আজ যে তাহা ছড়িয়ে গেছে
অনেক দূরে—
অনেক দেশে , অনেক বেশে ,
অনেক সুরে ।
কুড়িয়ে তারে বাঁধতে পারে
একটিখানে
এমনতরো মোহন – মন্ত্র
কেই বা জানে !
নিজের মন তো দেবার আশা
চুকেই গেছে ,
পরের মনটি পাবার আশায়
রইনু বেঁচে ।
এক গাঁয়ে
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ ,
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক ।
তাহার দুটি পালন – করা ভেড়া
চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে ,
যদি ভাঙে আমার খেতের বেড়া
কোলের ‘ পরে নিই তাহারে তুলে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা ,
আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা ,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে—
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।
দুইটি পাড়ায় বড়োই কাছাকাছি ,
মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাঁক—
তাদের বনের অনেক মধুমাছি
মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক ।
তাদের ঘাটে পূজার জবামালা
ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে ,
তাদের পাড়ার কুসুম – ফুলের ডালা
বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা ,
আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা ,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে—
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।
আমাদের এই গ্রামের গলি -‘ পরে
আমের বোলে ভরে আমের বন ,
তাদের খেতে যখন তিসি ধরে
মোদের খেতে তখন ফোটে শণ ।
তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা
আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে ।
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণধারা ,
আমার বনে কদম ফুটে ওঠে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা ,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা ,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে—
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।
একটি মাত্র
গিরিনদী বালির মধ্যে
যাচ্ছে বেঁকে বেঁকে ,
একটি ধারে স্বচ্ছ ধারায়
শীর্ণ রেখা এঁকে ।
মরু – পাহাড় – দেশে
শুষ্ক বনের শেষে
ফিরেছিলেম দুই প্রহরে
দগ্ধ চরণতল ।
বনের মধ্যে পেয়েছিলেম
একটি আঙুর ফল ।
রৌদ্র তখন মাথার ‘পরে
পায়ের তলায় মাটি
জলের তরে কেঁদে মরে
তৃষায় ফাটি ফাটি ।
পাছে ক্ষুধার ভরে
তুলি মুখের ‘পরে
আকুল ঘ্রাণে নিই নি তাহার
শীতল পরিমল ।
রেখেছিলেম লুকিয়ে আমার
একটি আঙুর ফল ।
বেলা যখন পড়ে এল ,
রৌদ্র হল রাঙা ,
নিশ্বাসিয়া উঠল হু হু
ধূ ধূ বালুর ডাঙা—
থাকতে দিনের আলো
ঘরে ফেরাই ভালো ,
তখন খুলে দেখনু চেয়ে
চক্ষে লয়ে জল
মুঠির মাঝে শুকিয়ে আছে
একটি আঙুর ফল ।
কবি
আমি যে বেশ সুখে আছি
অন্তত নই দুঃখে কৃশ ,
সে কথাটা পদ্যে লিখতে
লাগে একটু বিসদৃশ ।
সেই কারণে গভীর ভাবে
খুঁজে খুঁজে গভীর চিতে
বেরিয়ে পড়ে গভীর ব্যথা
স্মৃতি কিম্বা বিস্মৃতিতে ।
কিন্তু সেটা এত সুদূর
এতই সেটা অধিক গভীর
আছে কি না আছে তাহার
প্রমাণ দিতে হয় না কবির ।
মুখের হাসি থাকে মুখে ,
দেহের পুষ্টি পোষে দেহ ,
প্রাণের ব্যথা কোথায় থাকে
জানে না সেই খবর কেহ ।
কাব্য প’ড়ে যেমন ভাব
কবি তেমন নয় গো ।
আঁধার ক’রে রাখে নি মুখ ,
দিবারাত্র ভাঙছে না বুক ,
গভীর দুঃখ ইত্যাদি সব
হাস্যমুখেই বয় গো ।
ভালোবাসে ভদ্রসভায়
ভদ্র পোশাক পরতে অঙ্গ ,
ভালোবাসে ফুল্ল মুখে
কইতে কথা লোকের সঙ্গ ।
বন্ধু যখন ঠাট্টা করে
মরে না সে অর্থ খুঁজে ,
ঠিক যে কোথায় হাসতে হবে
একেক সময় দিব্যি বুঝে ।
সামনে যখন অন্ন থাকে
থাকে না সে অন্যমনে ,
সঙ্গীদলের সাড়া পেলে
রয় না বসে ঘরের কোণে ।
বন্ধুরা কয় ‘ লোকটা রসিক’ ,
কয় কি তারা মিথ্যামিথ্যি ?
শত্রুরা কয় ‘ লোকটা হাল্কা’ ,
কিছু কি তার নাইকো ভিত্তি ?
কাব্য দেখে যেমন ভাব
কবি তেমন নয় গো ।
চাঁদের পানে চক্ষু তুলে
রয় না পড়ে নদীর কূলে ,
গভীর দুঃখ ইত্যাদি সব
মনের সুখেই বয় গো ।
সুখে আছি লিখতে গেলে
লোকে বলে , ‘ প্রাণটা ক্ষুদ্র !
আশাটা এর নয়কো বিরাট ,
পিপাসা এর নয়কো রুদ্র । ‘
পাঠকদলে তুচ্ছ করে ,
অনেক কথা বলে কঠোর—
বলে , ‘ একটু হেসে – খেলেই
ভরে যায় এর মনের জঠর । ‘
কবিরে তাই ছন্দে বন্ধে
বানাতে হয় দুখের দলিল ।
মিথ্যা যদি হয় সে তবু
ফেলো পাঠক চোখের সলিল ।
তাহার পরে আশিস কোরো
রুদ্ধকণ্ঠে ক্ষুব্ধবুকে ,
কবি যেন আজন্মকাল
দুখের কাব্য লেখেন সুখে ।
কাব্য যেমন কবি যেন
তেমন নাহি হয় গো ।
বুদ্ধি যেন একটু থাকে ,
স্নানাহারের নিয়ম রাখে ,
সহজ লোকের মতোই যেন
সরল গদ্য কয় গো ।
কবির বয়স
ওরে কবি , সন্ধ্যা হয়ে এল ,
কেশে তোমার ধরেছে যে পাক ।
বসে বসে ঊর্ধ্বপানে চেয়ে
শুনতেছ কি পরকালের ডাক ?
কবি কহে , ‘ সন্ধ্যা হল বটে ,
শুনছি বসে লয়ে শ্রান্ত দেহ ,
এ পারে ওই পল্লী হতে যদি
আজো হঠাৎ ডাকে আমায় কেহ ।
যদি হোথায় বকুলবনচ্ছায়ে
মিলন ঘটে তরুণ – তরুণীতে ,
দুটি আঁখির ‘পরে দুইটি আঁখি
মিলিতে চায় দুরন্ত সংগীতে—
কে তাহাদের মনের কথা লয়ে
বীণার তারে তুলবে প্রতিধ্বনি ,
আমি যদি ভবের কূলে বসে
পরকালের ভালো মন্দই গনি ।
‘ সন্ধ্যাতারা উঠে অস্তে গেল ,
চিতা নিবে এল নদীর ধারে ,
কৃষ্ণপক্ষে হলুদবর্ণ চাঁদ
দেখা দিল বনের একটি পারে ,
শৃগালসভা ডাকে ঊর্ধ্বরবে
পোড়ো বাড়ির শূন্য আঙিনাতে—
এমন কালে কোনো গৃহত্যাগী
হেথায় যদি জাগতে আসে রাতে ,
জোড় – হস্তে ঊর্ধ্ব তুলি মাথা
চেয়ে দেখে সপ্ত ঋষির পানে ,
প্রাণের কূলে আঘাত করে ধীরে
সুপ্তিসাগর শব্দবিহীন গানে—
ত্রিভুবনের গোপন কথাখানি
কে জাগিয়ে তুলবে তাহার মনে
আমি যদি আমার মুক্তি নিয়ে
যুক্তি করি আপন গৃহকোণে ?