ক্ষুদ্র আমি
বুঝেছি বুঝেছি , সখা , কেন হাহাকার ,
আপনার’পরে মোর কেন সদা রোষ ।
বুঝেছি বিফল কেন জীবন আমার —
আমি আছি , তুমি নাই , তাই অসন্তোষ ।
সকল কাজের মাঝে আমারেই হেরি —
ক্ষুদ্র আমি জেগে আছে ক্ষুধা লয়ে তার ,
শীর্নবাহু – আলিঙ্গনে আমারেই ঘেরি
করিছে আমার হায় অস্থিচর্ম সার ।
কোথা নাথ , কোথা তব সুন্দর বদন —
কোথায় তোমার নাথ , বিশ্ব – ঘেরা হাসি ।
আমারে কাড়িয়া লও , করো গো গোপন —
আমারে তোমারে মাঝে করো গো উদাসী ।
ক্ষুদ্র আমি করিতেছে বড়ো অহংকার ,
ভাঙো নাথ , ভাঙো নাথ , অভিমান তার ।।
খেলা
পথের ধারে অশথতলে
মেয়েটি খেলা করে ;
আপন-মনে আপনি আছে
সারাটি দিন ধরে ।
উপর-পানে আকাশ শুধু ,
সমুখ-পানে মাঠ ,
শরৎকালে রোদ পড়েছে ,
মধুর পথঘাট ।
দুটি-একটি পথিক চলে ,
গল্প করে , হাসে ।
লজ্জাবতী বধূটি গেল
ছায়াটি নিয়ে পাশে ।
আকাশ-ঘেরা মাঠের ধারে
বিশাল খেলাঘরে
একটি মেয়ে আপন-মনে
কতই খেলা করে ।
মাথার’পরে ছায়া পড়েছে ,
রোদ পড়েছে কোলে ,
পায়ের কাছে একটি লতা
বাতাস পেয়ে দোলে ।
মাঠের থেকে বাছুর আসে ,
দেখে নূতন লোক ,
ঘাড় বেঁকিয়ে চেয়ে থাকে
ড্যাবা ড্যাবা চোখ ।
কাঠবিড়ালি উসুখুসু
আশেপাশে ছোটে ,
শব্দ পেলে লেজটি তুলে
চমক খেয়ে ওঠে ।
মেয়েটি তাই চেয়ে দেখে
কত যে সাধ যায় —
কোমল গায়ে হাত বুলায়ে
চুমো খেতে চায় !
সাধ যেতেছে কাঠবিড়ালি
তুলে নিয়ে বুকে ,
ভেঙে ভেঙে টুকুটুকু
খাবার দেবে মুখে ।
মিষ্টি নামে ডাকবে তারে
গালের কাছে রেখে ,
বুকের মধ্যে রেখে দেবে
আঁচল দিয়ে ঢেকে ।
‘‘ আয় আয়”’ ডাকে সে তাই —
করুণ স্বরে কয় ,
‘‘ আমি কিছু বলব না তো
আমায় কেন ভয় ! ”
মাথা তুলে চেয়ে থাকে
উঁচু ডালের পানে —
কাঠবিড়ালি ছুটে পালায়
ব্যথা সে পায় প্রাণে ।
রাখাল ছেলের বাঁশি বাজে
সুদূর তরুছায় ,
খেলতে খেলতে মেয়েটি তাই
খেলা ভুলে যায় ।
তরুর মূলে মাথা রেখে
চেয়ে থাকে পথে ,
না জানি কোন্ পরীর দেশে
ধায় সে মনোরথে ।
একলা কোথায় ঘুরে বেড়ায়
মায়াদ্বীপে গিয়ে —
হেনকালে চাষী আসে
দুটি গোরু নিয়ে ।
শব্দ শুনে কেঁপে ওঠে ,
চমক ভেঙে চায় ।
আঁখি হতে মিলায় মায়া ,
স্বপন টুটে যায় ।
গান
ওগো কে যায় বাঁশরি বাজায়ে !
আমার ঘরে কেহ নাই যে !
তারে মনে পড়ে যারে চাই যে !
তার আকুল পরান বিরহের গান
বাঁশি বুঝি গেল জানায়ে !
আমি আমার কথা তারে জানাব কী করে ,
প্রাণ কাঁদে মোর তাই যে !
কুসুমের মালা গাঁথা হল না ,
ধূলিতে পড়ে শুকায় রে !
নিশি হয় ভোর , রজনীর চাঁদ
মলিন মুখ লুকায় রে !
সারা বিভাবরী কার পূজা করি
যৌবনডালা সাজায়ে !
ওই বাঁশিস্বরে হায় প্রাণ নিয়ে যায় ,
আমি কেন থাকি হায় রে !
গান-রচনা
এ শুধু অলস মায়া , এ শুধু মেঘের খেলা ,
এ শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন —
এ শুধু আপন মনে মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা
নিমেষের হাসিকান্না গান গেয়ে সমাপন ।
শ্যামল পল্লবপাতে রবিকরে সারাবেলা
আপনার ছায়া লয়ে খেলা করে ফুলগুলি ,
এও সেই ছায়া – খেলা বসন্তের সমীরণে ।
কুহকের দেশে যেন সাধ করে পথ ভুলি
হেথা হোথা ঘুরি ফিরি সারাদিন আনমনে ।
কারে যেন দেব ব’লে কোথা যেন ফুল তুলি ,
সন্ধ্যায় মলিন ফুল উড়ে যায় বনে বনে ।
এ খেলা খেলিবে হায় খেলার সাথি কে আছে ?
ভুলে ভুলে গান গাই — কে শোনে , কে নাই শোনে —
যদি কিছু মনে পড়ে , যদি কেহ আসে কাছে !
গীতোচ্ছ্বাস
নীরব বাঁশরিখানি বেজেছে আবার ।
প্রিয়ার বারতা বুঝি এসেছে আমার
বসন্তকাননমাঝে বসন্তসমীরে !
তাই বুঝি মনে পড়ে ভোলা গান যত !
তাই বুঝি ফুলবনে জাহ্নবীর তীরে
পুরাতন হাসিগুলি ফুটে শত শত !
তাই বুঝি হৃদয়ের বিস্মৃত বাসনা
জাগিছে নবীন হয়ে পল্লবের মতো !
জগতকমলবনে কমল – আসনা
কতদিন পরে বুঝি তাই এল ফিরে !
সে এল না , এল তার মধুর মিলন !
বসন্তের গান হয়ে এল তার স্বর !
দৃষ্টি তার ফিরে এল , কোথা সে নয়ন ?
চুম্বন এসেছে তার , কোথা সে অধর ?
চরণ
দুখানি চরণ পড়ে ধরণীর গায় —
দুখানি অলস রাঙা কোমল চরণ ।
শত বসন্তের স্মৃতি জাগিছে ধরায় ,
শত লক্ষ কুসুমের পরশস্বপন ।
শত বসন্তের যেন ফুটন্ত অশোক
ঝরিয়া মিলিয়া গেছে দুটি রাঙা পায় ।
প্রভাতের প্রদোষের দুটি সূর্যলোক
অস্ত গেছে যেন দুটি চরণছায়ায় ।
যৌবনসংগীত পথে যেতেছে ছড়ায়ে ,
নূপুর কাঁদিয়া মরে চরণ জড়ায়ে ,
নৃত্য সদা বাঁধা যেন মধুর মায়ায় ।
হোথা যে নিঠুর মাটি , শুষ্ক ধরাতল —
এসো গো হৃদয়ে এসো , ঝুরিছে হেথায়
লাজরক্ত লালসার রাঙা শতদল ।
চিঠি
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু
স্টীমার ‘ রাজহংস ‘ । গঙ্গা
চিঠি লিখব কথা ছিল ,
দেখছি সেটা ভারি শক্ত ।
তেমন যদি খবর থাকে
লিখতে পারি তক্ত তক্ত ।
খবর বয়ে বেড়ায় ঘুরে
খবরওয়ালা ঝাঁকা-মুটে ।
আমি বাপু ভাবের ভক্ত
বেড়াই নাকো খবর খুঁটে ।
এত ধুলো , এত খবর
কলকাতাটার গলিতে!
নাকে চোকে খবর ঢোকে
দু-চার কদম চলিতে ।
এত খবর সয় না আমার
মরি আমি হাঁপোষে ।
ঘরে এসেই খবরগুলো
মুছে ফেলি পাপোষে ।
আমাকে তো জানই বাছা!
আমি একজন খেয়ালি ।
কথাগুলো যা বলি , তার
অধিকাংশই হেঁয়ালি ।
আমার যত খবর আসে
ভোরের বেলা পুব দিয়ে ।
পেটের কথা তুলি আমি
পেটের মধ্যে ডুব দিয়ে ।
আকাশ ঘিরে জাল ফেলে
তারা ধরাই ব্যাবসা ।
থাক্ গে তোমার পাটের হাটে
মথুর কুণ্ডু শিবু সা ।
কল্পতরুর তলায় থাকি
নই গো আমি খবুরে ।
হাঁ করিয়ে চেয়ে আছি
মেওয়া ফলে সবুরে ।
তবে যদি নেহাত কর
খবর নিয়ে টানাটানি ।
আমি বাপু একটি কেবল
দুষ্টু মেয়ের খবর জানি!
দুষ্টুমি তার শোনো যদি
অবাক হবে সত্যি!
এত বড়ো বড়ো কথা তার
মুখখানি একরত্তি ।
মনে মনে জানেন তিনি
ভারি মস্ত লোকটা ।
লোকের সঙ্গে না-হক কেবল
ঝগড়া করবার ঝোঁকটা ।
আমার সঙ্গেই যত বিবাদ
কথায় কথায় আড়ি ।
এর নাম কি ভদ্র ব্যাভার!
বড্ড বাড়াবাড়ি ।
মনে করেছি তার সঙ্গে
কথাবার্তা বন্দ করি ।
প্রতিজ্ঞা থাকে না পাছে
সেইটে ভারি সন্দ করি ।
সে না হলে সকাল বেলায়
চামেলি কি ফুটবে!
সে নইলে কি সন্ধে বেলায়
সন্ধেতারা উঠবে ।
সে না হলে দিনটা ফাঁকি
আগাগোড়াই মস্কারা ।
পোড়ারমুখী জানে সেটা
তাই এত তার আস্কারা ।
চুড়ি-পরা হাত দুখানি
কতই জানে ফন্দি ।
কোনোমতে তার সাথে তাই
করে আছি সন্ধি ।