ধান – খেত বেয়ে বাঁকা পথখানি ,
গিয়েছে গ্রামের পারে ।
বৃষ্টি আসিতে দাঁড়ায়েছিলেম
নিরালা কুটিরদ্বারে ।
থামিল বাদল , চলিনু এবার—
হে দোকানি , চাও মূল্য তোমার ?
ভয় নাই ভাই , আছে আছে , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
সকলি ফাঁকি ।
পথের প্রান্তে বটের তলায়
বসে আছ এইখানে—
হায় গো ভিখারি , চাহিছ কাতরে
আমারো মুখের পানে !
ভাবিতেছ মনে বেচা – কেনা সেরে
কত লাভ করে চলিয়াছে কে রে !
আছে আছে বটে , আছে ভাই , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
সকলি ফাঁকি ।
আঁধার রজনী , বিজন এ পথ ,
জোনাকি চমকে গাছে ।
কে তুমি আমার সঙ্গ ধরেছ ,
নীরবে চলেছ পাছে ?
এ ক’টি কড়ির মিছে ভার বওয়া ,
তোমাদের প্রথা কেড়েকুড়ে লওয়া—
হবে না নিরাশ , আছে আছে , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
কেবলি ফাঁকি ।
নিশি দু – পহর , পঁহুছিনু ঘর
দু – হাত রিক্ত করি ,
তুমি আছ একা সজলনয়নে
দাঁড়ায়ে দুয়ার ধরি ।
চোখে ঘুম নাই , কথা নাই মুখে ,
ভীতপাখিসম এলে মোর বুকে—
আছে আছে বিধি , এখনো অনেক
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
সকলি ফাঁকি ।
কৃষ্ণকলি
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি ,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক ।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ – চোখ ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে ,
মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ ।
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই ,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই ।
আকাশ – পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ ।
পুবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে ,
ধানের খেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা ,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে
আমিই জানি আর জানে সে মেয়ে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ ।
এমনি করে কালো কাজল মেঘ
জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে ।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ় মাসে নামে তমাল – বনে ।
এমনি করে শ্রাবণ – রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি ,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক ।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ – চোখ ।
মাথার ‘ পরে দেয় নি তুলে বাস ,
লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ ।
ক্ষণেক দেখা
চলেছিলে পাড়ার পথে
কলস লয়ে কাঁখে ,
একটুখানি ফিরে কেন
দেখলে ঘোমটা – ফাঁকে ?
ওইটুকু যে চাওয়া
দিল একটু হাওয়া
কোথা তোমার ও পার থেকে
আমার এ পার -‘ পরে ।
অতি দূরের দেখাদেখি
অতি ক্ষণেক – তরে ।
আমি শুধু দেখেছিলেম
তোমার দুটি আঁখি—
ঘোমটা – ফাঁদা আঁধার – মাঝে
ত্রস্ত দুটি পাখি ।
তুমি এক নিমিখে
চেয়ে আমার দিকে
পথের একটি পথিকেরে
দেখলে কতখানি
একটুমাত্র কৌতূহলে
একটি দৃষ্টি হানি ?
যেমন ঢাকা ছিলে তুমি
তেমনি রইলে ঢাকা ,
তোমার কাছে যেমন ছিনু
তেমনি রইনু ফাঁকা !
তবে কিসের তরে
থামলে লীলাভরে
যেতে যেতে পাড়ার পথে
কলস লয়ে কাঁখে ?
একটুখানি ফিরে কেন
দেখলে ঘোমটা – ফাঁকে ?
ক্ষতিপূরণ
তোমার তরে সবাই মোরে
করছে দোষী
হে প্রেয়সী !
বলছে—কবি তোমার ছবি
আঁকছে গানে ,
প্রণয়গীতি গাচ্ছে নিতি
তোমার কানে ,
নেশায় মেতে ছন্দে গেঁথে
তুচ্ছ কথা
ঢাকছে শেষে বাংলাদেশে
উচ্চ কথা ।
তোমার তরে সবাই মোরে
করছে দোষী
হে প্রেয়সী !
সে কলঙ্ক নিন্দাপঙ্ক
তিলক টানি
এলেম রানী !
ফেলুক মুছি হাস্যশুচি
তোমার লোচন
বিশ্বসুদ্ধ যতেক ক্রুদ্ধ
সমালোচন ।
অনুরক্ত তব ভক্ত
নিন্দিতেরে
করো রক্ষে শীতল বক্ষে
বাহুর ঘেরে ।
তাই কলঙ্কে নিন্দাপঙ্কে
তিলক টানি
এলেম রানী ।
আমি নাবব মহাকাব্য—
সংরচনে
ছিল মনে—
ঠেকল যখন তোমার কাঁকন—
কিংকিণীতে ,
কল্পনাটি গেল ফাটি
হাজার গীতে ।
মহাকাব্য সেই অভাব্য
দুর্ঘটনায়
পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে
কণায় কণায় ।
আমি নাবব মহাকাব্য—
সংরচনে
ছিল মনে ।
হায় রে কোথা যুদ্ধকথা
হৈল গত
স্বপ্নমত !
পুরাণচিত্র বীরচরিত্র
অষ্ট সর্গ
কৈল খণ্ড তোমার চণ্ড
নয়ন – খড়্গ ।
রইল মাত্র দিবারাত্র
প্রেমের প্রলাপ ,
দিলেম ফেলে ভাবীকেলে
কীর্তিকলাপ ।
হায় রে কোথা যুদ্ধকথা
হৈল গত
স্বপ্নমত !
সেসব – ক্ষতি – পূরণ প্রতি
দৃষ্টি রাখি
হরিণ – আঁখি !
লোকের মনে সিংহাসনে
নাইকো দাবি—
তোমার মনোগৃহের কোনো
দাও তো চাবি ।
মরার পরে চাই নে ওরে
অমর হতে ,
অমর হব আঁখির তব
সুধার স্রোতে ।
খ্যাতির ক্ষতি – পূরণ প্রতি
দৃষ্টি রাখি
হরিণ – আঁখি !
খেলা
মনে পড়ে সেই আষাঢ়ে
ছেলেবেলা ,
নালার জলে ভাসিয়েছিলেম
পাতার ভেলা ।
বৃষ্টি পড়ে দিবস – রাতি ,
ছিল না কেউ খেলার সাথি ,
একলা বসে পেতেছিলেম
সাধের খেলা ।
নালার জলে ভাসিয়েছিলেম
পাতার ভেলা ।
হঠাৎ হল দ্বিগুণ আঁধার
ঝড়ের মেঘে ,
হঠাৎ বৃষ্টি নামল কখন
দ্বিগুণ বেগে ।
ঘোলা জলের স্রোতের ধারা
ছুটে এল পাগল – পারা
পাতার ভেলা ডুবল নালার
তুফান লেগে—
হঠাৎ বৃষ্টি নামল যখন
দ্বিগুণ বেগে ।