সেদিন আমি ভেবেছিলেম
মনে মনে ,
হতবিধির যত বিবাদ
আমার সনে ।
ঝড় এল যে আচম্বিতে
পাতার ভেলা ডুবিয়ে দিতে ,
আর কিছু তার ছিল না কাজ
ত্রিভুবনে ।
হতবিধির যত বিবাদ
আমার সনে ।
আজ আষাঢ়ে একলা ঘরে
কাটল বেলা ,
ভাবতেছিলেম এত দিনের
নানান খেলা ।
ভাগ্য -‘ পরে করিয়া রোষ
দিতেছিলেম বিধিরে দোষ—
পড়ল মনে , নালার জলে
পাতার ভেলা ।
ভাবতেছিলেম এত দিনের
নানান খেলা ।
চিরায়মানা
যেমন আছ তেমনি এসো ,
আর কোরো না সাজ ।
বেণী নাহয় এলিয়ে রবে ,
সিঁথে নাহয় বাঁকা হবে ,
নাই বা হল পত্রলেখায়
সকল কারুকাজ ।
কাঁচল যদি শিথিল থাকে
নাইকো তাহে লাজ ।
যেমন আছ তেমনি এসো ,
আর কোরো না সাজ ।
এসো দ্রুত চরণ দুটি
তৃণের ‘ পরে ফেলে ।
ভয় কোরো না , অলক্তরাগ
মোছে যদি মুছিয়া যাক—
নূপুর যদি খুলে পড়ে
নাহয় রেখে এলে ।
খেদ কোরো না মালা হতে
মুক্তা খ’সে গেলে ।
এসো দ্রুত চরণ দুটি
তৃণের ‘ পরে ফেলে ।
হেরো গো , ওই আঁধার হল ,
আকাশ ঢাকে মেঘে ।
ও পার হতে দলে দলে
বকের শ্রেণী উড়ে চলে ,
থেকে থেকে শূন্য মাঠে
বাতাস ওঠে জেগে ।
ওই রে গ্রামের গোষ্ঠ – মুখে
ধেনুরা ধায় বেগে ।
হেরো গো , ওই আঁধার হল ,
আকাশ ঢাকে মেঘে ।
প্রদীপখানি নিবে যাবে ,
মিথ্যা কেন জ্বাল ?
কে দেখতে পায় চোখের কাছে
কাজল আছে কি না আছে ?
তরল তব সজল দিঠি
মেঘের চেয়ে কালো ।
আঁখির পাতা যেমন আছে
এমনি থাকা ভালো ।
কাজল দিতে প্রদীপখানি
মিথ্যা কেন জ্বাল ?
এসো হেসে সহজ বেশে
আর কোরো না সাজ ।
গাঁথা যদি না হয় মালা
ক্ষতি তাহে নাই গো বালা ,
ভূষণ যদি না হয় সারা
ভূষণে নাই কাজ ।
মেঘে মগন পূর্ব – গগন
বেলা নাই রে আজ—
এসো হেসে সহজ বেশে ,
নাই বা হল সাজ ।
জন্মান্তর
আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি
সুসভ্যতার আলোক ,
আমি চাই না হতে নববঙ্গ
নব যুগের চালক ।
আমি নাই বা গেলেম বিলাত ,
নাই বা পেলেম রাজার খিলাত ,
যদি পরজন্মে পাই রে হতে
ব্রজের রাখাল বালক
তবে নিবিয়ে দেব নিজের ঘরে
সুসভ্যতার আলোক ।
যারা নিত্য কেবল ধেনু চরায়
বংশীবটের তলে ,
যারা গুঞ্জা ফুলের মালা গেঁথে
পরে পরায় গলে ,
যারা বৃন্দাবনের বনে
সদাই শ্যামের বাঁশি শোনে ,
যারা যমুনাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে
শীতল কালো জলে—
যারা নিত্য কেবল ধেনু চরায়
বংশীবটের তলে ।
‘ ওরে বিহান হল , জাগো রে ভাই’
ডাকে পরস্পরে ।
ওরে ওই – যে দধি – মন্থ – ধ্বনি
উঠল ঘরে ঘরে ।
হেরো মাঠের পথে ধেনু
চলে উড়িয়ে গো – খুর – রেণু ,
হেরো আঙিনাতে ব্রজের বধূ
দুগ্ধ দোহন করে ।
‘ ওরে বিহান হল , জাগো রে ভাই’
ডাকে পরস্পরে ।
ওরে শাঙন – মেঘের ছায়া পড়ে
কালো তমাল – মূলে ,
ওরে এপার ওপার আঁধার হল
কালিন্দীরই কূলে ।
ঘাটে গোপাঙ্গনা ডরে
কাঁপে খেয়া তরীর ‘পরে ,
হেরো কুঞ্জবনে নাচে ময়ূর
কলাপখানি তুলে ।
ওরে শাঙন – মেঘের ছায়া পড়ে
কালো তমাল – মূলে ।
মোরা নবনবীন ফাগুন – রাতে
নীল নদীর তীরে
কোথা যাব চলি অশোকবনে
শিখিপুচ্ছ শিরে ।
যবে দোলার ফুলরশি
দিবে নীপশাখায় কষি
যবে দখিন – বায়ে বাঁশির ধ্বনি
উঠবে আকাশ ঘিরে
মোরা রাখাল মিলে করব মেলা
নীল নদীর তীরে ।
আমি হব না ভাই নববঙ্গে
নবযুগের চালক ,
আমি জ্বালাব না আঁধার দেশে
সুসভ্যতার আলোক ।
যদি ননি – ছানার গাঁয়ে
কোথাও অশোক – নীপের ছায়ে
আমি কোনো জন্মে পারি হতে
ব্রজের গোপবালক
তবে চাই না হতে নববঙ্গ
নবযুগের চালক ।
তথাপি
তুমি যদি আমায় ভালো না বাস
রাগ করি যে এমন আমার সাধ্য নাই—
এমন কথার দেব নাকো আভাসও ,
আমারো মন তোমার পায়ে বাধ্য নাই ।
নাইকো আমার কোনো গরব – গরিমা—
যেমন করেই কর আমায় বঞ্চিত
তুমি না রও তোমার সোনার প্রতিমা
রবে আমার মনের মধ্যে সঞ্চিত ।
কিন্তু তবু তুমিই থাকো , সমস্যা যাক ঘুচি ।
স্মৃতির চেয়ে আসলটিতেই আমার অভিরুচি ।
দৈবে স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া শক্ত নয়
সেটা কিন্তু বলে রাখাই সংগত ।
তাহা ছাড়া যারা তোমার ভক্ত নয়
নিন্দা তারা করতে পারে অন্তত ।
তাহা ছাড়া চিরদিন কি কষ্টে যায় ?
আমারো এই অশ্রু হবে মার্জনা ।
ভাগ্যে যদি একটি কেহ নষ্টে যায়
সান্ত্বনার্থে হয়তো পাব চার জনা ।
কিন্তু তবু তুমিই থাকো , সমস্যা যাক ঘুচি ।
চারের চেয়ে একের ‘পরেই আমার অভিরুচি ।
দুই তীরে
আমি ভালোবাসি আমার
নদীর বালুচর ,
শরৎকালে যে নির্জনে
চকাচকীর ঘর ।
যেথায় ফুটে কাশ
তটের চারি পাশ ,
শীতের দিনে বিদেশী সব
হাঁসের বসবাস ।
কচ্ছপেরা ধীরে
রৌদ্র পোহায় তীরে ,
দু – একখানি জেলের ডিঙি
সন্ধেবেলায় ভিড়ে ।
আমি ভালোবাসি আমার
নদীর বালুচর ,
শরৎকালে যে নির্জনে
চকাচকীর ঘর ।
তুমি ভালোবাস তোমার
ওই ও পারের বন ,
যেথায় গাঁথা ঘনচ্ছায়া
পাতার আচ্ছাদন ।
যেথায় বাঁকা গলি
নদীতে যায় চলি ,
দুই ধারে তার বেণুবনের
শাখায় গলাগলি ।
সকাল – সন্ধেবেলা
ঘাটে বধূর মেলা ,
ছেলের দলে ঘাটের জলে
ভাসে ভাসায় ভেলা ।
তুমি ভালোবাস তোমার
ওই ও পারের বন ,
যেথায় গাঁথা ঘনচ্ছায়া
পাতার আচ্ছাদন ।
তোমার আমার মাঝখানেতে
একটি বহে নদী ,
দুই তটেরে একই গান সে
শোনায় নিরবধি ।