ওই বাঁশিস্বর তার আসে বার বার ,
সেই শুধু কেন আসে না !
এই হৃদয় – আসন শূন্য যে থাকে ,
কেঁদে মরে শুধু বাসনা ।
মিছে পরশিয়া কায় বায়ু বহে যায় ,
বহে যমুনার লহরী ,
কেন কুহু কুহু পিক কুহরিয়া ওঠে —
যামিনী যে ওঠে শিহরি ।
ওগো যদি নিশিশেষে আসে হেসে হেসে ,
মোর হাসি আর রবে কি !
এই জাগরণে ক্ষীণ বদন মলিন
আমারে হেরিয়া কবে কী !
আমি সারা রজনীর গাঁথা ফুলমালা
প্রভাতে চরণে ঝরিব ,
ওগো আছে সুশীতল যমুনার জল —
দেখে তারে আমি মরিব ।
বিরহীর পত্র
হয় কি না হয় দেখা , ফিরি কি না ফিরি ,
দূরে গেলে এই মনে হয় ;
দুজনার মাঝখানে অন্ধকারে ঘিরি
জেগে থাকে সতত সংশয় ।
এত লোক , এত জন , এত পথ গলি ,
এমন বিপুল এ সংসার —
ভয়ে ভয়ে হাতে হাতে বেঁধে বেঁধে চল , ি
ছাড়া পেলে কে আর কাহার ।
তারায় তারায় সদা থাকে চোখে চোখে
অন্ধকারে অসীম গগনে ।
ভয়ে ভয়ে অনিমেষে কম্পিত আলোকে
বাঁধা থাকে নয়নে নয়নে ।
চৌদিকে অটল স্তব্ধ সুগভীর রাত্রি ,
তরুহীন মরুময় ব্যোম —
মুখে মুখে চেয়ে তাই চলে যত যাত্রী
চলে গ্রহ রবি তারা সোম ।
নিমেষের অন্তরালে কী আছে কে জানে ,
নিমেষে অসীম পড়ে ঢাকা —
অন্ধ কালতুরঙ্গম রাশ নাহি মানে ,
বেগে ধায় অদৃষ্টের চাকা ।
কাছে কাছে পাছে পাছে চলিবারে চাই ,
জেগে জেগে দিতেছি পাহারা ,
একটু এসেছে ঘুম — চমকি তাকাই
গেছে চলে কোথায় কাহারা !
ছাড়িয়ে চলিয়া গেলে কাঁদি তাই একা
বিরহের সমুদ্রের তীরে ।
অনন্তের মাঝখানে দু – দন্ডের দেখা
তাও কেন রাহু এসে ঘিরে !
মৃত্যু যেন মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যায় ,
পাঠায় সে বিরহের চর ।
সকলেই চলে যাবে , পড়ে রবে হায়
ধরণীর শূন্য খেলাঘর ।
গ্রহ তারা ধূমকেতু কত রবি শশী
শূন্য ঘেরি জগতের ভিড় ,
তারি মাঝে যদি ভাঙে , যদি যায় খসি
আমাদের দু – দন্ডের নীড় —
কোথায় কে হারাইব! কোন্ রাত্রিবেলা
কে কোথায় হইব অতিথি !
তখন কি মনে রবে দু – দিনের খেলা ,
দরশের পরশের স্মৃতি !
তাই মনে করে কি রে চোখে জল আসে
একটুকু চোখের আড়ালে !
প্রাণ যারে প্রাণের অধিক ভালোবাসে
সেও কি রবে না এক কালে !
আশা নিয়ে এ কি শুধু খেলাই কেবল —
সুখ দুঃখ মনের বিকার !
ভালোবাসা কাঁদে , হাসে , মোছে অশ্রুজল ,
চায় , পায় , হারায় আবার ।
বিলাপ
ওগো এত প্রেম – আশা প্রাণের তিয়াষা
কেমনে আছে সে পাসরি !
তবে সেথা কি হাসে না চাঁদিনী যামিনী ,
সেথা কি বাজে না বাঁশরি !
সখী , হেথা সমীরণ লুটে ফুলবন ,
সেথা কি পবন বহে না !
সে যে তার কথা মোরে কহে অনুক্ষণ
মোর কথা তারে কহে না !
যদি আমারে আজি সে ভুলিবে সজনী
আমারে ভুলাল কেন সে !
ওগো এ চির জীবন করিব রোদন
এই ছিল তার মানসে !
যবে কুসুমশয়নে নয়নে নয়নে
কেটেছিল সুখরাতি রে ,
তবে কে জানিত তার বিরহ আমার
হবে জীবনের সাথী রে !
যদি মনে নাহি রাখে , সুখে যদি থাকে ,
তোরা একবার দেখে আয় —
এই নয়নের তৃষা পরানের আশা
চরণের তলে রেখে আয় ।
আর নিয়ে যা রাধার বিরহের ভার ,
কত আর ঢেকে রাখি বল্ ।
আর পারিস যদি তো আনিস হরিয়ে
এক – ফোঁটা তার আঁখিজল ।
না না , এত প্রেম সখী ভুলিতে যে পারে
তারে আর কেহ সেধো না ।
আমি কথা নাহি কব , দুখ লয়ে রব ,
মনে মনে স ‘ ব বেদনা ।
ওগো মিছে , মিছে সখী , মিছে এই প্রেম ,
মিছে পরানের বাসনা ।
ওগো সুখদিন হায় যবে চলে যায়
আর ফিরে আর আসে না ।।
বৈতরণী
অশ্রুস্রোতে স্ফীত হয়ে বহে বৈতরণী ,
চৌদিকে চাপিয়া আছে আঁধার রজনী ।
পূর্ব তীর হতে হু হু আসিছে নিশ্বাস ,
যাত্রী লয়ে পশ্চিমেতে চলেছে তরণী ।
মাঝে মাঝে দেখা দেয় বিদ্যুৎ – বিকাশ ,
কেহ কারে নাহি চেনে ব’সে নতশিরে ।
গলে ছিল বিদায়ের অশ্রুকণা – হার ,
ছিন্ন হয়ে একে একে ঝ’রে পড়ে নীরে ।
ওই বুঝি দেখা যায় ছায়া – পরপার ,
অন্ধকারে মিটিমিটি তারা – দীপ জ্বলে ।
হোথায় কি বিস্মরণ , নিঃস্বপ্ন নিদ্রার
শয়ন রচিয়া দিবে ঝরা ফুলদলে !
অথবা অকূলে শুধু অনন্ত রজনী
ভেসে চলে কর্ণধারবিহীন তরণী !
ভবিষ্যতের রঙ্গভূমি
সম্মুখে রয়েছে পড়ি যুগ – যুগান্তর ।
অসীম নীলিমে লুটে ধরণী ধাইবে ছুটে ,
প্রতিদিন আসিবে , যাইবে রবিকর ।
প্রতিদিন প্রভাতে জাগিবে নরনারী ,
প্রতিসন্ধ্যা শ্রান্তদেহে ফিরিয়া আসিবে গেহে ,
প্রতিরাত্রে তারকা ফুটিবে সারি সারি ।
কত আনন্দের ছবি , কত সুখ আশা
আসিবে যাইবে হায় , সুখ – স্বপনের প্রায়
কত প্রাণে জাগিবে , মিলাবে ভালোবাসা ।
তখনো ফুটিবে হেসে কুসুম – কানন ,
তখনো রে কত লোকে কত স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে
আঁকিবে আকাশ – পটে সুখের স্বপন ।
নিবিলে দিনের আলো , সন্ধ্যা হলে , নিতি
বিরহী নদীর ধারে না জানি ভাবিবে কারে ,
না – জানি সে কী কাহিনী , কী সুখ , কী স্মৃতি ।
দূর হতে আসিতেছে , শুন কান পেতে —
কত গান , সেই মহা – রঙ্গভূমি হতে
কত যৌবনের হাসি , কত উৎসবের বাঁশি ,
তরঙ্গের কলধ্বনি প্রমোদের স্রোতে ।
কত মিলনের গীত , বিরহের শ্বাস ,
তুলেছে মর্মর তান বসন্ত – বাতাস ,
সংসারের কোলাহল ভেদ করি অবিরল
লক্ষ নব কবি ঢালে প্রাণের উচ্ছ্বাস ।
ওই দূর খেলাঘরে খেলাইছ কারা !
উঠেছে মাথার’পরে আমাদেরি তারা ।
আমাদেরি ফুলগুলি সেথাও নাচিছে দুলি ,
আমাদেরি পাখিগুলি গেয়ে হল সারা ।
ওই দূর খেলাঘরে করে আনাগোনা
হাসে কাঁদে কত কে যে নাহি যায় গণা ।
আমাদের পানে হায় ভুলেও তো নাহি চায় ,
মোদের ওরা তো কেউ ভাই বলিবে না
ওই – সব মধুমুখ অমৃত – সদন ,
না জানি রে আর কারা করিবে চুম্বন ।
শরমময়ীর পাশে বিজড়িত আধ – ভাষে
আমরা তো শুনাব না প্রাণের বেদন ।
আমাদের খেলাঘরে কারা খেলাইছ !
সাঙ্গ না হইতে খেলা চলে এনু সন্ধেবেলা ,
ধূলির সে ঘর ভেঙে কোথা ফেলাইছ ।
হোথা , যেথা বসিতাম মোরা দুই জন ,
হাসিয়া কাঁদিয়া হত মধুর মিলন ,
মাটিতে কাটিয়া রেখা কত লিখিতাম লেখা ,
কে তোরা মুছিলি সেই সাধের লিখন ।
সুধাময়ী মেয়েটি সে হোথায় লুটিত ,
চুমো খেলে হাসিটুকু ফুটিয়া উঠিত ।
তাই রে মাধবীলতা মাথা তুলেছিল হোথা ,
ভেবেছিনু চিরদিন রবে মুকুলিত ।
কোথায় রে , কে তাহারে করিলি দলিত ।