ওই যে শুকানো ফুল ছুঁড়ে ফেলে দিলে
উহার মরম – কথা বুঝিতে নারিলে ।
ও যেদিন ফুটেছিল নব রবি উঠেছিল ,
কানন মাতিয়াছিল বসন্ত – অনিলে ।
ওই যে শুকায় চাঁপা পড়ে একাকিনী ,
তোমরা তো জানিবে না উহার কাহিনী ।
কবে কোন্ সন্ধেবেলা ওরে তুলেছিল বালা
ওরি মাঝে বাজে কোন্ পূরবীরাগিণী ।
যারে দিয়েছিল ওই ফুল উপহার
কোথায় সে গেছে চলে , সে তো নেই আর ।
একটু কুসুমকণা তাও নিতে পারিল না ,
ফেলে রেখে যেতে হল মরণের পার ;
কত সুখ , কত ব্যথা , সুখের দুখের কথা
মিশিছে ধূলির সাথে ফুলের মাঝার ।
মিছে শোক , মিছে এই বিলাপ কাতর ,
সম্মুখে রয়েছে পড়ে যুগ – যুগান্তর ।
মঙ্গলগীত
শ্রীমতী ইন্দিরা । প্রাণাধিকাসু । নাসিক
এতবড়ো এ ধরণী মহাসিন্ধু-ঘেরা
দুলিতেছে আকাশসাগরে —
দিন – দুই হেথা রহি মোরা মানবেরা
শুধু কি, মা, যাব খেলা করে ।
তাই কি ধাইছে গঙ্গা ছাড়ি হিমগিরি ,
অরণ্য বহিছে ফুল-ফল —
শত কোটি রবি তারা আমাদের ঘিরি
গণিতেছে প্রতি দণ্ড পল !
শুধু কি , মা , হাসিখেলা প্রতি দিন রাত
দিবসের প্রত্যেক প্রহর !
প্রভাতের পরে আসি নূতন প্রভাত
লিখিছে কি একই অক্ষর !
কানাকানি হাসাহাসি কোণেতে গুটায়ে ,
অলস নয়ননিমীলন ,
দণ্ড – দুই ধরণীর ধূলিতে লুটায়ে
ধূলি হয়ে ধূলিতে শয়ন !
নাই কি , মা , মানবের গভীর ভাবনা ,
হৃদয়ের সীমাহীন আশা !
জেগে নাই অন্তরেতে অনন্ত চেতনা ,
জীবনের অনন্ত পিপাসা !
হৃদয়েতে শুষ্ক কি , মা , উৎস করুণার ,
শুনি না কি দুখীর ক্রন্দন !
জগৎ শুধু কি , মা গো , তোমার আমার
ঘুমাবার কুসুম – আসন !
শুনো না কাহারা ওই করে কানাকানি
অতি তুচ্ছ ছোটো ছোটো কথা ।
পরের হৃদয় লয়ে করে টানাটানি ,
শকুনির মতো নির্মমতা।
শুনো না করিছে কারা কথা – কাটাকাটি
মাতিয়া জ্ঞানের অভিমানে ,
রসনায় রসনায় ঘোর লাঠালাঠি ,
আপনার বুদ্ধিরে বাখানে ।
তুমি এস দূরে এস , পবিত্র নিভৃতে ,
ক্ষুদ্র অভিমান যাও ভুলি ।
সযতনে ঝেড়ে ফেলো বসন হইতে
প্রতি নিমেষের যত ধূলি !
নিমেষের ক্ষুদ্র কথা ক্ষুদ্র রেণুজাল
আচ্ছন্ন করিছে মানবেরে ,
উদার অনন্ত তাই হতেছে আড়াল
তিল তিল ক্ষুদ্রতার ঘেরে ।
আছে মা , তোমার মুখে স্বর্গের কিরণ ,
হৃদয়েতে উষার আভাস ,
খুঁজিছে সরল পথ ব্যাকুল নয়ন —
চারি দিকে মর্ত্যের প্রবাস ।
আপনার ছায়া ফেলি আমরা সকলে
পথ তোর অন্ধকারে ঢাকি —
ক্ষুদ্র কথা , ক্ষুদ্র কাজে , ক্ষুদ্র শত ছলে ,
কেন তোরে ভুলাইয়া রাখি ।
কেন , মা , তোমারে কেহ চাহে না জানাতে
মানবের উচ্চ কুলশীল —
অনন্তজগৎ – ব্যাপী ঈশ্বরের সাথে
তোমার যে সুগভীর মিল ।
কেন কেহ দেখায় না — চারি দিকে তব
ঈশ্বরের বাহুর বিস্তার !
ঘেরি তোরে , ভোগসুখ ঢালি নব নব
গৃহ বলি রচে কারাগার ।
অনন্তের মাঝখানে দাঁড়াও , মা আসি ,
চেয়ে দেখো আকাশের পানে —
পড়ুক বিমলবিভা পূর্ণ রূপরাশি
স্বর্গমুখী কমলনয়ানে ।
আনন্দে ফুটিয়া ওঠো শুভ্র সূর্যোদয়ে
প্রভাতের কুসুমের মতো ,
দাঁড়াও সায়াহ্নমাঝে পবিত্র হৃদয়ে
মাথাখানি করিয়া আনত ।
শোনো শোনো উঠিতেছে সুগম্ভীর বাণী ,
ধ্বনিতেছে আকাশ পাতাল !
বিশ্ব – চরাচর গাহে কাহারে বাখানি
আদিহীন অন্তহীন কাল !
যাত্রী সবে ছুটিয়াছে শূন্যপথ দিয়া ,
উঠেছে সংগীতকোলাহল ,
ওই নিখিলের সাথে কণ্ঠ মিলাইয়া
মা , আমরা যাত্রা করি চল্ ।
যাত্রা করি বৃথা যত অহংকার হতে ,
যাত্রা করি ছাড়ি হিংসাদ্বেষ ,
যাত্রা করি স্বর্গময়ী করুণার পথে ,
শিরে ধরি সত্যের আদেশ ।
যাত্রা করি মানবের হৃদয়ের মাঝে
প্রাণে লয়ে প্রেমের আলোক ,
আয় , মা গো , যাত্রা করি জগতের কাজে
তুচ্ছ করি নিজ দুঃখশোক ।
জেনো , মা , এ সুখে – দুঃখে – আকুল সংসারে
মেটে না সকল তুচ্ছ আশ —
তা বলিয়া অভিমানে অনন্ত তাঁহারে
কোরো না , কোরো না অবিশ্বাস ।
সুখ ব ‘ লে যাহা চাই সুখ তাহা নয় ,
কী যে চাই জানি না আপনি —
আঁধারে জ্বলিছে ওই ওরে কোরো ভয় ,
ভুজঙ্গের মাথার ও মণি ।
ক্ষুদ্র সুখ ভেঙে যায় না সহে নিশ্বাস ,
ভাঙে বালুকার খেলাঘর —
ভেঙে গিয়ে বলে দেয় এ নহে আবাস ,
জীবনের এ নহে নির্ভর ।
সকলে শিশুর মতো কত আবদার
আনিছে তাঁহার সন্নিধান —
পূর্ণ যদি নাহি হল , অমনি তাহার
ঈশ্বরে করিছে অপমান !
কিছুই চাব না , মা গো , আপনার তরে ,
পেয়েছে যা শুধিব সে ঋণ —
পেয়েছি যে প্রেমসুধা হৃদয় – ভিতরে ,
ঢালিয়া তা দিব নিশিদিন ।
সুখ শুধু পাওয়া যায় সুখ না চাহিলে ,
প্রেম দিলে প্রেমে পুরে প্রাণ ,
নিশিদিশি আপনার ক্রন্দন গাহিলে
ক্রন্দনের নাহি অবসান ।
মধুপাত্রে হতপ্রাণ পিপীলির মতো
ভোগসুখে জীর্ণ হয়ে থাকা ,
ঝুলে থাকা বাদুড়ের মতো শির নত
আঁকড়িয়া সংসারের শাখা ,
জগতের হিসাবেতে শূন্য হয়ে হায়
আপনারে আপনি ভক্ষণ ,
ফুলে উঠে ফেটে যাওয়া জলবিম্ব প্রায় —
এই কি রে সুখের লক্ষণ ।
এই অহিফেনসুখ কে চায় ইহাকে !
মানবত্ব এ নয় এ নয় ।
রাহুর মতন সুখ গ্রাস করে রাখে
মানবের মানবহৃদয় ।
মানবেরে বল দেয় সহস্র বিপদ ,
প্রাণ দেয় সহস্র ভাবনা ,
দারিদ্র্যে খুঁজিয়া পাই মনের সম্পদ ,
শোকে পাই অনন্ত সান্ত্বনা ।