ওরে চেয়ে দেখ্ মুখ আপনার ,
ভেবে দেখ্ তোরা কারা ,
মানবের মতো ধরিয়া আকার ,
কেন রে কীটের পারা ?
আছে ইতিহাস , আছে কুলমান ,
আছে মহত্ত্বের খনি —
পিতৃপিতামহ গেয়েছে যে গান
শোন্ তার প্রতিধ্বনি ।
খুঁজেছেন তাঁরা চাহিয়া আকাশে
গ্রহতারকার পথ ,
জগৎ ছাড়ায়ে অসীমের আশে
উড়াতেন মনোরথ ।
চাতকের মতো সত্যের লাগিয়া
তৃষিত – আকুল – প্রাণে
দিবসরজনী ছিলেন জাগিয়া
চাহিয়া বিশ্বের পানে ।
তবে কেন সবে বধির হেথায় ,
কেন অচেতন প্রাণ —
বিফল উচ্ছ্বাসে কেন ফিরে যায়
বিশ্বের আহ্বানগান !
মহত্ত্বের গাথা পশিতেছে কানে ,
কেন রে বুঝি নে ভাষা ?
তীর্থযাত্রী যত পথিকের গানে
কেন রে জাগে না আশা ?
উন্নতির ধ্বজা উড়িছে বাতাসে ,
কেন রে নাচে না প্রাণ ?
নবীন কিরণ ফুটেছে আকাশে ,
কেন রে জাগে না গান ?
কেন আছি শুয়ে , কেন আছি চেয়ে ,
পড়ে আছি মুখোমুখি —
মানবের স্রোত চলে গান গেয়ে ,
জগতের সুখে সুখী !
চলো দিবালোকে , চলো লোকালয়ে ,
চলো জনকোলাহলে —
মিশাব হৃদয় মানবহৃদয়ে
অসীম আকাশতলে ।
তরঙ্গ তুলিব তরঙ্গের’পরে ,
নৃত্যগীত নব নব —
বিশ্বের কাহিনী কোটি কণ্ঠস্বরে
এককণ্ঠ হয়ে কব ।
মানবের সুখ মানবের আশা
বাজিবে আমার প্রাণে ,
শত লক্ষ কোটি মানবের ভাষা
ফুটিবে আমার গানে ।
মানবের কাজে মানবের মাঝে
আমরা পাইব ঠাঁই ,
বঙ্গের দুয়ারে তাই শিঙা বাজে —
শুনিতে পেয়েছি ভাই !
মুছে ফেলো ধুলা , মুছ অশ্রুজল ,
ফেলো ভিখারির চীর —
পরো নব সাজ , ধরো নব বল ,
তোলো তোলো নত শির ।
তোমাদের কাছে আজি আসিয়াছে
জগতের নিমন্ত্রণ —
দীনহীন বেশ ফেলে যেয়ো পাছে ,
দাসত্বের আভরণ ।
সভার মাঝারে দাঁড়াবে যখন ,
হাসিয়া চাহিবে ধীরে ,
পুরবরবির হিরণ কিরণ
পড়িবে তোমার শিরে ।
বাঁধন টুটিয়া উঠিবে ফুটিয়া
হৃদয়ের শতদল ,
জগতমাঝারে যাইবে লুটিয়া
প্রভাতের পরিমল ।
উঠ বঙ্গকবি , মায়ের ভাষায়
মুমূর্ষুরে দাও প্রাণ —
জগতের লোক সুধার আশায়
সে ভাষা করিবে পান ।
চাহিবে মোদের মায়ের বদনে ,
ভাসিবে নয়নজলে —
বাঁধিবে জগৎ গানের বাঁধনে
মায়ের চরণতলে ।
বিশ্বের মাঝারে ঠাঁই নাই বলে
কাঁদিতেছে বঙ্গভূমি ,
গান গেয়ে কবি জগতের তলে
স্থান কিনে দাও তুমি ।
এক বার কবি মায়ের ভাষায়
গাও জগতের গান —
সকল জগৎ ভাই হয়ে যায় ,
ঘুচে যায় অপমান ।
উপকথা
মেঘের আড়ালে বেলা কখন যে যায়।
বৃষ্টি পড়ে সারাদিন থামিতে না চায় ।
আর্দ্র – পাখা পাখিগুলি গীতগান গেছে ভুলি ,
নিস্তব্ধে ভিজিছে তরুলতা ।
বসিয়া আঁধার ঘরে বরষার ঝরঝরে
মনে পড়ে কত উপকথা ।
কভু মনে লয় হেন এ – সব কাহিনী যেন
সত্য ছিল নবীন জগতে ।
উড়ন্ত মেঘের মতো ঘটনা ঘটিত কত ,
সংসার উড়িত মনোরথে ।
রাজপুত্র অবহেলে কোন্ দেশে যেত চলে
কত নদী কত সিন্ধু – পার ।
সরোবর – ঘাট আলা, মণি হাতে নাগবালা
বসিয়া বাঁধিত কেশভার ।
সিন্ধুতীরে কত দূরে কোন্ রাক্ষসের পুরে
ঘুমাইত রাজার ঝিয়ারি ।
হাসি তার মণিকণা কেহ তাহা দেখিত না ,
মুকুতা ঢালিত অশ্রুবারি ।
সাত ভাই একত্তরে চাঁপা হয়ে ফুটিত রে ,
এক বোন ফুটিত পারুল ।
সম্ভব কি অসম্ভব একত্রে আছিল সব —
দুটি ভাই সত্য আর ভুল ।
বিশ্ব নাহি ছিল বাঁধা, না ছিল কঠিন বাধা ,
নাহি ছিল বিধির বিধান ,
হাসিকান্না লঘুকায়া শরতের আলোছায়া ,
কেবল সে ছুঁয়ে যেত প্রাণ !
আজি ফুরায়েছে বেলা , জগতের ছেলেখেলা
গেছে আলো – আঁধারের দিন ।
আর তো নাই রে ছুটি , মেঘরাজ্য গেছে টুটি ,
পদে পদে নিয়ম – অধীন ।
মধ্যাহ্নে রবির দাপে বাহিরে কে রবে তাপে,
আলয় গড়িতে সবে চায় ।
যবে হায় প্রাণপণ করে তাহা সমাপন
খেলারই মতন ভেঙে যায় ।
কবির অহংকার
গান গাহি বলে কেন অহংকার করা !
শুধু গাহি বলে কেন কাঁদি না শরমে !
খাঁচার পাখির মতো গান গেয়ে মরা ,
এই কি , মা , আদি অন্ত মানবজনমে !
সুখ নাই , সুখ নাই , শুধু মর্মব্যথা —
মরীচিকা – পানে শুধু মরি পিপাসায় ।
কে দেখালে প্রলোভন , শূন্য অমরতা —
প্রাণে ম’রে গানে কি রে বেঁচে থাকা যায় !
কে আছ মলিন হেথা , কে আছ দুর্বল ,
মোরে তোমাদের মাঝে করো গো আহ্বান —
বারেক একত্রে বসে ফেলি অশ্রুজল ,
দূর করি হীন গর্ব , শূন্য অভিমান
তার পরে একসাথে এস কাজ করি
কেবলি বিলাপগান দূরে পরিহরি ।।
কল্পনামধুপ
প্রতিদিন প্রাতে শুধু গুন্ গুন্ গান ,
লালসে অলস-পাখা অলির মতন ।
বিকল হৃদয় লয়ে পাগল পরান
কোথায় করিতে যায় মধু অন্বেষণ ।
বেলা বহে যায় চলে — শ্রান্ত দিনমান ,
তরুতলে ক্লান্ত ছায়া করিছে শয়ন ,
মুরছিয়া পড়িতেছে বাঁশরির তান ,
সেঁউতি শিথিলবৃন্ত মুদিছে নয়ন ।
কুসুমদলের বেড়া , তারি মাঝে ছায়া ,
সেথা বসে করি আমি কল্পমধু পান —
বিজনে সৌরভময়ী মধুময়ী মায়া ,
তাহারি কুহকে আমি করি আত্মদান —
রেণুমাখা পাখা লয়ে ঘরে ফিরে আসি
আপন সৌরভে থাকি আপনি উদাসী ।
কল্পনার সাথি
যখন কুসুমবনে ফির একাকিনী ,
ধরায় লুটায়ে পড়ে পূর্ণিমাযামিনী ,
দক্ষিণবাতাসে আর তটিনীর গানে
শোন যবে আপনার প্রাণের কাহিনী —
যখন শিউলি ফুলে কোলখানি ভরি
দুটি পা ছড়ায়ে দিয়ে আনতবয়ানে
ফুলের মতন দুটি অঙ্গুলিতে ধরি
মালা গাঁথ ভোরবেলা গুন্ গুন্ তানে —
মধ্যাহ্নে একেলা যবে বাতয়নে ব ‘ সে
নয়নে মিলাতে চায় সুদূর আকাশ ,
কখন আঁচলখানি প ‘ ড়ে যায় খ ‘ সে ,
কখন হৃদয় হতে উঠে দীর্ঘশ্বাস ,
কখন অশ্রুটি কাঁপে নয়নের পাতে —
তখন আমি কি , সখী , থাকি তব সাথে !