‘ কেশে আমার পাক ধরেছে বটে ,
তাহার পানে নজর এত কেন ?
পাড়ায় যত ছেলে এবং বুড়ো
সবার আমি একবয়সী জেনো ।
ওষ্ঠে কারো সরল সাদা হাসি
কারো হাসি আঁখির কোণে কোণে
কারো অশ্রু উছলে পড়ে যায়
কারো অশ্রু শুকায় মনে মনে ,
কেউ বা থাকে ঘরের কোণে দোঁহে
জগৎ মাঝে কেউ বা হাঁকায় রথ ,
কেউ বা মরে একলা ঘরের শোকে
জনারণ্যে কেউ বা হারায় পথ ।
সবাই মোরে করেন ডাকাডাকি ,
কখন শুনি পরকালের ডাক ?
সবার আমি সমান – বয়সী যে
চুলে আমার যত ধরুক পাক । ‘
কর্মফল
পরজন্ম সত্য হলে
কী ঘটে মোর সেটা জানি—
আবার আমায় টানবে ঘরে
বাংলাদেশের এ রাজধানী ।
গদ্য পদ্য লিখনু ফেঁদে ,
তারাই আমায় আনবে বেঁধে ,
অনেক লেখায় অনেক পাতক ,
সে মহাপাপ করবে মোচন—
আমায় হয়তো করতে হবে
আমার লেখা সমালোচন ।
ততদিনে দৈবে যদি
পক্ষপাতী পাঠক থাকে
কর্ণ হবে রক্তবর্ণ
এমনি কটু বলব তাকে ।
যে বইখানি পড়বে হাতে
দগ্ধ করব পাতে পাতে ,
আমার ভাগ্যে হব আমি
দ্বিতীয় এক ধূম্রলোচন—
আমায় হয়তো করতে হবে
আমার লেখা সমালোচন ।
বলব , ‘ এ – সব কী পুরাতন !
আগাগোড়া ঠেকছে চুরি ।
মনে হচ্ছে , আমিও এমন
লিখতে পারি ঝুড়ি ঝুড়ি । ‘
আরো যে – সব লিখব কথা
ভাবতে মনে বাজছে ব্যথা ,
পরজন্মের নিষ্ঠুরতায়
এ জন্মে হয় অনুশোচন—
আমায় হয়তো করতে হবে
আমার লেখা সমালোচন ।
তোমরা , যাঁদের বাক্য হয় না
আমার পক্ষে মুখরোচক
তোমরা যদি পুনর্জন্মে
হও পুনর্বার সমালোচক—
আমি আমায় পাড়ব গালি ,
তোমরা তখন ভাববে খালি
কলম ক’ষে ব’সে ব’সে
প্রতিবাদের প্রতি বচন ।
আমায় হয়তো করতে হবে
আমার লেখা সমালোচন ।
লিখব , ইনি কবিসভায়
হংসমধ্যে বকো যথা !
তুমি লিখবে , কোন্ পাষণ্ড
বলে এমন মিথ্যা কথা !
আমি তোমায় বলব—মূঢ় ,
তুমি আমায় বলবে—রূঢ় ,
তার পরে যা লেখালেখি
হবে না সে রুচিরোচন ।
তুমি লিখবে কড়া জবাব ,
আমি কড়া সমালোচন ।
কল্যাণী
বিরল তোমার ভবনখানি
পুষ্পকাননমাঝে ,
হে কল্যাণী নিত্য আছ
আপন গৃহকাজে ।
বাইরে তোমার আম্রশাখে
স্নিগ্ধরবে কোকিল ডাকে ,
ঘরে শিশুর কলধ্বনি
আকুল হর্ষভরে ।
সর্বশেষের গানটি আমার
আছে তোমার তরে ।
প্রভাত আসে তোমার দ্বারে ,
পূজার সাজি ভরি ,
সন্ধ্যা আসে সন্ধ্যারতির
বরণডালা ধরি ।
সদা তোমার ঘরের মাঝে
নীরব একটি শঙ্খ বাজে ,
কাঁকন – দুটির মঙ্গলগীত
উঠে মধুর স্বরে ।
সর্বশেষের গানটি আমার
আছে তোমার তরে ।
রূপসীরা তোমার পায়ে
রাখে পূজার থালা ,
বিদুষীরা তোমার গলায়
পরায় বরমালা !
ভালে তোমার আছে লেখা
পুণ্যধামের রশ্মিরেখা ,
সুধাস্নিগ্ধ হৃদয়খানি
হাসে চোখের ‘ পরে ।
সর্বশেষের গানটি আমার
আছে তোমার তরে ।
তোমার নাহি শীত বসন্ত ,
জরা কি যৌবন—
সর্বঋতু সর্বকালে
তোমার সিংহাসন ।
নিবে নাকো প্রদীপ তব ,
পুষ্প তোমার নিত্য নব ,
অচলা শ্রী তোমায় ঘে রি
চির বিরাজ করে ।
সর্বশেষের গানটি আমার
আছে তোমার তরে ।
নদীর মতো এসেছিলে
গিরিশিখর হতে ,
নদীর মতো সাগর – পানে
চল অবাধ স্রোতে ।
একটি গৃহে পড়ছে লেখা
সেই প্রবাহের গভীর রেখা ,
দীপ্ত শিরে পুণ্যশীতল
তীর্থসলিল ঝরে ।
সর্বশেষের গানটি আমার
আছে তোমার তরে ।
তোমার শান্তি পান্থজনে
ডাকে গৃহের পানে ,
তোমার প্রীতি ছিন্ন জীবন
গেঁথে গেঁথে আনে ।
আমার কাব্যকুঞ্জবনে
কত অধীর সমীরণে
কত যে ফুল কত আকুল
মুকুল খসে পড়ে—
সর্বশেষের শ্রেষ্ঠ যে গান
আছে তোমার তরে ।
কূলে
আমাদের এই নদীর কূলে
নাইকো স্নানের ঘাট ,
ধূধূ করে মাঠ ।
ভাঙা পাড়ির গায়ে শুধু
শালিখ লাখে লাখে
খোপের মধ্যে থাকে ।
সকালবেলা অরুণ আলো
পড়ে জলের ‘পরে ,
নৌকা চলে দু – একখানি
অলস বায়ু – ভরে ।
আঘাটাতে বসে রইলে ,
বেলা যাচ্ছে বয়ে—
দাও গো মোরে কয়ে
ভাঙন – ধরা কূলে তোমার
আর কিছু কি চাই ?
সে কহিল , ভাই ,
না ই , না ই , নাই গো আমার
কিছুতে কাজ নাই ।
আমাদের এ নদীর কূলে
ভাঙা পাড়ির তল ,
ধেনু খায় না জল ।
দূর গ্রামের দু – একটি ছাগ
বেড়ায় চরি চরি
সারা দিবস ধরি ।
জলের ‘পরে বেঁকে – পড়া
খেজুর – শাখা হতে
ক্ষণে ক্ষণে মাছরাঙাটি
ঝাঁপিয়ে পড়ে স্রোতে ।
ঘাসের ‘পরে অশথতলে
যাচ্ছে বেলা বয়ে—
দাও আমারে কয়ে
আজকে এমন বিজন প্রাতে
আর কারে কি চাই ?
সে কহিল , ভাই ,
না ই , না ই , নাই গো আমার
কারেও কাজ নাই ।
কৃতার্থ
এখনো ভাঙে নি ভাঙে নি মেলা
নদীর তীরের মেলা ।
এ শুধু আষাঢ় – মেঘের আঁধার ,
এখনো রয়েছে বেলা ।
ভেবেছিনু দিন মিছে গোঙালেম ,
যাহা ছিল বুঝি সবই খোয়ালেম ,
আছে আছে তবু , আছে ভাই , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে আজ ঘটে নাই
কেবলি ফাঁকি ।
বেচিবার যাহা বেচা হয়ে গেছে
কিনিবার যাহা কেনা ,
আমি তো চুকিয়ে দিয়েছি নিয়েছি
সকল পাওনা দেনা ।
দিন না ফুরাতে ফিরিব এখন—
প্রহরী চাহিছ পসরার পণ ?
ভয় নাই ওগো , আছে আছে , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
কেবলি ফাঁকি ।
কখন বাতাস মাতিয়া আবার
মাথায় আকাশ ভাঙে !
কখন সহসা নামিবে বাদল ,
তুফান উঠিবে গাঙে !
তাই ছুটাছুটি চলিয়াছি ধেয়ে—
পারানির কড়ি চাহ তুমি নেয়ে ?
কিসের ভাবনা , আছে আছে , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
কেবলি ফাঁকি ।