কোথায় সে গুন গুন ঝরঝর মরমর ,
কোথা সে মাথার’পরে লতাপাতা থরথর ।
কোথায় সে ছায়া আলো , ছেলেমেয়ে খেলাধূলি ,
কোথা সে ফুলের মাঝে এলোচুলে হাসিগুলি ।
কোথা রে সরল প্রাণ , গভীর আনন্দ – গান ,
অসীম শান্তির মাঝে প্রাণের সাধের গেহ ,
তরুর শীতল ছায়া , বনের শ্যামল স্নেহ ।
বন্দী
দাও খুলে দাও , সখী , ওই বাহুপাশ —
চুম্বনমদিরা আর করায়ো না পান ।
কুসুমের কারাগারে রুদ্ধ এ বাতাস —
ছেড়ে দাও , ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান ।
কোথায় উষার আলো , কোথায় আকাশ —
এ চির পূর্ণিমারাত্রি হোক অবসান ।
আমারে ঢেকেছে তব মুক্ত কেশপাশ ,
তোমার মাঝারে আমি নাহি দেখি ত্রাণ !
আকুল অঙ্গুলিগুলি করি কোলাকুলি
গাঁথিছে সর্বাঙ্গে মোর পরশের ফাঁদ ।
ঘুমঘোরে শূন্যপানে দেখি মুখ তুলি
শুধু অবিশ্রামহাসি একখানি চাঁদ ।
স্বাধীন করিয়া দাও , বেঁধো না আমায় —
স্বাধীন হৃদয়খানি দিব তার পায় ।
বসন্ত-অবসান
কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান!
কখন বকুল-মূল ছেয়েছিল ঝরা ফুল ,
কখন যে ফুল-ফোটা হয়ে গেল অবসান !
কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান !
এবার বসন্তে কি রে যুথীগুলি জাগে নি রে !
অলিকুল গুঞ্জরিয়া করে নি কি মধুপান !
এবার কি সমীরণ জাগয় নি ফুলবন ,
সাড়া দিয়ে গেল না তো , চলে গেল ম্রিয়মাণ !
কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান!
যতগুলি পাখি ছিল গেয়ে বুঝি চলে গেল ,
সমীরণে মিলে গেল বনের বিলাপতান ।
ভেঙেছে ফুলের মেলা , চলে গেছে হাসি – খেলা ,
এতক্ষণে সন্ধ্যাবেলা জাগিয়া চাহিল প্রাণ ।
কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান !
বসন্তের শেষ রাতে এসেছি রে শূন্য হাতে ,
এবার গাঁথি নি মালা , কী তোমারে করি দান !
কাঁদিছে নীরব বাঁশি , অধরে মিলায় হাসি ,
তোমার নয়নে ভাসে ছলছল অভিমান ।
এবার বসন্ত গেল , হল না , হল না গান !
বাঁশি
ওগো , শোনো কে বাজায় !
বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়।
অধর ছুঁয়ে বাঁশিখানি চুরি করে হাসিখানি ,
বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায় ।
ওগো শোনো কে বাজায় !
কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে ,
বকুলগুলি আকুল হয়ে বাঁশির গানে মুঞ্জরে ।
যমুনারই কলতান কানে আসে , কাঁদে প্রাণ ,
আকাশে ঐ মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায় !
ওগো শোনো কে বাজায় !
বাকি
কুসুমের গিয়েছে সৌরভ,
জীবনের গিয়েছে গৌরব।
এখন যা-কিছু সব ফাঁকি,
ঝরিতে মরিতে শুধু বাকি।
বাসনার ফাঁদ
যারে চাই তার কাছে আমি দিই ধরা ,
সে আমার না হইতে আমি হই তার ।
পেয়েছি বলিয়ে মিছে অভিমান করা ,
অন্যেরে বাঁধিতে গিয়ে বন্ধন আমার ।
নিরখিয়া দ্বারমুক্ত সাধের ভাণ্ডার
দুই হাতে লুটে নিই রত্ন ভূরি ভূরি —
নিয়ে যাব মনে করি , ভারে চলা ভার ,
চোরা দ্রব্য বোঝা হয়ে চোরে করে চুরি ।
চিরদিন ধরণীর কাছে ঋণ চাই ,
পথের সম্বল ব ‘ লে জমাইয়া রাখি ,
আপনারে বাঁধা রাখি সেটা ভুলে যাই —
পাথেয় লইয়া শেষে কারাগারে থাকি ।
বাসনার বোঝা নিয়ে ডোবে – ডোবে তরী —
ফেলিতে সরে না মন , উপায় কী করি!
বাহু
কাহারে জড়াতে চাহে দুটি বাহুলতা ,
কাহারে কাঁদিয়া বলে ‘যেয়ো না যেয়ো না’।
কেমনে প্রকাশ করে ব্যাকুল বাসনা ,
কে শুনেছে বাহুর নীরব আকুলতা!
কোথা হতে নিয়ে আসে হৃদয়ের কথা ,
গায়ে লিখে দিয়ে যায় পুলক – অক্ষরে ।
পরশে বহিয়া আনে মরমবারতা ,
মোহ মেখে রেখে যায় প্রাণের ভিতরে ।
কণ্ঠ হতে উতারিয়া যৌবনের মালা
দুইটি আঙুলে ধরি তুলি দেয় গলে ।
দুটি বাহু বহি আনে হৃদয়ের ডালা ,
রেখে দিয়ে যায় যেন চরণের তলে ।
লতায়ে থাকুক বুকে চির আলিঙ্গন ,
ছিঁড়ো না ছিঁড়ো না দুটি বাহুর বন্ধন ।
বিজনে
আমারে ডেকো না আজি , এ নহে সময় —
একাকী রয়েছি হেথা গভীর বিজন ,
রুধিয়া রেখেছি আমি অশান্ত হৃদয় ,
দুরন্ত হৃদয় মোর করিব শাসন ।
মানবের মাঝে গেলে এ যে ছাড়া পায় ,
সহস্রের কোলাহলে হয় পথহারা ,
লুব্ধ মুষ্টি যাহা পায় আঁকড়িতে চায় ,
চিরদিন চিররাত্রি কেঁদে কেঁদে সারা ।
ভর্ৎসনা করিব তারে বিজনে বিরলে ,
একটুকু ঘুমাক সে কাঁদিয়া কাঁদিয়া ,
শ্যামল বিপুল কোলে আকাশ – অঞ্চলে
প্রকৃতি জননী তারে রাখুন বাঁধিয়া ।
শান্ত স্নেহকোলে বসে শিখুক সে স্নেহ ,
আমারে আজিকে তোরা ডাকিস নে কেহ ।
বিবসনা
ফেলো গো বসন ফেলো — ঘুচাও অঞ্চল ।
পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ
সুরবালিকার বেশ কিরণবসন ।
পরিপূর্ণ তনুখানি বিকচ কমল ,
জীবনের যৌবনের লাবণ্যের মেলা ।
বিচিত্র বিশ্বের মাঝে দাঁড়াও একেলা ।
সর্বাঙ্গে পড়ুক তব চাঁদের কিরণ ,
সর্বাঙ্গে মলয় – বায়ু করুক সে খেলা ।
অসীম নীলিমা – মাঝে হও নিমগন
তারাময়ী বিবসনা প্রকৃতির মতো ।
অতনু ঢাকুক মুখ বসনের কোণে
তনুর বিকাশ হেরি লাজে শির নত ।
আসুক বিমল উষা মানবভবনে ,
লাজহীনা পবিত্রতা — শুভ্র বিবসনে ।
বিরহ
আমি নিশি – নিশি কত রচিব শয়ন
আকুলনয়ন রে !
কত নিতি – নিতি বনে করিব যতনে
কুসুমচয়ন রে !
কত শারদ যামিনী হইবে বিফল ,
বসন্ত যাবে চলিয়া !
কত উদিবে তপন আশার স্বপন ,
প্রভাতে যাইবে ছলিয়া !
এই যৌবন কত রাখিব বাঁধিয়া ,
মরিব কাঁদিয়া রে !
সেই চরণ পাইলে মরণ মাগিব
সাধিয়া সাধিয়া রে ।
আমি কার পথ চাহি এ জনম বাহি ,
কার দরশন যাচি রে !
যেন আসিবে বলিয়া কে গেছে চলিয়া ,
তাই আমি বসে আছি রে ।
তাই মালাটি গাঁথিয়া পরেছি মাথায়
নীলবাসে তনু ঢাকিয়া ,
তাই বিজন আলয়ে প্রদীপ জ্বালায়ে
একেলা রয়েছি জাগিয়া ।
ওগো তাই কত নিশি চাঁদ ওঠে হাসি ,
তাই কেঁদে যায় প্রভাতে ।
ওগো তাই ফুলবনে মধুসমীরণে
ফুটে ফুল কত শোভাতে !