চিরদিবসের সুখ রয়েছে গোপন
আপনার আত্মার মাঝার ।
চারি দিকে সুখ খুঁজে শ্রান্ত প্রাণমন —
হেথা আছে , কোথা নেই আর ।
বাহিরের সুখ সে , সুখের মরীচিকা —
বাহিরেতে নিয়ে যায় ছ ‘ লে ,
যখন মিলায়ে যায় মায়াকুহেলিকা
কেন কাঁদি সুখ নেই ব ‘ লে ।
দাঁড়াও সে অন্তরের শান্তিনিকেতনে
চিরজ্যোতি চিরছায়াময় —
ঝড়হীন রৌদ্রহীন নিভৃত সদনে
জীবনের অনন্ত আলয় ।
পুণ্যজ্যোতি মুখে লয়ে পুণ্য হাসিখানি ,
অন্নপূর্ণা জননী – সমান ,
মহাসুখে সুখ দুঃখ কিছু নাহি মানি
কর সবে সুখশান্তি দান ।
মা , আমার এই জেনো হৃদয়ের সাধ
তুমি হও লক্ষ্মীর প্রতিমা —
মানবেরে জ্যোতি দাও , করো আশীর্বাদ ,
অকলঙ্ক মূর্তি মধুরিমা ।
কাছে থেকে এত কথা বলা নাহি হয় ,
হেসে খেলে দিন যায় কেটে ,
দূরে ভয় হয় পাছে না পাই সময় ,
বলিবার সাধ নাহি মেটে ।
কত কথা বলিবারে চাহি প্রাণপণে,
কিছুতে, মা, বলিতে না পারি —
স্নেহমুখখানি তোর পড়ে মোর মনে ,
নয়নে উথলে অশ্রুবারি ।
সুন্দর মুখেতে তোর মগ্ন আছে ঘুমে
একখানি পবিত্র জীবন;
ফলুক সুন্দর ফল সুন্দর কুসুমে
আশীর্বাদ করো , মা , গ্রহণ ।
২
শ্রীমতী ইন্দিরা। প্রাণাধিকাসু । নাসিক
চারি দিকে তর্ক উঠে সাঙ্গ নাহি হয় ,
কথায় কথায় বাড়ে কথা ।
সংশয়ের উপরেতে চাপিছে সংশয় ,
কেবলি বাড়িছে ব্যাকুলতা ।
ফেনার উপরে ফেনা , ঢেউ -‘ পরে ঢেউ ,
গরজনে বধির শ্রবণ —
তীর কোন্ দিকে আছে নাহি জানে কেউ ,
হা হা করে আকুল পবন ।
এই কল্লোলের মাঝে নিয়ে এস কেহ
পরিপূর্ণ একটি জীবন ,
নীরবে মিটিয়া যাবে সকল সন্দেহ ,
থেমে যাবে সহস্র বচন ।
তোমার চরণে আসি মাগিবে মরণ
লক্ষ্যহারা শত শত মত ,
যে দিকে ফিরাবে তুমি দুখানি নয়ন
সে দিকে হেরিবে সবে পথ ।
অন্ধকার নাহি যায় বিবাদ করিলে ,
মানে না বাহুর আক্রমণ ।
একটি আলোকশিখা সমুখে ধরিলে
নীরবে করে সে পলায়ন ।
এস মা , উষার আলো , অকলঙ্ক প্রাণ ,
দাঁড়াও এ সংসার – আঁধারে ।
জাগাও জাগ্রত হৃদে আনন্দের গান ,
কূল দাও নিদ্রার পাথারে ।
চারি দিকে নৃশংসতা করে হানাহানি ,
মানবের পাষাণ পরান ।
শাণিত ছুরির মতো বিঁধাইয়া বাণী ,
হৃদয়ের রক্ত করে পান ।
তৃষিত কাতর প্রাণী মাগিতেছে জল ,
উল্কাধারা করিছে বর্ষণ —
শ্যামল আশার ক্ষেত্র করিয়া বিফল
স্বার্থ দিয়ে করিছে কর্ষণ ।
শুধু এসে একবার দাঁড়াও কাতরে
মেলি দুটি সকরুণ চোখ ,
পড়ুক দু – ফোঁটা অশ্রু জগতের’পরে
যেন দুটি বাল্মীকীর শ্লোক ।
ব্যথিত করুক স্নান তোমার নয়নে ,
করুণার অমৃতনির্ঝরে ,
তোমারে কাতর হেরি মানবের মনে
দয়া হবে মানবের’পরে ।
সমুদয় মানবের সৌন্দর্যে ডুবিয়া
হও তুমি অক্ষয় সুন্দর ।
ক্ষুদ্র রূপ কোথা যায় বাতাসে উবিয়া
দুই – চারি পলকের পর ।
তোমার সৌন্দর্যে হোক মানব সুন্দর ;
প্রেমে তব বিশ্ব হোক আলো ।
তোমারে হেরিয়া যেন মুগুধ – অন্তর
মানুষে মানুষ বাসে ভালো ।
৩
শ্রীমতী ইন্দিরা । প্রাণাধিকাসু । নাসিক ।
আমার এ গান , মা গো , শুধু কি নিমেষে
মিলাইবে হৃদয়ের কাছাকাছি এসে ?
আমার প্রাণের কথা
নিদ্রাহীন আকুলতা
শুধু নিশ্বাসের মতো যাবে কি , মা , ভেসে !
এ গান তোমারে সদা ঘিরে যেন রাখে ,
সত্যের পথের’পরে নাম ধরে ডাকে ।
সংসারের সুখে দুখে
চেয়ে থাকে তোর মুখে ,
চির – আশীর্বাদ – সম কাছে কাছে থাকে ।
বিজনে সঙ্গীর মতো করে যেন বাস ,
অনুক্ষণ শোনে তোর হৃদয়ের আশ ।
পড়িয়া সংসারঘোরে
কাঁদিয়া হেরিলে তোরে
ভাগ করে নেয় যেন দুখের নিশ্বাস ।
সংসারের প্রলোভন যবে আসি হানে
মধুমাখা বিষবাণী দুর্বল পরানে ,
এ গান আপন সুরে
মন তোর রাখে পুরে ,
ইষ্টমন্ত্রসম সদা বাজে তোর কানে ।
আমার এ গান যেন সুদীর্ঘ জীবন
তোমার বসন হয় , তোমার ভূষণ ।
পৃথিবীর ধূলিজাল
করে দেয় অন্তরাল ,
তোমারে করিয়া রাখে সুন্দর শোভন ।
আমার এ গান যেন নাহি মানে মানা ,
উদার বাতাস হয়ে এলাইয়া ডানা
সৌরভের মতো তোরে
নিয়ে যায় চুরি করে —
খুঁজিয়া দেখাতে যায় স্বর্গের সীমানা ।
এ গান যেন রে হয় তোর ধ্রুবতারা ,
অন্ধকারে অনিমিষে নিশি করে সারা ।
তোমার মুখের’পরে
জেগে থাকে স্নেহভরে
অকূলে নয়ন মেলি দেখায় কিনারা ।
আমার এ গান যেন পশি তোর কানে
মিলায়ে মিশায়ে যায় সমস্ত পরানে ।
তপ্ত শোণিতের মতো
বহে শিরে অবিরত ,
আনন্দে নাচিয়া উঠে মহত্ত্বের গানে ।
এ গান বাঁচিয়া থাকে যেন তোর মাঝে ,
আঁখিতারা হয়ে তোর আঁখিতে বিরাজে ।
এ যেন রে করে দান
সতত নূতন প্রাণ ,
এ যেন জীবন পায় জীবনের কাজে ।
যদি যাই , মৃত্যু যদি নিয়ে যায় ডাকি ,
এই গানে রেখে যাব মোর স্নেহ – আঁখি ।
যবে হায় সব গান
হয়ে যাবে অবসান
এ গানের মাঝে আমি যেন বেঁচে থাকি ।
মথুরায়
বাঁশরি বাজাতে চাহি , বাঁশরি বাজিল কই ?
বিহরিছে সমীরণ , কুহরিছে পিকগণ ,
মথুরায় উপবন কুসুমে সাজিল ওই ।
বাঁশরি বাজাতে চাহি , বাঁশরি বাজিল কই ?
বিকচ বকুল ফুল দেখে যে হতেছে ভুল ,
কোথাকার অলিকুল গুঞ্জরে কোথায় !
এ নহে কি বৃন্দাবন ? কোথা সেই চন্দ্রানন ?
ওই কি নূপুরধ্বনি বনপথে শুনা যায় ?
একা আছি বনে বসি , পীত ধড়া পড়ে খসি ,
সোঙরি সে মুখশশী পরান মজিল সই ।
বাঁশরি বাজাতে চাহি , বাঁশরি বাজিল কই ?
এক বার রাধে রাধে ডাক্ বাঁশি , মনোসাধে ,
আজি এ মধুর চাঁদে মধুর যামিনী ভায় ।
কোথা সে বিধুরা বালা , মলিন মালতীমালা ,
হৃদয়ে বিরহ – জ্বালা , এ নিশি পোহায় , হায় ।
কবি যে হল আকুল , এ কি রে বিধির ভুল ,
মথুরায় কেন ফুল ফুটেছে আজি লো সই ?
বাঁশরি বাজাতে গিয়ে বাঁশরি বাজিল কই ?