- বইয়ের নামঃ কড়ি ও কোমল
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অক্ষমতা
এ যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা —
সলিল রয়েছে প ‘ ড়ে , শুধু দেহ নাই ।
এ কেবল হৃদয়ের দুর্বল দুরাশা
সাধের বস্তুর মাঝে করে চাই – চাই ।
দুটি চরণেতে বেঁধে ফুলের শৃঙ্খল
কেবল পথের পানে চেয়ে বসে থাকা!
মানবজীবন যেন সকলি নিষ্ফল —
বিশ্ব যেন চিত্রপট , আমি যেন আঁকা !
চিরদিন বুভুক্ষিত প্রাণহুতাশন
আমারে করিছে ছাই প্রতি পলে পলে ,
মহত্ত্বের আশা শুধু ভারের মতন
আমারে ডুবায়ে দেয় জড়ত্বের তলে ।
কোথা সংসারের কাজে জাগ্রত হৃদয়!
কোথা রে সাহস মোর অস্থিমজ্জাময় !
অঞ্চলের বাতাস
পাশ দিয়ে গেল চলি চকিতের প্রায় ,
অঞ্চলের প্রান্তখানি ঠেকে গেল গায় ,
শুধু দেখা গেল তার আধখানি পাশ —
শিহরি পরশি গেল অঞ্চলের বায় ।
অজানা হৃদয়বনে উঠেছে উচ্ছ্বাস ,
অঞ্চলে বহিয়া এল দক্ষিণবাতাস ,
সেথা যে বেজেছে বাঁশি তাই শুনা যায় ,
সেথায় উঠিছে কেঁদে ফুলের সুবাস ।
কার প্রাণখানি হতে করি হায় – হায়
বাতাসে উড়িয়া এল পরশ – আভাস !
ওগো কার তনুখানি হয়েছে উদাস ,
ওগো কে জানাতে চাহে মরম বারতা !
দিয়ে গেল সর্বাঙ্গের আকুল নিশ্বাস ,
বলে গেল সর্বাঙ্গের কানে কানে কথা ।।
অস্তমান রবি
আজ কি , তপন , তুমি যাবে অস্তাচলে
না শুনে আমার মুখে একটিও গান !
দাঁড়াও গো , বিদায়ের দুটি কথা বলে
আজিকার দিন আমি করি অবসান ।
থামো ওই সমুদ্রের প্রান্তরেখা -‘ পরে ,
মুখে মোর রাখো তব একমাত্র আঁখি ।
দিবসের শেষ পলে নিমেষের তরে
তুমি চেয়ে থাকো আর আমি চেয়ে থাকি ।
দুজনের আঁখি -‘ পরে সায়াহ্ন – আঁধার
আঁখির পাতার মতো আসুক মুদিয়া ,
গভীর তিমিরস্নিগ্ধ শান্তির পাথার
নিবায়ে ফেলুক আজি দুটি দীপ্ত হিয়া ।
শেষ গান সাঙ্গ করে থেমে গেছে পাখি ,
আমার এ গানখানি ছিল শুধু বাকি ।
» অস্তাচলের পরপারে
সন্ধ্যাসূর্যের প্রতি
আমার এ গান তুমি যাও সাথে করে
নূতন সাগরতীরে দিবসের পানে ।
সায়াহ্নের কূল হতে যদি ঘুমঘোরে
এ গান উষার কূলে পশে কারো কানে!
সারা রাত্রি নিশীথের সাগর বাহিয়া
স্বপনের পরপারে যদি ভেসে যায় ,
প্রভাত – পাখিরা যবি উঠিবে গাহিয়া
আমার এ গান তারা যদি খুঁজে পায় ।
গোধূলির তীরে বসে কেঁদেছে যে জন ,
ফেলেছে আকাশে চেয়ে অশ্রুজল কত ,
তার অশ্রু পড়িবে কি হইয়া নূতন
নবপ্রভাতের মাঝে শিশিরের মতো ।
সায়াহ্নের কুঁড়িগুলি আপনা টুটিয়া
প্রভাতে কি ফুল হয়ে উঠে না ফুটিয়া !
আকাঙ্ক্ষা
আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে
কী জানি পরান কী যে চায় !
ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে
বিহগবিহগী কী যে গায় !
আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে ,
রহে না আবাসে মন হায় !
কোন্ কুসুমের আশে , কোন্ ফুলবাসে
সুনীল আকাশে মন ধায় !
আজি কে যেন গো নাই , এ প্রভাতে তাই
জীবন বিফল হয় গো !
তাই চারি দিকে চায় , মন কেঁদে গায় —
‘ এ নহে , এ নহে , নয় গো ! ‘
কোন্ স্বপনের দেশে আছে এলোকেশে
কোন্ ছায়াময়ী অমরায় !
আজি কোন্ উপবনে বিরহবেদনে
আমারি কারণে কেঁদে যায় !
আমি যদি গাঁথি গান অথির – পরান
সে গান শুনাব কারে আর !
আমি যদি গাঁথি মালা লয়ে ফুলডালা
কাহারে পরাব ফুলহার !
আমি আমার এ প্রাণ যদি করি দান
দিব প্রাণ তবে কার পায় !
সদা ভয় হয় মনে পাছে অযতনে
মনে মনে কেহ ব্যথা পায় !
আত্ম-অপমান
মোছো তবে অশ্রুজল , চাও হাসিমুখে
বিচিত্র এ জগতের সকলের পানে ।
মানে আর অপমানে সুখে আর দুখে
নিখিলের ডেকে লও প্রসন্ন পরানে ।
কেহ ভালোবাসে কেহ নাহি ভালোবাসে ,
কেহ দূরে যায় কেহ কাছে চলে আসে —
আপনার মাঝে গৃহ পেতে চাও যদি
আপনারে ভুলে তবে থাকো নিরবধি ।
ধনীর সন্তান আমি , নহি গো ভিখারি ,
হৃদয়ে লুকানো আছে প্রেমের ভাণ্ডার —
আমি ইচ্ছা করি যদি বিলাইতে পারি
গভীর সুখের উৎস হৃদয় আমার ।
দুয়ারে দুয়ারে ফিরি মাগি অন্নপান
কেন আমি করি তবে আত্ম-অপমান !
আত্মাভিমান
আপনি কণ্টক আমি , আপনি জর্জর ।
আপনার মাঝে আমি শুধু ব্যথা পাই ।
সকলের কাছে কেন যাচি গো নির্ভর —
গৃহ নাই , গৃহ নাই , মোর গৃহ নাই !
অতি তীক্ষ্ম অতি ক্ষুদ্র আত্ম – অভিমান
সহিতে পারে না হায় তিল অসম্মান ।
আগেভাগে সকলের পায়ে ফুটে যায়
ক্ষুদ্র ব ‘ লে পাছে কেহ জানিতে না পায় ।
বরঞ্চ আঁধারে রব ধুলায় মলিন ,
চাহি না চাহি না এই দীন অহংকার —
আপন দারিদ্র্যে আমি রহিব বিলীন ,
বেড়াব না চেয়ে চেয়ে প্রসাদ সবার ।
আপনার মাঝে যদি শান্তি পায় মন
বিনীত ধুলার শয্যা সুখের শয়ন ।
আহ্বানগীত
পৃথিবী জুড়িয়া বেজেছে বিষাণ ,
শুনিতে পেয়েছি ওই —
সবাই এসেছে লইয়া নিশান ,
কই রে বাঙালি কই !
সুগভীর স্বর কাঁদিয়া বেড়ায়
বঙ্গসাগরের তীরে ,
‘ বাঙালির ঘরে কে আছিস আয়‘
ডাকিতেছে ফিরে ফিরে ।
ঘরে ঘরে কেন দুয়ার ভেজানো ,
পথে কেন নাই লোক ,
সারা দেশ ব্যাপি মরেছে কে যেন —
বেঁচে আছে শুধু শোক ।
গঙ্গা বহে শুধু আপনার মনে ,
চেয়ে থাকে হিমগিরি ,
রবি শশী উঠে অনন্ত গগনে
আসে যায় ফিরি ফিরি ।
কত – না সংকট , কত – না সন্তাপ
মানবশিশুর তরে ,
কত – না বিবাদ কত – না বিলাপ
মানবশিশুর ঘরে !
কত ভায়ে ভায়ে নাহি যে বিশ্বাস ,
কেহ কারে নাহি মানে ,
ঈর্ষা নিশাচরী ফেলিছে নিশ্বাস
হৃদয়ের মাঝখানে ।
হৃদয়ে লুকানো হৃদয়বেদনা ,
সংশয় – আঁধারে যুঝে ,
কে কাহারে আজি দিবে গো সান্ত্বনা —
কে দিবে আলয় খুঁজে !
মিটাতে হইবে শোক তাপ ত্রাস ,
করিতে হইবে রণ ,
পৃথিবী হইতে উঠেছে উচ্ছ্বাস —
শোনো শোনো সৈন্যগণ !
পৃথিবী ডাকিছে আপন সন্তানে ,
বাতাস ছুটেছে তাই —
গৃহ তেয়াগিয়া ভায়ের সন্ধানে
চলিয়াছে কত ভাই ।
বঙ্গের কুটিরে এসেছে বারতা ,
শুনেছে কি তাহা সবে ?
জেগেছে কি কবি শুনাতে সে কথা
জালদগম্ভীর রবে ?
হৃদয় কি কারো উঠেছে উথলি ?
আঁখি খুলেছে কি কেহ ?
ভেঙেছে কি কেহ সাধের পুতলি ?
ছেড়েছে খেলার গেহ ?
কেন কানাকানি , কেন রে সংশয় ?
কেন মরো ভয়ে লাজে ?
খুলে ফেলো দ্বার , ভেঙে ফেলো ভয় ,
চলো পৃথিবীর মাঝে ।
ধরাপ্রান্তভাগে ধুলিতে লুটায়ে ,
জড়িমাজড়িত তনু ,
আপনার মাঝে আপনি গুটায়ে
ঘুমায় কীটের অণু ।
চারি দিকে তার আপন – উল্লাসে
জগৎ ধাইছে কাজে ,
চারি দিকে তার অনন্ত আকাশে
স্বরগসংগীত বাজে !
চারি দিকে তার মানবমহিমা
উঠিছে গগনপানে ,
খুঁজিছে মানব আপনার সীমা
অসীমের মাঝখানে !
সে কিছুই তার করে না বিশ্বাস ,
আপনারে জানে বড়ো —
আপনি গণিছে আপন নিশ্বাস ,
ধুলা করিতেছে জড়ো ।
সুখদুঃখ লয়ে অনন্ত সংগ্রাম ,
জগতের রঙ্গভূমি —
হেথায় কে চায় ভীরুর বিশ্রাম ,
কেন গো ঘুমাও তুমি ।
ডুবিছ ভাসিছ অশ্রুর হিল্লোলে ,
শুনিতেছ হাহাকার —
তীর কোথা আছে দেখো মুখ তুলে ,
এ সমুদ্র করো পার ।
মহা কলরবে সেতু বাঁধে সবে ,
তুমি এসো , দাও যোগ —
বাধার মতন জড়াও চরণ
এ কী রে করম – ভোগ ।
তা যদি না পারো সরো তবে সরো ,
ছড়ে দাও তবে স্থান ,
ধুলায় পড়িয়া মরো তবে মরো —
কেন এ বিলাপগান !