শোনো শোনো ওই পারে যাবে ব’লে
কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে ।
খেয়া – পারাপার বন্ধ হয়েছে
আজি রে ।
পূবে হাওয়া বয় , কূলে নেই কেউ ,
দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ ,
দরদর বেগে জলে পড়ি জল
ছলছল উঠে বাজি রে ।
খেয়া – পারাপার বন্ধ হয়েছে
আজি রে ।
ওগো , আজ তোরা যাস নে গো তোরা
যাস নে ঘরের বাহিরে—
আকাশ আঁধার , বেলা বেশি আর
নাহি রে ।
ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল ,
ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল ,
ঐ বেণুবন দুলে ঘনঘন
পথপাশে দেখ্ চাহি রে ।
ওগো , আজ তোরা যাস নে ঘরের
বাহিরে ।
উদাসীন
হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি ,
ছুটি নে কাহারো পিছুতে ।
মন নাহি মোর কিছুতেই , নাই
কিছুতে ।
নির্ভয়ে ধাই সুযোগ – কুযোগ বিছুরি ,
খেয়াল – খবর রাখি নে তো কোনো – কিছুরি—
উপরে চড়িতে যদি নাই পাই সুবিধা
সুখে পড়ে থাকি নিচুতেই , থাকি
নিচুতে ।
হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি
ছুটি নে কাহারো পিছুতে—
মন নাহি মোর কিছুতেই , নাই
কিছুতে ।
যেথা – সেথা ধাই , যাহা – তাহা পাই—
ছাড়ি নেকো ভাই , ছাড়ি নে ।
তাই ব’লে কিছু কাড়াকাড়ি ক’রে
কাড়ি নে ।
যাহা যেতে চায় ছেড়ে দিই তারে তখুনি ,
বকি নে কারেও , শুনি নে কাহারো বকুনি—
কথা যত আছে মনের তলায় তলিয়ে
ভুলেও কখনো সহসা তাদের
নাড়ি নে ।
যেথা – সেথা ধাই , যাহা – তাহা পাই—
ছাড়ি নেকো ভাই , ছাড়ি নে ।
তাই ব’লে কিছু তাড়াতাড়ি ক’রে
কাড়ি নে ।
মন – দে’য়া – নে’য়া অনেক করেছি ,
মরেছি হাজার মরণে—
নূপুরের মতো বেজেছি চরণে
চরণে ।
আঘাত করিয়া ফিরেছি দুয়ারে দুয়ারে ,
সাধিয়া মরেছি ইঁহারে তাঁহারে উঁহারে—
অশ্রু গাঁথিয়া রচিয়াছি কত মালিকা ,
রাঙিয়াছি তাহা হৃদয় – শোণিত—
বরনে ।
মন – দে’য়া – নে’য়া অনেক করেছি ,
মরেছি হাজার মরণে
নূপুরের মতো বেজেছি চরণে
চরণে ।
এতদিন পরে ছুটি আজ ছুটি ,
মন ফেলে তাই ছুটেছি ;
তাড়াতাড়ি ক’রে খেলাঘরে এসে
জুটেছি ।
বুকভাঙা বোঝা নেব না রে আর তুলিয়া ,
ভুলিবার যাহা একেবারে যাব ভুলিয়া—
যাঁর বেড়ি তাঁরে ভাঙা বেড়িগুলি ফিরায়ে
বহুদিন পরে মাথা তুলে আজ
উঠেছি ।
এতদিন পরে ছুটি আজ ছুটি ,
মন ফেলে তাই ছুটেছি ।
তাড়াতাড়ি ক’রে খেলাঘরে এসে
জুটেছি ।
কত ফুল নিয়ে আসে বসন্ত
আগে পড়িত না নয়নে—
তখন কেবল ব্যস্ত ছিলাম
চয়নে ।
মধুকরসম ছিনু সঞ্চয়প্রয়াসী ;
কুসুমকান্তি দেখি নাই , মধু – পিয়াসী—
বকুল কেবল দলিত করেছি আলসে
ছিলাম যখন নিলীন বকুল—
শয়নে ।
কত ফুল নিয়ে আসে বসন্ত
আগে পড়িত না নয়নে —
তখন কেবল ব্যস্ত ছিলাম
চয়নে ।
দূরে দূরে আজ ভ্রমিতেছি আমি ,
মন নাহি মোর কিছুতে ;
তাই ত্রিভুবন ফিরিছে আমারি
পিছুতে ।
সবলে কারেও ধরি নে বাসনা – মুঠিতে ,
দিয়েছি সবারে আপন বৃন্তে ফুটিতে—
যখনি ছেড়েছি উচ্চে উঠার দুরাশা
হাতের নাগালে পেয়েছি সবারে
নিচুতে ।
দূরে দূরে আজ ভ্রমিতেছি আমি ,
মন নাহি মোর কিছুতে—
তাই ত্রিভুবন ফিরিছে আমারি
পিছুতে ।
উদ্বোধন
শুধু অকারণ পুলকে
ক্ষণিকের গান গা রে আজি প্রাণ
ক্ষণিক দিনের আলোকে
যারা আসে যায় , হাসে আর চায় ,
পশ্চাতে যারা ফিরে না তাকায় ,
নেচে ছুটে ধায় , কথা না শুধায় ,
ফুটে আর টুটে পলকে—
তাহাদেরি গান গা রে আজি প্রাণ
ক্ষণিক দিনের আলোকে ।
প্রতি নিমেষের কাহিনী
আজি বসে বসে গাঁথিস নে আর ,
বাঁধিস নে স্মৃতিবাহিনী ।
যা আসে আসুক , যা হবার হোক ,
যাহা চলে যায় মুছে যাক শোক ,
গেয়ে ধেয়ে যাক দ্যুলোক ভূলোক
প্রতি পলকের রাগিণী ।
নিমেষে নিমেষ হয়ে যাক শেষ
বহি নিমেষের কাহিনী ।
ফুরায় যা দে রে ফুরাতে ।
ছিন্ন মালার ভ্রষ্ট কুসুম
ফিরে যাস নেকো কুড়াতে ।
বুঝি নাই যাহা চাই না বুঝিতে ,
জুটিল না যাহা চাই না খুঁজিতে ,
পুরিল না যাহা কে রবে যুঝিতে
তারি গহ্বর পুরাতে ।
যখন যা পাস মিটায়ে নে আশ ,
ফুরাইলে দিস ফুরাতে ।
ওরে থাক্ থাক্ কাঁদনি !
দুই হাত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দে রে
নিজে হাতে বাঁধা বাঁধনি ।
যে সহজ তোর রয়েছে সমুখে
আদরে তাহারে ডেকে নে রে বুকে ,
আজিকার মতো যাক যাক চুকে
যত অসাধ্য – সাধনি ।
ক্ষণিক সুখের উৎসব আজি ,
ওরে থাক্ থাক্ কাঁদনি !
শুধু অকারণ পুলকে
নদীজলে – পড়া আলোর মতন
ছুটে যা ঝলকে ঝলকে ।
ধরণীর ‘পরে শিথিলবাঁধন
ঝলমল প্রাণ করিস যাপন ,
ছুঁয়ে থেকে দুলে শিশির যেমন
শিরীষ ফুলের অলকে ।
মর্মরতানে ভরে ওঠ্ গানে
শুধু অকারণ পুলকে ।
উৎসৃষ্ট
মিথ্যে তুমি গাঁথলে মালা
নবীন ফুলে ,
ভেবেছ কি কণ্ঠে আমার
দেবে তুলে ?
দাও তো ভালোই , কিন্তু জেনো
হে নির্মলে ,
আমার মালা দিয়েছি ভাই
সবার গলে ।
যে – ক’টা ফুল ছিল জমা
অর্ঘ্যে মম
উদ্দেশেতে সবায় দিনু—
নমো নমঃ ।
কেউ বা তাঁরা আছেন কোথা
কেউ জানে না ,
কারো বা মুখ ঘোমটা – আড়ে
আধেক চেনা ।
কেউ বা ছিলেন অতীত কালে
অবন্তীতে ,
এখন তাঁরা আছেন শুধু
কবির গীতে ।
সবার তনু সাজিয়ে মাল্যে
পরিচ্ছদে
কহেন বিধি ‘ তুভ্যমহং
সম্প্রদদে’ ।
হৃদয় নিয়ে আজ কি প্রিয়ে
হৃদয় দেবে ?
হায় ললনা , সে প্রার্থনা
ব্যর্থ এবে ।
কোথায় গেছে সেদিন আজি
যেদিন মম
তরুণ – কালে জীবন ছিল
মুকুলসম ,
সকল শোভা সকল মধু
গন্ধ যত
বক্ষোমাঝে বন্ধ ছিল
বন্দীমত ।