সমুদ্র
কিসের অশান্তি এই মহাপারাবারে ,
সতত ছিঁড়িতে চাহে কিসের বন্ধন !
অব্যক্ত অস্ফুট বাণী ব্যক্ত করিবারে
শিশুর মতন সিন্ধু করিছে ক্রন্দন ।
যুগযুগান্তর ধরি যোজন যোজন
ফুলিয়া ফুলিয়া উঠে উত্তাল উচ্ছ্বাস —
অশান্ত বিপুল প্রাণ করিছে গর্জন ,
নীরবে শুনিছে তাই প্রশান্ত আকাশ ।
আছাড়ি চূর্ণিতে চাহে সমগ্র হৃদয়
কঠিন পাষাণময় ধরণীর তীরে ,
জোয়ারে সাধিতে চায় আপন প্রলয় ,
ভাঁটায় মিলাতে চায় আপনার নীরে ।
অন্ধ প্রকৃতির হৃদে মৃত্তিকায় বাঁধা ।
সতত দুলিছে ওই অশ্রুর পাথার ,
উন্মুখী বাসনা পায় পদে পদে বাধা ,
কাঁদিয়া ভাসাতে চাহে জগৎ-সংসার ।
সাগরের কণ্ঠ হতে কেড়ে নিয়ে কথা
সাধ যায় ব্যক্ত করি মানবভাষায় —
শান্ত করে দিই ওই চির-ব্যাকুলতা ,
সমুদ্রবায়ুর ওই চির হায়-হায় ।
সাধ যায় মোর গীতে দিবস-রজনী
ধ্বনিবে পৃথিবী-ঘেরা সংগীতের ধ্বনি ।
সারাবেলা
হেলাফেলা সারাবেলা
এ কী খেলা আপন – সনে !
এই বাতাসে ফুলের বাসে
মুখখানি কার পড়ে মনে !
আঁখির কাছে বেড়ায় ভাসি
কে জানে গো কাহার হাসি !
দুটি ফোঁটা নয়নসলিল
রেখে যায় এই নয়ন কোণে ।
কোন্ ছায়াতে কোন্ উদাসী
দূরে বাজায় অলস বাঁশি ,
মনে হয় কার মনের বেদন
কেঁদে বেড়ায় বাঁশির গানে ।
সারাদিন গাঁথি গান
কারে চাহে , গাহে প্রাণ ,
তরুতলের ছায়ার মতন
বসে আছি ফুলবনে ।
সিন্ধুগর্ভ
উপরে স্রোতের ভরে ভাসে চরাচর
নীল সমুদ্রের’পরে নৃত্য ক’রে সারা ।
কোথা হতে ঝরে যেন অনন্ত নির্ঝর ,
ঝরে আলোকের কণা রবি শশী তারা ।
ঝরে প্রাণ , ঝরে গান , ঝরে প্রেমধারা —
পূর্ণ করিবারে চায় আকাশ সাগর ।
সহসা কে ডুবে যায় জলবিম্বপারা —
দু – একটি আলো – রেখা যায় মিলাইয়া ,
তখন ভাবিতে বসি কোথায় কিনারা —
কোন্ অতলের পানে ধাই তলাইয়া !
নিম্নে জাগে সিন্ধুগর্ভ স্তব্ধ অন্ধকার ।
কোথা নিবে যায় আলো , থেমে যায় গীত —
কোথা চিরদিন তরে অসীম আড়াল !
কোথায় ডুবিয়া গেছে অনন্ত অতীত !
» সিন্ধুতীরে
হেথা নাই ক্ষুদ্র কথা , তুচ্ছ কানাকানি ,
ধ্বনিত হতেছে চিরদিবসের বাণী ।
চিরদিবসের রবি ওঠে , অস্ত যায় ,
চিরদিবসের কবি গাহিছে হেথায় ।
ধরণীর চারি দিকে সীমাশূন্য গানে
সিন্ধু শত তটিনীরে করিছে আহ্বান —
হেথায় দেখিলে চেয়ে আপনার পানে
দুই চোখে জল আসে , কেঁদে ওঠে প্রাণ ।
শত যুগ হেথা বসে মুখপানে চায় ,
বিশাল আকাশে পাই হৃদয়ের সাড়া ।
তীব্র বক্র ক্ষুদ্র হাসি পায় যদি ছাড়া
রবির কিরণে এসে মরে সে লজ্জায় ।
সবারে আনিতে বুকে বুক বেড়ে যায় ,
সবারে করিতে ক্ষমা আপনারে ছাড়া ।
স্তন
১
নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল ,
বিকশিত যৌবনের বসন্তসমীরে
কুসুমিত হয়ে ওই ফুটেছে বাহিরে ,
সৌরভসুধায় করে পরান পাগল ।
মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল
উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে ।
কী যেন বাঁশির ডাকে জগতের প্রেমে
বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয় ,
সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে —
শরমে মরিতে চায় অঞ্চল – আড়ালে ।
প্রেমের সংগীত যেন বিকশিয়া রয় ,
উঠিছে পড়িছে ধীরে হৃদয়ের তালে ।
হেরো গো কমলাসন জননী লক্ষ্মীর —
হেরো নারীহৃদয়ের পবিত্র মন্দির ।
২
পবিত্র সুমেরু বটে এই সে হেথায় ,
দেবতা বিহারভূমি কনক – অচল ।
উন্নত সতীর স্তন স্বরগ প্রভায়
মানবের মর্ত্যভূমি করেছে উজ্জ্বল ।
শিশু রবি হোথা হতে ওঠে সুপ্রভাতে ,
শ্রান্ত রবি সন্ধ্যাবেলা হোথা অস্ত যায় ।
দেবতার আঁখিতারা জেগে থাকে রাতে ,
বিমল পবিত্র দুটি বিজন শিখরে ।
চিরস্নেহ – উৎসধারে অমৃত নির্ঝরে
সিক্ত করি তুলিতেছে বিশ্বের অধর ।
জাগে সদা সুখসুপ্ত ধরণীর’পরে ,
অসহায় জগতের অসীম নির্ভর ।
ধরণীর মাঝে থাকি স্বর্গ আছে চুমি ,
দেবশিশু মানবের ওই মাতৃভূমি ।
স্বপ্নরুদ্ধ
নিষ্ফল হয়েছি আমি সংসারের কাজে ,
লোকমাঝে আঁখি তুলে পারি না চাহিতে ।
ভাসায়ে জীবনতরী সাগরের মাঝে
তরঙ্গ লঙ্ঘন করি পারি না বাহিতে ।
পুরুষের মতো যত মানবের সাথে
যোগ দিতে পারি নাকো লয়ে নিজ বল ,
সহস্র সংকল্প শুধু ভরা দুই হাতে
বিফলে শুকায় যেন লক্ষ্মণের ফল ।
আমি গাঁথি আপনার চারি দিক ঘিরে
সূক্ষ্ম রেশমের জাল কীটের মতন ।
মগ্ন থাকি আপনার মধুর তিমিরে ,
দেখি না এ জগতের প্রকাণ্ড জীবন ।
কেন আমি আপনার অন্তরালে থাকি !
মুদ্রিত পাতার মাঝে কাঁদে অন্ধ আঁখি ।
স্মৃতি
ওই দেহ – পানে চেয়ে পড়ে মোর মনে
যেন কত শত পূর্বজনমের স্মৃতি ।
সহস্র হারানো সুখ আছে ও নয়নে ,
জন্মজন্মান্তের যেন বসন্তের গীতি ।
যেন গো আমারি তুমি আত্মবিস্মরণ ,
অনন্ত কালের মোর সুখ দুঃখ শোক ,
কত নব জগতের কুসুমকানন ,
কত নব আকাশের চাঁদের আলোক ।
কত দিবসের তুমি বিরহের ব্যথা ,
কত রজনীর তুমি প্রণয়ের লাজ ,
সেই হাসি সেই অশ্রু সেই – সব কথা
মধুর মুরতি ধরি দেখা দিল আজ ।
তোমার মুখেতে চেয়ে তাই নিশিদিন
জীবন সুদূরে যেন হতেছে বিলীন !
হাসি
সুদূর প্রবাসে আজি কেন রে কী জানি
কেবল পড়িছে মনে তার হাসিখানি ।
কখন নামিয়া গেল সন্ধ্যার তপন ,
কখন থামিয়া গেল সাগরের বাণী ।
কোথায় ধরার ধারে বিরহবিজন
একটি মাধবীলতা আপন ছায়াতে
দুটি অধরের রাঙা কিশলয় – পাতে
হাসিটি রেখেছে ঢেকে কুঁড়ির মতন !
সারা রাত নয়নের সলিল সিঞ্চিয়া
রেখেছে কাহার তরে যতনে সঞ্চিয়া!
সে হাসিটি কে আসিয়া করিবে চয়ন ,
লুব্ধ এই জগতের সবারে বঞ্চিয়া !
তখন দুখানি হাসি মরিয়া বাঁচিয়া
তুলিবে অমর করি একটি চুম্বন ।