অবিনয়
হে নিরুপমা ,
চপলতা আজ যদি কিছু ঘটে
করিয়ো ক্ষমা ।
এল আষাঢ়ের প্রথম দিবস ,
বনরাজি আজি ব্যাকুল বিবশ ,
বকুলবীথিকা মুকুলে মত্ত
কানন -‘ পরে—
নবকদম্ব মদিরগন্ধে
আকুল করে ।
হে নিরুপমা ,
আঁখি যদি আজ করে অপরাধ
করিয়ো ক্ষমা ।
হেরো আকাশের দূর কোণে কোণে
বিজুলি চমকি উঠে খনে খন ে ,
বাতায়নে তব দ্রুত কৌতুকে
মারিছে উঁকি—
বাতাস করিছে দুরন্তপনা
ঘরেতে ঢুকি ।
হে নিরুপমা ,
গানে যদি লাগে বিহ্বল তান
করিয়ো ক্ষমা ।
ঝরঝর ধারা আজি উতরোল ,
নদীকূলে – কূলে উঠে কল্লোল ,
বনে বনে গাহে মর্মরস্বরে
নবীন পাতা—
সজল পবন দিশে দিশে তুলে
বাদলগাথা ।
হে নিরুপমা ,
আজিকে আচারে ত্রুটি হতে পারে ,
করিয়ো ক্ষমা ।
দিবালোকহারা সংসারে আজ
কোনোখানে কার ও নাহি কোনো কাজ ,
জনহীন পথ ধেনুহীন মাঠ
যেন সে আঁকা—
বর্ষণঘন শীতল আঁধারে
জগৎ ঢাকা ।
হে নিরুপমা ,
চপলতা আজি যদি ঘটে তবে
করিয়ো ক্ষমা ।
তোমার দুখানি কালো আঁখি -‘ পরে
শ্যাম আষাঢ়ের ছায়াখানি পড়ে ,
ঘন কালো তব কুঞ্চিত কেশে
যূথীর মালা ।
তোমারি ললাটে নববরষার
বরণডালা ।
অসাবধান
আমায় যদি মনটি দেবে
দিয়ো , দিয়ো মন—
মনের মধ্যে ভাবনা কিন্তু
রেখো সারাক্ষণ ।
খোলা আমার দুয়ারখানা ,
ভোলা আমার প্রাণ—
কখন যে কার আনাগোনা
নইকো সাবধান ।
পথের ধারে বাড়ি আমার ,
থাকি গানের ঝোঁকে—
বিদেশী সব পথিক এসে
যেথা – সেথাই ঢোকে ।
ভাঙে কতক , হারায় কতক
যা আছে মোর দামি—
এমনি ক’রে একে একে
সর্বস্বান্ত আমি ।
আমায় যদি মনটি দেবে দিয়ো , দিয়ো মন—
মনের মধ্যে ভাবনা কিন্তু রেখো সারাক্ষণ ।
আমায় যদি মনটি দেবে
নিষেধ তাহে নাই ,
কিছুর তরে আমায় কিন্তু
কোরো না কেউ দায়ী ।
ভুলে যদি শপথ ক’রে
বলি কিছু কবে ,
সেটা পালন না করি তো
মাপ করিতেই হবে ।
ফাগুন মাসে পূর্ণিমাতে
যে নিয়মটা চলে
রাগ কোরো না চৈত্র মাসে
সেটা ভঙ্গ হলে ।
কোনো দিন বা পূজার সাজি
কুসুমে হয় ভরা ,
কোনো দিন বা শূন্য থাকে—
মিথ্যা সে দোষ ধরা ।
আমায় যদি মনটি দেবে নিষেধ তাহে নাই ,
কিছুর তরে আমায় কিন্তু কোরো না কেউ দায়ী ।
আমায় যদি মনটি দেবে
রাখিয়া যাও তবে ,
দিয়েছ যে সেটা কিন্তু
ভুলে থাকতে হবে ।
দুটি চক্ষে বাজবে তোমার
নবরাগের বাঁশি ,
কণ্ঠে তোমার উচ্ছ্বসিয়া
উঠবে হাসিরাশি ।
প্রশ্ন যদি শুধাও কভু
মুখটি রাখি বুকে ,
মিথ্যা কোনো জবাব পেলে
হেসো সকৌতুকে ।
যে দুয়ারটা বন্ধ থাকে
বন্ধ থাকতে দিয়ো ,
আপনি যাহা এসে পড়ে
তাহাই হেসে নিয়ো ।
আমায় যদি মনটি দেবে , রাখিয়া যাও তবে—
দিয়েছ যে সেটা কিন্তু ভুলে থাকতে হবে ।
আবির্ভাব
বহুদিন হল কোন্ ফাল্গুনে
ছিনু আমি তব ভরসায় ;
এলে তুমি ঘন বরষায় ।
আজি উত্তাল তুমুল ছন্দে
আজি নবঘন – বিপুল – মন্দ্রে
আমার পরানে যে গান বাজাবে
সে গান তোমার করো সায়
আজি জলভরা বরষায় ।
দূরে একদিন দেখেছিনু তব
কনকাঞ্চল – আবরণ ,
নবচম্পক – আভরণ ।
কাছে এলে যবে হেরি অভিনব
ঘোর ঘননীল গুণ্ঠন তব ,
চলচপলার চকিত চমকে
করিছে চরণ বিচরণ ।
কোথা চম্পক – আভরণ !
সেদিন দেখেছি খনে খনে তুমি
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে বনতল ,
নুয়ে নুয়ে যেত ফুলদল ।
শুনেছিনু যেন মৃদু রিনি রিনি
ক্ষীণ কটি ঘেরি বাজে কিংকিণী ,
পেয়েছিনু যেন ছায়াপথে যেতে
তব নিশ্বাসপরিমল ,
ছুঁয়ে যেতে যবে বনতল ।
আজি আসিয়াছ ভুবন ভরিয়া
গগনে ছড়ায়ে এলোচুল ,
চরণে জড়ায়ে বনফুল ।
ঢেকেছে আমারে তোমার ছায়ায়
সঘন সজল বিশাল মায়ায় ,
আকুল করেছ শ্যাম সমারোহে
হৃদয়সাগর – উপকূল
চরণে জড়ায়ে বনফুল ।
ফাল্গুনে আমি ফুলবনে বসে
গেঁথেছিনু যত ফুলহার
সে নহে তোমার উপহার ।
যেথা চলিয়াছ সেথা পিছে পিছে
স্তবগান তব আপনি ধ্বনিছে ,
বাজাতে শেখে নি সে গানের সুর
এ ছোটো বীণার ক্ষীণ তার—
এ নহে তোমার উপহার ।
কে জানিত সেই ক্ষণিকা মুরতি
দূরে করি দিবে বরষন ,
মিলাবে চপল দরশন ?
কে জানিত মোরে এত দিবে লাজ ?
তোমার যোগ্য করি নাই সাজ ,
বাসর – ঘরের দুয়ারে করালে
পূজার অর্ঘ্য – বিরচন—
একি রূপে দিলে দরশন ।
ক্ষমা করো তবে ক্ষমা করো মোর
আয়োজনহীন পরমাদ ,
ক্ষমা করো যত অপরাধ ।
এই ক্ষণিকের পাতার কুটিরে
প্রদীপ – আলোকে এসো ধীরে ধীরে ,
এই বেতসের বাঁশিতে পড়ুক
তব নয়নের পরসাদ—
ক্ষমা করো যত অপরাধ ।
আস নাই তুমি নবফাল্গুনে
ছিনু যবে তব ভরসায় ,
এসো এসো ভরা বরষায় ।
এসো গো গগনে আঁচল লুটায়ে ,
এসো গো সকল স্বপন ছুটায়ে ,
এ পরান ভরি যে গান বাজাবে
সে গান তোমার করো সায়
আজি জলভরা বরষায় ।
আষাঢ়
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে
তিল ঠাঁই আর নাহি রে ।
ওগো , আজ তোরা যাস নে ঘরের
বাহিরে ।
বাদলের ধারা ঝরে ঝর – ঝর ,
আউশের খেত জলে ভর – ভর ,
কালী – মাখা মেঘে ও পারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে ।
ওগো , আজ তোরা যাস নে ঘরের
বাহিরে ।
ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন ,
ধবলীরে আনো গোহালে ।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু
পোহালে ।
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি
মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি ?
রাখাল – বালক কী জানি কোথায়
সারাদিন আজি খোয়ালে ।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু
পোহালে ।