পত্র
নৌকাযাত্রা হইতে ফিরিয়া আসিয়া লিখিত
সুহৃদ্বর শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ সেন স্থলচরবরেষু
জলে বাসা বেঁধেছিলেম , ডাঙায় বড়ো কিচিমিচি ।
সবাই গলা জাহির করে , চেঁচায় কেবল মিছিমিছি ।
সস্তা লেখক কোকিয়ে মরে , ঢাক নিয়ে সে খালি পিটোয় ,
ভদ্রলোকের গায়ে পড়ে কলম নেড়ে কালি ছিটোয় ।
এখানে যে বাস করা দায় ভনভনানির বাজারে ,
প্রাণের মধ্যে গুলিয়ে উঠে হট্টগোলের মাঝারে ।
কানে যখন তালা ধরে , উঠি যখন হাঁপিয়ে
কোথায় পালাই , কোথায় পালাই — জলে পড়ি ঝাঁপিয়ে
গঙ্গাপ্রাপ্তির আশা করে গঙ্গাযাত্রা করেছিলেম ।
তোমাদের না বলে কয়ে আস্তে আস্তে সরেছিলেম ।
দুনিয়ার এ মজলিসেতে এসেছিলেম গান শুনতে ,
আপন মনে গুনগুনিয়ে রাগ – রাগিণীর জাল বুনতে ।
গান শোনে সে কাহার সাধ্যি , ছোঁড়াগুলো বাজায় বাদ্যি ,
বিদ্যেখানা ফাটিয়ে ফেলে থাকে তারা তুলো ধুনতে ।
ডেকে বলে , হেঁকে বলে , ভঙ্গি করে বেঁকে বলে —
‘‘ আমার কথা শোনো সবাই , গান শোনো আর নাই শোনো।
গান যে কাকে বলে সেইটে বুঝিয়ে দেব , তাই শোনে । ”
টীকে করেন ব্যখ্যা করেন , জেঁকে ওঠে বক্তিমে —
কে দেখে তার হাত – পা নাড়া , চক্ষু দুটোর রক্তিমে !
চন্দ্রসূর্য জ্বলছে মিছে আকাশখানার চালাতে —
তিনি বলেন , ‘‘ আমিই আছি জ্বলতে এবং জ্বালাতে । ”’
কুঞ্জবনের তানপুরোতে সুর বেঁধেছে বসন্ত ,
সেটা শুনে নাড়েন কর্ণ , হয় নাকো তাঁর পছন্দ ।
তাঁরি সুরে গাক – না সবাই টপ্পা খেয়াল ধুরবোধ —
গায় না যে কেউ , আসল কথা নাইকো কারো সুর – বোধ !
কাগজওয়ালা সারি সারি নাড়ছে কাগজ হাতে নিয়ে —
বাঙলা থেকে শান্তি বিদায় তিনশো কুলোর বাতাস দিয়ে ।
কাগজ দিয়ে নৌকা বানায় বেকার যত ছেলেপিলে ,
কর্ণ ধরে পার করবেন দু – এক পয়সা খেয়া দিলে ।
সস্তা শুনে ছুটে আসে যত দীর্ঘকর্ণগুলো —
বঙ্গদেশের চতুর্দিকে তাই উড়ছে এত ধুলো ।
খুদে খুদে ‘আর্য’ গুলো ঘাসের মতো গজিয়ে ওঠে ,
ছুঁচোলো সব জিবের ডগা কাঁটার মতো পায়ে ফোটে ।
তাঁরা বলেন , ‘‘ আমিই কল্কি” — গাঁজার কল্কি হবে বুঝি !
অবতারে ভরে গেল যত রাজ্যের গলিঘুঁজি ।
পাড়ার এমন কত আছে কত কব তার !
বঙ্গদেশে মেলাই এল বরা ‘- অবতার ।
দাঁতের জোরে হিন্দুশাস্ত্র তুলবে তারা পাঁকের থেকে ,
দাঁতকপাটি লাগে তাদের দাঁত – খিঁচুনির ভঙ্গি দেখে ।
আগাগোড়াই মিথ্যে কথা , মিথ্যেবাদীর কোলাহল ,
জিব নাচিয়ে বেড়ায় যত জিহ্বাওয়ালা সঙের দল ।
বাক্যবন্যা ফেনিয়ে আসে , ভাসিয়ে নে যায় তোড়ে —
কোনোক্রমে রক্ষে পেলাম মা – গঙ্গারই ক্রোড়ে ।
হেথায় কিবা শান্তি – ঢালা কুলুকুলু তান !
সাগর – পানে বহন করে গিরিরাজের গান ।
ধীরি ধীরি বাতাসটি দেয় জলের গায়ে কাঁটা ।
আকাশেতে আলো – আঁধার খেলে জোয়ারভাঁটা ।
তীরে তীরে গাছের সারি পল্লবেরই ঢেউ ।
সারা দিবস হেলে দোলে , দেখে না তো কেউ ।
পূর্বতীরে তরুশিরে অরুণ হেসে চায় —
পশ্চিমেতে কুঞ্জমাঝে সন্ধ্যা নেমে যায় ।
তীরে ওঠে শঙ্খধ্বনি , ধীরে আসে কানে ,
সন্ধ্যাতারা চেয়ে থাকে ধরণীর পানে ।
ঝাউবনের আড়ালেতে চাঁদ ওঠে ধীরে ,
ফোটে সন্ধ্যাদীপগুলি অন্ধকার তীরে ।
এই শান্তি – সলিলেতে দিয়েছিলেম ডুব ,
হট্টগোলটা ভুলেছিলেম , সুখে ছিলেম খুব ।
জান তো ভাই আমি হচ্ছি জলচরের জাত ,
আপন মনে সাঁতরে বেড়াই — ভাসি যে দিনরাত ।
রোদ পোহাতে ডাঙায় উঠি , হাওয়াটি খাই চোখ বুজে ,
ভয়ে ভয়ে কাছে এগোই তেমন তেমন লোক বুঝে ।
গতিক মন্দ দেখলে আবার ডুবি অগাধ জলে ,
এমনি করেই দিনটা কাটাই লুকোচুরির ছলে ।
তুমি কেন ছিপ ফেলেছ শুকনো ডাঙায় বসে ?
বুকের কাছে বিদ্ধ করে টান মেরেছ কষে ।
আমি তোমায় জলে টানি , তুমি ডাঙায় টানো —
অটল হয়ে বসে আছ , হার তো নাহি মানো ।
আমারি নয় হার হয়েছে , তোমারি নয় জিত —
খাবি খাচ্ছি ডাঙায় পড়ে হয়ে পড়ে চিত ।
আর কেন ভাই , ঘরে চলো ছিপ গুটিয়ে নাও ,
রবীন্দ্রনাথ পড়ল ধরা ঢাক পিটিয়ে দাও ।
পত্র
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু
স্টীমার । খুলনা
মাগো আমার লক্ষ্মী ,
মনিষ্যি না পক্ষী!
এই ছিলেম তরীতে ,
কোথায় এনু ত্বরিতে!
কাল ছিলেম খুলনায় ,
তাতে তো আর ভুল নাই ,
কলকাতায় এসেছি সদ্য ,
বসে বসে লিখছি পদ্য ।
তোদের ফেলে সারাটা দিন
আছি অমনি এক রকম ,
খোপে বসে পায়রা যেন
করছি কেবল বক্বকম!
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
মেঘ করেছে আকাশে ,
উষার রাঙা মুখখানি গো
কেমন যেন ফ্যাকাশে!
বাড়িতে যে কেউ কোথা নেই
দুয়োরগুলো ভেজানো ,
ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়াই
ঘরে আছে কে যেন!
পক্ষীটি সেই ঝুপসি হয়ে
ঝিমচ্ছে রে খাঁচাতে ,
ভুলে গেছে নেচে নেচে
পুচ্ছটি তার নাচাতে ।
ঘরের কোণে আপন মনে
শূন্য পড়ে বিছেনা ,
কাহার তরে কেঁদে মরে
সে কথাটা মিছে না!
বইগুলো সব ছড়িয়ে প ‘ ড়ে
নাম লেখা তায় কার গো!
এমনি তারা রবে কি রে
খুলবে না কেউ আর গো!
এটা আছে সেটা আছে
অভাব কিছু নেই তো ,
স্মরণ করে দেয় রে যারে
থাকে নাকো সেই তো!
বাগানে ওই দুটো গাছে
ফুল ফুটেছে রাশি রাশি ,
ফুলের গন্ধে মনে পড়ে
ফুল কে আমায় দিত মেলা ,
বিছেনায় কার মুখটি দেখে
সকাল হত সকালবেলা!
জল থেকে তুই আসবি কবে
মাটির লক্ষ্মী মাটিতে
ঠাকুরবাবুর ছয় নম্বর
জোড়াসাঁকোর বাটীতে!
ইস্টিম ওই রে ফুরিয়ে এল
নোঙর তবে ফেলি অদ্য ।
অবিদিত নেই তো তোমার
রবিকাকা কুঁড়ের হদ্দ!
আজকে নাকি মেঘ করেছে
ঠেকছে কেমন ফাঁকা-ফাঁকা ,
তাই খানিকটা ফোঁসফোঁসিয়ে
বিদায় হল —
রবিকাকা ।
পত্র
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু
স্টীমার । খুলনা
বসে বসে লিখলেম চিঠি
পুরিয়ে দিলাম চারটি পিঠই ,
পেলেম না তার জবাবই
এমনি তোমার নবাবী!
দুটো ছত্র লিখবি পত্র
একলা তোমার ‘ রব্-কা ‘ যে!
পোড়ারমুখী তাও হবে না
আলিস্যি তোর সব কাজে!
ঝগড়াটে নয় স্বভাব আমার
নইলে দেখতে কারখানা ,
গলার চোটে আকাশ ফেটে
হয়ে যেত চারখানা ,
বাছা আমার দেখতে পেতে
এই কলমের ধারখানা!
তোমার মতো এমনি মা তো
দেখি নি এ বঙ্গে গো ,
মায়া দয়া যা-কিছু সে
যদিন থাকে সঙ্গে গো!
চোখের আড়াল প্রাণের আড়াল
কেমনতরো ঢঙ এ গো!
তোমার প্রাণ যে পাষাণ-সম
জানি সেটা Long ago!
সংসারে যে সবি মায়া
সেটা নেহাত গল্প না!
বাইরেতে এক ভিতরে এক
এ যেন কার খল-পনা!
সত্যি বলে যেটা দেখি
সেটা আমার কল্পনা!
ভেবে একবার দেখো বাছা
ফিলজফি অল্প না!
মস্ত একটা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ
কে রেখেছে সাজিয়ে
যা করি তা কেবল ‘ থোড়া
জমির বাস্তে কাজিয়ে! ‘
বৃষ্টি পড়ে চিঠি না পাই ,
মনটা নিয়ে ততই হাঁপাই ,
শূন্যে চেয়ে ততই ভাবি
সকলি ভোজ-বাজি এ!
ফিলজফি মনের মধ্যে
ততই ওঠে গাঁজিয়ে!
দূর হোক গে , এত কথা
কেনই বলি তোমাকে!
ভরা নায়ে পা দিয়েছ ,
আছ তুমি দেমাকে!
—
তোমার সঙ্গে আর কথা না ,
তুমি এখন লোকটা মস্ত ,
কাজ কি বাপু , এইখেনেতেই
রবীন্দ্রনাথ হলেন অস্ত ।