হৃদয় – আকাশ
আমি ধরা দিয়েছি গো আকাশের পাখি ,
নয়নে দেখেছি তব নূতন আকাশ ।
দুখানি আঁখির পাতে কী রেখেছ ঢাকি ,
হাসিলে ফুটিয়া পড়ে উষার আভাস ।
হৃদয় উড়িতে চায় হোথায় একাকী
আঁখিতারকার দেশে করিবারে বাস ।
ঐ গগনেতে চেয়ে উঠিয়াছে ডাকি ,
হোথায় হারাতে চায় এ গীত – উচ্ছ্বাস ।
তোমার হৃদয়াকাশ অসীম বিজন —
বিমল নীলিমা তার শান্ত সুকুমার ,
যদি নিয়ে যাই ওই শূন্য হয়ে পার
আমার দুখানি পাখা কনকবরন ।
হৃদয় চাতক হয়ে চাবে অশ্রুধার ,
হৃদয়চকোর চাবে হাসির কিরণ ।
হৃদয়- আসন
কোমল দুখানি বাহু শরমে লতায়ে
বিকশিত স্তন দুটি আগুলিয়া রয় ,
তারি মাঝখানে কি রে রয়েছে লুকায়ে
অতিশয় সযতন গোপন হৃদয় !
সেই নিরালায় , সেই কোমল আসনে ,
দুইখানি স্নেহস্ফুট স্তনের ছায়ায় ,
কিশোর প্রেমের মৃদু প্রদোষকিরণে
আনত আঁখির তলে রাখিবে আমায় !
কত – না মধুর আশা ফুটিছে সেথায় —
গভীর নিশীথে কত বিজন কল্পনা ,
উদাস নিশ্বাসবায়ু বসন্তসন্ধ্যায় ,
গোপনে চাঁদিনী রাতে দুটি অশ্রুকণা !
তারি মাঝে আমারে কি রাখিবে যতনে
হৃদয়ের সুমধুর স্বপন – শয়নে !
হৃদয়ের ভাষা
হৃদয় , কেন গো মোরে ছলিছ সতত ,
আপনার ভাষা তুমি শিখাও আমায় ।
প্রত্যহ আকুল কন্ঠে গাহিতেছি কত ,
ভগ্ন বাঁশরিতে শ্বাস করে হায় হায় !
সন্ধ্যাকালে নেমে যায় নীরব তপন
সুনীল আকাশ হতে সুনীল সাগরে ।
আমার মনের কথা , প্রাণের স্বপন
ভাসিয়া উঠিছে যেন আকাশের ‘পরে ।
ধ্বনিছে সন্ধ্যার মাঝে কার শান্ত বাণী ,
ও কি রে আমারি গান ? ভাবিতেছি তাই ।
প্রাণের যে কথাগুলি আমি নাহি জানি
সে – কথা কেমন করে জেনেছে সবাই ।
মোর হৃদয়ের গান সকলেই গায় ,
গাহিতে পারি নে তাহা আমি শুধু হায় ।
১.উৎসর্গ ও কবির মন্তব্য (কড়ি ও কোমল)
উৎসর্গ
শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
দাদা মহাশয়
করকমলেষু
কবির মন্তব্য
যৌবন হচ্ছে জীবনে সেই ঋতুপরিবর্তনের সময় যখন ফুল ও ফসলের প্রচ্ছন্ন প্রেরণা নানা বর্ণে ও রূপে অকস্মাৎ বাহিরে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। কড়ি ও কোমল আমার সেই নবযৌবনের রচনা। আত্মপ্রকাশের একটা প্রবল আবেগ তখন যেন প্রথম উপলব্ধি করেছিলুম। মনে পড়ে তখনকার দিনে নিজের মনের একটা উদ্ বেল অবস্থা। তখন আমার বেশভূষায় আবরণ ছিল বিরল। গায়ে থাকত ধুতির সঙ্গে কেবল একটা পাতলা চাদর, তার খুঁটোয় বাঁধা ভোরবেলায় তোলা একমুঠো বেলফুল, পায়ে একজোড়া চটি। মনে আছে থ্যাকারের দোকানে বই কিনতে গেছি কিন্তু এর বেশি পরিচ্ছন্নতা নেই, এতে ইংরেজ দোকানদারের স্বীকৃত আদবকায়দার প্রতি উপেক্ষা প্রকাশ হত। এই আত্মবিস্মৃত বেআইনী প্রমত্ততা কড়ি ও কোমলের কবিতায় অবাধে প্রকাশ পেয়েছিল। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে এই রীতির কবিতা তখনো প্রচলিত ছিল না। সেইজন্যেই কাব্যবিশারদ প্রভৃতি সাহিত্যবিচারকদের কাছ থেকে কটুভাষায় ভর্ৎসনা সহ্য করেছিলুম। সে-সব যে উপেক্ষা করেছি অনায়াসে সে কেবল যৌবনের তেজে। আপনার মধ্যে থেকে যা প্রকাশ পাচ্ছিল, সে আমার কাছেও ছিল নূতন এবং আন্তরিক। তখন হেম বাঁড়ুজ্জে এবং নবীন সেন ছাড়া এমন কোনো দেশপ্রসিদ্ধ কবি ছিলেন না যাঁরা নূতন কবিদের কোনো-একটা কাব্যরীতির বাঁধা পথে চালনা করতে পারতেন। কিন্তু আমি তাঁদের সম্পূর্ণই ভুলে ছিলুম। আমাদের পরিবারের বন্ধু কবি বিহারীলালকে ছেলেবেলা থেকে জানতুম এবং তাঁর কবিতার প্রতি অনুরাগ আমার ছিল অভ্যস্ত। তাঁর প্রবর্তিত কবিতার রীতি ইতিপূর্বেই আমার রচনা থেকে সম্পূর্ণ স্খলিত হয়ে গিয়েছিল। বড়োদাদার স্বপ্নপ্রয়াণের আমি ছিলুম অত্যন্ত ভক্ত, কিন্তু তাঁর বিশেষ কবিপ্রকৃতির সঙ্গে আমার বোধ হয় মিল ছিল না, সেইজন্য ভালোলাগা সত্ত্বেও তাঁর প্রভাব আমার কবিতা গ্রহণ করতে পারে নি। তাই কড়ি ও কোমলের কবিতা মনের অন্তঃস্তরের উৎসের থেকে উছলে উঠেছিল। তার সঙ্গে বাহিরের কোনো মিশ্রণ যদি ঘটে থাকে তো সে গৌণভাবে।
এই আমার প্রথম কবিতার বই যার মধ্যে বিষয়ের বৈচিত্র্য এবং বহির্দৃষ্টিপ্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর প্রথম আমি সেই কথা বলেছি যা পরবর্তী আমার কাব্যের অন্তরে অন্তরে বারবার প্রবাহিত হয়েছে—
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই —
যা নৈবেদ্যে আর-এক ভাবে প্রকাশ পেয়েছে—
বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়।
কড়ি ও কোমলের যৌবনের রসোচ্ছ্বাসের সঙ্গে আর-একটি প্রবল প্রবর্তনা প্রথম আমার কাব্যকে অধিকার করেছে, সে জীবনের পথে মৃত্যুর আবির্ভাব। যাঁরা আমার কাব্য মন দিয়ে পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবেন এই মৃত্যুর নিবিড় উপলব্ধি আমার কাব্যের এমন একটি বিশেষ ধারা, নানা বাণীতে যার প্রকাশ। কড়ি ও কোমলেই তার প্রথম উদ্ভব।
শান্তিনিকেতন
৭|১২|৩৯