ছোটো ফুল
আমি শুধু মালা গাঁথি ছোটো ছোটো ফুলে ,
সে ফুল শুকায়ে যায় কথায় কথায় !
তাই যদি , তাই হোক , দুঃখ নাহি তায় —
তুলিব কুসুম আমি অনন্তের কূলে ।
যারা থাকে অন্ধকারে , পাষাণকারায় ,
আমার এ মালা যদি লহে গলে তুলে ,
নিমেষের তরে তারা যদি সুখ পায় ,
নিষ্ঠুর বন্ধনব্যথা যদি যায় ভুলে !
ক্ষুদ্র ফুল , আপনার সৌরভের সনে
নিয়ে আসে স্বাধীনতা , গভীর আশ্বাস —
মনে আনে রবিকর নিমেষস্বপনে ,
মনে আনে সমুদ্রের উদার বাতাস ।
ক্ষুদ্র ফুল দেখে যদি কারো পড়ে মনে
বৃহৎ জগৎ , আর বৃহৎ আকাশ !
জন্মতিথির উপহার
একটি কাঠের বাক্স
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু
স্নেহ-উপহার এনেছি রে দিতে
লিখেও এনেছি দু-তিন ছত্তর ।
দিতে কত কী যে সাধ যায় তোরে
দেবার মতো নেই জিনিস-পত্তর!
টাকাকড়িগুলো ট্যাঁকশালে আছে
ব্যাঙ্কে আছে সব জমা ,
ট্যাঁকে আছে খালি গোটা দুত্তিন ,
এবার করো বাছ ক্ষমা!
হীরে জহরাৎ যত ছিল মোর
পোঁতা ছিল সব মাটিতে ,
জহরী যে যেত সন্ধান পেয়ে
নে গেছে যে যার বাটীতে!
দুনিয়া শহর জমিদারি মোর ,
পাঁচ ভূতে করে কাড়াকাড়ি ,
হাতের কাছেতে যা-কিছু পেলুম ,
নিয়ে এনু তাই তাড়াতাড়ি!
স্নেহ যদি কাছে রেখে যাওয়া যেত
চোখে যদি দেখা যেত রে ,
বাজারে-জিনিস কিনে নিয়ে এসে
বল্ দেখি দিত কে তোরে!
জিনিসটা অতি যৎসামান্য
রাখিস ঘরের কোণে ,
বাক্সখানি ভরে স্নেহ দিনু তোরে
এইটে থাকে যেন মনে!
বড়োসড়ো হবি ফাঁকি দিয়ে যাবি ,
কোন্খেনে রবি নুকিয়ে ,
কাকা-ফাকা সব ধুয়ে-মুছে ফেলে
দিবি একেবারে চুকিয়ে ।
তখন যদি রে এই কাঠখানা
মনে একটুকু তোলে ঢেউ —
একবার যদি মনে পড়ে তোর
‘ বুজি ‘ বলে বুঝি ছিল কেউ!
এই-যে সংসারে আছি মোরা সবে
এ বড়ো বিষম দেশটা!
ফাঁকিফুঁকি দিয়ে দূরে চলে যেতে
ভুলে যেতে সবার চেষ্টা!
ভয়ে ভয়ে তাই সবারে সবাই
কত কী যে এনে দিচ্ছে ,
এটা-ওটা দিয়ে স্মরণ জাগিয়ে
বেঁধে রাখিবার ইচ্ছে!
মনে রাখতে যে মেলাই কাঠ-খড় চাই ,
ভুলে যাবার ভারি সুবিধে ,
ভালোবাস যারে কাছে রাখ তারে
যাহা পাস তারে খুবি দে!
বুঝে কাজ নেই এত শত কথা ,
ফিলজফি হোক ছাই!
বেঁচে থাকো তুমি সুখে থাকো বাছা
বালাই নিয়ে মরে যাই!
জাগিবার চেষ্টা
মা কেহ কি আছ মোর , কাছে এসো তবে ,
পাশে বসে স্নেহ ক’রে জাগাও আমায় ।
স্বপ্নের সমাধি – মাঝে বাঁচিয়া কী হবে ,
যুঝিতেছি জাগিবারে — আঁখি রুদ্ধ হায় ,
ডেকো না ডেকো না মোরে ক্ষুদ্রতার মাঝে ,
স্নেহময় আলস্যেতে রেখো না বাঁধিয়া ,
আশীর্বাদ করে মোরে পাঠাও গো কাজে —
পিছনে ডেকো না আর কাতরে কাঁদিয়া ।
মোর বলে কাহারেও দেব না কি বল!
মোর প্রাণে পাবে না কি কেহ নবপ্রাণ
করুণা কি শুধু ফেলে নয়নের জল ,
প্রেম কি ঘরের কোণে গাহে শুধু গান!
তবেই ঘুচিবে মোর জীবনের লাজ
যদি মা করিতে পারি কারো কোনো কাজ ।
তনু
ওই তনুখানি তব আমি ভালোবাসি ।
এ প্রাণ তোমার দেহে হয়েছে উদাসী।
শিশিরেতে টলমল ঢলঢল ফুল
টুটে পড়ে থরে থরে যৌবন বিকাশি ।
চারি দিকে গুঞ্জরিছে জগৎ আকুল ,
সারানিশি সারাদিন ভ্রমর পিপাসী ।
ভালোবেসে বায়ু এসে দুলাইছে দুল ,
মুখে পড়ে মোহভরে পূর্ণিমার হাসি ।
পূর্ণ দেহখানি হতে উঠিছে সুবাস ।
মরি মরি কোথা সেই নিভৃত নিলয়
কোমল শয়নে যেথা ফেলিছে নিশ্বাস
তনুঢাকা মধুমাখা বিজন হৃদয় ।
ওই দেহখানি বুকে তুলে নেব বালা ,
পঞ্চদশ বসন্তের একগাছি মালা ।।
তুমি
তুমি কোন্ কাননের ফুল ,
তুমি কোন্ গগনের তারা !
তোমায় কোথায় দেখেছি
যেন কোন্ স্বপনের পারা !
কবে তুমি গেয়েছিলে ,
আঁখির পানে চেয়েছিলে
ভুলে গিয়েছি ।
শুধু মনের মধ্যে জেগে আছে ,
ঐ নয়নের তারা ।।
তুমি কথা কয়ো না ,
তুমি চেয়ে চলে যাও ।
এই চাঁদের আলোতে
তুমি হেসে গলে যাও ।
আমি ঘুমের ঘোরে চাঁদের পানে
চেয়ে থাকি মধুর প্রাণে ,
তোমার আঁখির মতন দুটি তারা
ঢালুক কিরণ – ধারা ।।
দেহের মিলন
প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ – তরে ।
প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন ।
হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে
মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ -‘ পরে ।
তোমার নয়ন পানে ধাইছে নয়ন ,
অধর মরিতে চায় তোমার অধরে ।
তৃষিত পরান আজি কাঁদিছে কাতরে
তোমারে সর্বাঙ্গ দিয়ে করিতে দর্শন ।
হৃদয় লুকানো আছে দেহের সায়রে ,
চিরদিন তীরে বসি করি গো ক্রন্দন ।
সর্বাঙ্গ ঢালিয়া আজি আকুল অন্তরে
দেহের রহস্য – মাঝে হইব মগন ।
আমার এ দেহমন চির রাত্রিদিন
তোমার সর্বাঙ্গে যাবে হইয়া বিলীন !
নিদ্রিতার চিত্র
মায়ায় রয়েছে বাঁধা প্রদোষ – আঁধার ;
চিত্রপটে সন্ধ্যাতারা অস্ত নাহি যায় ।
এলাইয়া ছড়াইয়া গুচ্ছ কেশভার
বাহুতে মাথাটি রেখে রমণী ঘুমায় ।
চারি দিকে পৃথিবীতে চিরজাগরণ ,
কে ওরে পাড়ালে ঘুম তারি মাঝখানে !
কোথা হতে আহরিয়া নীরব গুঞ্জন
চিরদিন রেখে গেছে ওরই কানে কানে !
ছবির আড়ালে কোথা অনন্ত নির্ঝর
নীরব ঝর্ঝর – গানে পড়িছে ঝরিয়া ।
চিরদিন কাননের নীরব মর্মর ,
লজ্জা চিরদিন আছে দাঁড়ায়ে সমুখে —
যেমনি ভাঙিবে ঘুম , মরমে মরিয়া
বুকের বসনখানি তুলে দিবে বুকে ।
নূতন
হেথাও তো পশে সূর্যকর ।
ঘোর ঝটিকার রাতে দারুণ অশনিপাতে
বিদীরিল যে গিরিশিখর —
বিশাল পর্বত কেটে , পাষাণহৃদয় ফেটে ,
প্রকাশিল যে ঘোর গহ্বর —
প্রভাতে পুলকে ভাসি বহিয়া নবীন হাসি ,
হেথাও তো পশে সূর্যকর !
দুয়ারেতে উঁকি মেরে ফিরে তো যায় না সে রে ,
শিহরি উঠে না আশঙ্কায় ,
ভাঙা পাষাণের বুকে খেলা করে কোন্ সুখে
হেসে আসে , হেসে চলে যায় ।
হেরো হেরো হায় হায় , যত প্রতিদিন যায় —
কে গাঁথিয়া দেয় তৃণজাল ।
লতাগুলি লতাইয়া বাহুগুলি বিথাইয়া
ঢেকে ফেলে বিদীর্ণ কঙ্কাল ।
বজ্রদগ্ধ অতীতের নিরাশার অতিথের
ঘোর স্তব্ধ সমাধি – আবাস ,
ফুল এসে , পাতা এসে কেড়ে নেয় হেসে হেসে ,
অন্ধকারে করে পরিহাস ।
এরা সব কোথা ছিল , কেই বা সংবাদ দিল ,
গৃহহারা আনন্দের দল —
বিশ্বে তিল শূন্য হলে অনাহূত আসে চলে ,
বাসা বাঁধে করি কোলাহল ।
আনে হাসি , আনে গান , আনে রে নূতন প্রাণ ,
সঙ্গে করে আনে রবিকর —
অশোক শিশুর প্রায় এত হাসে এত গায়
কাঁদিতে দেয় না অবসর ।
বিষাদ বিশালকায়া ফেলেছে আঁধার ছায়া ,
তারে এরা করে না তো ভয় —
চারি দিক হতে তারে ছোটো ছোটো হাসি মারে ,
অবশেষে করে পরাজয় ।
এই যে রে মরুস্থল , দাবদগ্ধ ধরাতল ,
এইখানে ছিল ‘পুরাতন’ —
একদিন ছিল তার শ্যামল যৌবনভার ,
ছিল তার দক্ষিণপবন ।
যদি রে সে চলে গেল , সঙ্গে যদি নিয়ে গেল
গীত গান হাসি ফুল ফল —
শুষ্ক স্মৃতি কেন মিছে রেখে তবে গেল পিছে ,
শুষ্ক শাখা শুষ্ক ফুলদল ।
সে কি চায় শুষ্ক বনে গাহিবে বিহঙ্গগণে
আগে তারা গাহিত যেমন।
আগেকার মতো করে স্নেহে তার নাম ধরে
উচ্ছ্বসিবে বসন্তপবন ?
নহে নহে , সে কি হয় ! সংসার জীবনময় ,
নাহি হেথা মরণের স্থান ।
আয় রে , নূতন , আয় , সঙ্গে করে নিয়ে আয় ,
তোর সুখ , তোর হাসি গান ।
ফোটা নব ফুলচয় , ওঠা নব কিশলয় ,
নবীন বসন্ত আয় নিয়ে ।
যে যায় সে চলে যাক , সব তার নিয়ে যাক ,
নাম তার যাক মুছে দিয়ে ।
এ কি ঢেউ – খেলা হায় , এক আসে , আর যায় ,
কাঁদিতে কাঁদিতে আসে হাসি ,
বিলাপের শেষ তান না হইতে অবসান
কোথা হতে বেজে ওঠে বাঁশি ।
আয় রে কাঁদিয়া লই শুকাবে দু – দিন বই
এ পবিত্র অশ্রুবারিধারা ।
সংসারে ফিরিব ভুলি , ছোটো ছোটো সুখগুলি ,
রচি দিবে আনন্দের কারা ।
না রে , করিব না শোক , এসেছে নূতন লোক ,
তারে কে করিবে অবহেলা ।
সেও চলে যাবে কবে , গীত গান সাঙ্গ হবে ,
ফুরাইবে দু – দিনের খেলা ।