মরীচিকা
এসো , ছেড়ে এসো , সখী , কুসুমশয়ন ।
বাজুক কঠিন মাটি চরণের তলে ।
কত আর করিবে গো বসিয়া বিরলে
আকাশকুসুমবনে স্বপন চয়ন ।
দেখো ওই দূর হতে আসিছে ঝটিকা ,
স্বপ্নরাজ্য ভেসে যাবে খর অশ্রুজলে ।
দেবতার বিদ্যুতের অভিশাপশিখা
দহিবে আঁধার নিদ্রা বিমল অনলে ।
চলো গিয়ে থাকি দোঁহে মানবের সাথে ,
সুখদুঃখ লয়ে সবে গাঁথিছে আলয় —
হাসি – কান্না ভাগ করি ধরি হাতে হাতে
সংসারসংশয়রাত্রি রহিব নির্ভয় ।
সুখরৌদ্রমরীচিকা নহে বাসস্থান ,
মিলায় মিলায় বলি ভয়ে কাঁপে প্রাণ ।
মানবহৃদয়ের বাসনা
নিশীথে রয়েছি জেগে ; দেখি অনিমেখে ,
লক্ষ হৃদয়ে সাধ শূন্যে উড়ে যায় ।
কত দিক হতে তারা ধায় কত দিকে !
কত – না অদৃশ্যকায়া ছায়া – আলিঙ্গন
বিশ্বময় কারে চাহে , করে হায় – হায় ।
কত স্মৃতি খুঁজিতেছে শ্মশানশয়ন —
অন্ধকারে হেরো শত তৃষিত নয়ন
ছায়াময় পাখি হয়ে কার পানে ধায় ।
ক্ষীণশ্বাস – মুমূর্ষুর অতৃপ্ত বাসনা
ধরণীর কূলে কূলে ঘুরিয়া বেড়ায় ।
উদ্দেশে ঝরিছে কত অশ্রুবারিকণা ,
চরণ খুঁজিয়া তারা মরিবারে চায় ।
কে শুনিছে শত কোটি হৃদয়ের ডাক !
নিশীথিনী স্তব্ধ হয়ে রয়েছে অবাক ।
মোহ
এ মোহ ক ‘ দিন থাকে , এ মায়া মিলায় ,
কিছুতে পারে না আর বাঁধিয়া রাখিতে ।
কোমল বাহুর ডোর ছিন্ন হয়ে যায় ,
মদিরা উথলে নাকো মদির আঁখিতে ।
কেহ কারে নাহি চিনে আঁধার নিশায় ।
ফুল ফোটা সাঙ্গ হলে গাহে না পাখিতে ।
কোথা সেই হাসিপ্রান্ত চুম্বনতৃষিত
রাঙা পুষ্পটুকু যেন প্রস্ফুট অধর !
কোথা কুসুমিত তনু পূর্ণবিকশিত ,
কম্পিত পুলকভরে , যৌবনকাতর !
তখন কি মনে পড়ে সেই ব্যাকুলতা ,
সেই চিরপিপাসিত যৌবনের কথা ,
সেই প্রাণপরিপূর্ণ মরণ – অনল —
মনে পড়ে হাসি আসে ? চোখে আসে জল ?
যোগিয়া
বহুদিন পরে আজি মেঘ গেছে চলে ,
রবির কিরণসুধা আকাশে উথলে ।
স্নিগ্ধ শ্যাম পত্রপুটে আলোক ঝলকি উঠে
পুলক নাচিছে গাছে গাছে ।
নবীন যৌবন যেন প্রেমের মিলনে কাঁপে ,
আনন্দ বিদ্যুৎ – আলো নাচে ।
জুঁই সরোবরতীরে নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে
ঝরিয়া পড়িতে চায় ভুঁয়ে ,
অতি মৃদু হাসি তার , বরষার বৃষ্টিধার
গন্ধটুকু নিয়ে গেছে ধুয়ে ।
আজিকে আপন প্রাণে না জানি বা কোন্খানে
যোগিয়া রাগিণী গায় কে রে ।
ধীরে ধীরে সুর তার মিলাইছে চারি ধার ,
আচ্ছন্ন করিছে প্রভাতেরে ।
গাছপালা চারি ভিতে সংগীতের মাধুরীতে
মগ্ন হয়ে ধরে স্বপ্নছবি ।
এ প্রভাত মনে হয় আরেক প্রভাতময় ,
রবি যেন আর কোনো রবি ।
ভাবিতেছি মনে মনে কোথা কোন্ উপবনে
কী ভাবে সে গান গাইছে না জানি ,
চোখে তার অশ্রুরেখা একটু দেছে কি দেখা ,
ছড়ায়েছে চরণ দুখানি ।
তার কি পায়ের কাছে বাঁশিটি পড়িয়া আছে —
আলোছায়া পড়েছে কপোলে ।
মলিন মালাটি তুলি ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি
ভাসাইছে সরসীর জলে ।
বিষাদ – কাহিনী তার সাধ যায় শুনিবার
কোন্খানে তাহার ভবন ।
তাহার আঁখির কাছে যার মুখ জেগে আছে
তাহারে বা দেখিতে কেমন ।
এ কী রে আকুল ভাষা ! প্রাণের নিরাশ আশা
পল্লবের মর্মরে মিশালো ।
না জানি কাহারে চায় তার দেখা নাহি পায়
ম্লান তাই প্রভাতের আলো ।
এমন কত – না প্রাতে চাহিয়া আকাশপাতে
কত লোক ফেলেছে নিশ্বাস ,
সে – সব প্রভাত গেছে , তারা তার সাথে গেছে
লয়ে গেছে হৃদয় – হুতাশ !
এমন কত না আশা কত ম্লান ভালোবাসা
প্রতিদিন পড়িছে ঝরিয়া ,
তাদের হৃদয় – ব্যথা তাদের মরণ – গাথা
কে গাইছে একত্র করিয়া ,
পরস্পর পরস্পরে ডাকিতেছে নাম ধরে ,
কেহ তাহা শুনিতে না পায় ।
কাছে আসে , বসে পাশে , তবুও কথা না ভাষে ,
অশ্রুজলে ফিরে ফিরে যায় ।
চায় তবু নাহি পায় , অবশেষে নাহি চায় ,
অবশেষে নাহি গায় গান ,
ধীরে ধীরে শূন্য হিয়া বনের ছায়ায় গিয়া
মুছে আসে সজল নয়ান ।
যৌবন – স্বপ্ন
আমার যৌবনস্বপ্নে যেন ছেয়ে আছে বিশ্বের আকাশ ।
ফুলগুলি গায়ে এসে পড়ে রূপসীর পরশের মতো ।
পরানে পুলক বিকাশিয়া বহে কেন দক্ষিণা বাতাস
যেথা ছিল যত বিরহিণী সকলের কুড়ায়ে নিশ্বাস !
বসন্তের কুসুমকাননে গোলাপের আঁখি কেন নত ?
জগতের যত লাজময়ী যেন মোর আঁখির সকাশ ?
কাঁপিছে গোলাপ হয়ে এসে , মরমের শরমে বিব্রত !
প্রতি নিশি ঘুমাই যখন পাশে এসে বসে যেন কেহ ,
সচকিত স্বপনের মতো জাগরণে পলায় সলাজে ।
যেন কার আঁচলের বায় উষার পরশি যায় দেহ ,
শত নূপুরের রুনুঝুনু বনে যেন গুঞ্জরিয়া বাজে ।
মদির প্রাণের ব্যাকুলতা ফুটে ফুটে বকুলমুকুলে ;
কে আমারে করেছে পাগল — শূন্যে কেন চাই আঁখি তুলে !
যেন কোন্ উর্বশীর আঁখি চেয়ে আছে আকাশের মাঝে !
রাত্রি
জগতেরে জড়াইয়া শত পাকে যামিনীনাগিনী
আকাশ – পাতাল জুড়ি ছিল পড়ে নিদ্রায় মগনা ,
আপনার হিম দেহে আপনি বিলীনা একাকিনী ।
মিটিমিটি তারকায় জ্বলে তার অন্ধকার ফণা ।
উষা আসি মন্ত্র পড়ি বাজাইল ললিত রাগিণী ।
রাঙা আঁখি পাকালিয়া সাপিনী উঠিল তাই জাগি —
একে একে খুলে পাক , আঁকিবাঁকি কোথা যায় ভাগি ।
পশ্চিমসাগরতলে আছে বুঝি বিরাট গহ্বর ,
সেথায় ঘুমাবে বলে ডুবিতেছে বাসুকিভগিনী
মাথায় বহিয়া তার শত লক্ষ রতনের কণা ।
শিয়রেতে সারা দিন জেগে রবে বিপুল সাগর —
নিভৃতে স্তিমিত দীপে চুপি চুপি কহিয়া কাহিনী
মিলি কত নাগবালা স্বপ্নমালা করিবে রচনা ।