পূর্ণ মিলন
নিশিদিন কাঁদি , সখী , মিলনের তরে
যে মিলন ক্ষুধাতুর মৃত্যুর মতন ।
লও লও বেঁধে লও কেড়ে লও মোরে —
লও লজ্জা , লও বস্ত্র , লও আবরণ ।
এ তরুণ তনুখানি লহ চুরি করে —
আঁখি হতে লও ঘুম , ঘুমের স্বপন ।
জাগ্রত বিপুল বিশ্ব লও তুমি হরে
অনন্তকালের মোর জীবন – মরণ ।
বিজন বিশ্বের মাঝে মিলনশ্মশানে
নির্বাপিতসূর্যালোক লুপ্ত চরাচর ,
লাজমুক্ত বাসমুক্ত দুটি নগ্ন প্রাণে
তোমাতে আমাতে হই অসীম সুন্দর ।
এ কী দুরাশার স্বপ্ন হায় গো ঈশ্বর ,
তোমা ছাড়া এ মিলন আছে কোন্খানে !
প্রত্যাশা
সকলে আমার কাছে যত কিছু চায়
সকলেরে আমি তাহা পেরেছি কি দিতে !
আমি কি দিই নি ফাঁকি কত জনে হায় ,
রেখেছি কত – না ঋণ এই পৃথিবীতে ।
আমি তবে কেন বকি সহস্র প্রলাপ ,
সকলের কাছে চাই ভিক্ষা কুড়াইতে !
এক তিল না পাইলে দিই অভিশাপ ,
অমনি কেন রে বসি কাতরে কাঁদিতে !
হা ঈশ্বর , আমি কিছু চাহি নাকো আর ,
ঘুচাও আমার এই ভিক্ষার বাসনা ।
মাথায় বহিয়া লয়ে চির ঋণভার
‘ পাইনি’ ‘পাইনি’ বলে আর কাঁদিব না ।
তোমারেও মাগিব না , অলস কাঁদনি —
আপনারে দিলে তুমি আসিবে আপনি ।
প্রাণ
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে ,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই ।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয় – মাঝে যদি স্থান পাই ।
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত ,
বিরহ মিলন কত হাসি – অশ্রু – ময় ,
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর – আলয় ।
তা যদি না পারি তবে বাঁচি যত কাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই ,
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই ।
হাসিমুখে নিয়ো ফুল , তার পরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল , যদি সে ফুল শুকায় ।
প্রার্থনা
তুমি কাছে নাই ব’লে হেরো , সখা , তাই
‘আমি বড়ো’ ‘আমি বড়ো’ করিছে সবাই ।
সকলেই উঁচু হয়ে দাঁড়ায়ে সমুখে
বলিতেছে , ‘ এ জগতে আর কিছু নাই । ‘
নাথ , তুমি একবার এসো হাসিমুখে
এরা সবে ম্লান হয়ে লুকাক লজ্জায় —
সুখদুঃখ টুটে যাক তব মহাসুখে ,
যাক আলো-অন্ধকার তোমার প্রভায় ।
নহিলে ডুবেছি আমি , মরেছি হেথায় ,
নহিলে ঘুচে না আর মর্মের ক্রন্দন —
শুষ্ক ধূলি তুলি শুধু সুধাপিপাসায় ,
প্রেম ব’লে পরিয়াছি মরণবন্ধন ।
কভু পড়ি কভু উঠি , হাসি আর কাঁদি —
খেলাঘর ভেঙে প’ড়ে রচিবে সমাধি ।
বঙ্গবাসীর প্রতি
আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না ।
এ কি শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা
শুধু মিছে কথা ছলনা !
আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না ।
এ যে নয়নের জল , হতাশের শ্বাস ,
কলঙ্কের কথা দরিদ্রের আশ ,
এ যে বুক – ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে
গভীর মরমবেদনা ।
এ কি শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা ,
শুধু মিছে কথা ছলনা !
এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি
কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি ,
মিছে কথা কয়ে মিছে যশ লয়ে
মিছে কাজে নিশিযাপনা !
কে জাগিবে আজ , কে করিবে কাজ ,
কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ —
কাতরে কাঁদিবে , মা ‘ র পায়ে দিবে
সকল প্রাণের কামনা ।
এ কি শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা ,
শুধু মিছে কথা ছলনা !
বঙ্গভূমির প্রতি
কেন চেয়ে আছ , গো মা , মুখপানে !
এরা চাহে না তোমারে চাহে না যে ,
আপন মায়েরে নাহি জানে !
এরা তোমায় কিছু দেবে না , দেবে না —
মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভানে !
তুমি তো দিতেছ মা , যা আছে তোমারি —
স্বর্ণশস্য তব , জাহ্নবীবারি ,
জ্ঞান ধর্ম কত পুণ্যকাহিনী ।
এরা কী দেবে তোরে , কিছু না , কিছু না —
মিথ্যা কবে শুধু হীন পরানে !
মনের বেদনা রাখো , মা , মনে ,
নয়নবারি নিবারো নয়নে ,
মুখ লুকাও , মা , ধূলিশয়নে —
ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে ।
শূন্যপানে চেয়ে প্রহর গণি গণি
দেখো কাটে কি না দীর্ঘ রজনী
দুঃখ জানায়ে কী হবে , জননী ,
নির্মম চেতনহীন পাষাণে !
» বঙ্গভূমির প্রতি
কেন চেয়ে আছ , গো মা , মুখপানে !
এরা চাহে না তোমারে চাহে না যে ,
আপন মায়েরে নাহি জানে !
এরা তোমায় কিছু দেবে না , দেবে না —
মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভানে !
তুমি তো দিতেছ মা , যা আছে তোমারি —
স্বর্ণশস্য তব , জাহ্নবীবারি ,
জ্ঞান ধর্ম কত পুণ্যকাহিনী ।
এরা কী দেবে তোরে , কিছু না , কিছু না —
মিথ্যা কবে শুধু হীন পরানে !
মনের বেদনা রাখো , মা , মনে ,
নয়নবারি নিবারো নয়নে ,
মুখ লুকাও , মা , ধূলিশয়নে —
ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে ।
শূন্যপানে চেয়ে প্রহর গণি গণি
দেখো কাটে কি না দীর্ঘ রজনী
দুঃখ জানায়ে কী হবে , জননী ,
নির্মম চেতনহীন পাষাণে !
বনের ছায়া
কোথা রে তরুর ছায়া , বনের শ্যামল স্নেহ ।
তট-তরু কোলে কোলে সারাদিন কলরোলে
স্রোতস্বিনী যায় চলে সুদূরে সাধের গেহ ;
কোথা রে তরুর ছায়া , বনের শ্যামল স্নেহ ;
কোথা রে সুনীল দিশে বনান্ত রয়েছে মিশে
অনন্তের অনিমিষে নয়ন নিমেষ-হারা ।
দূর হতে বায়ু এসে চলে যায় দূর-দেশে
গীত – গান যায় ভেসে , কোন্ দেশে যায় তারা ।
হাসি , বাঁশি , পরিহাস , বিমল সুখের শ্বাস ,
মেলামেশা বারো মাস নদীর শ্যামল তীরে ;
কেহ খেলে , কেহ দোলে , ঘুমায় ছায়ার কোলে ,
বেলা শুধু যায় চলে কুলুকুলু নদীনীরে ।
বকুল কুড়োয় কেহ , কেহ গাঁথে মালাখানি ;
ছায়াতে ছায়ার প্রায় বসে বসে গান গায় ,
করিতেছে কে কোথায় চুপিচুপি কানাকানি ।
খুলে গেছে চুলগুলি , বাঁধিতে গিয়েছে ভুলি ,
আঙুলে ধরেছে তুলি আঁখি পাছে ঢেকে যায় ,
কাঁকন খসিয়া গেছে , খুঁজিছে গাছের ছায় ।
বনের মর্মের মাঝে বিজনে বাঁশরি বাজে ,
তারি সুরে মাঝে মাঝে ঘুঘু দুটি গান গায় ।
ঝুরু ঝুরু কত পাতা গাহিছে বনের গাথা ,
কত-না মনের কথা তারি সাথে মিশে যায় ।
লতাপাতা কত শত খেলে কাঁপে কত মতো
ছোটো ছোটো আলোছায়া ঝিকিমিকি বন ছেয়ে ,
তারি সাথে তারি মতো খেলে কত ছেলেমেয়ে ।