আমি শুনি শুয়ে
বিজন বালু – ভুঁয়ে ,
তুমি শোন কাঁখের কলস
ঘাটের ‘ পরে থুয়ে ।
তুমি তাহার গানে
বোঝ একটা মানে ,
আমার কূলে আরেক অর্থ
ঠেকে আমার কানে ।
তোমার আমার মাঝখানেতে
একটি বহে নদী ,
দুই তটেরে একই গান সে
শোনায় নিরবধি ।
দুই বোন
দুটি বোন তারা হেসে যায় কেন
যায় যবে জল আনতে ?
দেখেছি কি তারা পথিক কোথায়
দাঁড়িয়ে পথের প্রান্তে ?
ছায়ায় নিবিড় বনে
যে আছে আঁধার কোণে
তারে যে কখন কটাক্ষে চায়
কিছু তো পারি নে জানতে ।
দুটি বোন তারা হেসে যায় কেন
যায় যবে জল আনতে ?
দুটি বোন তারা করে কানাকানি
কী না জানি জল্পনা !
গুঞ্জনধ্বনি দূর হতে শুনি ,
কী গোপন মন্ত্রণা !
আসে যবে এইখানে
চায় দোঁহে দোঁহাপানে ,
কাহা র ও মনের কোনো কথা তারা
করেছে কি কল্পনা ?
দুটি বোন তারা করে কানাকানি
কী না জানি জল্পনা !
এইখানে এসে ঘট হতে কেন
জল উঠে উচ্ছলি ?
চপল চক্ষে তরল তারকা
কেন উঠে উজ্জ্বলি ?
যেতে যেতে নদীপথে
জেনেছ কি কোনোমতে
কাছে কোথা এক আকুল হৃদয়
দুলে উঠে চঞ্চলি ?
এইখানে এসে ঘট হতে জল
কেন উঠে উচ্ছলি ?
দুটি বোন তারা হেসে যায় কেন
যায় যবে জল আনতে ?
বটের ছায়ায় কেহ কি তাদের
পড়েছে চোখের প্রান্তে ?
কৌতুকে কেন ধায়
সচকিত দ্রুত পায় ?
কলসে কাঁকন ঝলকি ঝনকি
ভোলায় রে দিক্ভ্রান্তে ।
দুটি বোন তারা হেসে যায় কেন
যায় যবে জল আনতে ?
দুর্দিন
এতদিন পরে প্রভাতে এসেছ
কী জানি কী ভাবি মনে ।
ঝড় হয়ে গেছে কাল রজনীতে
রজনীগন্ধাবনে ।
কাননের পথ ভেসে গেছে জলে ,
বেড়াগুলি ভেঙে পড়েছে ভূতলে ,
নব ফুটন্ত ফুলের দণ্ড
লুটায় তৃণের সনে ।
এতদিন পরে তুমি যে এসেছ
কী জানি কী ভাবি মনে ।
হেরো গো আজিও প্রভাত অরুণ
মেঘের আড়ালে হারা ,
রহি রহি আজো ঘনায়ে ঘনায়ে
ঝরিছে বাদলধারা ।
মাতাল বাতাস আজো থাকি থাকি
চেতিয়া চেতিয়া উঠে ডাকি ডাকি ,
জড়িত পাতায় সিক্ত শাখায়
দোয়েল দেয় না সাড়া ।
আজিও আঁধার প্রভাতে অরুণ
মেঘের আড়ালে হারা ।
এ ভরা বাদলে আর্দ্র আঁচলে
একেলা এসেছ আজি ,
এনেছ বহিয়া রিক্ত তোমার
পূজার ফুলের সাজি ।
এত মধুমাস গেছে বার বার—
ফুলের অভাব ঘটে নি তোমার ,
বন আলো করি ফুটেছিল যবে
রজনীগন্ধারাজি ।
এ ভরা বাদলে আর্দ্র আঁচলে
একেলা এসেছ আজি ।
আজি তরুতলে দাঁড়ায়েছে জল ,
কোথা বসিবার ঠাঁই ?
কাল যাহা ছিল সে ছায়া সে আলো
সে গন্ধগান নাই ।
তবু ক্ষণকাল রহ ত্বরাহীন ,
ছিন্ন কুসুম পঙ্কে মলিন
ভূতল হইতে যতনে তুলিয়া
ধুয়ে ধুয়ে দিব তাই ।
আজি তরুতলে দাঁড়ায়েছে জল ,
কোথা বসিবার ঠাঁই ?
এত দিন পরে তুমি যে এসেছ
কী জানি কী ভাবি মনে ।
প্রভাত আজিকে অরুণবিহীন ,
কুসুম লুটায় বনে ।
যাহা আছে লও প্রসন্ন করে ,
ও সাজি তোমার ভরে কি না ভরে
ওই যে আবার নামে বারিধার
ঝরঝর বরষনে ।
এতদিন পরে তুমি যে এসেছ
কী জানি কী ভাবি মনে ।
নববর্ষা
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচে রে , হৃদয়
নাচে রে ।
শত বরনের ভাব – উচ্ছ্বাস
কলাপের মতো করেছে বিকাশ ,
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া
উল্লাসে কারে যাচে রে ।
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচে রে !
গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি
গরজে গগনে গগনে , গরজে
গগনে ।
ধেয়ে চলে আসে বাদলের ধারা ,
নবীন ধান্য দুলে দুলে সারা ,
কুলায়ে কাঁপিছে কাতর কপোত ,
দাদুরি ডাকিছে সঘনে ।
গুরুগুরু মেঘ গুমরি গুমরি
গরজে গগনে গগনে ।
নয়নে আমার সজল মেঘের
নীল অঞ্জন লেগেছে , নয়নে
লেগেছে ।
নবতৃণদলে ঘনবনছায়ে
হরষ আমার দিয়েছি বিছায়ে ,
পুলকিত নীপনিকুঞ্জ আজি
বিকশিত প্রাণ জেগেছে ।
নয়নে সজল স্নিগ্ধ মেঘের
নীল অঞ্জন লেগেছে ।
ওগো , প্রাসাদের শিখরে আজিকে
কে দিয়েছে কেশ এলায়ে , কবরী
এলায়ে ?
ওগো , নবঘন নীলবাসখানি
বুকের উপরে কে লয়েছে টানি ?
তড়িৎ – শিখার চকিত আলোকে
ওগো , কে ফিরিছে খেলায়ে ?
ওগো , প্রাসাদের শিখরে আজিকে
কে দিয়েছে কেশ এলায়ে ?
ওগো , নদীকূলে তীরতৃণতলে
কে ব’সে অমল বসনে , শ্যামল
বসনে ?
সুদূর গগনে কাহারে সে চায় ?
ঘাট ছেড়ে ঘট কোথা ভেসে যায় ?
নবমালতীর কচি দলগুলি
আনমনে কাটে দশনে ।
ওগো , নদীকূলে তীরতৃণতলে
কে ব ‘ সে শ্যামল বসনে ?
ওগো , নির্জনে বকুল শাখায়
দোলায় কে আজি দুলিছে , দোদুল
দুলিছে ?
ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল ,
আঁচল আকাশে হতেছে আকুল ,
উড়িয়া অলক ঢাকিছে পলক—
কবরী খসিয়া খুলিছে ।
ওগো , নির্জনে বকুলশাখায়
দোলায় কে আজি দুলিছে ?
বিকচকেতকী তটভূমি -‘ পরে
কে বেঁধেছে তার তরণী , তরুণ
তরণী ?
রাশি রাশি তুলি শৈবালদল
ভরিয়া লয়েছে লোল অঞ্চল ,
বাদলরাগিণী সজলনয়নে
গাহিছে পরানহরণী ।
বিকচকেতকী তটভূমি -‘ পরে
বেঁধেছে তরুণ তরণী ।
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচে রে , হৃদয়
নাচে রে ।
ঝরে ঘনধারা নবপল্লবে ,
কাঁপিছে কানন ঝিল্লির রবে ,
তীর ছাপি নদী কলকল্লোলে
এল পল্লীর কাছে রে ।
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচে রে ।
নষ্ট স্বপ্ন
কালকে রাতে মেঘের গরজনে
রিমিঝিমি – বাদল – বরিষনে
ভাবিতেছিলাম একা একা—
স্বপ্ন যদি যায় রে দেখা
আসে যেন তাহার মূর্তি ধ’রে
বাদলা রাতে আধেক ঘুমঘোরে ।