দিয়ে করিছে কর্ষণ ।
শুধু এসে একবার দাঁড়াও কাতরে
মেলি দুটি সকরুণ চোখ ,
পড়ুক দু – ফোঁটা অশ্রু জগতের’পরে
যেন দুটি বাল্মীকীর শ্লোক ।
ব্যথিত করুক স্নান তোমার নয়নে ,
করুণার অমৃতনির্ঝরে ,
তোমারে কাতর হেরি মানবের মনে
দয়া হবে মানবের’পরে ।
সমুদয় মানবের সৌন্দর্যে ডুবিয়া
হও তুমি অক্ষয় সুন্দর ।
ক্ষুদ্র রূপ কোথা যায় বাতাসে উবিয়া
দুই – চারি পলকের পর ।
তোমার সৌন্দর্যে হোক মানব সুন্দর ;
প্রেমে তব বিশ্ব হোক আলো ।
তোমারে হেরিয়া যেন মুগুধ – অন্তর
মানুষে মানুষ বাসে ভালো ।
৩
শ্রীমতী ইন্দিরা । প্রাণাধিকাসু । নাসিক ।
আমার এ গান , মা গো , শুধু কি নিমেষে
মিলাইবে হৃদয়ের কাছাকাছি এসে ?
আমার প্রাণের কথা
নিদ্রাহীন আকুলতা
শুধু নিশ্বাসের মতো যাবে কি , মা , ভেসে !
এ গান তোমারে সদা ঘিরে যেন রাখে ,
সত্যের পথের’পরে নাম ধরে ডাকে ।
সংসারের সুখে দুখে
চেয়ে থাকে তোর মুখে ,
চির – আশীর্বাদ – সম কাছে কাছে থাকে ।
বিজনে সঙ্গীর মতো করে যেন বাস ,
অনুক্ষণ শোনে তোর হৃদয়ের আশ ।
পড়িয়া সংসারঘোরে
কাঁদিয়া হেরিলে তোরে
ভাগ করে নেয় যেন দুখের নিশ্বাস ।
সংসারের প্রলোভন যবে আসি হানে
মধুমাখা বিষবাণী দুর্বল পরানে ,
এ গান আপন সুরে
মন তোর রাখে পুরে ,
ইষ্টমন্ত্রসম সদা বাজে তোর কানে ।
আমার এ গান যেন সুদীর্ঘ জীবন
তোমার বসন হয় , তোমার ভূষণ ।
পৃথিবীর ধূলিজাল
করে দেয় অন্তরাল ,
তোমারে করিয়া রাখে সুন্দর শোভন ।
আমার এ গান যেন নাহি মানে মানা ,
উদার বাতাস হয়ে এলাইয়া ডানা
সৌরভের মতো তোরে
নিয়ে যায় চুরি করে —
খুঁজিয়া দেখাতে যায় স্বর্গের সীমানা ।
এ গান যেন রে হয় তোর ধ্রুবতারা ,
অন্ধকারে অনিমিষে নিশি করে সারা ।
তোমার মুখের’পরে
জেগে থাকে স্নেহভরে
অকূলে নয়ন মেলি দেখায় কিনারা ।
আমার এ গান যেন পশি তোর কানে
মিলায়ে মিশায়ে যায় সমস্ত পরানে ।
তপ্ত শোণিতের মতো
বহে শিরে অবিরত ,
আনন্দে নাচিয়া উঠে মহত্ত্বের গানে ।
এ গান বাঁচিয়া থাকে যেন তোর মাঝে ,
আঁখিতারা হয়ে তোর আঁখিতে বিরাজে ।
এ যেন রে করে দান
সতত নূতন প্রাণ ,
এ যেন জীবন পায় জীবনের কাজে ।
যদি যাই , মৃত্যু যদি নিয়ে যায় ডাকি ,
এই গানে রেখে যাব মোর স্নেহ – আঁখি ।
যবে হায় সব গান
হয়ে যাবে অবসান
এ গানের মাঝে আমি যেন বেঁচে থাকি ।
মথুরায়
বাঁশরি বাজাতে চাহি , বাঁশরি বাজিল কই ?
বিহরিছে সমীরণ , কুহরিছে পিকগণ ,
মথুরায় উপবন কুসুমে সাজিল ওই ।
বাঁশরি বাজাতে চাহি , বাঁশরি বাজিল কই ?
বিকচ বকুল ফুল দেখে যে হতেছে ভুল ,
কোথাকার অলিকুল গুঞ্জরে কোথায় !
এ নহে কি বৃন্দাবন ? কোথা সেই চন্দ্রানন ?
ওই কি নূপুরধ্বনি বনপথে শুনা যায় ?
একা আছি বনে বসি , পীত ধড়া পড়ে খসি ,
সোঙরি সে মুখশশী পরান মজিল সই ।
বাঁশরি বাজাতে চাহি , বাঁশরি বাজিল কই ?
এক বার রাধে রাধে ডাক্ বাঁশি , মনোসাধে ,
আজি এ মধুর চাঁদে মধুর যামিনী ভায় ।
কোথা সে বিধুরা বালা , মলিন মালতীমালা ,
হৃদয়ে বিরহ – জ্বালা , এ নিশি পোহায় , হায় ।
কবি যে হল আকুল , এ কি রে বিধির ভুল ,
মথুরায় কেন ফুল ফুটেছে আজি লো সই ?
বাঁশরি বাজাতে গিয়ে বাঁশরি বাজিল কই ?
মরীচিকা
এসো , ছেড়ে এসো , সখী , কুসুমশয়ন ।
বাজুক কঠিন মাটি চরণের তলে ।
কত আর করিবে গো বসিয়া বিরলে
আকাশকুসুমবনে স্বপন চয়ন ।
দেখো ওই দূর হতে আসিছে ঝটিকা ,
স্বপ্নরাজ্য ভেসে যাবে খর অশ্রুজলে ।
দেবতার বিদ্যুতের অভিশাপশিখা
দহিবে আঁধার নিদ্রা বিমল অনলে ।
চলো গিয়ে থাকি দোঁহে মানবের সাথে ,
সুখদুঃখ লয়ে সবে গাঁথিছে আলয় —
হাসি – কান্না ভাগ করি ধরি হাতে হাতে
সংসারসংশয়রাত্রি রহিব নির্ভয় ।
সুখরৌদ্রমরীচিকা নহে বাসস্থান ,
মিলায় মিলায় বলি ভয়ে কাঁপে প্রাণ ।
মানবহৃদয়ের বাসনা
নিশীথে রয়েছি জেগে ; দেখি অনিমেখে ,
লক্ষ হৃদয়ে সাধ শূন্যে উড়ে যায় ।
কত দিক হতে তারা ধায় কত দিকে !
কত – না অদৃশ্যকায়া ছায়া – আলিঙ্গন
বিশ্বময় কারে চাহে , করে হায় – হায় ।
কত স্মৃতি খুঁজিতেছে শ্মশানশয়ন —
অন্ধকারে হেরো শত তৃষিত নয়ন
ছায়াময় পাখি হয়ে কার পানে ধায় ।
ক্ষীণশ্বাস – মুমূর্ষুর অতৃপ্ত বাসনা
ধরণীর কূলে কূলে ঘুরিয়া বেড়ায় ।
উদ্দেশে ঝরিছে কত অশ্রুবারিকণা ,
চরণ খুঁজিয়া তারা মরিবারে চায় ।
কে শুনিছে শত কোটি হৃদয়ের ডাক !
নিশীথিনী স্তব্ধ হয়ে রয়েছে অবাক ।
মোহ
এ মোহ ক ‘ দিন থাকে , এ মায়া মিলায় ,
কিছুতে পারে না আর বাঁধিয়া রাখিতে ।
কোমল বাহুর ডোর ছিন্ন হয়ে যায় ,
মদিরা উথলে নাকো মদির আঁখিতে ।
কেহ কারে নাহি চিনে আঁধার নিশায় ।
ফুল ফোটা সাঙ্গ হলে গাহে না পাখিতে ।
কোথা সেই হাসিপ্রান্ত চুম্বনতৃষিত
রাঙা পুষ্পটুকু যেন প্রস্ফুট অধর !
কোথা কুসুমিত তনু পূর্ণবিকশিত ,
কম্পিত পুলকভরে , যৌবনকাতর !
তখন কি মনে পড়ে সেই ব্যাকুলতা ,
সেই চিরপিপাসিত যৌবনের কথা ,
সেই প্রাণপরিপূর্ণ মরণ – অনল —
মনে পড়ে হাসি আসে ? চোখে আসে জল ?
যোগিয়া
বহুদিন পরে আজি মেঘ গেছে চলে ,
রবির কিরণসুধা আকাশে উথলে ।
স্নিগ্ধ শ্যাম পত্রপুটে আলোক ঝলকি উঠে
পুলক নাচিছে গাছে গাছে ।
নবীন যৌবন যেন প্রেমের মিলনে কাঁপে ,
আনন্দ বিদ্যুৎ – আলো নাচে ।
জুঁই সরোবরতীরে নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে
ঝরিয়া পড়িতে চায় ভুঁয়ে ,
অতি মৃদু হাসি তার , বরষার বৃষ্টিধার
গন্ধটুকু নিয়ে গেছে ধুয়ে ।
আজিকে আপন প্রাণে না জানি বা কোন্খানে
যোগিয়া রাগিণী গায় কে রে ।
ধীরে ধীরে সুর তার মিলাইছে চারি ধার ,
আচ্ছন্ন করিছে প্রভাতেরে ।
গাছপালা চারি ভিতে সংগীতের মাধুরীতে
মগ্ন হয়ে ধরে স্বপ্নছবি ।
এ প্রভাত মনে হয় আরেক প্রভাতময় ,
রবি যেন আর কোনো রবি ।
ভাবিতেছি মনে মনে কোথা কোন্ উপবনে
কী ভাবে সে গান গাইছে না জানি ,
চোখে তার অশ্রুরেখা একটু দেছে কি দেখা ,
ছড়ায়েছে চরণ দুখানি ।
তার কি পায়ের কাছে বাঁশিটি পড়িয়া আছে —
আলোছায়া পড়েছে কপোলে ।
মলিন মালাটি তুলি ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি
ভাসাইছে সরসীর জলে ।
বিষাদ – কাহিনী তার সাধ যায় শুনিবার
কোন্খানে তাহার ভবন ।
তাহার আঁখির কাছে যার মুখ জেগে আছে
তাহারে বা দেখিতে কেমন ।
এ কী রে আকুল ভাষা ! প্রাণের নিরাশ আশা
পল্লবের মর্মরে মিশালো ।
না জানি কাহারে চায় তার দেখা নাহি পায়
ম্লান তাই প্রভাতের আলো ।
এমন কত – না প্রাতে চাহিয়া আকাশপাতে
কত লোক ফেলেছে নিশ্বাস ,
সে – সব প্রভাত গেছে , তারা তার সাথে গেছে
লয়ে গেছে হৃদয় – হুতাশ !
এমন কত না আশা কত ম্লান ভালোবাসা
প্রতিদিন পড়িছে ঝরিয়া ,
তাদের হৃদয় – ব্যথা তাদের মরণ – গাথা
কে গাইছে একত্র করিয়া ,
পরস্পর পরস্পরে ডাকিতেছে নাম ধরে ,
কেহ তাহা শুনিতে না পায় ।
কাছে আসে , বসে পাশে , তবুও কথা না ভাষে ,
অশ্রুজলে ফিরে ফিরে যায় ।
চায় তবু নাহি পায় , অবশেষে নাহি চায় ,
অবশেষে নাহি গায় গান ,
ধীরে ধীরে শূন্য হিয়া বনের ছায়ায় গিয়া
মুছে আসে সজল নয়ান ।
যৌবন – স্বপ্ন
আমার যৌবনস্বপ্নে যেন ছেয়ে আছে বিশ্বের আকাশ ।
ফুলগুলি গায়ে এসে পড়ে রূপসীর পরশের মতো ।
পরানে পুলক বিকাশিয়া বহে কেন দক্ষিণা বাতাস
যেথা ছিল যত বিরহিণী সকলের কুড়ায়ে নিশ্বাস !
বসন্তের কুসুমকাননে গোলাপের আঁখি কেন নত ?
জগতের যত লাজময়ী যেন মোর আঁখির সকাশ ?
কাঁপিছে গোলাপ হয়ে এসে , মরমের শরমে বিব্রত !
প্রতি নিশি ঘুমাই যখন পাশে এসে বসে যেন কেহ ,
সচকিত স্বপনের মতো জাগরণে পলায় সলাজে ।
যেন কার আঁচলের বায় উষার পরশি যায় দেহ ,
শত নূপুরের রুনুঝুনু বনে যেন গুঞ্জরিয়া বাজে ।
মদির প্রাণের ব্যাকুলতা ফুটে ফুটে বকুলমুকুলে ;
কে আমারে করেছে পাগল — শূন্যে কেন চাই আঁখি তুলে !
যেন কোন্ উর্বশীর আঁখি চেয়ে আছে আকাশের মাঝে !
রাত্রি
জগতেরে জড়াইয়া শত পাকে যামিনীনাগিনী
আকাশ – পাতাল জুড়ি ছিল পড়ে নিদ্রায় মগনা ,
আপনার হিম দেহে আপনি বিলীনা একাকিনী ।
মিটিমিটি তারকায় জ্বলে তার অন্ধকার ফণা ।
উষা আসি মন্ত্র পড়ি বাজাইল ললিত রাগিণী ।
রাঙা আঁখি পাকালিয়া সাপিনী উঠিল তাই জাগি —
একে একে খুলে পাক , আঁকিবাঁকি কোথা যায় ভাগি ।
পশ্চিমসাগরতলে আছে বুঝি বিরাট গহ্বর ,
সেথায় ঘুমাবে বলে ডুবিতেছে বাসুকিভগিনী
মাথায় বহিয়া তার শত লক্ষ রতনের কণা ।
শিয়রেতে সারা দিন জেগে রবে বিপুল সাগর —
নিভৃতে স্তিমিত দীপে চুপি চুপি কহিয়া কাহিনী
মিলি কত নাগবালা স্বপ্নমালা করিবে রচনা ।
শরতের শুকতারা
একাদশী রজনী
পোহায় ধীরে ধীরে —
রাঙা মেঘ দাঁড়ায়
উষারে ঘিরে ঘিরে ।
ক্ষীণ চাঁদ নভের
আড়ালে যেতে চায় ,
মাঝখানে দাঁড়ায়ে
কিনারা নাহি পায় ।
বড়ো ম্লান হয়েছে
চাঁদের মুখখানি ,
আপনাতে আপনি
মিশাবে অনুমানি ।
হেরো দেখো কে ওই
এসেছে তার কাছে ,
শুকতারা চাঁদের
মুখেতে চেয়ে আছে ।
মরি মরি কে তুমি
একটুখানি প্রাণ ,
কী না জানি এনেছ
করিতে ওরে দান ।
চেয়ে দেখো আকাশে
আর তো কেহ নাই ,
তারা যত গিয়েছে
যে যার নিজ ঠাঁই ।
সাথীহারা চন্দ্রমা
হেরিছে চারি ধার ,
শূন্য আহা নিশির
বাসর-ঘর তার!
শরতের প্রভাতে
বিমল মুখ নিয়ে
তুমি শুধু রয়েছে
শিয়রে দাঁড়াইয়ে ।
ও হয়তো দেখিতে
পেলে না মুখ তোর!
ও হয়তো তারার
খেলার গান গায় ,
ও হয়তো বিরাগে
উদাসী হতে চায়!
ও কেবল নিশির
হাসির অবশেষ!
ও কেবল অতীত
সুখের স্মৃতিলেশ!
দ্রুতপদে তাহারা
কোথায় চলে গেছে —
সাথে যেতে পারে নি
পিছনে পড় আছে!
কত দিন উঠেছ
নিশির শেষাশেষি ,
দেখিয়াছ চাঁদেতে
তারাতে মেশামেশি!
দুই দণ্ড চাহিয়া
আবার চলে যেতে ,
মুখখানি লুকাতে
উষার আঁচলেতে ।
পুরবের একান্তে
একটু দিয়ে দেখা ,
কী ভাবিয়া তখনি
ফিরিতে একা একা ।
আজ তুমি দেখেছ
চাঁদের কেহ নাই ,
স্নেহময়ি , আপনি
এসেছ তুমি তাই!
দেহখানি মিলায়
মিলায় বুঝি তার!
হাসিটুকু রহে না
রহে না বুঝি আর!
দুই দণ্ড পরে তো
রবে না কিছু হায়!
কোথা তুমি , কোথায়
চাঁদের ক্ষীণকায়!
কোলাহল তুলিয়া
গরবে আসে দিন ,
দুটি ছোটো প্রাণের
লিখন হবে লীন ।
সুখশ্রমে মলিন
চাঁদের একসনে
নবপ্রেম মিলাবে
কাহার রবে মনে!
শান্তি
থাক্ থাক্ চুপ কর্ তোরা , ও আমার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে ।
আবার যদি জেগে ওঠে বাছা কান্না দেখে কান্না পাবে যে ।
কত হাসি হেসে গেছে ও , মুছে গেছে কত অশ্রুধার ,
হেসে কেঁদে আজ ঘুমাল , ওরে তোরা কাঁদাস নে আর ।
কত রাত গিয়েছিল হায় , বসেছিল বসন্তের বায় ,
পুবের জানালাখানি দিয়ে চন্দ্রালোক পড়েছিল গায় ;
কত রাত গিয়েছিল হায় , দূর হতে বেজেছিল বাঁশি ,
সুরগুলি কেঁদে ফিরেছিল বিছানার কাছে কাছে আসি ।
কত রাত গিয়েছিল হায় , কোলেতে শুকানো ফুলমালা
নত মুখে উলটি পালটি চেয়ে চেয়ে কেঁদেছিল বালা ।
কত দিন ভোরে শুকতারা উঠেছিল ওর আঁখি -‘ পরে ,
সমুখের কুসুম – কাননে ফুল ফুটেছিল থরে থরে ।
একটি ছেলেরে কোলে নিয়ে বলেছিল সোহাগের ভাষা ,
কারেও বা ভালোবেসেছিল , পেয়েছিল কারো ভালোবাসা !
হেসে হেসে গলাগলি করে খেলেছিল যাহাদের নিয়ে
আজো তারা ওই খেলা করে , ওর খেলা গিয়েছে ফুরিয়ে ।
সেই রবি উঠেছে সকালে ফুটেছে সুমুখে সেই ফুল ,
ও কখন খেলাতে খেলাতে মাঝখানে ঘুমিয়ে আকুল ।
শ্রান্ত দেহ , নিস্পন্দ নয়ন , ভুলে গেছে হৃদয় – বেদনা ।
চুপ করে চেয়ে দেখো ওরে , থামো থামো , হেসো না কেঁদো না ।
শেষ কথা
মনে হয় কী একটি শেষ কথা আছে ,
সে কথা হইলে বলা সব বলা হয় ।
কল্পনা কাঁদিয়া ফিরে তারি পাছে পাছে ,
তারি তরে চেয়ে আছে সমস্ত হৃদয় ।
শত গান উঠিতেছে তারি অন্বেষণে ,
পাখির মতন ধায় চরাচরময় ।
শত গান ম’রে গিয়ে , নূতন জীবনে
একটি কথায় চাহে হইতে বিলয় ।
সে কথা হইলে বলা নীরব বাঁশরি ,
আর বাজাব না বীণা চিরদিন – তরে ।
সে কথা শুনিতে সবে আছে আশা করি ,
মানব এখনো তাই ফিরিছে না ঘরে ।
সে কথায় আপনারে পাইব জানিতে ,
আপনি কৃতার্থ হব আপন বাণীতে ।
শ্রান্তি
সুখশ্রমে আমি , সখী , শ্রান্ত অতিশয় ;
পড়েছে শিথিল হয়ে শিরার বন্ধন ।
অসহ্য কোমল ঠেকে কুসুমশয়ন ,
কুসুমরেণুর সাথে হয়ে যাই লয় ।
স্বপনের জালে যেন পড়েছি জড়ায়ে ।
যেন কোন্ অস্তাচলে সন্ধ্যাস্বপ্নময়
রবির ছবির মতো যেতেছি গড়ায়ে ,
সুদূরে মিলিয়া যায় নিখিলনিলয় ।
ডুবিতে ডুবিতে যেন সুখের সাগরে
কোথাও না পাই ঠাঁই , শ্বাস রুদ্ধ হয় —
পরান কাঁদিতে থাকে মৃত্তিকার তরে ।
এ যে সৌরভের বেড়া , পাষাণের নয় —
কেমনে ভাঙিতে হবে ভাবিয়া না পাই ,
অসীম নিদ্রার ভারে পড়ে আছি তাই ।
সত্য
১
ভয়ে ভয়ে ভ্রমিতেছি মানবের মাঝে
হৃদয়ের আলোটুকু নিবে গেছে ব’লে !
কে কী বলে তাই শুনে মরিতেছি লাজে ,
কী হয় কী হয় ভেবে ভয়ে প্রাণ দোলে !
‘ আলো’ ‘আলো’ খুঁজে মরি পরের নয়নে ,
‘ আলো’ ‘আলো’ খুঁজে খুঁজে কাঁদি পথে পথে ,
অবশেষে শুয়ে পড়ি ধূলির শয়নে —
ভয় হয় এক পদ অগ্রসর হতে !
বজ্রের আলোক দিয়ে ভাঙো অন্ধকার ,
হৃদি যদি ভেঙে যায় সেও তবু ভালো ।
যে গৃহে জানালা নাই সে তো কারাগার —
ভেঙে ফেলো , আসিবেক স্বরগের আলো ।
হায় হায় কোথা সেই অখিলের জ্যোতি !
চলিব সরল পথে অশঙ্কিতগতি !
২
জ্বালায়ে আঁধার শূন্যে কোটি রবিশশী
দাঁড়ায়ে রয়েছ একা অসীমসুন্দর ।
সুগভীর শান্ত নেত্র রয়েছে বিকশি ,
চিরস্থির শুভ্র হাসি , প্রসন্ন অধর ।
আনন্দে আঁধার মরে চরণ পরশি ,
লাজ ভয় লাজে ভয়ে মিলাইয়া যায় —
আপন মহিমা হেরি আপনি হরষি
চরাচর শির তুলি তোমাপানে চায় ।
আমার হৃদয়দীপ আঁধার হেথায় ,
ধূলি হতে তুলি এরে দাও জ্বালাইয়া —
ওই ধ্রুবতারাখানি রেখেছ যেথায়
সেই গগনের প্রান্তে রাখো ঝুলাইয়া ।
চিরদিন জেগে রবে নিবিবে না আর ,
চিরদিন দেখাইবে আঁধারের পার ।
সমুদ্র
কিসের অশান্তি এই মহাপারাবারে ,
সতত ছিঁড়িতে চাহে কিসের বন্ধন !
অব্যক্ত অস্ফুট বাণী ব্যক্ত করিবারে
শিশুর মতন সিন্ধু করিছে ক্রন্দন ।
যুগযুগান্তর ধরি যোজন যোজন
ফুলিয়া ফুলিয়া উঠে উত্তাল উচ্ছ্বাস —
অশান্ত বিপুল প্রাণ করিছে গর্জন ,
নীরবে শুনিছে তাই প্রশান্ত আকাশ ।
আছাড়ি চূর্ণিতে চাহে সমগ্র হৃদয়
কঠিন পাষাণময় ধরণীর তীরে ,
জোয়ারে সাধিতে চায় আপন প্রলয় ,
ভাঁটায় মিলাতে চায় আপনার নীরে ।
অন্ধ প্রকৃতির হৃদে মৃত্তিকায় বাঁধা ।
সতত দুলিছে ওই অশ্রুর পাথার ,
উন্মুখী বাসনা পায় পদে পদে বাধা ,
কাঁদিয়া ভাসাতে চাহে জগৎ-সংসার ।
সাগরের কণ্ঠ হতে কেড়ে নিয়ে কথা
সাধ যায় ব্যক্ত করি মানবভাষায় —
শান্ত করে দিই ওই চির-ব্যাকুলতা ,
সমুদ্রবায়ুর ওই চির হায়-হায় ।
সাধ যায় মোর গীতে দিবস-রজনী
ধ্বনিবে পৃথিবী-ঘেরা সংগীতের ধ্বনি ।
সারাবেলা
হেলাফেলা সারাবেলা
এ কী খেলা আপন – সনে !
এই বাতাসে ফুলের বাসে
মুখখানি কার পড়ে মনে !
আঁখির কাছে বেড়ায় ভাসি
কে জানে গো কাহার হাসি !
দুটি ফোঁটা নয়নসলিল
রেখে যায় এই নয়ন কোণে ।
কোন্ ছায়াতে কোন্ উদাসী
দূরে বাজায় অলস বাঁশি ,
মনে হয় কার মনের বেদন
কেঁদে বেড়ায় বাঁশির গানে ।
সারাদিন গাঁথি গান
কারে চাহে , গাহে প্রাণ ,
তরুতলের ছায়ার মতন
বসে আছি ফুলবনে ।
সিন্ধুগর্ভ
উপরে স্রোতের ভরে ভাসে চরাচর
নীল সমুদ্রের’পরে নৃত্য ক’রে সারা ।
কোথা হতে ঝরে যেন অনন্ত নির্ঝর ,
ঝরে আলোকের কণা রবি শশী তারা ।
ঝরে প্রাণ , ঝরে গান , ঝরে প্রেমধারা —
পূর্ণ করিবারে চায় আকাশ সাগর ।
সহসা কে ডুবে যায় জলবিম্বপারা —
দু – একটি আলো – রেখা যায় মিলাইয়া ,
তখন ভাবিতে বসি কোথায় কিনারা —
কোন্ অতলের পানে ধাই তলাইয়া !
নিম্নে জাগে সিন্ধুগর্ভ স্তব্ধ অন্ধকার ।
কোথা নিবে যায় আলো , থেমে যায় গীত —
কোথা চিরদিন তরে অসীম আড়াল !
কোথায় ডুবিয়া গেছে অনন্ত অতীত !
» সিন্ধুতীরে
হেথা নাই ক্ষুদ্র কথা , তুচ্ছ কানাকানি ,
ধ্বনিত হতেছে চিরদিবসের বাণী ।
চিরদিবসের রবি ওঠে , অস্ত যায় ,
চিরদিবসের কবি গাহিছে হেথায় ।
ধরণীর চারি দিকে সীমাশূন্য গানে
সিন্ধু শত তটিনীরে করিছে আহ্বান —
হেথায় দেখিলে চেয়ে আপনার পানে
দুই চোখে জল আসে , কেঁদে ওঠে প্রাণ ।
শত যুগ হেথা বসে মুখপানে চায় ,
বিশাল আকাশে পাই হৃদয়ের সাড়া ।
তীব্র বক্র ক্ষুদ্র হাসি পায় যদি ছাড়া
রবির কিরণে এসে মরে সে লজ্জায় ।
সবারে আনিতে বুকে বুক বেড়ে যায় ,
সবারে করিতে ক্ষমা আপনারে ছাড়া ।
স্তন
১
নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল ,
বিকশিত যৌবনের বসন্তসমীরে
কুসুমিত হয়ে ওই ফুটেছে বাহিরে ,
সৌরভসুধায় করে পরান পাগল ।
মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল
উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে ।
কী যেন বাঁশির ডাকে জগতের প্রেমে
বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয় ,
সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে —
শরমে মরিতে চায় অঞ্চল – আড়ালে ।
প্রেমের সংগীত যেন বিকশিয়া রয় ,
উঠিছে পড়িছে ধীরে হৃদয়ের তালে ।
হেরো গো কমলাসন জননী লক্ষ্মীর —
হেরো নারীহৃদয়ের পবিত্র মন্দির ।
২
পবিত্র সুমেরু বটে এই সে হেথায় ,
দেবতা বিহারভূমি কনক – অচল ।
উন্নত সতীর স্তন স্বরগ প্রভায়
মানবের মর্ত্যভূমি করেছে উজ্জ্বল ।
শিশু রবি হোথা হতে ওঠে সুপ্রভাতে ,
শ্রান্ত রবি সন্ধ্যাবেলা হোথা অস্ত যায় ।
দেবতার আঁখিতারা জেগে থাকে রাতে ,
বিমল পবিত্র দুটি বিজন শিখরে ।
চিরস্নেহ – উৎসধারে অমৃত নির্ঝরে
সিক্ত করি তুলিতেছে বিশ্বের অধর ।
জাগে সদা সুখসুপ্ত ধরণীর’পরে ,
অসহায় জগতের অসীম নির্ভর ।
ধরণীর মাঝে থাকি স্বর্গ আছে চুমি ,
দেবশিশু মানবের ওই মাতৃভূমি ।
স্বপ্নরুদ্ধ
নিষ্ফল হয়েছি আমি সংসারের কাজে ,
লোকমাঝে আঁখি তুলে পারি না চাহিতে ।
ভাসায়ে জীবনতরী সাগরের মাঝে
তরঙ্গ লঙ্ঘন করি পারি না বাহিতে ।
পুরুষের মতো যত মানবের সাথে
যোগ দিতে পারি নাকো লয়ে নিজ বল ,
সহস্র সংকল্প শুধু ভরা দুই হাতে
বিফলে শুকায় যেন লক্ষ্মণের ফল ।
আমি গাঁথি আপনার চারি দিক ঘিরে
সূক্ষ্ম রেশমের জাল কীটের মতন ।
মগ্ন থাকি আপনার মধুর তিমিরে ,
দেখি না এ জগতের প্রকাণ্ড জীবন ।
কেন আমি আপনার অন্তরালে থাকি !
মুদ্রিত পাতার মাঝে কাঁদে অন্ধ আঁখি ।
স্মৃতি
ওই দেহ – পানে চেয়ে পড়ে মোর মনে
যেন কত শত পূর্বজনমের স্মৃতি ।
সহস্র হারানো সুখ আছে ও নয়নে ,
জন্মজন্মান্তের যেন বসন্তের গীতি ।
যেন গো আমারি তুমি আত্মবিস্মরণ ,
অনন্ত কালের মোর সুখ দুঃখ শোক ,
কত নব জগতের কুসুমকানন ,
কত নব আকাশের চাঁদের আলোক ।
কত দিবসের তুমি বিরহের ব্যথা ,
কত রজনীর তুমি প্রণয়ের লাজ ,
সেই হাসি সেই অশ্রু সেই – সব কথা
মধুর মুরতি ধরি দেখা দিল আজ ।
তোমার মুখেতে চেয়ে তাই নিশিদিন
জীবন সুদূরে যেন হতেছে বিলীন !
হাসি
সুদূর প্রবাসে আজি কেন রে কী জানি
কেবল পড়িছে মনে তার হাসিখানি ।
কখন নামিয়া গেল সন্ধ্যার তপন ,
কখন থামিয়া গেল সাগরের বাণী ।
কোথায় ধরার ধারে বিরহবিজন
একটি মাধবীলতা আপন ছায়াতে
দুটি অধরের রাঙা কিশলয় – পাতে
হাসিটি রেখেছে ঢেকে কুঁড়ির মতন !
সারা রাত নয়নের সলিল সিঞ্চিয়া
রেখেছে কাহার তরে যতনে সঞ্চিয়া!
সে হাসিটি কে আসিয়া করিবে চয়ন ,
লুব্ধ এই জগতের সবারে বঞ্চিয়া !
তখন দুখানি হাসি মরিয়া বাঁচিয়া
তুলিবে অমর করি একটি চুম্বন ।
হৃদয় – আকাশ
আমি ধরা দিয়েছি গো আকাশের পাখি ,
নয়নে দেখেছি তব নূতন আকাশ ।
দুখানি আঁখির পাতে কী রেখেছ ঢাকি ,
হাসিলে ফুটিয়া পড়ে উষার আভাস ।
হৃদয় উড়িতে চায় হোথায় একাকী
আঁখিতারকার দেশে করিবারে বাস ।
ঐ গগনেতে চেয়ে উঠিয়াছে ডাকি ,
হোথায় হারাতে চায় এ গীত – উচ্ছ্বাস ।
তোমার হৃদয়াকাশ অসীম বিজন —
বিমল নীলিমা তার শান্ত সুকুমার ,
যদি নিয়ে যাই ওই শূন্য হয়ে পার
আমার দুখানি পাখা কনকবরন ।
হৃদয় চাতক হয়ে চাবে অশ্রুধার ,
হৃদয়চকোর চাবে হাসির কিরণ ।
হৃদয়- আসন
কোমল দুখানি বাহু শরমে লতায়ে
বিকশিত স্তন দুটি আগুলিয়া রয় ,
তারি মাঝখানে কি রে রয়েছে লুকায়ে
অতিশয় সযতন গোপন হৃদয় !
সেই নিরালায় , সেই কোমল আসনে ,
দুইখানি স্নেহস্ফুট স্তনের ছায়ায় ,
কিশোর প্রেমের মৃদু প্রদোষকিরণে
আনত আঁখির তলে রাখিবে আমায় !
কত – না মধুর আশা ফুটিছে সেথায় —
গভীর নিশীথে কত বিজন কল্পনা ,
উদাস নিশ্বাসবায়ু বসন্তসন্ধ্যায় ,
গোপনে চাঁদিনী রাতে দুটি অশ্রুকণা !
তারি মাঝে আমারে কি রাখিবে যতনে
হৃদয়ের সুমধুর স্বপন – শয়নে !
হৃদয়ের ভাষা
হৃদয় , কেন গো মোরে ছলিছ সতত ,
আপনার ভাষা তুমি শিখাও আমায় ।
প্রত্যহ আকুল কন্ঠে গাহিতেছি কত ,
ভগ্ন বাঁশরিতে শ্বাস করে হায় হায় !
সন্ধ্যাকালে নেমে যায় নীরব তপন
সুনীল আকাশ হতে সুনীল সাগরে ।
আমার মনের কথা , প্রাণের স্বপন
ভাসিয়া উঠিছে যেন আকাশের ‘পরে ।
ধ্বনিছে সন্ধ্যার মাঝে কার শান্ত বাণী ,
ও কি রে আমারি গান ? ভাবিতেছি তাই ।
প্রাণের যে কথাগুলি আমি নাহি জানি
সে – কথা কেমন করে জেনেছে সবাই ।
মোর হৃদয়ের গান সকলেই গায় ,
গাহিতে পারি নে তাহা আমি শুধু হায় ।
১.উৎসর্গ ও কবির মন্তব্য (কড়ি ও কোমল)
উৎসর্গ
শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
দাদা মহাশয়
করকমলেষু
কবির মন্তব্য
যৌবন হচ্ছে জীবনে সেই ঋতুপরিবর্তনের সময় যখন ফুল ও ফসলের প্রচ্ছন্ন প্রেরণা নানা বর্ণে ও রূপে অকস্মাৎ বাহিরে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। কড়ি ও কোমল আমার সেই নবযৌবনের রচনা। আত্মপ্রকাশের একটা প্রবল আবেগ তখন যেন প্রথম উপলব্ধি করেছিলুম। মনে পড়ে তখনকার দিনে নিজের মনের একটা উদ্ বেল অবস্থা। তখন আমার বেশভূষায় আবরণ ছিল বিরল। গায়ে থাকত ধুতির সঙ্গে কেবল একটা পাতলা চাদর, তার খুঁটোয় বাঁধা ভোরবেলায় তোলা একমুঠো বেলফুল, পায়ে একজোড়া চটি। মনে আছে থ্যাকারের দোকানে বই কিনতে গেছি কিন্তু এর বেশি পরিচ্ছন্নতা নেই, এতে ইংরেজ দোকানদারের স্বীকৃত আদবকায়দার প্রতি উপেক্ষা প্রকাশ হত। এই আত্মবিস্মৃত বেআইনী প্রমত্ততা কড়ি ও কোমলের কবিতায় অবাধে প্রকাশ পেয়েছিল। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে এই রীতির কবিতা তখনো প্রচলিত ছিল না। সেইজন্যেই কাব্যবিশারদ প্রভৃতি সাহিত্যবিচারকদের কাছ থেকে কটুভাষায় ভর্ৎসনা সহ্য করেছিলুম। সে-সব যে উপেক্ষা করেছি অনায়াসে সে কেবল যৌবনের তেজে। আপনার মধ্যে থেকে যা প্রকাশ পাচ্ছিল, সে আমার কাছেও ছিল নূতন এবং আন্তরিক। তখন হেম বাঁড়ুজ্জে এবং নবীন সেন ছাড়া এমন কোনো দেশপ্রসিদ্ধ কবি ছিলেন না যাঁরা নূতন কবিদের কোনো-একটা কাব্যরীতির বাঁধা পথে চালনা করতে পারতেন। কিন্তু আমি তাঁদের সম্পূর্ণই ভুলে ছিলুম। আমাদের পরিবারের বন্ধু কবি বিহারীলালকে ছেলেবেলা থেকে জানতুম এবং তাঁর কবিতার প্রতি অনুরাগ আমার ছিল অভ্যস্ত। তাঁর প্রবর্তিত কবিতার রীতি ইতিপূর্বেই আমার রচনা থেকে সম্পূর্ণ স্খলিত হয়ে গিয়েছিল। বড়োদাদার স্বপ্নপ্রয়াণের আমি ছিলুম অত্যন্ত ভক্ত, কিন্তু তাঁর বিশেষ কবিপ্রকৃতির সঙ্গে আমার বোধ হয় মিল ছিল না, সেইজন্য ভালোলাগা সত্ত্বেও তাঁর প্রভাব আমার কবিতা গ্রহণ করতে পারে নি। তাই কড়ি ও কোমলের কবিতা মনের অন্তঃস্তরের উৎসের থেকে উছলে উঠেছিল। তার সঙ্গে বাহিরের কোনো মিশ্রণ যদি ঘটে থাকে তো সে গৌণভাবে।
এই আমার প্রথম কবিতার বই যার মধ্যে বিষয়ের বৈচিত্র্য এবং বহির্দৃষ্টিপ্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর প্রথম আমি সেই কথা বলেছি যা পরবর্তী আমার কাব্যের অন্তরে অন্তরে বারবার প্রবাহিত হয়েছে—
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই —
যা নৈবেদ্যে আর-এক ভাবে প্রকাশ পেয়েছে—
বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়।
কড়ি ও কোমলের যৌবনের রসোচ্ছ্বাসের সঙ্গে আর-একটি প্রবল প্রবর্তনা প্রথম আমার কাব্যকে অধিকার করেছে, সে জীবনের পথে মৃত্যুর আবির্ভাব। যাঁরা আমার কাব্য মন দিয়ে পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবেন এই মৃত্যুর নিবিড় উপলব্ধি আমার কাব্যের এমন একটি বিশেষ ধারা, নানা বাণীতে যার প্রকাশ। কড়ি ও কোমলেই তার প্রথম উদ্ভব।
শান্তিনিকেতন
৭|১২|৩৯